পবিত্র লাইলাতুল বরাত
আজ দিবাগত রাত পবিত্র লাইলাতুল বরাত। পরম করুণাময় আল্লাহতায়ালা তার বান্দাদের গুনাহ মাফ, বিপদমুক্তি ও
দেশের স্বাস্থ্য খাতের অবস্থা বেশ নাজুক। রোগ প্রতিরোধের ক্ষেত্রেও তাই। ফলে ক্রমান্বয়ে ব্যাধিগ্রস্ত মানুষের সংখ্যা বাড়ছে। এর মধ্যে প্রাণঘাতী ব্যাধিও রয়েছে। স্বাস্থ্য খাতের এই দৈন্যদশার চিত্র করোনার প্রাথমিক পর্যায়ে প্রমাণিত হয়েছে। তখন বিনা চিকিৎসায় মারা গেছেন অনেক মানুষ। আর হয়রানির শিকার হয়েছেন অসংখ্যজন। মানুষের চিকিৎসা ব্যয়ও হয়েছে অত্যধিক। করোনাহীন রোগীরাও অবর্ণনীয় ভোগান্তির শিকার হয়েছেন। এসব মিডিয়ায় প্রচারিত হয়েছে। তবুও পরিস্থিতির উন্নতি তেমন হয়নি। এই অবস্থায় বিশ্বের বহু দেশের ন্যায় এ দেশেও করোনার দ্বিতীয় ঢেউ শুরু হয়েছে। আক্রান্ত ও মৃত্যু বাড়ছে। বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, ‘করোনার দ্বিতীয় ঢেউ হবে মারাত্মক।’ সরকারও তেমন হুঁশিয়ারি জানিয়েছে। এই সঙ্গে অবশ্য বলেছে, ‘করোনা পরিস্থিতি সামাল দেওয়ার প্রস্তুতি রয়েছে।’ গত ১৬ নভেম্বর বিবিসিতে প্রকাশ, ‘বাংলাদেশে করোনার সংক্রমণ ঠেকানোর ব্যবস্থা ভেঙ্গে পড়েছে।’ পত্রপত্রিকায় বলা হয়েছে, ‘শীতে করোনার সংক্রমণ ভয়াবহ আকার ধারণ করতে পারে বলে আশঙ্কা করছেন স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা। বিশেষত, স্বাস্থ্যবিধি যথাযথভাবে না মানলে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করা দুঃসাধ্য হয়ে ওঠতে পারে বলে তাদের শঙ্কা। এখনই সারাদেশে করোনা রোগীরা যথাযথ চিকিৎসা পাচ্ছেন না। হাসপাতালে আইসিইউ সিট পাওয়া যেন সোনার হরিণ। করোনা রোগীকে বাঁচাতে স্বজনরা হাসপাতাল থেকে হাসপাতালে আইসিইউ সিটের জন্য তদবির করছেন। না পেয়ে কান্নাকাটি করছেন। করোনা সংক্রমণ ব্যাপক আকারে ছড়িয়ে পড়লে দেশের পরিস্থিতি আরও অবনতি হতে পারে। মৃত্যু ও আক্রান্তের সংখ্যা লাগামহীনভাবে বৃদ্ধির আশঙ্কা করছেন তারা।’ এই অবস্থায় জনমনে পুনরায় আতংক দেখা দিয়েছে। ইউরোপ, আমেরিকা, ভারতসহ বহু দেশে করোনার দ্বিতীয় ঢেউ ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে! ফলে অনেক দেশে পুনরায় লকডাউন/কারফিউ শুরু হয়েছে।
দেশে প্রায় সব ব্যাধির চিকিৎসাই নাজুক! উপরন্তু চিকিৎসা সংশ্লিষ্ট অন্য সব খাতের অবস্থাও তথৈবচ। সাম্প্রতিক প্রকাশিত কিছু উদাহরণ হচ্ছে: ‘১৯৮২ সাল থেকে এ পর্যন্ত দেশে ১৫ হাজারের বেশি প্রতিষ্ঠান হাসপাতাল, ক্লিনিক, ডায়াগনস্টিক, ব্লাডব্যাংক পরিচালনা করে আসছে। কিন্তু বর্তমানে স্বাস্থ্য অধিদফতরের কাছে তালিকা আছে ১৩,৪২৬টির। বাকি দেড় হাজারের বেশি প্রতিষ্ঠানের কোনও হদিস নেই। অথচ প্রতিষ্ঠানগুলো কাজ চালিয়ে যাচ্ছে। অধিদফতর এখন এই সাড়ে ১৩ হাজার প্রতিষ্ঠান ধরেই হিসাব কষছে। চলতি বছর সেই তালিকা থেকে নিবন্ধন প্রক্রিয়া সম্পন্ন করেছে ৬,০১৬টি। নানা কারণে বাকি ৭,৪১০টির লাইসেন্স নবায়ন হয়নি। ফলে এসব প্রতিষ্ঠান নিবন্ধন ছাড়াই অবৈধভাবে চলছে। তাই এসব প্রতিষ্ঠানকে শৃঙ্খলায় আনতে গত ৮ নভেম্বর দেশের সব সিভিল সার্জনদের প্রতি নির্দেশ দেন স্বাস্থ্য অধিদফতরের মহাপরিচালক।’ ‘২০১৪ ও ২০১৫ সালের দিকে স্বাস্থ্য অধিদফতরের তৎকালীন পরিচালক প্রফেসর সামিউল ইসলাম সাদী লাইসেন্সবিহীন প্রতিষ্ঠানগুলোর বিরুদ্ধে সাঁড়াশি অভিযান চালান। কিন্তু একটি মহলের চাপে তাকে সরে যেতে হয় পদ থেকে। এরপর আর অবৈধ বেসরকারি ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টারগুলোর বিরুদ্ধে তেমন কোন কার্যক্রম গ্রহণ করা হয়নি।’ ‘রাজধানীতে গড়ে ওঠা শত শত মাদকাসক্তি নিরাময় কেন্দ্রের অধিকাংশেরই অনুমোদন নেই। নেই কোনও প্রশিক্ষিত চিকিৎসক। দেখভাল করারও নেই কেউ। চিকিৎসার নামে মাদক ব্যবসা প্রকাশ্যেই চলছে। স্থানীয় থানা পুলিশ ছাড়াও মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের কর্মকর্তাদের নিয়মিত বখরা দিয়েই চালানো হচ্ছে এসব। আদাবরে একজন সিনিয়র এএসপি আনিসুলকে চিকিৎসার নামে তার পরিবারের কাছ থেকে নিয়ে পিটিয়ে হত্যার পর ঊর্ধ্বতন পুলিশ কর্মকর্তারা নড়েচড়ে বসেছেন।’ ওষুধ প্রশাসন অধিদপ্তরের মহাপরিচালক গত ১৯ নভেম্বর বলেন, ‘চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়াই সাধারণ ভাইরাল অসুখে উচ্চমাত্রার অ্যান্টিবায়োটিক সেবনের কারণে ওষুধ কাজ করছে না। তাই প্রেসক্রিপশন ছাড়া অ্যান্টিবায়োটিক ওষুধ বিক্রি বন্ধ করতে হবে।’ ‘সাইকেল চালিয়ে কালাচাঁদপুরে কর্মস্থলের দিকে যাচ্ছিলেন নুরুল ইসলাম মাস্টার। গুলশানে পৌঁছলে পেছন থেকে আসা দ্রুতগামী একটি গাড়ি তাকে ধাক্কা দেয়। মারাত্মক আহত অবস্থায় তাকে উদ্ধার করে নেয়া হয় নিকটস্থ কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতালে। কিন্তু কভিড-১৯ টেস্ট রিপোর্ট ছাড়া তার চিকিৎসা দেয়া সম্ভব নয় বলে ফিরিয়ে দেয়া হয়। পরে আরো দুটি হাসপাতাল ঘুরে চিকিৎসা না পেয়ে মারা যান তিনি।’ ‘দেশে নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত হয়ে প্রতি ঘণ্টায় তিন জন শিশু মারা যায়। এর বেশিরভাগ চিকিৎসা পায় না।’ এর বাইরে আরও অনেক বেআইনি কর্ম রয়েছে, যা মিডিয়ায় প্রকাশিত হয়নি। এছাড়া, বেসরকারি হাসপাতাল, ডায়াগনস্টিক সেন্টার ও ক্লিনিকগুলোর বেশিরভাগেই জনবল, মেশিনপত্র ইত্যাদির অনেক সংকট রয়েছেই। সর্বোপরি এসবে ব্যয় অত্যধিক। জালিয়াতিরও অন্ত নেই। ভুল চিকিৎসায় রোগীর ক্ষতি হওয়ার ও মৃত্যুর সংখ্যা বহু।
দেশের প্রায় সব সরকারি হাসপাতালে জনবল, মেশিনপত্র ইত্যাদির সংকট রয়েছে। দুর্নীতি, অনিয়ম ইত্যাদিতেও ভরপুর। স্বাস্থ্য খাতে করোনাকালে কিছু দুর্নীতি সর্বকালের রেকর্ড ভঙ্গ করেছে। এ নিয়ে খবর প্রকাশের পর কয়েকটি চাঞ্চল্যকর মামলা হয়েছে, যা বিচারাধীন আছে। আর বাকীরা ধরা ছোঁয়ার বাইরেই রয়েছে!তাই স্বাস্থ্য সচিব গত ১৩ নভেম্বর বলেন, ‘স্বাস্থ্য খাতের দুর্নীতিবাজরা অনেক ক্ষমতাধর কিন্তু তাদের এ ক্ষমতা চিরস্থায়ী নয়। এসব দুর্নীতিবাজ রাজনৈতিক পরিচয় ব্যবহার করে নেতাদের সাথে ঘুরে ও ছবি তুলে নিজেদের স্বার্থ হাসিলে ব্যস্ত থেকে দেশের উন্নয়ন বাধাগ্রস্ত করছে।’ সম্প্রতি টিভির এক টক শো’তে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা বলেন, ‘বিশ্ব সংস্থার মতে, হাসপাতাল-ক্লিনিকে জনবলের রেশিও হচ্ছে: ১ জন ডাক্তারের বিপরীতে ৩ জন নার্স ও ৫ জন স্টাফ থাকতে হবে। কিন্তু বাংলাদেশে ১ জন ডাক্তারের বিপরীতে অর্ধজন নার্স ও ১ জন স্টাফ রয়েছে।’ আর গত ১৬ নভেম্বর সংসদে প্রশ্নোত্তরে স্বাস্থ্যমন্ত্রী বলেন, দেশে সরকারি হাসপাতালে এখন ১১,৩৬৪টি চিকিৎসকের পদ শূন্য আছে। উপরন্তু সরকারি হাসপাতালে যেটুকু জনবল আছে, তারও আউটপুট ভালো নয়। বেশিরভাগের মান ও আচরণ খারাপ। মেশিন পত্রেরও ঘাটতি অনেক। এছাড়া, অপ্রয়োজনীয় টেস্ট ও ওষুধের ছড়াছড়ি। এক্ষেত্রে অনেকের বেসরকারি হাসপাতাল-ক্লিনিক, টেস্ট কেন্দ্র ও ওষুধ কোম্পানির সাথে যোগসাজশের অভিযোগ রয়েছে। অফিস সময়ে সরকারি হাসপাতালের ডাক্তার ও নার্সের বেসরকারি হাসপাতাল ও নিজস্ব চেম্বারে কাজ করেন অনেকেই। উপরন্তু মেশিনপত্র অব্যবহারের সংখ্যাও কম নয়। গত ১৭ নভেম্বর এক দৈনিকে প্রকাশ, ‘খুলনা অঞ্চলের ক্যান্সার রোগীদের চিকিৎসার লক্ষ্যে ক্রয় করা রেডিওথেরাপি মেশিন খুলনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ক্যান্সার বিভাগের সামনে পড়ে আছে। এটি স্থাপন এবং চিকিৎসা শুরু করতে না পারায় ৮ বছর ধরে ১৫ কোটি টাকা মূল্যের মেশিনটি বাস্কবন্দি অবস্থায় রয়েছে।’ এরূপ অবস্থা শুধু উক্ত হাসপাতালেই নয়, খোঁজ নিলে দেখা যাবে বেশিরভাগ সরকারি হাসপাতাল ও মেডিকেল কলেজে বহু নামী দামী মেশিন অব্যবহৃত হয়ে পড়ে রয়েছে!
দেশে চিকিৎসা ব্যবস্থার মান খুব কম। ব্যয় অত্যধিক, যার বেশিরভাগই ব্যয় করতে হয় চিকিৎসায় প্রার্থীর। ফলে চিকিৎসা ব্যয় মিটাতে গিয়ে অনেক মানুষ দরিদ্র হয়ে পড়ছেন। তাই বাধ্য হয়ে অধিকাংশ মানুষ চিকিৎসার বাইরে থাকছেন। অনেকেই কবিরাজি ও হাতুড়ে ডাক্তারের কাছে চিকিৎসা করান। তাতে অষুখ ভালো হয় না। এভাবে বেশিরভাগ মানুষ বিনা চিকিৎসায় থেকে যাচ্ছেন। আবার অনেকেই অকালেই মৃত্যুবরণ করছেন। যাদের সামর্থ আছে তারা বিদেশে চিকিৎসা করাচ্ছেন।
এই অবস্থায় দেশে নিত্য নতুন ব্যাধি সৃষ্টি হচ্ছে এবং তাতে বিপুল সংখ্যক মানুষ আক্রান্ত হচ্ছেন। এছাড়া, পুরাতন ব্যাধিতে আক্রান্তের সংখ্যাও বাড়ছে। এদের মধ্যে অনেকগুলো প্রাণঘাতী ও খুবই ব্যয়বহুল ব্যাধি। যেমন: ক্যান্সার, হৃদরোগ, ডায়াবেটিস, মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যা, নিউমোনিয়া, হাই প্রেশার, ডেঙ্গু ইত্যাদি।
দেশের স্বাস্থ্য শিক্ষার অবস্থাও খুব নাজুক। গত ৮ নভেম্বর স্বাস্থ্য ব্যবস্থা উন্নয়ন ফোরামের ওয়েবিনারে বিশিষ্ট চিকিৎসক ও স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলেন, ‘দেশের স্বাস্থ্য শিক্ষাকে ঢেলে সাজাতে না পারলে এই জনগুরুত্বপূর্ণ খাতের আশু বিপর্যয় অবশ্যম্ভাবী।’ বক্তাদের বক্তব্যের সারাংশ হচ্ছে: ডা. শারমিন বলেন, ‘কম্পিটেন্সি বেইজড কারিকুলামের কথা বলা হলেও তার যথাযথ বাস্তবায়ন হচ্ছে কিনা তা নিয়ে প্রশ্ন আছে। দেশে চিকিৎসকদের মধ্যে যে অনেকক্ষেত্রেই যোগ্যতা এবং দক্ষতার ঘাটতি রয়েছে তা করোনা মহামারির সময়ে উন্মোচিত হয়েছে।’ ডা. খসরু বলেন, ‘খাতা-কলমেই শুধু কম্পিটেন্সি বেইজড কারিকুলামের কথা বলা হয়। একসময় বেসরকারি মেডিকেল কলেজগুলোর বিরুদ্ধে নানা অভিযোগ থাকলেও এখন সরকারি মেডিকেল কলেজগুলোতে মানসম্পন্ন শিক্ষা, শিক্ষক, শিক্ষা উপকরণ দেখা যাচ্ছে না। সরকারি মেডিকেলে রোগীদের বেশ প্রবাহ থাকলেও সেখানে মানসম্পন্ন শিক্ষক পদায়ন করা যায়নি। কম্পিটেন্সি বেইজড করতে হলে শিক্ষক-শিক্ষার্থীর অনুপাত অনেক কমাতে হবে। অন্যদিকে বেসরকারিগুলোতে শিক্ষক এবং রোগীর স্বল্পতা রয়েছে। অথচ কম্পিটেন্সি বেইজড এডুকেশনের মূল শর্তই হলো শিক্ষার্থীকে রোগীকে সম্মুখীন হতে হবে। অল্প সময়ে অনেক মেডিকেল কলেজ গড়ে ওঠায় হয়তো ঠিকভাবে এসবকিছু নিয়ন্ত্রণ করা যায়নি। ভারতে প্রতি ২৪ লক্ষ ও পাকিস্তানে প্রতি ১৮ লক্ষ মানুষের জন্য একটি মেডিকেল কলেজ আছে। আর বাংলাদেশে প্রতি ১৪ লক্ষ মানুষের জন্য একটি মেডিকেল কলেজ রয়েছে। মেডিকেল কলেজের আসনের ক্ষেত্রেও তাই। কিন্তু দেশে নামকাওয়াস্তে মেডিকেল কলেজের সংখ্যা বাড়ানো হলেও মানসম্পন্ন লোকবল তৈরি করা হয়নি। শিক্ষা হয়ে গেছে অনেকক্ষেত্রেই বইনির্ভর, মুখস্ত করে পরীক্ষা দিয়ে পাশ করা। যার ফলে বর্তমান বিশ্বের সাথে আমরা তাল মিলাতে পারছি না। ফলে বাংলাদেশ থেকে এমবিবিএস পাশ করা ৭৩% চিকিৎসক ভারতে গিয়ে লাইসেন্সিং পরীক্ষায় অকৃতকার্য হচ্ছেন। তাই বাংলাদেশে মেডিকেল শিক্ষার্থীদের লাইসেন্স দেয়ার আগে বিএমডিসির পরীক্ষা নেয়া উচিত, যেন তাদের মান নিশ্চিত হয়।’ অধ্যাপক ডা. বেনজীর বলেন, ‘নেপালি যেসব শিক্ষার্থী বাংলাদেশের মেডিকেল কলেজে পড়াশোনা করে দেশে যাচ্ছে, তারাও সেখানে গ্রহণযোগ্যতা পাচ্ছে না। কেবল ভালো চিকিৎসক কিংবা উন্নত চিকিৎসা ব্যবস্থা হলেই জনস্বাস্থ্য ভালো হয় না, সেজন্য প্রয়োজন মানবিক এবং সার্বজনীন চিকিৎসাসেবা। গত ২০-২৫ বছরে দেশে চিকিৎসা ব্যয় বাড়তে বাড়তে শুধু দরিদ্র নয় মধ্যবিত্তেরও নাগালের বাইরে চলে গেছে। অনেকক্ষেত্রেই শুধু ব্যবসায়িক স্বার্থে চিকিৎসকরা রোগীকে অত্যাধুনিক পরীক্ষা দিলেও রিপোর্ট ঠিকমতো দেখেন না। দেশে এমন কোন প্যারামেডিকেল ইন্সটিটিউট পাওয়া যাবে না যার অধ্যক্ষ পেশাদার কেউ। সেসব জায়গায় হয় প্রশাসনের লোক নয়তো মেডিকেল এডুকেশনের সাথে সম্পৃক্ত নন এমন লোকদের নিয়োগ দেয়া হয়। মেডিকেল টেকনোলজিতে যারা ডিপ্লোমা করেন তাদের অবস্থা খুব খারাপ। সবমিলিয়ে সেবা দেয়ার জন্য যে টিম অর্থাৎ চিকিৎসক, নার্স, টেস্ট ইত্যাদি সব ক্ষেত্রে দুর্বলতা রয়েছে। এভাবে মানসম্পন্ন চিকিৎসা সেবা প্রদান সম্ভব নয়।’
চিকিৎসায় ব্যাধি নিরাময়ের চেয়ে প্রতিরোধ বেশি গুরুত্বপূর্ণ। তথাপিও দেশে ব্যাধি সৃষ্টিতে বিশ্বসেরা, যার অন্যতম হচ্ছে দূষণ। বিশ্বে যত রকমের দূষণ রয়েছে, তার সবগুলোই রয়েছে এ দেশে এবং তা বিশ্বের মধ্যে সর্বাধিক। বায়ু দূষণ, শব্দ দূষণ, বর্জ্য দূষণ, পানি দূষণ, পরিবেশ দূষণ ইত্যাদি। অন্যদিকে, দেশে যে পরিমাণ বনাঞ্চল থাকা দরকার তার অর্ধেকও আছে বলে মনে হয় না। এছাড়া পচা, বাসী ও অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে তৈরি খাবার স্বাস্থ্যের জন্য চরম ক্ষতিকর। বেশিরভাগ হোটেলে এসব চলছে। পথে-ঘাটের সব দোকানেই খোলা খাবার বিক্রি হচ্ছে। তাতে মশা, মাছি ও ধূলা-ময়লা পড়ে। এছাড়া, সারাদেশ বিভিন্ন ধরনের মাদকে সয়লাব। মাদকের বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স নীতি গ্রহণ করার পরও মাদকের ব্যবহার তেমন কমেনি। মাদকাসক্তের সংখ্যা ক্রমান্বয়ে বাড়ছে। এতে বছরে প্রায় ৬০ হাজার কোটি টাকা নষ্ট হচ্ছে। উপরন্তু দেশে নানা ধরনের দুর্ঘটনায়, বিশেষ করে সড়ক দুর্ঘটনায় মৃত্যু ও আহতের হার বিশ্বে সর্বাধিক।তামাকজাত পণ্য থেকে নানা জটিল ব্যাধি সৃষ্টি হয়। তবুও এর ব্যবহার ক্রমান্বয়ে বাড়ছে। দেশের এখনো শহরের অনেক মানুষ নিরাপদ স্যানিটেশনের বাইরে। বস্তিগুলোতে তা আরও কম। ফলে নানা ব্যাধি সৃষ্টি হচ্ছে। অসংখ্য মানুষ অপুষ্টির শিকার হয়ে নানা ব্যাধিতে আক্রান্ত হচ্ছেন।
এই অবস্থায় দেশের স্বাস্থ্য খাতের ব্যাপক পরিবর্তন জরুরি, যার অন্যতম হচ্ছে চিকিৎসাকেন্দ্র, ওষুধ কারখানা, ফার্মেসি, চিকিৎসা শিক্ষা তথা চিকিৎসা খাতের সব দুর্নীতি, অনিয়ম ও অব্যবস্থাপনা দূর করতে হবে। প্রয়োজনীয় জনবল নিয়োগ ও মেশিন সরবরাহ করতে হবে। মানসম্মতভাবে ব্যাধিভিত্তিক প্রয়োজনীয় চিকিৎসক ও বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক এবং নার্স, টেকনোলজিস্ট তৈরি করার ব্যবস্থা করতে হবে। মানহীন চিকিৎসক ও চিকিৎসাকর্মী দিয়ে মানসম্মত চিকিৎসা সম্ভব নয়। সর্বোপরি সব হাসপাতালে প্রচলিত সব ব্যাধির চিকিৎসা ও টেস্ট করার ব্যবস্থা করা দরকার। তাহলে মানুষের ব্যয় ও হয়রানি অনেক হ্রাস পাবে। চিকিৎসা ব্যয় কমানোর জন্য চিকিৎসা ব্যবস্থায় আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহার করতে হবে। এটা যত বৃদ্ধি পাবে, ব্যয় তত কমবে ও চিকিৎসার মান বৃদ্ধি পাবে। অপ্রয়োজনীয় টেস্ট ও ওষুধ প্রদান এবং নকল, মেয়াদ উত্তীর্ণ ওষুধ ও অ্যান্টিবায়োটিকের যথেচ্ছ ব্যবহার বন্ধ করতে হবে। দেশীয় ওষুধের মূল্য কমাতে হবে। এসব কাজ শুধুমাত্র কথায় বা আদেশে হবে না। এ জন্য প্রয়োজন স্বাস্থ্য খাতের সবটিতেই নিয়মিত তদারকির ব্যবস্থা করা এবং তদারকিতে প্রমাণিত দোষী ব্যক্তিদের কঠোর শাস্তি প্রদান করতে হবে।
গত ১৭ নভেম্বর স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের টাস্কফোর্সের সভায় ৪টি বিষয়ে সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়েছে।সেগুলো হচ্ছে: ‘১. অফিস সময়ে সরকারি হাসপাতালের কোন চিকিৎসক বেসরকারি স্বাস্থ্য প্রতিষ্ঠানে কর্মরত থাকতে পারবে না। কোন কারণে কর্মরত অবস্থায় থাকলে টাস্কফোর্স ও সংশ্লিষ্টদের অবগত করতে হবে। ২. হাসপাতাল/ ডায়াগনস্টিক সেন্টার/ ল্যাব/ ক্লিনিকগুলিতে লাইসেন্স নিবন্ধন নম্বর স্পস্টভাবে উল্লেখ থাকতে হবে। ৩. টাস্কফোর্স কর্তৃক সরকারি হাসপাতালের পাশাপাশি বেসরকারি হাসপাতাল ও ক্লিনিক পরিদর্শন/ অবৈধ কার্যক্রমের বিরুদ্ধে অভিযান পরিচালনা। ৪. ১৬ নভেম্বরের পর অনিবন্ধিত প্রতিষ্ঠানগুলোর লাইসেন্স গ্রহণ না করা। সভায় আরও সিদ্ধান্ত হয় যে, বেসরকারি হাসপাতাল, ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টারকে তিন স্তরে ভাগ করে বিভিন্ন স্বাস্থ্য পরীক্ষা ও সেবার ফি নির্ধারণ করে দেবে সরকার। শিগগির এ সংক্রান্ত নীতিমালা জারি করা হবে।আর এসব নির্দেশনা যথাযথভাবে অনুসরণ হচ্ছে কি না, তা দেখাভালে গঠিত হবে ৩ সদস্যের পাঁচটি পরিদর্শন দল।’ টাক্সফোর্সের এ সিদ্ধান্ত কল্যাণকর। কিন্তু আমরা শুরু করি ঢাকঢোল পিটিয়ে কিন্তু তা শেষ করিনা। এটাই আমাদের ঐতিহ্য। চিকিৎসা খাতে যেন তা না হয় সেদিকে সতর্ক থাকা দরকার। এরূপ কঠোর ব্যবস্থা ওষুধ কারখানা ও ফার্মেসিতেও করতে হবে। একই সঙ্গে মেডিকেল শিক্ষা ও সরকারি হাসপাতালের অব্যবস্থাপনা দূর করতে হবে।
লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।