পবিত্র লাইলাতুল বরাত
আজ দিবাগত রাত পবিত্র লাইলাতুল বরাত। পরম করুণাময় আল্লাহতায়ালা তার বান্দাদের গুনাহ মাফ, বিপদমুক্তি ও
ইউনিক আইডি নামে একটি প্রকল্প হাতে নিয়েছে নির্বাচন কমিশনের জাতীয় পরিচয় নিবন্ধন অণুবিভাগ। এই প্রকল্পের মাধ্যমে পঞ্চম শ্রেণির শিক্ষার্থী বা ১০ বছর বয়সী শিশুদের পরিচয়পত্র দেয়া হবে। এই পরিচয়পত্রের নম্বরের ওপর ভিত্তি করে পরবর্তীতে জাতীয় পরিচয়পত্র, পাসপোর্ট, ব্যাংক একাউন্ট, টিন ও লাইসেন্সসহ গুরুত্বপূর্ণ কাগজপত্র তৈরি হবে। ইউনিক আইডি প্রকল্পটি বাস্তবায়িত হলে দেশের শিশু-কিশোরদের একটি তথ্যভান্ডার গড়ে উঠবে, যা কেন্দ্রীয় তথ্যভান্ডারের অপরিহার্য অংশে পরিণত হবে। শিশু-কিশোরদের সম্পর্ক প্রয়োজনীয় তথ্য নানা কারণেই থাকা দরকার। বিশ্লেষকরা মনে করেন, শিশু-কিশোরদের অপরাধ দমনে এই তথ্য কাজে আসবে। সাম্প্রতিককালে শিশু-কিশোরদের মধ্যে বিভিন্ন ধরনের অপরাধ প্রবণতা বেড়ে গেছে। এতে দেশের মানুষ অতিশয় উদ্বিগ্ন ও বিচলিত। এর পেছনে পারিবারিক, সামাজিক ও অন্যান্য কারণ ছাড়াও তথ্যের অপ্রতুলতা বা অভাবও বিশেষভাবে দায়ী। ইউনিক আইডি প্রকল্প সেই তথ্যের যোগান নিশ্চিত করবে এবং তা শিশু-কিশোরদের অপরাধ বা গ্যাং কালচার দমনে সহায়ক হবে। এদিক দিয়ে এটি গুরুত্বপূর্ণ তো অবশ্যই, ইউনিক প্রকল্পও বটে। আমরা এর দ্রুত বাস্তবায়ন কামনা করি। অত্যন্ত পরিতাপজনক হলেও বলতে হচ্ছে, কিশোরদের সংঘবদ্ধভাবে অপরাধ সংঘটনের হার দিনকে দিন বাড়ছে। বিস্তৃতি ঘটছে গ্যাং কালচারের। কিশোর গ্যাংগুলো ছোটখাটো অপরাধ থেকে শুরু করে ডাকাতি, ছিনতাই, রাহাজানি, মাদক সেবন, মাদক ব্যবসা, ধর্ষণ এমন কি খুনখারাবি পর্যন্ত অবলীলায় করছে। শহরের পাড়া-মহল্লায় ও গ্রাম-গঞ্জে একের পর এক কিশোর গ্যাং গড়ে উঠছে। তারা সর্বত্র ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করছে। কিশোর গ্যাংগুলোর পেছনে রয়েছে ক্ষমতাসীন দলের এক শ্রেণির নেতা, যারা ‘বড় ভাই’ হিসেবে পরিচিত। কিশোর গ্যাংয়ের হাতে গত চার মাসে এক ডজনের বেশি মানুষ নিহত হয়েছে। অন্যান্য অপরাধের তো কথাই নেই। অপরাধ বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, কিশোর গ্যাংয়ের সদ্যদের স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে আনা খুব কঠিন, যা সার্বিক বিবেচনায় ভবিষ্যতে দেশের জন্য হতে পারে অত্যন্ত বিপদজনক।
দেশে কিশোর গ্যাংয়ের সংখ্যা এখন কত হতে পারে, কারো পক্ষেই বলা সম্ভব নয়। সংবাদপত্রে প্রকাশিত রিপোর্ট অনুযায়ী, রাজধানী ঢাকায় এ সংখ্যা ৬০-এর ওপর। চট্টগ্রামেও সংখ্যাটা এরকমই। অন্যান্য শহরে কিছু কম। গ্রামে-গঞ্জেও কিশোর গ্যাংয়ের কমতি নেই। যেহেতু ক্ষমতাসীন দলের একশ্রেণির নেতার মদদেই কিশোর গ্যাং গড়ে উঠেছে বা উঠছে, সুতরাং তাদের দৌরাত্ম্যও সীমাহীন। আগেও শহরের পাড়া-মহল্লায় কখনো কখনো ‘বড় ভাই’ সৃষ্টি হতে দেখা যেতো। তাদের চেনা যেতো এমনকি কাছেও যাওয়া যেতো। কিন্তু এখনকার বড় ভাইরা ধরা ছোঁয়ার বাইরে রিমোর্ট কন্ট্রোলে কাজ করে। কিশোর গ্যাংগুলো তাদের অঙ্গুলি হেলনে চলে। এদের অনেক সময় চেনা যায় না, দেখা যায় না, সংখ্যাও নিরূপণ করা সম্ভব হয় না। এরা কেবল বড় ভাইদের হয়েই কাজ করে না, দাগী-সন্ত্রাসীদের হয়েও কাজ করে। অনেক সময় প্রভাবশালী ও বিত্তবানদের পক্ষে কাজ করে অর্থের বিনিময়ে। এক কথায় বলা যায়, ক্ষমতাসীন দলের এক শ্রেণির নেতা, চিহ্নিত সন্ত্রাসী এবং প্রভাবশালীদের হাতের ক্রীড়নকে পরিণত হয়েছে কিশোর গ্যাংয়ের সদস্যরা, যারা এমন কোনো অপরাধ ও অপকর্ম নেই, যা করছে না। কিশোররা স্বভাবতই অ্যাডভেঞ্চারপ্রিয়। কোনো কিছুর তোয়াক্কা না করার প্রবণতা তাদের মধ্যে বিদ্যমান। এছাড়া, তারা বাঁধন হারা থাকতে পছন্দ করে, যা ইচ্ছে তাই করতে চায় এবং নিষেধ-বারনের ধার ধারতে চায় না, তাদের বয়সগত স্বভাবের সুযোগটিই নিচ্ছে বড় ভাই, সন্ত্রাসী ও বিত্তশালীরা। অর্থ, অস্ত্র ও মাদক-এই ত্রিবস্তু জোগান দিয়ে সহজেই কিশোরদের বাগে আনা যায়। আর একবার বাগে আনতে পারলে তাদের ফেরার আর পথ থাকে না, আপনা-আপনিই পথ বন্ধ হয়ে যায়। শিশু-কিশোরদের জাতির ভবিষ্যৎ বলে গণ্য করা হয়। তারাই যদি এভাবে নষ্ট হয়ে যায়, ধ্বংস হয়ে যায়, দুর্বৃত্ত ও অপরাধী হিসেবে বেড়ে ওঠে, তবে জাতির ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত হয়ে পড়তে বাধ্য।
কিশোর গ্যাং যেহেতু সুনির্দিষ্টভাবে চিহ্নিত নয়, সহজদৃশ্যও নয়, কাজেই তাদের দমন করা কঠিন। শুধু দেশের মানুষই নয়, আইনশৃংখলা বাহিনীও এ ব্যাপারে উদ্বিগ্ন। কিছু দিন আগে ডিএমপি কমিশনার কিশোর গ্যাং চিহ্নিত করার ও তাদের গতিবিধির ওপর নজর রাখার জন্য পুলিশের প্রতি নির্দেশ দিয়েছেন। কিশোর গ্যাং দমনে পুলিশের সক্রিয়তা ও তৎপরতা তেমন ফলপ্রসূ না হওয়ার কারণে তিনি এই নির্দেশনা দিয়েছেন। এমন কি, তা প্রতিপালনে ব্যর্থ হলে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হবে বলে হুঁশিয়ারি উচ্চারণও করেছেন। আইন করে, অভিযান চালিয়ে কিশোর গ্যাং দমনে সফলতা পাওয়া কতটা সম্ভব, তা নিয়ে প্রশ্ন আছে। যদিও এর প্রয়োজনীয়তা অস্বীকার করার উপায় নেই। কিশোর গ্যাং নির্মূল এবং গ্যাং কালচার অবসান করতে চাইলে আমাদের গোড়ায় নজর দিতে হবে। এটা ঠিক, আমাদের শিশু-কিশোররা অধিকাংশই আর আগের মতো বাবা-মায়ের আদর-ভালোবাসা ও সেবা-যতœ, নৈতিক শিক্ষাদীক্ষা ও সদাচার নিয়ে বেড়ে ওঠার সুযোগ পাচ্ছে না। বাবা-মায়ের ব্যস্ততাই এর প্রধান কারণ। বাবা-মা ও অভিভাবকদের ভূমিকা শিথিল হওয়ার কারণে শিশু-কিশোররা স্বাধীন ও বেপরোয়া জীবনে অভ্যস্ত হয়ে পড়ছে। আগে সামাজিক শাসন ও শৃংখলা কঠোর থাকায় শিশু-কিশোররা কদাচিৎ বিপদগামী হওয়ার সুযোগ পেতো। এখন সামাজিক শাসন উঠে গেছে। নৈতিক শিক্ষার পাঠ ঘরে থেকে শুরু হলেও স্কুল জীবনে তার নিরবচ্ছিন্ন চর্চা ছিল, পাঠ্যসূচিতে তা প্রতিষ্ঠান ছিল। এখন সে সবও নেই। বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, বাবা-মার ভূমিকা, সামাজিক শাসন, নৈতিক ও ধর্মীয় মূল্যবোধের চর্চা বাড়ানোর মধ্যে দিয়ে বিদ্যমান অবস্থার পরিবর্তন ঘটানো সম্ভব। এসব দিকে যেমন গুরুত্ব ও নজর দিতে হবে তেমনি আইনশৃংখলা বাহিনীর অর্থবহ তৎপরতা জোরদার করতে হবে। শিশু-কিশোরদের ইউনিক আইডি তাদের অপরাধ প্রবণতা দূর করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে বলে তার বাস্তবায়নে বিলম্ব করা যাবে না। স্কুল-কলেজে যেমন নিবন্ধনের জন্য যেতে হবে তেমনি কলোনি, বস্তি এবং অধিক জনসমাবেশ আছে এমন এলাকায়ও দ্রুত কাজ করতে হবে। শিক্ষার্র্থীই কেবল নয়, যারা শিক্ষার্থী নয়, তেমন শিশু-কিশোরদেরও ইউনিক আইডির আওতায় আনতে হবে।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।