Inqilab Logo

বৃহস্পতিবার ০৭ নভেম্বর ২০২৪, ২২ কার্তিক ১৪৩১, ০৪ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

স্যাটানিক ভার্সেস থেকে শার্লি এবদো একই সূত্রে গাঁথা

ড. মুহম্মদ দিদারে আলম মুহসিন | প্রকাশের সময় : ১৭ নভেম্বর, ২০২০, ১২:০১ এএম

কৌশলটা বেশ পুরনো। কেবল প্রেজেন্টেশনটাই একটু ভিন্ন, এই যা। মুসলমানদের উত্যক্ত করা। কীভাবে? তাদের সবচেয়ে স্পর্শকাতর আবেগের জায়গাগুলোতে আঘাত করে। উদ্দেশ্য? সারা বিশ্বে মুসলমানরা বিক্ষুব্ধ হবে, প্রতিবাদ-বিক্ষোভে সোচ্চার হবে। শান্তিপূর্ণ প্রতিবাদের পাশাপাশি কিছু চরমপন্থী লোক সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড চালাবে, কিছু হতাহতের ঘটনা ঘটবে। আর সেগুলো মিডিয়ায় ফলাও করে প্রচার করা হবে, ‘দেখ, দেখ! এই মুসলমানদের জাতটাই একটি সন্ত্রাসীর জাত। এরা আর ঠিক হলো না!’ আশির দশকে সালমান রুশদির স্যাটানিক ভার্সেস আর আজকে শার্লি এবদোর ক্যারিকেচার- সবই হয়তো একই লক্ষ্যে নিবেদিত।

তা, কী বিষয়-আশয় এসব ক্যারিকেচারের পেছনে চালিকাশক্তি হিসেবে কাজ করছে? পাশ্চাত্যে ইসলাম দ্রুত বিস্তার লাভ করছে। একদিকে দাস, শরণার্থী কিংবা অভিবাসী হয়ে এসে যারা ওখানে ঠাঁই পেয়েছে, তারা নিজেরা তো আছেই। সেই সাথে তাদের জন্ম হার উঁচু। বেশি বেশি বাচ্চা-কাচ্চা পয়দা করে দিন দিন দলে ভারী হচ্ছে। আর এগুলার অনেকেই অল্প-স্বল্প পাশ্চাত্য ঢং ধরলেও আসল জায়গায় ঠিক। মুসলিম পরিচয়েই থাকতে চায়, ওটাতেই তারা স্বচ্ছন্দ, গৌরবান্বিত বোধ করে। এর সাথে নতুন বিপদ যুক্ত হয়েছে, দিন দিন ইসলামে দীক্ষা গ্রহণকারীর সংখ্যা বাড়ছে। কাজেই, একটু কেওয়াজ তৈরি করে মুসলিমদের উপর ভালো মতন সন্ত্রাসী তকমাটা এঁটে দেয়া গেলে এই ফ্লো’টা যদি কিছুটা হলেও থামানো যায়!

এ তো গেল মুদ্রার একটি পিঠ। অন্য দিকটাও বেশ ইন্টারেস্টিং। ইসলাম ও মুসলমানদের বিষয়ে সামগ্রিক দৃষ্টিভঙ্গি কী হবে, তা নিয়ে পাশ্চাত্যের নীতি নির্ধারকরা দ্বিধাবিভক্ত। উদারপন্থীরা কে কোন ধর্ম পালন করছে, তা নিয়ে অতটা নাক গলাতে চান না। তাঁরা মনে করেন, ধর্ম-কর্ম এসব মানুষের ব্যক্তিগত ব্যাপার। যে যদৃচ্ছা যে কোনো ধর্ম পালন করুক, তাতে সমস্যা কী? এরা সকল ধর্মের সহাবস্থানে বিশ্বাসী। কিন্তু, রেডিক্যালিস্টরা তা মানতে নারাজ। পাশ্চাত্যে ইসলাম ও মুসলিমের ক্রমশ শক্তি বৃদ্ধিতে তাদের মধ্যে ‘গেল গেল’ রব উঠেছে, রীতিমতো ঘুম হারাম হয়ে গেছে। যে কোনো মূল্যে এটা ঠেকানো চাই। মিডিয়ার ক্রমাগত প্রচারণায় গত কয়েক দশকে এদের পালে বেশ হাওয়া লেগেছে। তাই, ভোটের বাজারে নিজেদের অবস্থান ধরে রাখতে কিংবা আরও জোরালো করতে পলিটিক্যাল লিডাররা তাদের আশ্বস্থ করতে চায়, আমরা কিন্তু তোমাদের সাথেই আছি। মতপ্রকাশের স্বাধীনতার নামে ইমানুয়েল ম্যাখোদের শার্লি এবদোর ক্যারিকেচারে সমর্থন দিয়ে যাওয়া হয়তো সেই কৌশলেরই বহিঃপ্রকাশ।

তবে, এসব করে কি শেষ রক্ষা হবে? বিভিন্ন সূত্রে জানা যায়, ইরাক ও আফগানিস্তানে যাদের পাঠানো হয়েছিল, মুসলিম ‘সন্ত্রাসী’দের শায়েস্তা করতে, তাদের অনেকেই ফেরৎ গেছে মুসলিম হয়ে। ইসলাম মানুষের কাছে যে ধরনের আচার-আচণ দাবি করে, স্বর্ণযুগের মুসলিমদের যে চারিত্রিক মাধুর্য ও আত্মত্যাগের কাহিনী আমরা ইতিহাসে দেখতে পাই, আজকের মুসলিম সমাজ হয়তো চারিত্রিক মাধুর্যের বিচারে সেখান থেকে যোজন যোজন দূরে অবস্থান করছে। তারপরও মুসলিম সমাজের সামগ্রিক চাল-চলনে হয়তো এখনও এমন আকর্ষণীয় কিছু আছে, যা মুসলিম ‘সন্ত্রাসী’দের দমনে আসা ওসব সেনাদের আকৃষ্ট করেছিল, তাদের কনভার্সনে উৎসাহ যুগিয়েছিল।

যুগে যুগে ইসলাম বিরোধী প্রচারণা উল্টো ইসলামের প্রসারে সাহায্য করেছে। কারণ, এর মাধ্যমে ইসলামের আওয়াজ এমন অনেক সত্যানুসন্ধিৎসু মানুষের কাছে পৌঁছেছে, যারা হয়তো এরূপ বিরূপ প্রচারণা না হলে ইসলাম সম্পর্কে জানতে উৎসুক হতেন না। মক্কায় রাসুল (সা.) যখন ইসলাম বিরোধীদের কঠোর বিরোধিতার সম্মুখীন হচ্ছিলেন, তারপরও এক-দুই করে তাঁর কাছে দীক্ষা গ্রহণকারীর সংখ্যা বেড়ে চলছিল, বিরোধীরা তাঁর সম্মোহনী শক্তির সাথে কুলিয়ে উঠতে না পেরে তাঁর বিরুদ্ধে ব্যাপক প্রপাগান্ডা চালানোকেই অন্যতম প্রধান হাতিয়ার হিসেবে গ্রহণ করেছিল। হজ্জ্বের সময় সমগ্র আরব জাহান থেকে লোকেরা মক্কায় আসতেন। রাসুল (সা.) এ উপলক্ষটা কাজে লাগিয়ে অনেক লোকের কাছে পৌঁছার চেষ্টা করতেন। আর বিরোধীরা আগত লোকেরা যাতে কিছুতেই তাঁর পাশ ঘেঁষতে না পারে, তজ্জন্য জোরালো অপপ্রচার চালাত। এতে ফল হয়েছিল এই যে, যেসব লোকের কাছে রাসুল (সা.) নিজে পৌঁছতে পারছিলেন না, তাদের কাছেও ইসলামের আওয়াজ পৌঁছে যাচ্ছিল।

কাজেই, এত উদ্বেগের কী আছে? ইসলামের বিরুদ্ধে প্রপাগান্ডা চালিয়ে, হট্টগোল করে ওরা সত্যপ্রিয় সাধারণ মানুষকে ইসলাম থেকে দূরে সরিয়ে রাখতে চায়। তাদের জন্য সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ তো পবিত্র কুরআন, যা এখনও অবিকৃত অবস্থায় মুসলমানদের মধ্যে বিদ্যমান আছে। আল্লাহ ওয়াদা করেছেন, এটিকে অবিকৃত রাখার দায়িত্বটা তিনি নিজ কাঁধে তুলে নিয়েছেন। কুরআনের অমিয় বাণী যাতে মানুষের কাছে পৌঁছতে না পারে, তজ্জন্য তারা অতীতেও হট্টগোল করেছে, এখনও করছে, ভবিষ্যতেও করবে। এটাই বাস্তবতা। ‘বিরোধীরা (তাদের অনুসারীদের) বলে, তোমরা এ কুরআন শুনবে না। আর (যেখানেই এটি পাঠ করা হবে) সেখানে হট্টগোল করবে। তাহলেই হয়তো তোমরা বিজয়ী হতে পারবে।’ (আল-কুরআন ৪১:২৬)

তাহলে, করণীয়? আমি বলছি না, আপনি চুপ করে বসে থাকুন। আপনার কলজেতে আঘাত দেবে আর আপনি আর্ত চিৎকারও করতে পারবেন না সেটা বলা অবশ্যই সঙ্গত হবে না। তবে মনে রাখবেন, ইসলাম শান্তির ধর্ম। শান্তিই ইসলামের শক্তি। আপনি অবশ্যই প্রতিবাদ করবেন। মিডিয়ায় লেখালেখি ও প্রচার-প্রচারণা, বক্তৃতা-বিবৃতি, মিছিল-মিটিং, কূটনৈতিক প্রতিবাদ, পণ্য বর্জন ইত্যাদির মাধ্যমে জানান দেন, বিশ্বের শত কোটি মুসলিম ফরাসি সরকারের এহেন কর্মকান্ডে খুবই আহত বোধ করছে, হতাশ হয়েছে। একটি সূত্র মতে, ইতিপূর্বে ডেনমার্ক যখন এধরনের আচরণ করে, অর্থনৈতিক চাপ ভালো কাজ দিয়েছিল। এছাড়া এটার বিরুদ্ধে কোনো আইনি ব্যবস্থা নেয়া যায় কিনা সেটাও বিবেচনা করা যেতে পারে। তবে, সাবধান! ওদের পাতা ফাঁদে ভুলেও পা দেয়া যাবে না। প্রতিবাদ যেন সহিংসতা ও সন্ত্রাসের রূপ ধারণ না করে। তাহলে বুঝবেন, আপনি তাদের উদ্দেশ্য সিদ্ধির হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহৃত হয়ে গেলেন। আবারও বলব, ‘শান্তি, শান্তি এবং শান্তি’। এটাই ইসলামের শিক্ষা, ইসলামের শক্তি। ‘আল্লাহর বান্দাহরা জমিনের উপর বিনয়াবত হয়ে চলে। আর অর্বাচীন লোকেরা যখন তাদের উদ্দেশে কিছু বলে, তাঁরা জবাবে বলে: শান্তি।’ (আল-কুরআন ২৫:৬৩)
লেখক: অধ্যাপক, ফার্মেসি বিভাগ, জাবি।



 

Show all comments
  • Shafiqul Islam ১৭ নভেম্বর, ২০২০, ১০:০৯ এএম says : 0
    সুন্দর বিশ্লেষণ। পড়ে ভাল লাগলো। সত্যি বলতে কি ইসলাম ধর্ম নিয়ে ইসলাম বিদ্বেষীদের অপপ্রচারের কারণেই সকল শ্রেণির মানুষের মধ্যে ইসলাম ধর্ম সম্পর্কে জানার আগ্রহ বেড়েছে এবং পৃথিবীর সর্বত্রই আস্তিক সম্প্রদায়ের জ্ঞানীরা ইসলাম ধর্মের ছায়াতলে শান্তি খুঁজে পেয়েছে। ভবিষ্যতেও তা অব্যাহত থাকবে- ইনশাআল্লাহ্।
    Total Reply(0) Reply

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: শার্লি-এবদো
আরও পড়ুন