Inqilab Logo

শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

প্রাকৃতিক ও পরিবেশিক ভারসাম্য রক্ষা করতে হবে

| প্রকাশের সময় : ৩০ নভেম্বর, ২০২০, ১২:০১ এএম

রাজধানী ঢাকায় এক সময় প্রচুর খাল ছিল। ছিল অসংখ্য পুকুর ও জলাশয়। চারপাশে ছিল নদী। পানির কোনো সমস্যা ছিল না। পানি নিকাষের প্রাকৃতিক ব্যবস্থা ছিল চমৎকার। যখন ঢাকাকে রাজধানী করা হয় তখন এসব দিক ভালোভাবে বিবেচনায় নেয়া হয়। স্বীকার করতেই হবে, বিশ্বের রাজধানী নগরীগুলোর মধ্যে নিরাপত্তা ও নাগরিক সুবিধাদির দিক দিয়ে ঢাকা ছিল অনন্যসাধারণ। সেদিন হয়েছে বাসী। এখন ঢাকা বসবাস অযোগ্যতার বিচারে বিশ্বের মধ্যে শীর্ষে। বর্জ্য, বস্তি ও যানজটের নগরী হিসাবে পরিচিত। মাটি, পানি, বায়ু ও শব্দদূষণেও এর অবস্থান শীর্ষে। এ জন্য আমরাই দায়ী। আমাদের অপপরিকল্পনা, অপরিণামদর্শিতা, অজ্ঞতা ও লোভ-লালসার দায় মোটাদাগে এর জন্য দায়ী। খালের কথাই ধরা যাক। কত খাল ছিল, এখন আমরা কেউ বলতে পারবো না। পুরানো ম্যাপ ও কাগজপত্রে যেসব খালের উল্লেখ পাওয়া যায়, তার একটা অংশের কোনো অস্তিত্ব নেই। জাতীয় নদী রক্ষা কমিশন ৬৫টি খালের একটা হিসাব দিয়েছে। এই ৬৫ খালের কতটা অস্তিত্বে আছে, কতটা নেই, সে প্রশ্ন প্রাসঙ্গিক। বলা বাহুল্য, এদের অনেকগুলোই হয়তো কাগজে-মানচিত্রে আছে অস্তিত্ব নেই। পত্রিকান্তরে প্রকাশিত এক খবরে ৪০টি খালের কথা বলা হয়েছে, যেসব খালের ওপর বক্স কালভার্ট তৈরি কিংবা রাস্তা নির্মাণ করা হয়েছে। সরকারি বিভিন্ন প্রকল্পের নামেও দখল করা হয়েছে। ৯টি খাল ঢাকা ওয়াসা সরু করে কংক্রিট স্লাভ দিয়ে ঢেকে দিয়েছে। ওয়াসা ছাড়াও সরকারের বিভিন্ন এজেন্সি রাস্তা ও স্থাপনা তৈরি করেছে। শত শত ব্যবসায়ী ও প্রভাবশালী ব্যক্তি খাল দখল করে বাড়িঘর, দোকানপাট নির্মাণ করেছে। যেসব খাল বা তার অংশবিশেষ এখনো নামকাওয়াস্তে টিকে আছে, যেগুলো ময়লা-আবর্জনার ভাগাড় হিসাবে ব্যবহৃত হচ্ছে। কোনো কোনো খালে পানি থাকলেও তরল বর্জ্যে নষ্ট।

খালগুলো স্বমহিমায় টিকে থাকলে ঢাকায় পানিবদ্ধতার যে সমস্যা ও নাগরিক বিড়ম্বনা, সেটা থাকতো না। প্রবাহমান খালের মাধ্যমে পানি নদীতে নিষ্কাষিত হয়ে যেতো। খালের যেমন দশা, নদীরও তাই। চার নদী দখল-দূষণে জেরবার ফলে পানি নিকাষ সম্ভবপর হচ্ছে না। বিভিন্ন নালা-নর্দমা দিয়ে নগরীর যাবতীয় তরল বর্জ্য গিয়ে পড়ছে নদীতে। নদী দূষণ এমন পর্যায়ে গেছে যে, মাছ বা জলজপ্রাণী বাঁচা প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়েছে। পানিবদ্ধতা নিরসনে খাল উদ্ধার এবং পানিনিকাষ ব্যবস্থার উন্নয়ন জরুরি হলেও ঢাকা ওয়াসা লাগাতার ব্যর্থতার পরিচয় দিয়ে আসছে। দখল-দূষণ প্রতিরোধ করে নদী নাব্য করার ক্ষেত্রেও ব্যর্থতার পরিচয় দিয়ে আসছে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ। সম্প্রতি প্রকাশিত এক খবরে জানা গেছে, খালের দায়িত্ব ঢাকা ওয়াসার হাত থেকে দুই সিটি করপোরেশনের হাতে ন্যস্ত করার চিন্তা করছে সরকার। এটা ভালো চিন্তা। খাল নিয়ে টানাটানিটা অন্তত বন্ধ হবে। খাল উদ্ধার, সংষ্কার এবং স্রােতবাহী করার বিকল্প নেই। এইসঙ্গে নদী দখল ও দূষণমুক্ত করতে হবে। এব্যাপারে দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্র্তপক্ষকে দ্রুত কাজ করতে হবে। একদা ঢাকার চারদিকে ছোট ছোট পাহাড় বা টিলা এবং বন-জঙ্গলের এক অপূর্ব বিস্তার ছিল। দুঃখজনক হলেও বলতে হচ্ছে, সেই পাহাড়-টিলা ও বন-জঙ্গলও দিনে দিনে হারিয়ে যাচ্ছে। ভাওয়ালের গড় বলে পরিচিত বিস্তীর্ণ এলাকার বিভিন্ন অংশে পাহাড়-টিলা কেটে সমান করে বসতি স্থাপন করা হচ্ছে। একই সঙ্গে সাফ করা হচ্ছে বন-জঙ্গল। ইনকিলাবে প্রকাশিত এক খবরে বলা হয়েছে, ঢাকার অদূরে পূর্বাচল নতুন শহর প্রতিষ্ঠার জন্য ভাওয়ালগড়ের একাংশ নির্বাচন করা হয়েছে। সেখানে পাহাড়-টিলা কেটে সাবাড় করা হচ্ছে। গাছও কেটে ফেলা হচ্ছে। এর প্রতিক্রিয়া কী হতে পারে, এখনই আন্দাজ করা যাচ্ছে না। প্রাকৃতিক বৈচিত্র্য ও বৈশিষ্ট্য যে এতে ক্ষু্ণ্ণ হবে, পরিবেশিক ভারসাম্য নষ্ট হবে, তাতে কোনো সন্দেহ নেই।

পাহাড়, বন-জঙ্গল, নদ-নদী, খাল-বিল, জলাশয় ইত্যাদি প্রকৃতির অপরিহার্য উপাদান। জীবন ও পরিবেশের ভারসাম্য বজায় রাখার জন্য এদের প্রয়োজনীয়তা অনস্বীকার্য। আমরা গভীর উদ্বেগের সঙ্গে লক্ষ করে আসছি, নির্বিচারে পাহাড় কাটা হচ্ছে, বন-জঙ্গল উজাড় করা হচ্ছে, নদ-নদী, খাল-বিল দখল করা হচ্ছে। চট্টগ্রাম, পার্বত্য চট্টগ্রাম, কক্সবাজার ও সিলেটে পাহাড়কর্তন রীতিমত উৎসবের রূপ নিয়েছে। সরকারি হিসাবে গত দেড় যুগে শুধুমাত্র চট্টগ্রাম মহানগরীতেই ১২৩টি পাহাড় কেটে শেষ করা হয়েছে। অন্যান্য পাহাড়ি এলাকার পরিস্থিতিটা কী রকম হতে পারে, সহজেই অনুমান করা যায়। বন-জঙ্গল সাফ করা এক শ্রেণির মানুষের নেশায় পরিণত হয়েছে। এর মধ্যে বনবিভাগের এক শ্রেণির কর্মকর্তাও আছে। যে কোনো দেশের প্রাকৃতিক ভারসাম্যের জন্য ২৫ শতাংশ বনভূমি থাকা প্রয়োজন। আমাদের দেশে আছে ১০ শতাংশের কম। এইসঙ্গে বনভূমি দখল বা লুণ্ঠিত হচ্ছে বেপরোয়াভাবে। ইতোমধ্যে ৪ লাখ ৫৮ হাজার একর বনভূমি হারিয়ে গেছে। এর অংশ বিশেষ সরকারের বিভিন্ন বিভাগ ও এজেন্সি তাদের প্রয়োজনে নিয়েছে, অংশবিশেষ লিজ দেয়া হয়েছে, আর বাকীটা ক্ষমতাবান ও প্রভাবশালী ব্যক্তিরা দখল করে নিয়েছে। নদ-নদী, খাল-বিল ও জলাশয়ের অবস্থাও শোচনীয়। বহু নদী হারিয়ে গেছে। বহু খাল-বিল, জলাশয় এখন আবাদী জমি। ১৯ হাজার কিলোমিটার নৌপথ ইতোমধ্যেই বিলীন হয়ে গেছে। এতে বুঝা যায়, এক্ষেত্রে পরিস্থিতি কতটা নাজুক। মহান আল্লাহপাক প্রকৃতি ও পরিবেশকে ভারসাম্যপূর্ণ এবং মানুষের জন্য উপযোগী ও কল্যাণকর রূপে সৃজন করেছেন। কিন্তু মানুষ দিনের পর দিন নানা অনাচার-অত্যাচারের মাধ্যমে সেই ভারসাম্য নষ্ট করে ঝুঁকির মধ্যে নিক্ষেপ করেছে। জলবায়ু পরিবর্তনজনিত সমস্যা মানুষেরই সৃষ্ট। এখন জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে প্রকৃতি ও পরিবেশের অন্যান্য উপাদনের মতো মানুষও হুমকিতে পড়েছে। এই হুমকি থেকে সুরক্ষা পেতে হলে প্রাকৃতিক ও পরিবেশিক ভারসাম্য পুনঃপ্রতিষ্ঠার বিকল্প নেই। আমরা আশা করবো, প্রকৃতি ও পরিবেশের প্রতি মানুষ সদয় হবে এবং তা সুরক্ষার ক্ষেত্রে সতর্ক ও সচেতন হবে।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: পরিবেশিক-ভারসাম্য
আরও পড়ুন