পবিত্র লাইলাতুল বরাত
আজ দিবাগত রাত পবিত্র লাইলাতুল বরাত। পরম করুণাময় আল্লাহতায়ালা তার বান্দাদের গুনাহ মাফ, বিপদমুক্তি ও
অবাসযোগ্য ও অসভ্য নগরী হিসেবে ঢাকার দুর্নাম পুরনো। এই দুর্নামের কারণ বলে শেষ করা যাবে না। একটি রাজধানী যেমন হওয়া উচিৎ ঢাকা তার ধারেকাছেও নেই। এখানে নাগরিক সুবিধা বলতে তেমন কিছু নেই। বছরের পর বছর ধরে সীমাহীন দুর্গতি নিয়ে নাগরিকরা এই শহরে বসবাস করছে। যানজট, পানিবদ্ধতা, বায়ু দূষণ, শব্দ দূষণ, বর্জ্য দূষণ, খাল দখল, নদী দখল, সড়ক খোঁড়াখুঁড়ির দুর্ভোগসহ হেন কোনো সমস্যা নেই, যা এই নগরীতে নেই। এসব আদি সমস্যার সাথে ফুটপাত দখল, চাঁদাবাজি, নিরাপত্তাহীনতা সমান তালে চলছে। রাজধানী দেখভাল করার সিটি করপোরেশনসহ অর্ধ শতাধিক সেবামূলক সংস্থা থাকলেও তারা সমস্যার সমাধান করতে পারছে না। বরং এক সংস্থা আরেক সংস্থাকে দোষারোপ করে দায়িত্ব এড়িয়ে যাচ্ছে। এতে বোঝা যায়, সেবামূলক প্রতিষ্ঠানগুলো নামমাত্র রয়েছে। এসব প্রতিষ্ঠানের কর্মরতরা জনগণের ট্যাক্সের পয়সায় বেতন পেলেও সেবার কাজটি নিশ্চিত করতে পারছে না। ফলে রাজধানী অবাসযোগ্যই থেকে যাচ্ছে।
রাজধানীকে বলা হয়, দেশের মুখ। এর মাধ্যমে দেশের কৃষ্টি, সংস্কৃতি, সভ্যতা, রাজনীতি, অর্থনীতিসহ দেশের সার্বিক চিত্র ফুটে উঠে। বিদেশীরা দেশটি সম্পর্কে ধারণা লাভ করে। ঢাকার চিত্র দেখে কে বলবে, আমরা একটি উদীয়মান অর্থনীতি এবং উন্নয়নশীল দেশ? বরং এই ধারণাই প্রতিষ্ঠিত হয়, এমন অবাসযোগ্য রাজধানী বিশ্বের আর কোথাও নেই। যুক্তরাজ্যের বিখ্যাত জরিপকারি প্রতিষ্ঠান ইকোনোমিক ইন্টেলিজেন্স ইউনিট (ইআইইউ)-এর একাধিক জরিপে এ চিত্র উঠে এসেছে। তারা একে বিশ্বের শীর্ষ অবাসযোগ্য রাজধানী ও অসভ্য নগরী হিসেবে আখ্যায়িত করেছে। রাজধানীর অন্যতম প্রধান সমস্যা যানজট নিয়ে অনেক গবেষণা হয়েছে। নগরবিদরা এ সমস্যার সমাধানের পথও বাতলে দিয়েছেন। এতে কি পরিমাণ ক্ষতি হয় তারও হিসাব বিভিন্ন সংস্থা দিয়েছে। বুয়েটের এক গবেষণায় বলা হয়েছে, যানজটের কারণে বছরে ২২ হাজার কোটি টাকার ক্ষতি হয়। কোনো কোনো সংস্থার মতে আরো বেশি। জাতিসংঘের ইউএনডিপির গবেষণায় বলা হয়েছে, এ ক্ষতি ৩৫ হাজার কোটি টাকার উপরে। এ হিসাবের মধ্যে রয়েছে, যানজটে দৈনিক ৪০ লাখ কর্মঘন্টা নষ্ট হওয়ায় আর্থিক ক্ষতি হয় ৩০০ কোটি টাকা। এর সাথে যুক্ত হয়েছে যানবাহনের পুড়ে যাওয়া বাড়তি জ্বালানির মূল্য এবং নগরবাসীর স্বাস্থ্যহানির আর্থিক মূল্য। যানজটের এই ক্ষতি বছরের পর বছর ধরে বেড়ে চলেছে। বায়ু দূষণের ক্ষতির হিসাবটি করা না হলেও এতে নগরবাসীর স্বাস্থ্যের যে ক্ষতি হয়, তা অপূরণীয়। শ্বাস কষ্ট, অ্যাজমা, হৃদরোগ, ডায়বেটিসসহ অত্যন্ত জটিল রোগে নগরবাসী আক্রান্ত হচ্ছে। বিশ্বের শীর্ষ বায়ু দূষণের নগরী এখন ঢাকা। এটি এখন ধুলায় ধূসরিত হয়ে কুয়াশাচ্ছন্ন এক নগরীতে পরিণত হয়েছে। বিভিন্ন সেবামূলক প্রতিষ্ঠানের সড়ক খোঁড়াখুঁড়ি করে মাসের পর মাস ফেলে রাখায় তা ধুলার ফ্যাক্টরিতে পরিণত হয়েছে। বায়ু দূষণ এতটাই মারাত্মক আকার ধারণ করেছে যে, বুক ভরে নিঃশ্বাস নেয়া অসম্ভব হয়ে পড়েছে। শব্দ দূষণ কি মাত্রায় হচ্ছে, তার যথাযথ কোনো হিসাব নেই। সাধারণভাবে কোনো এলাকায় শব্দ দূষণের মাত্রা ৩৫ ডেসিবল থাকার কথা। দেখা যায়, এ মাত্রা ছাড়িয়ে তা দ্বিগুণ হয়ে আছে। ফলে শিশুসহ সুস্থ নাগরিকরাও বধিরতার শিকার হচ্ছে। বর্জ্য দূষণের বিষয়টি নিত্যকার। অলিগলি থেকে শুরু করে প্রধান সড়কগুলো বরাবরই অপরিচ্ছন্ন অবস্থায় থাকে। সিটি করপোরেশন বর্জ্য অপসারণের কাজে নিয়োজিত থাকলেও, এ কাজটি যথাযথভাবে করা হচ্ছে না। নাগরিক অসচেতনতা তো রয়েছেই। রাজধানীর এসব সমস্যার মধ্যে ফুটপাত দখল করে দোকানপাট বসানো এবং চাঁদাবাজির ঘটনা নাগরিকদের চরম ভোগান্তিতে ফেলেছে। গতকাল দৈনিক ইনকিলাবে প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, রাজধানীজুড়ে চাঁদাবাজির মহোৎসব চলছে। ফুটপাতে দোকানপাট বসানো, অবৈধ ইজিবাইক চালানো, ভ্যানে করে অলিগলিতে মাছ-গোশত, শাক-সবজির ভ্রাম্যমান বাজার বসানোসহ পরিবহণ খাত থেকে বেসুমার চাঁদাবাজি চলছে। এর সাথে জড়িয়ে আছে শীর্ষ সন্ত্রাসী, ক্ষমতাসীন দলের একশ্রেণীর নেতা-কর্মী ও কাউন্সিলর, পুলিশের কতিপয় সদস্যসহ প্রভাবশালী মহল। তাদের এই চাঁদাবাজির উৎপাতে ফুটপাত ও সড়ক যেমন অবৈধ দখলমুক্ত করা যাচ্ছে না, তেমনি যানজট সৃষ্টি থেকে শুরু করে মানুষের স্বাভাবিক চলাচল প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়েছে। এসব সমস্যা সমাধানে যেসব কর্তৃপক্ষ রয়েছে তারা উদাসীন হয়ে বসে আছে।
সরকার অর্থনীতির বিভিন্ন সূচকের ঊর্ধ্বগতির কথা তুলে ধরে উন্নয়নের আত্মতৃপ্তি লাভ করলেও বাসযোগ্য রাজধানী গড়ে তুলতে যে ব্যর্থতার পরিচয় দিচ্ছে, তা সকলেই স্বীকার করবেন। অথচ সরকারের কাজ রাজধানীকে পরিপাটি করে গড়ে তুলে নাগরিকদের স্বস্তি ও স্বচ্ছন্দে রেখে জীবন সহজ করে দেয়া। এর কোনোটিই সরকার করতে পারছে না। যানজট থেকে নিস্কৃতি দেয়ার জন্য সরকার মেট্রো রেল, এলিভেটেড এক্সপ্রেস ওয়ের মতো মেগা প্রকল্প হাতে নিয়ে হয়তো মনে করছে, এতে সকল সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে। নগরবিদরা মনে করছেন, এতে উপর দিয়ে যাতায়াত দ্রুত ও সহজ হলেও এগুলোর নিচে জালের মতো বিস্তৃত যেসব অপরিসর ও দখলকৃত সড়ক রয়েছে, তার সমাধান হবে না। কারণ, এ প্রকল্পের মাধ্যমে দ্রুত গন্তব্য স্থলে পৌঁছলেও নিচে নামে সেই যানজটেই পড়তে হবে। যানজট নিরসনে যেসব ফ্লাইওভার নির্মাণ করা হয়েছে সেগুলোর চিত্র দেখলে তা বুঝতে অসুবিধা হয় না। যানজট এখন নিচ থেকে উপরে উঠে গেছে। তারা মনে করছেন, যানজট নিরসনে এসব প্রকল্পের পাশাপাশি অলিগলি থেকে শুরু করে প্রধান সড়কগুলোর অবাধ চলাচল নিশ্চিত করতে হবে। ফুটপাত ও সড়ক অবৈধ দখলমুক্ত করতে হবে। চাঁদাবাজির বিরুদ্ধে কঠোর পদক্ষেপ নিতে হবে। এর সাথে যারাই জড়িত থাকুক তাদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নিতে হবে। যখন-তখন সড়ক খোঁড়াখুঁড়ি বন্ধ করতে হবে। সড়ক খুঁড়ে ফেলে রাখা যাবে না। সাথে সাথে তা মেরামত করতে হবে। বায়ু ও শব্দ দূষণ এবং পানিবদ্ধতা নিরসনে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে। রাজধানীর সেবামূলক প্রতিষ্ঠানগুলোকে সমন্বিত পরিকল্পনার আওতায় আনতে হবে। রাজধানীকে বাসযোগ্য এবং নাগরিকদের স্বস্তি ও স্বাচ্ছন্দে জীবনযাপন নিশ্চিত করতে যথাযথ পদক্ষেপ নিতে হবে।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।