পবিত্র লাইলাতুল বরাত
আজ দিবাগত রাত পবিত্র লাইলাতুল বরাত। পরম করুণাময় আল্লাহতায়ালা তার বান্দাদের গুনাহ মাফ, বিপদমুক্তি ও
এই সময়ের অন্যতম শ্রেষ্ঠ অলরাউন্ডার সাকিব আল হাসানকে নিয়ে চায়ের পেয়ালায় ঝড় তোলার অপচেষ্টা করা হয়েছিল। অপচেষ্টা করেছিল প্রগতির সাইনবোর্ডধারী একটি মহল। সুখের বিষয়, বাংলাদেশের জাতীয়তাবাদী ও ইসলামী শক্তিসমূহ এ ব্যাপারে অত্যন্ত পরিপক্কতার পরিচয় দিয়েছে। সেই সাথে ধন্যবাদ দিতে হয় সাকিব আল হাসানকে। তাকে নিয়ে একটি অবাঞ্ছিত বিতর্ক সৃষ্টি হওয়ার আগেই একটি লম্বা বিবৃতি দিয়ে তিনি নিজের অবস্থান পরিষ্কার করেছেন। মজার ব্যাপার হলো এই যে, যারা ইসলামী শিবিরের বিরুদ্ধে সাকিবকে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করতে চেষ্টা করেছেন তারা সাকিবের বিবৃতিটিও ছাপেননি। উল্টা তারা পত্রিকায় নিবন্ধ ফেঁদেছেন। একজন তার নিবন্ধের শিরোনাম দিয়েছেন, ‘ধর্ম ব্যবসায়ীদের কাছে আত্মসমর্পণ করেছেন সাকিব’। আরেকজন তার নিবন্ধের শিরোনাম দিয়েছেন, ‘সাকিবকে ক্ষমা চাইতে হল কেন?’ আসলে এরা কি চাচ্ছিলেন? তারা সম্ভবত চাচ্ছিলেন যে, সাকিব নিরব থাকুন, আর সেই সুযোগে প্রগতির মুখোশধারীরা দেশের আলেম ওলামা এবং দেশপ্রেমিকদের বিরুদ্ধে হেট ক্যাম্পেইন বা ঘৃণা ছড়াতে থাকুক। সাকিবের বিবৃতি তাদের বাড়া ভাতে ছাই দিয়েছে। আর সাকিবের হুমকিদাতা যুবককে সংক্ষিপ্ততম সময়ে গ্রেফতার করে সরকারও রটনাকারীদের মুখ বন্ধ করে দিয়েছেন। বিষয়টি পাঠকদের কাছে পরিষ্কার করার জন্য ঘটনার গোড়াতে যাওয়া যাক।
গত কালীপূজার কয়েকদিন আগে সমকালীন বিশ্বে ক্রিকেটের অন্যতম শ্রেষ্ঠ অলরাউন্ডার সাকিব আল হাসান কলকাতা যান। এরপর সামাজিক মাধ্যমে কে বা কারা এই খবরটি ভাইরাল করেন যে, কলকাতায় সাকিব একটি পূজামন্ডপে কালীপুজা উদ্বোধন করেছেন। প্রথম দৃষ্টিতে খবরটি বিব্রতকর হলেও সরকারি বা কোনো রাজনৈতিক বা কোন ধর্মীয়, অর্থাৎ কোন দায়িত্বশীল মহল থেকে এ বিষয়ে কোনো মন্তব্য করা হয়নি।
পরদিন সিলেটের এক যুবক হাতে রামদা জাতীয় অস্ত্র নিয়ে ফেসবুকে ছবি দিয়ে বলে যে, কালীপূজা উদ্বোধন করে সাকিব খুব অন্যায় করেছেন। তাই সে হেঁটে ঢাকা যাবে এবং সাকিবকে হত্যা করবে। ফেসবুকে এই পোস্ট দেওয়া হয় রাত ১২টার সময়। ৪ ঘণ্টা পর রাত ৪টায় ঐ যুবক ঐ পোস্টটি ফেসবুক থেকে প্রত্যাহার করে। সে বলে যে, সে সাকিবের একজন অন্ধ ভক্ত। কিন্তু সাকিবের কালীপূজা উদ্বোধনের ঘটনাটি সে মেনে নিতে পারেনি। তার মাথা গরম হয়ে গিয়েছিল। তাই সে ঐ পোস্ট দিয়েছিল। সে এখন বুঝতে পেরেছে যে, সে ভুল করেছিল। তাই সেই পোস্ট সে প্রত্যাহার করেছে। এরপর সাকিবের নিন্দা করে আর কেউ সামাজিক মাধ্যমে কিছু লিখেছেন বলে আমার চোখে পড়েনি। যুবকটির ঐ হুমকি দেয়া পোস্ট দেখে পুলিশ সাথে সাথেই তৎপর হয় এবং সম্ভবত ৪৮ ঘণ্টার মধ্যেই যুবকটি গ্রেফতার হয়।
দুই
পরদিন ঢাকার একটি বাংলা দৈনিকে উক্ত মন্ডপে অনুষ্ঠিত পূজার আমন্ত্রণপত্র ছাপা হয়। ঐ দাওয়াত পত্রে দেখা যায় যে, উক্ত কালীপূজা উদ্বোধন করবেন একজন পুরোহিত। প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত থাকবেন কলকাতার মেয়র ফিরহাদ হাকিম। বিশেষ অতিথি হিসেবে উপস্থিত থাকবেন বাংলাদেশের আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন ক্রিকেটার সাকিব আল হাসান।
১৭ নভেম্বর মঙ্গলবার ‘ডেইলি স্টারের’ দ্বিতীয় পৃষ্ঠার অষ্টম কলামে ইউটিউবে স¤প্রচারিত সাকিবের বক্তব্য ছাপা হয়। ঐ ভিডিও ক্লিপে সাকিব বলেন যে, তিনি কালীপুজো উদ্বোধন করেননি। ঐ ভিডিওতে আমন্ত্রণপত্র পড়ে শোনান। সেখানে উদ্বোধকের নাম লেখা আছে। তিনি বলেন, সকলের অনুরোধে মন্ডপে তিনি প্রদীপ জ্বালান।
সাকিব ভিডিওতে বলেন, ‘আমি একজন গর্বিত মুসলমান। ওখানে যাওয়াটাই আমার ঠিক হয়নি। সেটা যদি আপনারা মনে করেন তাহলে অবশ্যই এর জন্য আমি আন্তরিকভাবে দুঃখিত, ক্ষমা প্রার্থী। ভবিষ্যতে এরকম ঘটনার পুনরাবৃত্তি না হয় সেটি চেষ্টা করব। আমি প্রথমেই বলতে চাই যে আমি নিজেকে একজন গর্বিত মুসলমান মনে করি এবং আমি সেটাই চেষ্টা করি পালন করার। ভুল ত্রুটি হবেই এবং ভুল ত্রুটি নিয়েই আমরা জীবনে চলা চল করি। কোন ভুল হয়ে থাকলে অবশ্যই আমি আপনাদের কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করি এবং আপনাদের মনে কোন কষ্ট দিয়ে থাকলে সে জন্যও আমি ক্ষমা প্রার্থনা করি।’ (সাকিবের ভিডিও থেকে হুবহু নেওয়া)।
সাকিব আল হাসানের এই বক্তব্যে কোন ভুল নাই। একটি মুহূর্ত বিলম্ব না করে পুলিশ হুমকীদাতাকে গ্রেফতার করেছে এবং সাকিব অনুতপ্ত হয়ে ক্ষমা চেয়েছেন। বিষয়টি এখানেই শেষ হয়ে গেছে বলে বাংলাদেশের শান্তিপ্রিয় মানুষ মনে করেছিলেন। কিন্তু ভারতীয় দুই চারটি চ্যানেল এবং বেশ কিছু ইউটিউবার সাকিবের ওপর ক্ষেপে গেলেন। কেন সাকিব দুঃখ প্রকাশ করলেন বা ক্ষমা চাইলেন? ভারতের কয়েকটি চ্যানেল এবং ইউটিউব এই ইস্যুটি নিয়ে যখন রীতিমতো ক্যাম্পেইন শুরু করে তখন স্বাভাবিকভাবেই রিমোট কন্ট্রোলের বোতাম টেপার মত বাংলাদেশেও কয়েকজন তাদের তালে গান ধরে। কিন্তু এবার সুর, তাল এবং লয়ে ছন্দপতন ঘটে। তাই তাদের আসর জমেনি।
আর জমবেই বা কেন? সাকিবের বিরুদ্ধে তো হুংকার দিয়েছে একজন মাত্র যুবক। ঐ যুবকটির ভিডিও ফুটেজ দেখেছেন, এমন একজন মানসিক রোগ বিশেষজ্ঞ বলেন, যুবকটির বডি ল্যাঙ্গুয়েজ বা বডি মুভমেন্ট থেকে পরিষ্কার ধারণা করা যায় যে, সে একজন মস্তিষ্কবিকৃত মানুষ। রাত ১২ টায় একটি স্ট্যাটাস দিয়ে মাত্র ৪ ঘণ্টা পর শেষ রাত্রি ৪ টার সময় সে সেটি ফেসবুক থেকে সরিয়ে নেয় কেন? আরও একটি বিষয় লক্ষণীয় যে, বাংলাদেশের ১৭ কোটি মানুষের মধ্যে মাত্র একজন অশিক্ষিত যুবক এই হুমকি দিয়েছে। অবশিষ্ট বিশাল জনগোষ্ঠী তার আস্ফালনে সাড়া দেয়নি।
তিন
অথচ ঐ এক ব্যক্তির আস্ফালনকে পুঁজি করে ওরা মাঠে নামার চেষ্টা করেছিল। ভারতীয় প্রিন্ট মিডিয়া এবং বাংলাদেশের একটি অথবা দুটি প্রিন্ট মিডিয়ায় অপপ্রচার শুরু হলো যে, যারা সাকিবকে হুমকি দিয়েছে তারা নাকি মৌলবাদী। ওরা নাকি তালেবান। ওরা আই এস। ওরা আলকায়েদা। ওরা বাংলাদেশকে পাকিস্তান বানাতে চায়। তাদের একজন হলো বাংলাদেশ থেকে বিতাড়িত, ভারতে আশ্রয় নেয়া নারীটি। বাংলাদেশের মানুষ তাকে আর গণনার মধ্যে নেয় না। আমিও নেই না। কিন্তু নিতে হলো এই কারণে যে আসরে দেখা গেল আরেক ব্যক্তিকে। তিনি বিচার বিভাগের একজন অবসরপ্রাপ্ত ব্যাক্তি। খুবই উচ্চ পদে ছিলেন। মৌলবাদী বলে যাদেরকে ইঙ্গিত করা হচ্ছে তাদের কেউই তো সাকিবের ব্যাপারে একটি কথাও বলেননি।
হেফাজতে ইসলামের কোন নেতা কি সাকিবের বিরুদ্ধে কোন কথা বলেছেন? বলেননি। জামায়াতে ইসলামীর কোন নেতা কি কিছু বলেছেন? বলেননি। জমিয়াতুল মোর্দারেসিনের কেউ কি কিছু বলেছেন? বলেননি। অনুরূপভাবে চরমোনাইয়ের হুজুরের ইসলামী আন্দোলন, খেলাফত মজলিস প্রভৃতি সংগঠনের কেউ কিছু বলেননি। তাহলে ওরা শূন্যে গদা ঘোরাচ্ছেন কেন? কার বিরুদ্ধে?
দুঃখ প্রকাশ করে বা ক্ষমা চেয়ে সাকিব আল হাসান কি নিজেকে ছোট করেছেন? মোটেই করেননি। ওরা ভুলে গেছেন যে, ক্ষমা চাওয়া এবং ক্ষমা করে দেওয়া মানুষের একটি বড় গুণ। বলা হয় যে ক্ষমা চাওয়া এবং ক্ষমা করা মহত্তে¡র লক্ষণ। নিজের ইউটিউবে সাকিব যা বলেছেন তার ফলে সর্ব শ্রেণীর মানুষের কাছে তিনি অনেক বড় হয়েছেন। রাতারাতি তার ইমেজ অনেক বৃদ্ধি পেয়েছে। সাকিব যখন বলেছেন যে তিনি একজন গর্বিত মুসলমান এবং সেটাই পালন করেন, তখন সাথে সাথে বাংলাদেশের কোটি কোটি ধর্মভীরু মানুষের হৃদয়ে সাকিবের জন্য ভালোবাসার আসন স্থাপিত হয়েছে। যারা বলেন, মৌলবাদীরা তার বিরুদ্ধে গেছে তারা রাতকে দিন বলছেন এবং দিনকে রাত বলছেন।
চার
সাকিবের ঘটনাকে কেন্দ্র করে যারা ‘মৌলবাদ’ ও ‘মৌলবাদী’ বলে চিৎকার করছেন তারা কি জানেন যে মৌলবাদ কোথা থেকে এসেছে? মৌলবাদ বা ফান্ডামেন্টালিজম শব্দটি এসেছে খ্রিস্টানদের মাঝখান থেকে। খ্রিষ্টধর্মের ত্রিনিটি বা ত্রিতত্ববাদ থেকেই এর উৎপত্তি। খুব সোজা করে বলতে গেলে ত্রিতত্ববাদ হলো একের ভেতর তিন। অর্থাৎ পিতা, পুত্র এবং পবিত্র আত্মা (Father, Son and Holy Spirit)। এই তিন সত্বা নিহিত রয়েছে একটি সত্বায়। আর তিনি হলেন যীশু খ্রীষ্ট (Jesus Christ)। এই ত্রিতত্ববাদে যারা বিশ্বাসী নয়, তারা খৃষ্টানই নয়। এই তিন সত্বাই হল খ্রিস্টান ধর্মের মৌলিক স্তম্ভ। এই তিন সত্বা থেকেই উৎসারিত হয়েছে মৌলবাদ শব্দটি। এবং মৌলবাদ নিয়ে খ্রিস্টানদের আন্দোলনও হয়েছে।
মুসলমানদের মধ্যে মৌলবাদ বলে কিছু নাই। কিন্তু মুসলমান হতে গেলে তাকে বিশ্বাস করতে হবে (১) পৃথিবী নভোমন্ডল এবং এর মধ্যবর্তী যা কিছু আছে অর্থাৎ আকাশ, চন্দ্র, সূর্য, নক্ষত্রমন্ডলী, মেঘমালা, পাহাড়-পর্বত, সমুদ্র, নদী, অরণ্য, জীব ও মানুষ- সবকিছুর স্রষ্টা এবং পালনকর্তা আল্লাহ (২) তিনিই একমাত্র মাবুদ, অর্থাৎ তিনি ছাডড়া অন্য কোন উপাস্য নাই, অর্থাৎ একমাত্র তাঁরই এবাদত বন্দেগী করতে হবে (৩) তিনি অতীতে ছিলেন, বর্তমানে আছেন এবং ভবিষ্যতেও তিনিই থাকবেন (৪) রোজ কিয়ামত এবং পরকালে বিশ্বাস (৫) নামাজ কায়েম (৬) তিনি মানুষকে পাঠিয়েছেন একটি নির্দিষ্ট সময়ের জন্য। ঐ সময় পার হলে মানুষের মৃত্যু হবে (৭) এই পৃথিবীতে মানুষ যে কয়দিন জীবিত থাকবে ততদিন তার প্রতিটি পূন্য এবং প্রতিটি পাপের হিসাব নেওয়া হবে রোজ হাশরে। নেকির পাল্লা ভারী হলে জান্নাত এবং গুনাহর পাল্লা ভারী হলে জাহান্নাম (৮) আল্লাহ তাআলার নির্দেশ এবং বিধানাবলী কোরআন শরীফে বিবৃত। তাই কোরআনের নির্দেশ মোতাবেক চলতে হবে।
পবিত্র কোরআনের ছত্রে ছত্রে আল্লাহর একত্ববাদ, মহাবিশ্বের স্রষ্টা এবং তার ওপর তার একচ্ছত্র ক্ষমতার কথা বলা হয়েছে। এবং আল্লাহর প্রতি অবিশ্বাসীদের ওপর তার আজাবের কথা বিধৃত হয়েছে। ‘আমি একজন গর্বিত মুসলমান’, একথা দৃঢ়তার সাথে বলে সাকিব আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন করেছেন। আল্লাহ রাব্বুল আলামীন তাঁর হেফাজত করুন।
Email: [email protected]
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।