পবিত্র লাইলাতুল বরাত
আজ দিবাগত রাত পবিত্র লাইলাতুল বরাত। পরম করুণাময় আল্লাহতায়ালা তার বান্দাদের গুনাহ মাফ, বিপদমুক্তি ও
একটি দেশের রাজধানী কেমন হয় এবং এতে বসবাসকারি নাগরিকদের জন্য কি সুবিধা থাকে, তা সম্ভবত আমাদের দেশের সাধারণ মানুষ ও নগরবাসীর জানা নাই। তারা কেবল ভাবতে পারে ঢাকার মতো রাজধানী বিশ্বের আর কোথাও আছে কিনা, কিংবা এমন হয় কিনা? অবশ্য ইতোমধ্যে তারা জানতে পেরেছে, ঢাকা বিশ্বের সবচেয়ে বসবাস অনুপযোগী রাজধানী। কয়েক বছর আগে যুক্তরাজ্যভিত্তিক ইকোনোমিক ইন্টেলিজেন্স ইউনিট (ইআইইউ)-এর এক জরিপে ঢাকাকে বিশ্বের সবচেয়ে অবাসযোগ্য নগরী হিসেবে তুলে ধরা হয়েছে। মন্তব্যও করেছে ঢাকা ‘অসভ্য’ নগরী। এটি বসবাসের অনুপযোগী। একটি রাজধানীতে বসবাসের জন্য যেসব সুযোগ-সুবিধা থাকা প্রয়োজন, তার কোনোটাই নাই। ঢাকার বসবাসের অনুপযোগিতা নিয়ে পত্র-পত্রিকায় অনেক লেখালেখি হয়েছে। নগরবিদরা বহু পরামর্শ দিয়েছেন। তাতে রাজধানীর সেবায় নিয়োজিত প্রায় অর্ধশতাধিক কর্তৃপক্ষের কোনো টনক নড়েনি। তারা যেন কানে তুলা দিয়ে বসে আছে। অথচ এই নগরেই তাদের বসবাস হলেও তাদের কোনো চেতনা কাজ করে না। যদি করত, তাহলে রাজধানীকে বসবাস উপযোগী করার কিছু উদ্যোগ চোখে পড়ত। নগরবাসী তাদের কোনো উদ্যোগই দেখছে না। বছরের পর বছর ধরে তারা কেবল নানা সমস্যা, সংকট ও দুর্ভোগের মধ্যেই বসবাস করে যাচ্ছে।
ঢাকার প্রধান সমস্যাগুলো সকলেরই জানা। প্রতিদিনই তাদের এ সমস্যার মুখোমুখি হতে হচ্ছে। এটাকে তারা তাদের দুর্ভাগ্য মেনে নিয়েই বসবাস করছে। যানজট, পানিবদ্ধতা, বায়ু দূষণ, শব্দ দূষণ থেকে শুরু করে হেন কোনো সমস্যা নেই, যা তারা মোকাবেলা করছে না। প্রধানতম এসব সমস্যা ও সংকটের মধ্যে পড়ে রাজধানীবাসী প্রতিনিয়ত নাকাল হচ্ছে। এক যানজটের কথাই যদি ধরা হয় তবে দেখা যাবে, এতে তাদের শারিরীক ও মানসিক যে ক্ষতি হয়, তা অপূরণীয়। এসব ক্ষতির কোনো হিসাব করা যায় না। তবে আর্থিক যে ক্ষতি হয় তার হিসাব বিভিন্ন সময়ে জাতিসংঘসহ দেশী-বিদেশী অনেক সংস্থাই দিয়েছে। জাতিসংঘের ইউএনডিপির এক গবেষণায় বলা হয়েছে, যানজটে ক্ষতির পরিমান বছরে ৩৫ হাজার কোটি টাকার উপরে। এ হিসাবের মধ্যে রয়েছে, যানজটে দৈনিক ৪০ লাখ কর্মঘন্টা নষ্ট হওয়ায় আর্থিক ক্ষতি হয় ৩০০ কোটি টাকা। অন্যান্য সংস্থার হিসেবে এ ক্ষতির পরিমাণ আরও বেশি। আর এখন রাজধানীর যানজটের যে চিত্র, তাতে এটি একটি অচল ও স্থবির শহরে পরিণত হয়েছে। মেট্রোরেল ও এলিভেটেড এক্সপ্রেস ওয়ের নির্মাণ কাজের জন্য প্রধান প্রধান সড়কগুলো দখল হয়ে গেছে। মূল সড়কের পাশ দিয়ে সরু গলির মতো সড়ক দিয়ে যান চলাচল করতে হচ্ছে। এতে যানজটের কী পরিস্থিতি, তা কল্পনাও করা যায় না। এই দুই প্রকল্পের পাশাপাশি রয়েছে ওয়াসা, ডেসা, তিতাসসহ আরও অন্যান্য সংস্থার সড়ক খোঁড়াখুঁড়ি। সড়ক খোঁড়াখুঁড়ির এই উপদ্রবও নগরবাসীর জন্য নতুন কিছু নয়। উন্নয়নের নামে সড়ক খুঁড়ে মাসের পর মাস ফেলে রাখা হয়। মেরামতের কোনো নামগন্ধও নয়। বর্ষার সময় বৃষ্টির পানি জমে এগুলো যেমন মরণফাঁদে পরিণত হয়, তেমনি শুকনো মৌসুমে পরিণত হয় ধুলা-বালির কারখানায়। এখন তো ঢাকা ধুলার রাজধানীতে পরিণত হয়েছে। বুকভরে নিঃশ্বাস নেয়া দূরে থাক, স্বাভাবিকভাবেও নিঃশ্বাস নিতে কষ্ট হয়। এই ধুলার সাথে যুক্ত হচ্ছে, যানবাহন, কলকারখানা এবং ইটভাটার বিষাক্ত কালো ধোঁয়া। বলা যায়, ধুলো-বালি ও বিষাক্ত ধোঁয়ায় রাজধানী এখন যেন কুয়াশার নগরীতে পরিণত হয়েছে। বায়ু দূষণ এখন এমন এক পর্যায়ে গেছে যে, কয়েক দিন পরপরই এটি বিশ্বের এক নম্বর বায়ু দূষণের নগরীতে পরিণত হচ্ছে। এই দূষণে সাধারণ মানুষ শ্বাসকষ্ট, অ্যাজমা, হৃদরোগসহ নানা রোগ-ব্যাধিতে আক্রান্ত হচ্ছে। মানুষের ক্ষতির এ দায় কে নেবে? যদি কারো দায় নিতে হয়, তবে নিশ্চিতভাবেই তা রাজধানীর সেবামূলক প্রতিষ্ঠানগুলোকে নিতে হবে। কারণ, তারা রাজধানীর কোনো সেবাই নিশ্চিত করতে পারেনি। রাজধানীর পানিবদ্ধতার বিষয়টি অতি পুরনো। বর্ষায় সামান্য বৃষ্টিতেই সড়কগুলো হাঁটু পানিতে তলিয়ে যায়। মাঝারি মানের বৃষ্টিতে তা কোমর এমনকি বুক সমান ডুবে যায়। কখনো কখনো নৌকা চলাচল করতেও দেখা যায়। গাড়িগুলো যেন পানির নিচ দিয়ে চলাফেরা করে। সুরম্য অট্টালিকাগুলোকে পানিতে ভাসতে দেখা যায়। অথচ এই পানিবদ্ধতা নিরসনের দায়িত্ব ওয়াসার হলেও প্রতিষ্ঠানটি তার জন্য সিটি করপোরেশনকে দায়ী করে আসছে। সিটি করপোরেশনও ওয়াসাকে দায়ী করছে। অবশ্য গত সপ্তাহে ‘ঢাকা শহরের জলাবদ্ধতা নিরসনে খালসমূহ সিটি করপোরেশনের নিকট ন্যাস্তকরণ’ সংক্রান্ত এক পরামর্শ সভা শেষে স্থানীয় সরকারমন্ত্রী তাজুল ইসলাম বলেছেন, রাজধানীর জলাবদ্ধতা নিরসনে বৃষ্টির পানি নিষ্কাশনের দায়িত্ব ওয়াসার কাছ থেকে ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনকে দেয়ার নীতিগত সিদ্ধান্ত হয়েছে। এ হস্তান্তর কোন প্রক্রিয়ায় করা যায়, এ নিয়ে একটি টেকনিক্যাল কমিটি গঠন করা হয়েছে। কমিটি এক মাসের মধ্যে প্রতিবেদন দেবে। এরপর হস্তান্তর প্রক্রিয়া শুরু হবে। রাজধানীর অসহনীয় পানিবদ্ধতা নিরসনে এটি একটি ইতিবাচক সিদ্ধান্ত। যে কাজটি ৩০ বছর আগে করার কথা ছিল, তা এখন করা হচ্ছে। এখন দেখার বিষয় হচ্ছে, দুই সিটি করপোরেশন এই পানিবদ্ধতার অবসান ঘটাতে কি পদক্ষেপ নেয়। আগামী বর্ষায় রাজধানী পানিবদ্ধতামুক্ত হতে পারবে কিনা।
রাজধানীর আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ সমস্যা শব্দ দূষণ। এ দূষণটিকে কেউ যেন আমলে নিচ্ছে না। অথচ এটি নীরব ঘাতক হয়ে রয়েছে। এর কারণে হৃদরোগ, হাইপ্রেসার, ডায়বেটিসে আক্রান্ত হওয়া থেকে শুরু করে মানুষের শ্রবণশক্তি হারিয়ে যাচ্ছে। যানবাহনের তীব্র হর্ণ, মাইকের শব্দ, বাসার ছাদে গভীর রাতে বিয়ে-সাদী, জন্মদিনের অনুষ্ঠানে জোরে গান-বাজনা প্রতিনিয়ত শব্দ দূষণ করছে। এতে অসুস্থ মানুষ থেকে শুরু করে সুস্থ মানুষও অসুস্থ হয়ে পড়ছে। হাইপারটেনশন বেড়ে যাচ্ছে। সাধারণত একটি অঞ্চলে শব্দের মান ৩৫ ডেসিবল আদর্শ হিসেবে ধরা হয়। দেখা যাচ্ছে, রাজধানীর শব্দ দূষণের হার কোনো কোনো জায়গায় গড়ে ৬০ ডেসিবলের বেশি। দিনের পর দিন এটা যে মানুষের কত মারাত্মক ক্ষতি করে চলেছে, তা কেউ টের পাচ্ছে না। এ সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষেরও কোনো উদ্যোগ নেই। শব্দ দূষণের পাশাপাশি বর্জ্য দূষণ রাজধানীর পরিবেশের জন্য সবচেয়ে বড় ক্ষতির কারণ হয়ে রয়েছে। গৃহস্থালী বর্জ্য থেকে শুরু করে মেডিক্যাল বর্জ্যে দূষণের বিষয়টি নতুন নয়। বছরের পর বছর ধরে তা চলছে। এর সাথে যুক্ত হয়েছে নতুন ভয়াবহ বর্জ্য করোনা সুরক্ষা সামগ্রী। সম্প্রতি এক হিসেবে দেখা গেছে, রাজধানীতে প্রতিদিন কয়েক টন করোনা বর্জ্য উৎপাদিত হচ্ছে। এই বর্জ্য সাধারণ বর্জ্যরে সাথে মিশে ভয়াবহ পরিবেশ দূষণ সৃষ্টি করছে। যত্রতত্র করোনা বর্জ্য ফেলার কারণে করোনা সংক্রমণের ঝুঁকিও বৃদ্ধি করে চলেছে। অথচ চিকিৎসকরা এসব বর্জ্য আলাদাভাবে সংরক্ষণ করে নির্দিষ্ট স্থানে ফেলা এবং এর আলাদা অপসারণ ব্যবস্থাপনা গড়ে তোলার কথা বলেছেন। দেখা যাচ্ছে, এ ধরনের কোনো উদ্যোগ নেই। সিটি করপোরেশন সাধারণ বর্জ্যরে সাথেই করোনা বর্জ্য অপসারণ করছে।
ঢাকার সমস্যার অন্ত নেই। নেই বলেই এটি বসবাসের অনুপযোগী হয়ে রয়েছে। এ পরিস্থিতি আর কতকাল চলবে, তা কেউই বলতে পারবে না। অথচ আমরা আগামী বছর উন্নয়নশীল দেশের তালিকায় ঢুকতে যাচ্ছি। একটি উন্নয়নশীল দেশের রাজধানী যদি বসবাসের অযোগ্য হয়, তবে তা কেমন উন্নয়ন তা বোঝা মুশকিল। ঢাকাকে দেখলে যে কেউ মনে করবে, বাংলাদেশের অর্থনীতি শক্তিশালী হচ্ছে, এ কথা কি বলা যায়। যে দেশের রাজধানীই বসবাসের যোগ্য নয়, তা উন্নয়নশীল দেশ হয় কিভাবে? অথচ উন্নয়ন হচ্ছে, তবে রাজধানীর চেহারা দেখে তা বোঝার উপায় নেই। আমরা মনে করি, সরকার ও রাজধানী কর্তৃপক্ষকে ঢাকার দুর্নাম ঘুচাতে পরিকল্পিত ও সমন্বিত পদক্ষেপ নিতে হবে। দুই সিটি করপোরেশন, রাজউক, ওয়াসাসহ যেসব সেবামূলক প্রতিষ্ঠান রয়েছে, সেগুলোর ওপর অর্পিত দায়িত্ব যথাযথভাবে পালন করতে হবে। যানজট, পানিবদ্ধতা, বায়ু দূষণ, শব্দ দূষণ, বর্জ্য দূষণসহ সব ধরনের সমস্যার সমাধানে তৎপর হতে হবে। রাজধানীকে বাসযোগ্য করে তুলতে যা করা প্রয়োজন তাই করতে হবে।
লেখকঃ সাংবাদিক ও কলামিস্ট।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।