Inqilab Logo

মঙ্গলবার ১৯ নভেম্বর ২০২৪, ০৪ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ১৬ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

অর্থনীতিতে নারীর অবদানের স্বীকৃতি দিতে হবে

রিম্পা খাতুন | প্রকাশের সময় : ১৩ ডিসেম্বর, ২০২০, ১২:০২ এএম

নারী মমতাময়ী বলেই তাদের মমতাময় ছোঁয়ার পরশে ধরণীকে প্রশান্তির জোয়ারে ভাসিয়েছে আজীবন, আমরণ। তাদের উৎসর্গকৃত গল্পকাহিনী স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে ইতিহাসের পাতায়। অথচ এদেশের নারী আজও অবহেলিত, লাঞ্ছিত, উপেক্ষিত, বঞ্চিত বিভিন্নভাবে বিভিন্ন আঙ্গিকে। কৃষি ও নারী ইতিহাসের এক অবিচ্ছেদ্য আলোকিত গল্প। অনেক কাজের মধ্যে কৃষিই উল্লেখযোগ্য। ‘শস্যক্ষেত উর্বর হলো, পুরুষ চালানো হাল, নারী সেই মাঠে শস্য রোপিয়া করিল সুশ্যামল।’

আমাদের ইতিহাস জানায়, পৃথিবীতে শস্য উৎপাদনের জন্য নারীর হাত দিয়েই রোপিত হয়েছিল প্রথম বীজ। আদিমকালে খাদ্য সংগ্রহ করা হতো দুইভাবে আহরণ ও শিকার করে। আহরণ হতো ৮০ ভাগ, যার পুরোটাই করতো নারী। কাজেই দেখা যাচ্ছে, সেই আদিকাল থেকেই নারী কৃষির সাথে সম্পৃক্ত।

দেশের মোট জনসংখ্যার প্রায় অর্ধেকই নারী আর শতকরা ৮৬ ভাগের বাস গ্রামে। গ্রামের এ সকল নারীকে আমরা গ্রামীণ নারী বলে আখ্যায়িত করে থাকি। একজন গ্রামীণ নারী প্রতিদিন ঘর গোছানো, রান্না, পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন, জ্বালানি সংগ্রহ, পরিবারের সবার দেখাশোনা করার পাশাপাশি কৃষিকাজেও যুক্ত থাকে। যেমন হাঁস- মুরগি পালন, গবাদিপশু পালন, বনায়ন, মাছ চাষ, ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প, হস্তশিল্প। তাছাড়া ফসলের প্রাক বপন প্রক্রিয়া থেকে শুরু করে ফসল উত্তোলন, বীজ সংরক্ষণ, প্রক্রিয়াজাতকরণ এমনকি বিপণন পর্যন্ত অনেক কাজ নারীকে করতে হয়। এক গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, গ্রামীণ নারীর অবদান গ্রামীণ অর্থনীতিতে ৫৩ শতাংশ যেখানে পুরুষের অবদান মাত্র ৪৭ শতাংশ। যেখানে পরিবারে মজুরিবিহীন কাজে পুরুষ সময় দেয় আড়াই ঘণ্টা সেখানে নারী দিয়ে থাকে আট ঘণ্টা। যেখানে প্রতিদিন নারী পরিবারের কাজ করে ১২ টি যা মোট দেশজ উৎপাদনে (জিডিপি) অন্তর্ভুক্ত হয় না, আর পুরুষ করে গড়ে ৩টিরও কম কাজ। তারপরও নারীর কাজের রাষ্ট্রীয়ভাবে কোন স্বীকৃতি নেই। যে নারী কৃষির অগ্রদূত, যে নারী আমাদের কৃষি সমাজকে মহিমান্বিত করেছে জীবনের সবটুকু বিনিয়োগ দিয়ে, তার কষ্টগাঁথা খুবই অমানবিক। কৃষির সাথে সম্পৃক্ত ২০টি কাজের মধ্যে ১৭ টি কাজই সম্পাদন করে থাকে নারী। বলা চলে, কৃষি ও এর উপখাতের মূল চালিকা শক্তিই হচ্ছে নারী। কিন্তু এ নারী শ্রমিকের কাজের তেমন কোনো মূল্যায়ন করা হয় না। এখনো গ্রামীণ সমাজে কৃষি ও চাষের কাজকে নারীর প্রাত্যহিক কাজের অংশ বলে বিবেচনা করা হয়। সেখানে মজুরি প্রদানের বিষয়টি অবান্তর। কোন কোন ক্ষেত্রে নামমাত্র মজুরি দেয়া হয়। সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত পুরুষ শ্রমিকের সমান কাজ করলেও কৃষিখাতে নারী শ্রমিকের বৈধ পরিচিতি নেই। এছাড়া অন্যান্য অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতে অন্য নারী শ্রমিকের মতোই কৃষিখাতে নিয়োজিত নারী শ্রমিকেরা তীব্রভাবে বৈষম্যের শিকার হয়। নিয়মহীন নিযুক্তি, দীর্ঘ কর্মঘন্টা, নারীর অধিক আন্তরিকতা, অল্প মজুরি, মজুরি বৈষম্য দূর্ব্যবহার এমনকি ২০১৫ সালে রাষ্ট্রীয় প্রণোদনার অংশ হিসেবে যে ১ কোটি ৩৯ লাখ কৃষককে কার্ড বিতরণ করা হয়েছিল তার মধ্যে একজনও নারী কৃষক ছিল না। এর কারণ কী? আসলে কৃষক হিসেবে নারী এখনো স্বীকৃতি পায়নি।

২০০৫-২০০৬ সালে শ্রমিক শক্তি জরিপ অনুযায়ী, দেশের মোট কৃষি শ্রমিকের ৭৭ শতাংশ নারী। একইভাবে মোট কৃষি শ্রমের ৪৫ দশমিক ৬ শতাংশ বিনামূল্যে নারীশ্রম এবং ৫৪ দশমিক ৪ শতাংশ অর্থের বিনিময়ে কেনা হয়। তবে নারীশ্রমকে কেনা হলেও মজুরি বৈষম্য তো লেগেই আছে। আর নারী পারিশ্রমিক হিসেবে যেটুকু অর্থ পেয়ে থাকে, সেটুকুও জিডিপিতে অন্তর্ভুক্ত হচ্ছে না। তাছাড়া দেখা যায়, জমির মালিকানায় ৮১ শতাংশই পুরুষ এবং এ ক্ষেত্রে নারীর মালিকানা মাত্র ১৯ শতাংশ। আবার অনেক ক্ষেত্রে সরকার কর্তৃক ভূমিহীনদের যে খাসজমি প্রদান করা হয় তার সম্পূর্ণটাই থাকে স্বামীর নামে, তাতে নারীর কোন অধিকার থাকে না। যে বিষয়টি সব থেকে হতাশার ব্যাপার তা হলো, যদিও সীমিত পরিমাণ জমির মালিক নারী, তবুও কৃষক হিসেবে স্বীকৃতি নেই তার। ২০১৮ সালের সেন্টার ফর পলিসি ডায়লগ (সিডিপি) এর এক গবেষণায় দেখা গেছে, নারী শ্রমিকের আর্থিক মূল্য আনুমানিক ১০ লাখ ৩৭ হাজার ৫০৬ কোটি টাকা, যেটি ওই বছরের জিডিপির প্রায় ৭৮ শতাংশ। তবুও অর্থনীতিতে তাদের অবদানটি অস্বীকৃত। কৃষক হিসেবে নারীকে স্বীকৃতি না দেওয়ার অন্যতম কারণ হলো সামাজিক পশ্চাৎপদতা ও সামাজিক মূল্যবোধের অভাব। এই জায়গাতে আমাদের সংকট রয়েছে। এছাড়াও রাষ্ট্রীয়ভাবে সংজ্ঞায়িত না করাটাও বড় সমস্যা। আর গ্রামীণ নারী যদি কৃষক হিসাবে স্বীকৃতি না পায় তাহলে একজন কৃষক যে সুযোগ-সুবিধা পায়, সেই অনুযায়ী গ্রামীণ নারী যেমন সেই সুযোগ সুবিধা থেকে বঞ্চিত হয়ে যাচ্ছে, এভাবে ভবিষ্যতেও বঞ্চিত হয়েই থাকবে, যা আমাদের অর্থনীতিতে বিরূপ প্রভাব ফেলবে।

আমাদের দেশকে বলা হয় কৃষিপ্রধান দেশ। কিন্তু জিডিপিতে কৃষির অবদান মাত্র ১৭ শতাংশ, যা যথেষ্ট নয়। জিডিপিতে কৃষির অবদানের হার দিন দিন কমতেই আছে, সেটাও লক্ষণীয়। তবে গবেষণা প্রতিবেদন অনুযায়ী, কৃষিতে প্রান্তিক গ্রামীণ নারীর অবদান কমেনি। এই অবদান আরও ত্বরান্বিত করা যায়। আমাদের জিডিপিও বৃদ্ধি করা যায়। তাই পরিবার এবং সমাজের দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন জরুরি। এবং রাষ্ট্রকে কিছু পদক্ষেপ গ্রহণ করা অতীব জরুরি:

যেমন, সরকারকে জমি ও অন্যান্য প্রাকৃতিক সম্পদের উপর নারীর অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে হবে । অর্থ পাওয়ার সুবিধা নিশ্চিত করতে হবে। ব্যাংকগুলো থেকে যেন সহজেই ঋণ নিতে পারে তার সুব্যবস্থা করতে হবে। বিশেষ করে ক্ষুদ্রঋণ প্রদানের ব্যবস্থা করতে হবে। অস্বীকৃত কাজের মূল্যায়ন করতে হবে। যদিও এখনই আন্তর্জাতিকভাবে জিডিপিতে এই অস্বীকৃত কাজ অন্তর্ভুক্ত করা সম্ভব নয়। তবে জিডিপির মূল একাউন্টের পাশে স্যাটেলাইট একাউন্টের মাধ্যমে নারীর অস্বীকৃত কাজের হিসাব করা এবং এটির অর্থনৈতিক মূল্যায়ন করা যেতে পারে। যাতে আমরা বুঝতে পারি যে, নারীরা অর্থনীতিতে কতটুকু ভূমিকা রাখছে। নারীর দক্ষতা বৃদ্ধি করতে হবে। বর্তমান যুগ প্রযুক্তির। কৃষিতে নতুন নতুন প্রযুক্তি আসছে। নারী যদি এসকল প্রযুক্তি সম্পর্কে অবগত না থাকে তাহলে অনেক পিছিয়ে পড়বে। তাই নারীর প্রযুক্তিগত দক্ষতা বৃদ্ধি করতে হবে। তথ্য প্রাপ্তিতে সহজলভ্যতা। গ্রামীণ নারীরা অনেক তথ্যই সঠিক সময়ে পান না। যেমন গ্রামের বেশিরভাগ নারীই সরকারের প্রণোদনা প্যাকেজ সম্পর্কে জানতে পারে না। ১৫ শতাংশ নারীর ঋণ সহায়তার কথা থাকলেও ৫ শতাংশের বেশি নারী এটা পায় না। এর একমাত্র কারণ, সঠিক সময়ে তথ্য না পাওয়া। তাই গ্রামীণ নারী যাতে সহজে তথ্য পেতে পারে তার সুব্যবস্থা করতে হবে। বর্তমান সময়ে যেটি সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ তা হল নারীর নিরাপত্তা। অনেক সময় গ্রামীণ নারী তাদের উৎপাদিত পণ্য-সামগ্রী স্থানীয় বাজারেই স্বল্প মূল্যে বিক্রয় করতে বাধ্য হয় যেজন্য তারা পণ্যের ন্যায্য মূল্য পায় না। এর কারণ হলো, বাজার ব্যবস্থাপনায় নারীবান্ধব পরিবেশ না থাকা। বাজার ব্যবস্থাপনা যেন নারী বান্ধব হয় এবং নারী যেন নিরাপদে বাজারে প্রবেশ এবং তাদের পণ্য বিক্রয় করতে পারে তার দিকেও দৃষ্টিপাত করতে হবে। এককথায়, গ্রামীণ নারীর সকল অসুবিধা অনুধাবন করে তা দূরকরণের প্রচেষ্টা করতে হবে। সাসটেইনেবল ডেভেলপমেন্ট গোল (এসডিজিতে) বলা হয়েছে, শ্রম বাজারের নারীর ব্যবধান আরো ২৫ শতাংশ কমানো গেলে আমাদের জিডিপি ৪ শতাংশ বেড়ে যেতে পারে। নারীর উৎপাদন যন্ত্রের মালিকানা ,শিক্ষা, বাজারে অভিগম্যতা থাকলে কৃষি উৎপাদন লক্ষনীয় মাত্রায় বাড়ানো সম্ভব। সেইসাথে ক্ষুধার্ত জনগোষ্ঠীর সংখ্যাও অনেক কমানো সম্ভব।
লেখক: শিক্ষার্থী, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, কুষ্টিয়া



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: নারীর-অবদান
আরও পড়ুন