পবিত্র লাইলাতুল বরাত
আজ দিবাগত রাত পবিত্র লাইলাতুল বরাত। পরম করুণাময় আল্লাহতায়ালা তার বান্দাদের গুনাহ মাফ, বিপদমুক্তি ও
এতদিন ধরে আমরা জেনে এসেছি যে, বিশাল ভারতে আঞ্চলিকতা ও প্রাদেশিকতা নাই। ৩১টি রাজ্য বা প্রদেশ এবং কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল নিয়ে গঠিত ভারত। ভারতের ভৌগোলিক বিশালতা ভালোভাবে বোঝাবার জন্যই ভারতীয় লেখকরা বর্ণনা করেন, আসমুদ্র হিমাচল পর্যন্ত বিস্তৃত ভারত। এত বড় ভারতের ঐক্য ও সংস্কৃতি ধরে রাখা হয়েছে কীভাবে? অধিকাংশ ভারতীয় তো বটেই, বাংলাদেশের পলিটিশিয়ানদের একটি অংশ ভারতীয়দের সাথে সুর মিলিয়ে বলেন, বৈচিত্রের মাঝেই নিহিত রয়েছে ভারতের ঐক্য। সংক্ষেপে বলেন, unity in diversity. কিন্তু বিজেপি দুই মেয়াদে ক্ষমতায় এসে প্রমাণ করেছে যে, ধর্ম, অর্থাৎ হিন্দু ধর্মই ভারতকে ঐক্যবদ্ধ রেখেছে এবং ভবিষ্যতেও রাখবে। ‘ভগবান রামকে’ বিজেপি রাজনীতিতে নিয়ে এসেছে। বাবরি মসজিদ গুড়িয়ে দেয়া, সেখানে রামমন্দির ছিল বলে উচ্চ আদালতকে প্রভাবিত করে রায় আনা এবং এই তো কিছুদিন আগে রূপার ইট দিয়ে সেই মন্দিরের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন উপলক্ষে প্রদত্ত বক্তৃতায় প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি, উত্তরপ্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী যোগী আদিত্যনাথ এবং রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘের প্রধান মোহন ভগত উচ্চকণ্ঠে হিন্দুত্বের জয়গান গেয়েছেন।
কিন্তু সেই ভারতে যে, বাঙালি ও অবাঙালির প্রশ্ন উঠবে, অবাঙালিরা বাঙালিদের কোণঠাসা করছে, সে কথা এই বাংলাদেশে বসে অতীতে আমরা তেমন একটা শুনতে পাইনি। এবার পাচ্ছি এবং খুব জোরেসোরেই শুনতে পাচ্ছি। গত ২০ নভেম্বর শুক্রবার কলকাতার শতবর্ষের প্রাচীন পত্রিকা ‘আনন্দবাজারে’ এ সম্পর্কে একটি চাঞ্চল্যকর সংবাদ প্রকাশিত হয়েছে। প্রথম পৃষ্ঠায় প্রকাশিত সংবাদটির শিরোনাম, ‘নেতাজির মতোই কোণঠাসা করার চেষ্টা বাঙালি মমতাকে: ব্রাত্য’। ব্রাত্য বসু পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য সরকারের মন্ত্রী।
খবরে বলা হয়েছে, ‘বাঙালিকে শাসন করার জন্য উত্তর ও পশ্চিম ভারত থেকে অবাঙালিদের বাংলায় পাঠানো হচ্ছে’। তিনি এই মর্মে গুরুতর অভিযোগ করেন যে, নেতাজি সুভাষ চন্দ্র বসুকে যেভাবে কোণঠাসা করা হয়েছিল সেভাবেই এখন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে কোণঠাসা করার চেষ্টা হচ্ছে। ব্রাত্য বসু তাঁর আক্রমণের টার্গেট করেছেন পশ্চিমবঙ্গের ৫ জন বিজেপি নেতাকে। এরা রাজ্য বিধানসভার নির্বাচন পরিচালনার দায়িত্ব প্রাপ্ত ৫ নেতা। কিন্তু এরা সবাই অবাঙালি।
ব্রাত্য বসু বলেন, ‘বহিরাগত কর্তৃক বাংলাকে আক্রমণ করা হচ্ছে। বাংলাকে না বোঝা, বাংলার সংস্কৃতিকে না বোঝা, বাংলার নাড়ী বা বোঝা কিছু লোক বাংলায় ঘোরাঘুরি করছেন। এই বহিরাগত তান্ডব বিদ্যাসাগরের মূর্তি ভাঙ্গারই একটা পরের ধাপ।’ তিনি আরো বলেন, ‘আরএসএস এর প্রধান পদে তো কোনদিন কোন বাঙালিকে বসানো হয়নি। হয় তেলুগু ব্রাহ্মণ বা মারাঠি ব্রাহ্মণকে বসানো হয়েছে ঐ পদে। ব্রাত্যের মতে, বাঙালিরা বিশ্বের যে কোন প্রান্তের মানুষকে চিরকালই স্বাগত জানায়। কিন্তু এখন যা হচ্ছে সেটি বাঙালিকে নিয়ন্ত্রণ করা এবং কোণঠাসা করার চেষ্টা।’
সেই প্রসঙ্গেই নেতাজি সুভাষ চন্দ্রের উদাহরণ দিয়ে মন্ত্রী বলেন, যেভাবে অবাঙালিদের দিয়ে সুভাষ বসুকে কোণঠাসা করা হয়েছিল, সেই একইভাবে উত্তর ও পশ্চিম ভারত থেকে লোক পাঠানো হচ্ছে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে নিয়ন্ত্রণ করতে। বাংলার মানুষ কি এটা মেনে নেবেন? নেতাজিকে যেভাবে কংগ্রেস ছাড়তে হয়েছিল, নেতাজির অন্তর্ধানের পাঁচ দশক পর মমতাকেও সেভাবে কংগ্রেস ছাড়তে বাধ্য করা হয়েছিল বলে অভিযোগ করেন ব্রাত্য বসু। তার মতে, এদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর জন্যই মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় সুভাষ বসুর মতো নিজস্ব আজাদ হিন্দ বাহিনী গঠন করেছিলেন, যার নাম তৃণমূল কংগ্রেস।
আনন্দবাজারের ভাষায়, অনেকটা আক্রমণাত্মক ভঙ্গিতেই ব্রাত্য বলেন, ‘আমাদের মাথার ওপর অন্য রাজ্যের নেতারা এসে বসবেন, শাসন করবেন আর বলবেন, রবীন্দ্রনাথের জন্ম বোলপুরে। এগুলো মেনে নেওয়া হবে না।’ তিনি প্রশ্ন করেন, ‘বিজেপি ৭ বছর ধরে কেন্দ্রে সরকার চালাচ্ছে। অথচ সেখানে একজনও বাঙালি পূর্ণমন্ত্রী নেই কেন?’
দুই
ভারতের বাঙালিদের ওপর উত্তর ও পশ্চিম ভারতের অবাঙালিদের শাসন ও আধিপত্য নিয়ে এই ধারে, অর্থাৎ বাংলাদেশিদের মনে অনেক প্রশ্নই ঘোরাফেরা করে। লাখ লাখ বাংলাদেশি ভারতে, বিশেষ করে পশ্চিমবঙ্গে যান প্রধানত চিকিৎসার জন্য। ব্যবসা-বাণিজ্য, কেনাকাটা এবং পর্যটনের জন্যও অনেকেই যান। অথচ অবাক হতে হয় যখন দেখা যায় যে, কলকাতা বিমানবন্দরে বা বিপণিবিতানে অধিকাংশই হিন্দিতে কথা বলেন। আমি যে কয়বার ইন্ডিয়া গেছি, দেখেছি, নেতাজী সুভাষ বসু বিমানবন্দরে (কলকাতা বিমান বন্দরে) বাঙালি অফিসার ও কর্মচারীরা আমার সাথে হিন্দিতে কথা বলছেন। আমি যখন বলি, আমি বাংলাদেশের বাঙালি আর আপনি পশ্চিমবঙ্গের বাঙালি। তো আমার সাথে হিন্দিতে কথা বলছেন কেন? ওদের উত্তর, বোঝেন তো দাদা, অভ্যাস হয়ে গেছে। হায়দ্রাবাদের রাজীব গান্ধী আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরেও বাঙালিদের একই অবস্থা। সেখানকার শপিং মলগুলোতেও একই পরিস্থিতির সম্মুখীন হয়েছি।
১৯৪৭ সালে ভারত স্বাধীন হওয়ার পর ভারতে ক্ষমতায় গিয়েছেন ১৭ জন প্রধানমন্ত্রী। অথচ এই ৭৩ বছরে একজন বাঙালিও প্রধানমন্ত্রী হতে পারেননি। এই ৭৩ বছরে সেনাপ্রধান হয়েছেন ৩০ জন। এর মধ্যে একজন মাত্র ছিলেন বাঙালি। নাম জেনারেল জয়ন্ত নাথ চৌধুরী। ভারতের শিল্প, ব্যবসা-বাণিজ্যের দিকে তাকান, দেখবেন, বাঙালিরা কত পেছনে পড়ে আছে। সারা ভারত তো দূরের কথা, খোদ পশ্চিমবঙ্গেরও ব্যবসা-বাণিজ্য তথা অর্থনীতি দখল করে আছে অবাঙালিরা। ওরা বলে আপকান্ট্রির মানুষ। অর্থাৎ ভারতের উত্তর অঞ্চলের মানুষ।
এগুলো ভারতের অভ্যন্তরীণ বিষয়। ভারতীয় বাঙালিরা, অর্থাৎ পশ্চিমবঙ্গের বাঙালিরা যে সর্বক্ষেত্রে বিরাট বঞ্চনার শিকার হচ্ছেন, সে সম্পর্কে তথ্যের অভাব নাই। কিন্তু সেটি তাদের অভ্যন্তরীণ ব্যাপার বলে আমরা এ বিষয়ে আর আলোচনায় যাচ্ছি না। তবে তৃণমূলের মুখপাত্র ব্রাত্য বসু একটি গুরুত্বপূর্ণ ইস্যু তুলেছেন। বলেছেন, ‘অবাঙালিদেরকে দিয়ে সুভাষ বসুকে কোণঠাসা করা হয়েছে এবং সেভাবে মমতা ব্যানার্জিকেও কোণঠাসা করা হচ্ছে।’ এ সম্পর্কে উইকিপিডিয়ার তথ্য নিম্নরূপ:
১৯৩৮ সালে গান্ধীর বিরোধিতার মুখে সুভাষ বোস ভারতীয় কংগ্রেসের সভাপতি নির্বাচিত হন। ১৯৩৯ সালে তিনি দ্বিতীয়বার ত্রিপুরা অধিবেশনে কংগ্রেসের সভাপতি নির্বাচিত হন। এই নির্বাচনে গান্ধী পট্টভি সীতারামকে সমর্থন দেন। নির্বাচনের ফলাফল শোনার পর গান্ধী বলেন, ‘পট্টভির হার আমার হার’। নির্বাচনে জয়ী হলেও সুভাষ সুষ্ঠুভাবে দলীয় কাজ করতে পারছিলেন না। তাকে পদে পদে বাধা দেয়া হয়। উইকিপিডিয়ায় স্পষ্ট ভাষায় বলা হয়েছে গান্ধীর অনুগামীরা তার কাজে বাধা সৃষ্টি করেছিলেন। গান্ধী ও নেহেরুর দক্ষিণ হস্ত গোবিন্দ বল্লভ পন্থ এই সময় একটি প্রস্তাব পেশ করেন। প্রস্তাবে বলা হয় যে, কার্যনির্বাহী পরিষদকে পুনর্গঠন করতে হবে। আর সুভাষ বোস জয়লাভ করলেও যেহেতু গান্ধী তার বিরোধিতা করেছেন তাই সুভাষকে সভাপতির পদ থেকে পদত্যাগ করতে হবে। না করলে কার্যনির্বাহী পরিষদের সকল সদস্য পদত্যাগ করবেন। এই হুমকির কারণে সুভাষ বোস কংগ্রেস থেকে পদত্যাগ করতে বাধ্য হন। অপর একটি গবেষণা থেকে দেখা যায় যে, সুভাষ বোস প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হলেও কার্যনির্বাহী কমিটি গঠন করতে পারেননি। সুভাষের নির্বাচনের প্রতিবাদে কংগ্রেস ওয়ার্কিং কমিটির ১৩ জন সদস্য পদত্যাগ করেন। তখন সুভাষ চন্দ্র পদত্যাগ করতে বাধ্য হন। তার স্থলে সভাপতি নির্বাচিত হন ড. রাজেন্দ্র প্রসাদ। সুভাষ বোস কংগ্রেস ছাড়েন এবং মাত্র কয়েকদিন পর ১৯৩৯ সালের ২২ জুন ফরওয়ার্ড ব্লক নামে একটি নতুন রাজনৈতিক দল গঠন করেন।
নেতাজি সুভাষ বসুকে যেরূপ অসহযোগিতা ও হুমকির মুখে পদত্যাগ করতে হয় মমতা ব্যানার্জিও কংগ্রেসে তার সঠিক মূল্যায়ন না হওয়ায় ২৬ বছর ধরে কংগ্রেস দল করলেও ২৬ বছর পর ১৯৯৮ সালের ১ জানুয়ারি তৃণমূল কংগ্রেস গঠন করেন।
তিন
একজন মহিলা হয়েও মমতা ব্যানার্জি অসাধারণ সাংগঠনিক শক্তির পরিচয় দিয়েছেন। ২০১১ সালে তার দল সারা ভারতে কমিউনিস্টদের দুর্গ বলে কথিত পশ্চিমবঙ্গে এক নাগাড়ে ৩২ বছরের কমিউনিস্ট শাসনের অবসান ঘটায় এবং তিনি পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী হন। ২০১৬ সালের নির্বাচনে পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভার ২৯৪টি আসনের মধ্যে ২১১টি আসনে জয়লাভ করে মমতা ব্যানার্জি নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করেন।
এবার বিজেপি লেগেছে মমতা ব্যানার্জি তথা তৃণমূল কংগ্রেসের পেছনে। মমতার বিপুল জনসমর্থনের পেছনে হিন্দুত্ববাদী বিজেপি এক নতুন ষড়যন্ত্র আবিষ্কার করেছে। আর সেটা হল, বাংলাদেশ থেকে নাকি দলে দলে মানুষ পশ্চিমবঙ্গে প্রবেশ করেছে এবং ভোট দিয়ে মমতা ব্যানার্জিকে ক্ষমতায় এনেছে। এই অভিযোগ করেন স্বয়ং বিজেপির সাবেক সভাপতি, প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির দক্ষিণ হস্ত স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ। এই নভেম্বরের প্রথম সপ্তাহে পশ্চিমবঙ্গে এসে অমিত শাহ হুংকার দিয়েছেন, ভুয়া ভোটার নিয়ন্ত্রণে প্রয়োজনে বাংলাদেশ সীমান্ত সিল করে দেওয়া হবে।
অমিত শাহ’র বক্তব্যের উপযুক্ত জবাব দিয়েছেন বাংলাদেশের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল। তিনি দাবি করেছেন যে, ’৭১-এর মুক্তিযুদ্ধের পর ভারতে আর কোন বাংলাদেশি প্রবেশ করেনি। তিনি বলেন, বাংলাদেশের আর্থিক অবস্থা ভালো। বাংলাদেশিরা কেন ভারতে যাবে? বাংলাদেশের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর এই বক্তব্যের পর ভারতের আর কোনো মন্তব্য পাওয়া যায়নি।
[email protected]
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।