পবিত্র লাইলাতুল বরাত
আজ দিবাগত রাত পবিত্র লাইলাতুল বরাত। পরম করুণাময় আল্লাহতায়ালা তার বান্দাদের গুনাহ মাফ, বিপদমুক্তি ও
বাংলাদেশে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির বিষয়টি প্রশ্নাতীত। শতকরা ৯২ ভাগ মুসলমানের দেশে হিন্দু, খ্রিস্টান, বৌদ্ধসহ অন্যান্য ধর্মাবলম্বী যেভাবে পারস্পরিক সহবস্থান ও সম্মিলনের মাধ্যমে বসবাস করে, তা বিশ্বের খুব কম দেশেই দেখা যায়। হাজার বছর ধরে বাংলাদেশের মুসলমানদের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য এই, কে কোন ধর্মের তা তারা বিচার-বিবেচনা করে না। হোক সে হিন্দু, বৌদ্ধ কিংবা খ্রিস্টান। একই সঙ্গে চলা, একই সঙ্গে খাওয়া এবং পারস্পরিক সদাচার ও সদ্ভাবের সঙ্গে তারা এক অপূর্ব সহবস্থানের মধ্যে বসবাস করছে। স্বাধীনতার পর থেকে আজ পর্যন্ত সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা সৃষ্টি হয়েছে, এমন কোনো নজির নেই। মুসলমান সংখ্যাগরিষ্ঠ এই দেশে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির এমন অনন্য পরিবেশের জন্য বিশ্বের ক্ষমতাধর দেশসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থা বিভিন্ন সময়ে ভূয়সী প্রশংসা করেছে। তারা বাংলাদেশকে একটি ‘মডারেট মুসলিম কান্ট্রি’ এবং সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির ‘রোল মডেল’ হিসেবে অভিহিত করেছে। কয়েক বছর আগে বাংলাদেশের সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতিতে মুগ্ধ হয়ে ইউরোপীয় ইউনিয়নের ডেলিগেশন প্রধান উইলিয়াম হানা বলেছিলেন, ‘বাংলাদেশের মতো সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত পৃথিবীতে বিরল। ঐতিহাসিকভাবে বাংলাদেশ সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির উন্নত মডেল। এদেশে সব বিশ্বাস ও ধর্মের মানুষ শান্তি ও সম্প্রীতি বজায় রেখে পাশাপাশি বসবাস এবং নিজ নিজ ধর্ম পালনে পূর্ণ স্বাধীনতা ভোগ করে।’ অস্ট্রেলিয়ার হাইকমিশনার মি. এইচ. ই. গ্রে উইলকুক বলেছিলেন, ‘বাংলাদেশ সম্প্রদায়িক সম্প্রীতির দেশ। পূজা ও ঈদ একই সময়ে পালনে এক ধর্মের মানুষ অন্য ধর্মের মানুষকে যেভাবে সহযোগিতা করে, তা দেখে আমি মুগ্ধ।’ বিদেশি ডেলিগেট, রাষ্ট্রদূত থেকে শুরু করে সরকার প্রধানদের যারাই সফর করেছেন, তারা একবাক্যে বাংলাদেশের সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির প্রশংসা করেছেন। তারা দেখেছেন, এখানে সকল ধর্মের মানুষ পূর্ণ স্বাধীনতা এবং সম্প্রীতির মধ্যে বসবাস করে। বিশেষ করে সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমারা অন্য ধর্মের মানুষকে কখনো তুচ্ছ বা অচ্ছুৎ ভাবে না। এই যে গত মাসের শেষের দিকে হিন্দুদের অন্যতম প্রধান ধর্মীয় উৎসব দূর্গা পুজা এবং গত শনিবার দীপাবলী বা কালী পুজা হয়ে গেল, তাতে হিন্দু ও মুসলমানরা একে অপরকে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম থেকে শুরু করে সরাসরি শুভেচ্ছা জানিয়েছে। হিন্দুদের এই উৎসব পালনে কোথাও কোনো বাধা-বিঘ্নের সৃষ্টি হয়নি। তারা আনন্দ-উৎসবের মাধ্যমে তা পালন করেছে।
দুই.
মাঝে মাঝে কিছু দুষ্টলোক হিন্দুদের বাড়ি-ঘর ভাংচুর করলেও হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রিস্টানদের সংগঠন তা নিয়ে ব্যাপক সোরগোল এবং গেল গেল বলে চিৎকার চেঁচামেচি শুরু করে। তাদের সঙ্গে তারস্বরে চিৎকার করে পার্শ্ববর্তী দেশের কিছু হিন্দু সংগঠন। তারা এ নিয়ে ব্যাপক প্রতিক্রিয়া দেখায়। গত মাসে কুমিল্লার মুরাদ নগরে দুর্বৃত্তরা হিন্দুদের কিছু বাড়ি-ঘর ভাংচুর ও জ্বালিয়ে দেয়। প্রশাসন এ ব্যাপারে কার্যকর পদক্ষেপ নিয়েছে। বাংলাদেশে কদাচ এ ধরনের ঘটনা ঘটে। তবে সরকারের তরফ থেকে যথাযথ পদক্ষেপ নেয়ায় তার সুরাহাও হয়ে যায়। এসব ঘটনা মানুষের কাছে বিচ্ছিন্ন ঘটনা হিসেবেই বিবেচিত হয়। বলার অপেক্ষা রাখে না, সংখ্যালঘুদের বাড়ি-ঘর ভাংচুর কিংবা জমি-জমা দখল করার ঘটনা কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়। তবে দুয়েকটি বিচ্ছিন্ন ঘটনা নিয়ে হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রিস্টান ঐক্যপরিষদ যেভাবে বক্তব্য-বিবৃতি দিতে থাকে এবং তিলকে তালে পরিণত করার চেষ্ট করে, তাতে প্রতীয়মান হয়, দেশে যেন হিন্দুদের নির্যাতন করে শেষ করে দেয়া হচ্ছে। পার্শ্ববর্তী দেশের হিন্দুরাও মনে করে, বাংলাদেশে হিন্দুদের উপর চরম নির্যাতন হচ্ছে। দুঃখের বিষয়, ভারত ও মিয়ানমারে যখন সরকারি মদদে মুসলমানদের হত্যা, নির্যাতন এবং বিতাড়নের ঘটনা ঘটানো হয়, তখন বাংলাদেশের হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদ চুপ মেরে থাকে। টুঁ শব্দটি পর্যন্ত করে না। প্রতিবাদে মানববন্ধন করা দূরে থাক, কখনো একটি বিবৃতিও দিতে দেখা যায় না। ভারতে মুসলমানরা কী দুর্দশায় আছে এবং উগ্র হিন্দু সংগঠন ও ব্যক্তি দ্বারা কীভাবে হত্যা ও নির্যাতনের শিকার হচ্ছে, তা বিশ্ববাসীর অজানা নয়। আমরা যদি অতীতের ঘটনার দিকে দৃষ্টিপাত করি তাহলে দেখব, ২০০২ সালে গুজরাটের গোধরায় একটি ট্রেনে আগুন লাগা এবং তাতে ৫৮ জন হিন্দু তীর্থযাত্রী নিহত হওয়ার ঘটনা নিয়ে মুসলমানদের কীভাবে হত্যা ও নির্যাতন করা হয়েছিল। উগ্র হিন্দুত্ববাদী সংগঠনগুলো অভিযোগ করে ট্রেনটিতে মুসলমানরা আগুন দিয়েছিল। মুসলমানরা এ কাজ করে বলে গুজরাটের স্থানীয় পত্র-পত্রিকাগুলোও বানোয়াট ও অসত্য সংবাদ পরিবেশন করে। রাজ্য সরকারের পক্ষ থেকে তখন মুসলমানদের বাড়ি-ঘর ও ব্যবসা কেন্দ্রের ঠিকানা ও অবস্থান লিফলেট আকারে ছড়িয়ে দেয়া হয়। এসব লিফলেট তৎকালীন গুজরাটের প্রশাসন থেকে উগ্র হিন্দুদের হাতে পৌঁছে দেয়া হয়। আরএসএস, বজরঙ দল, বিশ্ব হিন্দু পরিষদের সদস্যরা গেরুয়া পোশাক পরে ট্রাকে চড়ে সরবরাহকৃত ঠিকানা অনুযায়ী মুসলমানদের হত্যা, ধর্ষণ, লুটপাট এবং বাড়ি-ঘর জ্বালিয়ে দেয়ার উল্লাসে মেতে উঠে। আড়াইশ’র মতো নারীকে গণধর্ষণ করে পুড়িয়ে হত্যা করা হয়, উলঙ্গ করে প্যারেড করানো হয়, গর্ভবতী মায়ের পেট কেটে বাচ্চা বের করে পিষে মারা হয়, শিশুদের জোর করে পেট্রল খাইয়ে আগুন ধরিয়ে দেয়া হয়, অসংখ্য মুসলমানের গলা কেটে, দেহ থেকে হাত-পা বিচ্ছিন্ন করে এবং পেট চিরে পুড়িয়ে মারা হয়। সেখানের গুলবার্গ সোসাইটির এহসান জাফরি নামে এক ব্যক্তি উগ্রবাদী হিন্দুদের কাছে অনুনয়-বিনয় করে তার পরিবারের লোকজনদের বাঁচানোর আকুতি জানিয়েছিলেন। হিন্দুরা তার আকুতি তো শোনেইনি উল্টো তাকে উলঙ্গ করে টেনেহিঁচড়ে রাস্তায় নিয়ে ‘জয় শ্রী রাম’ বলার জন্য আদেশ দেয়। তিনি তা না করায় শিরুচ্ছেদ করে দেহ আগুনে পুড়িয়ে দেয়া হয়। তার বাড়িতে আগুন দিয়ে পুরো পরিবারকে পুড়িয়ে হত্যা করা হয়। এভাবে প্রায় দেড় হাজার মুসলমান হত্যা করা হয়। ২৩০টি মসজিদ এবং ২৭৪টি দরগা ধ্বংস করা হয়। মুসলমানদের এক লাখ বাড়ি-ঘর, ১১০০ হোটেল, ১৫০০ ব্যবসা কেন্দ্র ও ৫ হাজার গাড়ি ধ্বংস করা হয়। উগ্রবাদী হিন্দুদের এমন বর্বরতা ইতিহাসে নজিরবিহীন। এসবই হয়েছিল গুজরাটে বিজেপি সরকার ক্ষমতায় থাকার সময় এবং যার মুখ্যমন্ত্রী ছিলেন নরেন্দ্র মোদি। এ ঘটনায় ক্ষুদ্ধ হয়ে সে সময় যুক্তরাষ্ট্রের স্টেট ডিপার্টমেন্ট নরেন্দ্র মোদিকে যুক্তরাষ্ট্রে প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা জারি করেছিল। দাঙ্গার পরও উগ্র হিন্দুত্ববাদী নেতারা মুসলমানদের বিরুদ্ধে প্রচন্ড বিদ্বেষমূলক বক্তব্য দিতে থাকে। শিবসেনা নেতা বালথেকার বলেছিলেন, ‘মুসলমানরা ভারতের জন্য ক্যান্সার। ক্যান্সার অনিরাময়যোগ্য। এটা কেবলমাত্র থামানো যায় অপারেশনের মাধ্যমে।’ তিনি হিন্দুদের আহবান জানিয়ে বলেছিলেন, ‘ও হিন্দুরা, অস্ত্র হাতে তুলে নাও এবং তোমার মূল থেকে এ ক্যান্সার নির্মূল করো।’ বিশ্ব হিন্দু পরিষদের আর্ন্তজাতিক প্রেসিডেন্ট প্রভিন টোগাড়িয়া বলেছিলেন, ‘হিন্দুদের প্রতিপক্ষ প্রত্যেককেই মৃত্যুদন্ডে দন্ডিত করা হবে। বিশ্ব হিন্দু পরিষদের তৎকালীণ প্রেসিডেন্ট অশোক সিঙ্গাল বলেছিলেন, গুজরাটের দাঙ্গা সফল হয়েছে, যা আগামীতে দেশব্যাপী ছড়িয়ে দেয়া হবে। ভারতের এমন ভয়াবহ দাঙ্গা এবং মুসলমান নিধন প্রক্রিয়া আজও থেমে নেই। ভারত থেকে মুসলমানদের বিতাড়নে সরকারের উদ্যোগেই এনআরসি নামক আইন পাস করা হয়েছে। এ নিয়ে আমাদের দেশের হিন্দু এবং তাদের হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদকে কোনো কথা বা প্রতিক্রিয়া দেখাতে দেখা যায়নি। কেন? এ প্রশ্নের উত্তর কি তারা দেবে? ২০১৭ সালের অক্টোবরে মিয়ানমার সরকারের পরোক্ষ মদদে উগ্রবাদী বৌদ্ধ ও সরকারের সামরিক বাহিনী রোহিঙ্গা মুসলমানদের ঠিক গুরাটের মতো খুন, ধর্ষণ, পুড়িয়ে মারা, বাড়ি-ঘর জ্বালিয়ে দেয়াসহ দেশ থেকে বের করার ঘটনা ঘটিয়েছে, এ নিয়ে কি আমাদের দেশের বৌদ্ধরা কোনো প্রতিবাদ করেছে? করেনি। ভারত বা মিয়ানমারে দাঙ্গার রেশ ধরে আমাদের দেশের মুসলমানরা কি দাঙ্গা বাঁধিয়ে হিন্দু বা বৌদ্ধ সম্প্রদায়কে হত্যা বা নির্যাতন করেছে? করেনি। কারণ, আমাদের দেশের মুসলমানদের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যই হচ্ছে, সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বজায় রাখা। তারা মনে করে, প্রত্যেকেই বাংলাদেশী এবং পারস্পরিক সহাবস্থানের মাধ্যমে স্বাধীনভাবে যার যার ধর্ম পালন করবে। বরং কোথাও হিন্দুরা সন্ত্রাসীদের দ্বারা আক্রান্ত হলে সাধারণ মুসলমানরাই প্রতিরোধ গড়ে তোলে। কয়েক বছর আগের একটি ঘটনার উদাহরণ দিলে বিষয়টি পরিস্কার হয়ে যাবে। পাবনার সাঁথিয়ায় সন্ত্রাসীদের দ্বারা এক হিন্দু পরিবার আক্রান্ত হলে তাদের রক্ষায় মসজিদ থেকে সাধারণ মুসল্লিরা এগিয়ে এসেছিল। এ ঘটনার যেন পুনরাবৃত্তি না ঘটে, তার জন্য দলমত নির্বিশেষে সকলে কঠোর অবস্থান নিয়েছিল। ঘটনার সুষ্ঠু বিচার করা হয়েছিল। এটাই বাংলাদেশের মানুষের মৌলিক বৈশিষ্ট্য। তাদের মধ্যে সা¤প্রদায়িক স¤প্রীতির বন্ধন এতটাই মজবুত যে ’৯২ সালে ভারতের অযোধ্যায় বিশ্ব হিন্দু পরিষদ ও বিজেপি যখন বাবরি মসজিদ গুঁড়িয়ে দেয়, তখনও তাদের মধ্যে কোন ধরনের উত্তেজনা দেখা দেয়নি এবং প্রতিশোধস্বরূপ হিন্দুদের মন্দির ভাঙচুর করেনি। দেশের মুসলমানরা ইসলামের বিধান অনুযায়ী ধৈর্য্য ও সহিঞ্চুতা প্রদর্শন করেছে। এক্ষেত্রে হাজার বছর ধরে অগ্রণী ভূমিকা পালন করে আসছেন দেশের ইসলামী চিন্তাবিদ, আলেম-ওলামা, পীর-মাশায়েখ। তারা ইসলামের সাম্যবাদ ও ধর্মীয় স্বাধীনতাকে সাধারণ মানুষের অন্তরে পৌঁছে দিতে সক্ষম হয়েছেন। তারা পবিত্র কোরআনে বর্ণিত আল্লাহর এই নির্দেশ পৌঁছে দিয়েছেন, ‘আল্লাহকে ছাড়া তারা যাদেরকে ডাকে তাদের গালি দিও না। কারণ, তারা সীমা লঙ্ঘন করে অজ্ঞানতাবশত আল্লাহকেও গালি দেবে। এভাবে আমি প্রত্যেক জাতির দৃষ্টিতে তাদের কার্যকলাপ সুশোভন করেছি, অতঃপর তাদের প্রতিপালকের নিকট তাদের প্রত্যাবর্তন করতে হবে। অনন্তর তিনি তাদেরকে তাদের কৃতকর্ম সম্বন্ধে অবহিত করবেন।’ (সুরা আনআম:১০৮)। মহানবীহযরত মুহম্মদ (স.) কে যখন কাফেররা কটূক্তি করত তখন আল্লাহ তাঁকে নির্দেশ দিয়ে বলেছেন, ‘লোকে যা বলে, তাতে তুমি ধৈর্য্য ধারণ করো এবং সৌজন্য সহকারে এগুলো পরিহার করো।’ (সুরা মুজ্জাম্মিল: ১০)। মহান রাব্বুল আলামিনের এসব আদেশ-নির্দেশ অন্তরে লালন করে আমাদের দেশের ইসলামি চিন্তাবিদ, আলেম-ওলামা, পীর-মাশায়েখ সাধারণ মুসলমানদের শিক্ষা দিয়েছেন। তারাও আল্লাহ ও রাসূলের আদেশ-নির্দেশ অন্তরে ধারণ করে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি অক্ষুন্ন-অটুট রেখে চলেছেন। কেউ কি আজ পর্যন্ত বলতে পারবে, আমাদের দেশের কোনো মুসলমান অন্য ধর্ম নিয়ে ব্যঙ্গ-বিদ্রুপ করেছে? করেনি। বরং আমাদের দেশেরই কিছু হিন্দু ইসলাম নিয়ে ব্যঙ্গ-বিদ্রুপ করার নজির সৃষ্টি করেছে।
তিন.
একটি প্রশ্ন এখন অনিবার্য হয়ে পড়েছে আর তা হচ্ছে, বাংলাদেশে ধর্মের ভিত্তিতে কোনো শ্রেণী বিন্যাস বা ভেদাভেদ করা হয় কিনা? এ প্রশ্নের জবাবে বলা যায়, সমাজে এ ধরনের শ্রেণীবিন্যাস ও ভেদাভেদ কোনো কালেই ছিল না এখনো নেই। সরকারি চাকরি থেকে শুরু করে বেসরকারি খাতেও ধর্মের ভিত্তিতে এ ধরনের কোনো বৈষম্য নেই। আমরা যদি সরকারের দিকে তাকাই তাহলে দেখব, সেখানে প্রশাসন, বিচার বিভাগ, পুলিশ প্রশাসনের বড় বড় পদে বিপুল সংখ্যক হিন্দু সম্প্রদায়ের লোকজন দায়িত্ব পালন করছেন। তাদের নিয়োগের ক্ষেত্রে কখনোই ধর্মীয় বিষয় প্রাধান্য পায়নি, পাচ্ছেও না। যোগ্যতার মাপকাঠিতেই তারা নিয়োজিত হয়েছেন এবং হচ্ছেন। যদি তা না হতো, তবে সচিব থেকে শুরু করে অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্রের উচ্চপদে হিন্দুরা সুযোগ পেত না, এমনকি প্রধান বিচারপতি হিসেবেও কেউ নিয়োগ পেত না। বিখ্যাত আন্তর্জাতিক পত্রিকা ইকোনোমিকস টাইমসের হিসাব অনুযায়ী, হিন্দু জনসংখ্যার হার অনুপাতে বাংলাদেশে সরকারি চাকরিতে হিন্দুদের অংশগ্রহণ রয়েছে শতকরা ৭ ভাগ। শুধু পুলিশে চাকরি করছে শতকরা ১০ ভাগ। অন্যদিকে কাগজে-কলমে না হলেও মনস্তাত্তি¡কভাবে ভারতে মুসলমানদের দ্বিতীয় শ্রেণীর নাগরিক হিসেবে বিবেচনা করা হয়। সেখানে সরকারি উচ্চপদে খুব কম মুসলমানই নিযুক্ত হয়। বাংলাদেশ যেসব ধর্ম ও বর্ণের অপূর্ব সম্প্রীতির দেশ তা বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থার প্রতিবেদনে উঠে এসেছে। কয়েক বছর আগে যুক্তরাজ্যভিত্তিক লেগাটাম ইনস্টিটিউটের এক জরিপে ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে জীবনযাপনের উৎকৃষ্ট দেশ হিসেবে ভারত ও পাকিস্তানের চেয়ে বাংলাদেশের নাম আগে তুলে ধরা হয়েছে। জরিপে ১৪২টি দেশের মধ্যে ভারত ও পাকিস্তানের চেয়ে বাংলাদেশের অবস্থান উপরে। বাংলাদেশ ১০৩ এবং ভারত ও পাকিস্তান যথাক্রমে ১০৬ ও ১৩২। অর্থাৎ সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির দেশ হিসেবে বাংলাদেশ ভারত ও পাকিস্তানের চেয়ে অধিক নিরাপদ। এ থেকে প্রমাণিত হয়, বাংলাদেশের মতো সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি ও পারস্পরিক সহাবস্থানের দেশ হিসেবে কতটা উৎকৃষ্ট। বাংলাদেশের প্রতিটি ক্ষেত্রেই সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির বিষয়টি পরিলক্ষিত হয়। জাতীয় সংসদ অধিবেশন যখন শুরু হয়, তখন কোরআন তেলওয়াতের পর হিন্দু ও বৌদ্ধদের ধর্মীয় গ্রন্থও পাঠ করা হয়। বিশ্বের আর কোনো দেশে কি এমন সম্প্রীতি দেখা যায়? আমরা যদি যুক্তরাষ্ট্রের নবনির্বাচিত প্রেসিডেন্টের শপথ অনুষ্ঠান লক্ষ্য করি তখন দেখি, প্রেসিডেন্ট তার বাম হাত বাইবেলের উপর রেখে ডান হাত উঁচিয়ে শপথ করেন। শপথের শেষ বাক্যে বলেন, ‘সো হেল্প মি গড’। সেখানে তো অন্য কোনো ধর্মের গ্রন্থ হাতে নিয়ে প্রেসিডেন্টকে শপথ করতে দেখা যায় না। ভারত বা অন্য কোনো দেশের প্রধানমন্ত্রী ও প্রেসিডেন্টও কি তা করেন? করেন না। একমাত্র বাংলদেশেই মুসলমানদের ধর্মীয় আচার-আচরণের পাশাপাশি হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রিস্টানদের ধর্মীয় রীতি পালন করা হয়। সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির এমন উদাহরণ কি আর কোনো দেশে আছে? ভারতের কিছু হিন্দু নেতা বাংলাদেশে হিন্দুদের ওপর সামান্য আঁচড়ে যেভাবে তেড়েফুড়ে ওঠেন, তাদের উচিৎ তাদের দেশে মুসলমানদের বর্তমান পরিস্থিতি কি সেদিকে দৃষ্টি দেয়া। এ নিয়ে তো তাদের কোনো কথা বলতে দেখা যায় না। উল্টো কীভাবে মুসলমানদের হত্যা, নির্যাতন ও বিতাড়ন করা যায়, তা নিশ্চিত করতে উঠেপড়ে লাগতে দেখা যায। তাদের দেশটি যে উগ্র হিন্দু মৌলবাদী দেশ এবং একটি হিন্দু রাষ্ট্রে পরিণত করার চেষ্টা চলছে, এদিকে তাদের কোনো খেয়াল নেই। এ নিয়ে কয়েক বছর আগে ভারতের প্রখ্যাত সাংবাদিক কুলদীপ নায়ার ‘ভারতে মৌলবাদের উত্থান’ শীর্ষক এক নিবন্ধে লিখেছিলেন, ‘মৌলবাদ আবারও তার জঘন্য মাথা তোলা শুরু করেছে। উগ্র হিন্দুত্ববাদী এবং গান্ধীর হত্যাকারী নথুরাম গডসের সংগঠন রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘ (আরএসএস) সরাসরি রাজনীতিতে প্রবেশ করছে।’ কুলদীপ নায়ার বিস্ময় প্রকাশ করে লিখেছিলেন, ‘কীভাবে একটি সাংস্কৃতিক সংগঠন (আরএসএস) এক লাফে রাজনৈতিক বৃত্তে ঢুকে পড়ে!’ তিনি লিখেছিলেন, ‘সবচেয়ে খারাপ কাজটি অযোধ্যায় করেছে বিশ্ব হিন্দু পরিষদ ও বিজেপি। তারা বাবরি মসজিদ ধ্বংস এবং হাজারো মুসলিমকে হত্যার জন্য দায়ী।’ কাজেই ভারতে যেখানে হিন্দু মৌলবাদীর উত্থান এবং উগ্র হিন্দুত্ববাদী দল হিসেবে পরিচিত বিজেপি ক্ষমতায়, সেখানে বাংলাদেশের সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি নিয়ে কি তাদের নেতাদের কথা বলার কোনো সুযোগ রয়েছে? দ্ব্যর্থহীনভাবে এ কথা বলা যায়, বাংলাদেশে সম্প্রদায়গত কোন বিরোধ নেই। মাঝে মাঝে দুয়েকটি বিচ্ছিন্ন ঘটনা ঘটলেও তাতে রাজনৈতিক স্বার্থসিদ্ধির ব্যাপার থাকলেও থাকতে পারে। এক রাজনৈতিক দল অন্য রাজনৈতিক দলকে ঘায়েল করার হাতিয়ার হিসেবে এ ধরনের ঘটনা ঘটানোর প্রবণতা অস্বাভাবিক নয়। তবে এসব ঘটনায় সাধারণ মানুষের কোন সম্পৃক্ততা থাকে না। এ নিয়ে কোন সংঘাতেরও সৃষ্টি হয় না। বলা যায়, ধর্মপ্রাণ মানুষ তা হতে দেয় না। বাংলাদেশ সরকারও হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিস্টানসহ অন্য ধর্মাবলম্বীদের সমান সুযোগ নিশ্চিত করেছে। সাংবিধানিকভাবেই তা নিশ্চিত করা হয়েছে। এ সুযোগ ক্রমেই বৃদ্ধি পাচ্ছে। মনে রাখতে হবে, বাংলাদেশে হিন্দুরা প্রতি বছর মন্দিরসহ ৩২ থেকে ৩৩ হাজার স্থানে দূর্গা পুজা করে। পক্ষান্তরে ভারতে কোরবানি নিষিদ্ধ এমনকি ঈদের জামাত পড়তেও বাধা দেয়া হয়। গরু জবাই নিয়ে একটি নিবর্তনমূলক আইনও করেছে। এই আইনে ভারতে মুসলমানদের গরুর গোশত খাওয়াও নিষিদ্ধ করা হয়েছে। এর মাধ্যমে কি একটি সম্প্রদায়ের প্রতি সুবিচার করা হয়েছে? ভারত যেমন গরু জবাই বন্ধ করেছে, তেমনি বাংলাদেশেও গরু জবাই বন্ধের দাবি জানিয়েছিল। ২০১৫ সালে মোদী সরকারের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী রাজনাথ সিং বাংলাদেশের সীমান্তে এসে বিএসএফকে বাংলাদেশে গরু খাওয়া বন্ধ করার আহবান জানিয়েছিলেন। কতটা উগ্র এবং সাম্প্রদায়িক হলে সরকারের একজন মন্ত্রী এমন আহবান জানাতে পারেন, তা সহজেই অনধাবনীয়। গরু নিয়ে মুসলমানদের হত্যা ও নির্যাতনের যেসব ঘটনা ঘটেছে, তা নিয়ে ইন্ডিয়াস্পেড নামে একটি গবেষণা প্রতিষ্ঠানের প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, ২০১০ সালের পর গরু সংক্রান্ত সহিংসতায় প্রাণ হারানো ব্যক্তিদের ৮৬ শতাংশই মুসলমান। আর গরু নিয়ে মুসলমানদের উপর যত হামলা হয় তার ৯৭ শতাংশই নরেন্দ্র মোদীর শাসনামলে হয়েছে। এসব হামলার ৫২ শতাংশই হয় গুজব ছড়িয়ে। এ পরিসংখ্যান থেকেই বোঝা যায়, ভারতের সংখ্যালঘু মুসলমানরা কতটা নীপিড়ন-নির্যাতনের শিকার হচ্ছে।
চার.
বাংলাদেশ হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদের নেতাদের বক্তব্য শুনলে দেশের যে কারো মনে হবে, এদেশে হিন্দুরা যেন অচ্ছুৎ হয়ে পড়েছে। দেশে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বলে কিছু নেই। তাদের এসব বক্তব্য যে বাস্তবতা বিবর্জিত, তা মুসলমান-হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রিস্টানদের পারস্পরিক সুসম্পর্কের মাধ্যমে বসবাস করা থেকে কারো বুঝতে অসুবিধা হয় না। বরং তাদের এসব বক্তব্য বাংলাদেশের হাজার বছরের সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির বিপরীত এবং তা বিনষ্ট করার ক্ষেত্রে উস্কানিমূলক। তাদের বক্তব্য সাম্প্রীতির বিরুদ্ধে এবং দেশের ভাবমর্যাদার জন্যও হানিকর। তাদের বক্তব্যকে ‘ঘোলা পানিতে মাছ শিকার’ ছাড়া আর কিছুই বলা যায় না। সম্প্রীতির পরিবেশকে অস্থিতিশীল করার এক ধরনের মিশন, যা অপপ্রচারের নামান্তর এবং এর পেছনে তাদের ব্যক্তিস্বার্থ জড়িত থাকতে পারে। আমরা মনে করি, দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমান, সংখ্যালঘু হিন্দু, বৌদ্ধ ও খ্রিস্টানরা তাদের এসব কথা আমলে নেয় না। তারা সম্মিলিতভাবে দেশের হাজার বছরের সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি ও পারস্পরিক সহবস্থান বজায় রেখে বসবাস করার ঐতিহ্য ধরে রাখতে বদ্ধপরিকর।
[email protected]
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।