পবিত্র লাইলাতুল বরাত
আজ দিবাগত রাত পবিত্র লাইলাতুল বরাত। পরম করুণাময় আল্লাহতায়ালা তার বান্দাদের গুনাহ মাফ, বিপদমুক্তি ও
গত ৮ নভেম্বর ২০২০ অনুষ্ঠিত হয়েছে মিয়ানমারের জাতীয় নির্বাচন। জয় পেয়েছে অং সান সু’চির দল ন্যাশনাল লিগ ফর ডেমোক্রেসি (এনএলডি)। একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভের পরও এনএলডির মুখপাত্র জানিয়েছেন, তারা এককভাবে নয়, বরং সর্বদলীয় সরকার গঠনের উদ্যোগ নিতে যাচ্ছেন। নির্বাচনে সু’চির দল বিজয়ী হওয়ায় বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী অভিনন্দন জানিয়ে রোহিঙ্গা সংকট নিরসনের আশাবাদ ব্যক্ত করেছেন। যদিও করোনার দোহাই দিয়ে গেল কয়েকমাস রোহিঙ্গাদের ফেরত নেওয়ার ব্যাপারে আলোচনার টেবিলেই নেই মিয়ানমার। তারপরও নির্বাচনী ডামাডোলের পর সর্বদলীয় সরকার গঠন হলে রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসনের ব্যাপারে উদ্যোগী হতে পারে মিয়ানমার- এমনটাই আশা করছে বাংলাদেশ। বাংলাদেশের পক্ষে এমন আশাবাদ তো স্বাভাবিক। কারো অজানা নেই, রোহিঙ্গা সংকট চূড়ান্ত রূপ নিয়েছে ২০১৭ সালে। সেসময় ক্ষমতায় ছিল অং সান সু’চির দল। সেনাবাহিনী রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে গণহত্যা চালালেও সু’চির সরকার তা প্রতিহত করার উদ্যোগই নেয়নি। এমনকি রোহিঙ্গাদের নাগরিক অধিকারও স্বীকার করেনি। রোহিঙ্গাদের নৃতাত্তি¡ক পরিচয়টুকু পর্যন্ত মুছে দিতে তাদের রোহিঙ্গা না বলে ‘বাঙালি’ হিসেবে অভিহিত করছে তারা। এটা সত্য যে, মিয়ানমারের সরকার নামে গণতান্ত্রিক হলেও সামরিক বাহিনীর ইচ্ছার বিরুদ্ধে যাওয়ার খুব একটা সুযোগ নেই। কিন্তু তারপরও গণতন্ত্রের জন্য দীর্ঘদিন আন্দোলন-সংগ্রাম করে ক্ষমতায় আসা সু’চি চাইলে, কোনো না কোনো উপায়ে রোহিঙ্গাদের মানবাধিকারের পক্ষে নিজের অবস্থান প্রকাশ করতে পারতেন। তিনি তার ধারে কাছেও যাননি, বরং আন্তর্জাতিক ন্যায়বিচার আদালত (ইন্টারন্যাশনাল কোর্ট অব জাস্টিস, আইসিজে) থেকে শুরু করে সর্বত্র সেনাবাহিনীর পক্ষ নিয়েই কথা বলে এসেছেন। বারবার রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নেবেন বলে আশ্বাস দিলেও প্রতিশ্রুতি রাখাতে দৃশ্যমান কোনো পদক্ষেপই গ্রহণ করেননি। এর ফলে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে ব্যাপকভাবে সমালোচিত হয়েছেন, কিন্তু তাতেও তিনি ভ্রুক্ষেপ করেননি। এবারের নির্বাচনে তার দল ফের নির্বাচিত হয়েছে। আর সেনাবাহিনীর ক্ষমতাও যথারীতি একই আছে। অতএব, সম্ভাব্য সর্বদলীয় নতুন সরকারের কাছ থেকে খুব বেশি কিছু আশা করা যায় বলে মনে হয় না। তাই বলে বাংলাদেশের পক্ষে হতাশ হলেও চলবে না। বরং নানা কৌশল এবং প্রচেষ্টার মাধ্যমে রোহিঙ্গা সংকট নিরসনের পথ তাকে বের করতেই হবে।
ইতোমধ্যে বাংলাদেশের পক্ষ থেকে রোহিঙ্গা সংকট নিরসনে ভারতকে সম্পৃক্ত করার কথা বলা হয়েছে। তাতে চীনের কোনো আপত্তি নেই বলে দেশটি জানিয়েছে। কিন্তু মিয়ানমারে সর্বদলীয় নতুন সরকার গঠনের পর আলোচনার টেবিলে ভারত যুক্ত হলেই কি রোহিঙ্গা সংকট সমাধানের দিকে যেতে পারে? আসলে তেমনটি ভাবার কোনো কারণ দেখা যায় না। কেননা, সংকটের শুরু থেকে ভারতকে কখনোই রোহিঙ্গাদের রাখাইনে প্রত্যাবসনের ব্যাপারে খুব একটা আগ্রহী হিসেবে দেখা যায়নি। বরং, সংকটের চূড়ান্ত অবস্থার মধ্যেই ভারতের প্রধানমন্ত্রীকে মিয়ানমার সফরে গিয়ে সু’চির পাশে দাঁড়াতে দেখেছে বিশ^বাসী। ভারত রোহিঙ্গা সংকট নিরসনের চেয়ে বরং, মিয়ানমারে তার কালাদান প্রজেক্ট বাস্তবায়ন নিয়েই বেশি মনোযোগী। অপরদিকে, শুরুতে বাংলাদেশ-মিয়ানমার দ্বিপাক্ষিক প্রচেষ্টা বহুদিন চালানো হয়েছে, তাতে সুফল না আসায় চীনকে যুক্ত করে বাংলাদেশ-মিয়ানমার-চীন ত্রিপক্ষীয় প্রচেষ্টা চলছে। এ ত্রিপক্ষীয় প্রচেষ্টা থেকে বারবার আলোচনা, সমঝোতা, প্রতিশ্রুতির বাণী শোনা গেলেও মিয়ানমারের অসহযোগিতার কারণে বাস্তবে কোনো সাফল্যই আসেনি। মোট কথা, রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসন প্রশ্নে প্রচলতি কূটনীতির ভাষা বুঝতে বারবার ব্যর্থ হচ্ছে মিয়ানমার। তাই, এবার ভারত আলোচনার টেবিলে এলেই যে নতুন কিছু ঘটবে সে ব্যাপারে বেশি আশবাদী না হওয়াই ভালো। তবে কোনো কোনো অভিজ্ঞ কূটনীতিক মনে করছেন, নতুন করে শুধু ভারতকে আলোচনার টেবিলে আনার চেষ্টার মধ্যে সীমাবদ্ধ না থেকে জাপান, রাশিয়া এবং যুক্তরাষ্ট্রকেও যুক্ত করা গেলে এ ক্ষেত্রে নতুন মাত্রা যোগ হতে পারে। কেননা, এ দেশগুলোর প্রতিটিরই মিয়ানমারের সাথে স্বার্থগত সম্পর্ক এবং যথেষ্ট প্রভাবও আছে। এসব শক্তিশালী পক্ষ আলোচনার টেবিলে একত্রে থাকলে হয়তো মিয়ানমারের উপর চাপ বাড়তে পারে, যা রোহিঙ্গা সংকট সমাধানে নতুন পথ দেখাতেও পারে। তবে এটাও সত্য যে, রোহিঙ্গাদের রাখাইনে প্রত্যাবাসনে সফল হতে হলে শুধু এই একমুখী উদ্যোগের উপর ভরসা করেও থাকা যাবে না। এ ক্ষেত্রে সফল হতে হলে প্রয়োজন হবে বহুমুখী তৎপরতা।
মিয়ানমার সরকারের দমন-পীড়ন-নির্যাতন থেকে বাঁচতে রোহিঙ্গারা দেশ ছেড়ে পালাতে শুরু করে ১৯৭৮ সাল থেকেই। তবে ২০১৭ সালের ২৫ আগস্ট থেকে দেশটির সেনাবাহিনী তাদের উপর ব্যাপকভাবে গণহত্যা চালালে সাত লাখের বেশি রোহিঙ্গা বাংলাদেশে পালিয়ে আসে। এ সময় মিয়ানমার সেনাবাহিনীর হামলায় কয়েক হাজার রোহিঙ্গার মৃত্যু হয়েছে রাখাইনে। ধর্ষণের শিকার হয়েছে হাজার হাজার রোহিঙ্গা নারী। গ্রামের পর গ্রাম জ্বালিয়ে-পুড়িয়ে নিশ্চিহ্ন করা হয়েছে তাদের অস্তিত্বের শেষ চিহ্নটুকুও। জাতিসংঘের ভাষায়, যাকে গণহত্যার ‘টেক্সট বুক’ উদাহরণ বলে আখ্যায়িত করা হয়েছে। আগে থেকে বাংলাদেশের বিভিন্ন আশ্রয় শিবিরে থাকা চার লক্ষাধিক রোহিঙ্গার সাথে নতুন করে যুক্ত হওয়া সাত লক্ষাধিক মানুষ এদেশের উপর এখন এক বিরাট বোঝা হয়ে দাঁড়িয়েছে। মানবিক কারণে আশ্রয় দিলেও এই বিপুল সংখ্যক রোহিঙ্গা নাগরিককে দীর্ঘদিন ধরে লালন-পালন করা বাংলাদেশের পক্ষে অসম্ভব। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের এটি জানা থাকা সত্তে¡ও তারা রোহিঙ্গাদের ভরণ-পোষণের জন্য পর্যাপ্ত সহযোগিতা করতে যেমন ব্যর্থ হচ্ছে, তেমনি তাদের নিজ ভূমি আরাকান তথা রাখাইনে পুনর্বাসনে যথাযথ পদক্ষেপ নিতেও উদ্যোগী হচ্ছে না। অনেকেই নিন্দা জানিয়েছে, রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে দমন-পীড়ন বন্ধ করে তাদের নিজ বাসভূমিতে ফেরত নেওয়ার আহবান জানিয়েছে। এখনো এসব নিন্দা-আহবান অব্যাহত আছে। কিন্তু বিশ্বসম্প্রদায়ের পক্ষ থেকে এসব নিন্দা, আহবানকে কোনো গুরুত্বই দেয়নি মিয়ানমার। অপরদিকে রোহিঙ্গা জেনোসাইড বন্ধ ও অবশিষ্ট রোহিঙ্গাদের সুরক্ষায় আইসিজে’র অন্তর্বর্তী আদেশ মানা বাধ্যতামূলক হলেও তা মানছে না মিয়ানমার। গত ২৮ জানুয়ারি আইসিজে’র দেওয়া ওই আদেশের কপি পাওয়ার পরপরই জাতিসংঘ মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস তা নিরাপত্তা পরিষদে পাঠিয়েছিলেন। কিন্তু দুর্ভাগ্যের বিষয় হলো, নিরাপত্তা পরিষদ আজ পর্যন্ত আইসিজে’র আদেশ কার্যকরে কোনো সিদ্ধান্ত নিতে পারেনি। অন্যদিকে, মানবাধিকারের ব্যাপারে সোচ্চার ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ) মিয়ানমারের এবারের নির্বাচনে বিভিন্ন সহায়তা করেছে। অন্যান্য সহায়তার পাশাপাশি নির্বাচনে অংশগ্রহণকারী প্রার্থীদের সম্পর্কে তথ্য প্রদানের জন্য একটি অ্যাপ তৈরি করে দেয় ইইউ, যেখানে রোহিঙ্গাদের অস্তিত্বকে অস্বীকার করে তাদের প্রার্থীদের ‘বাঙালি’ হিসেবে অভিহিত করা হয়। মিয়ানমার সামরিক জান্তা ও অং সান সু’চির নেতৃত্বাধীন সরকারের ইচ্ছানুযায়ী ইউরোপীয় ইউনিয়ন রোহিঙ্গাদের নির্বাচনী প্রক্রিয়ায় কোনো ধরনের সম্পৃক্ততাকেও অস্বীকার করেছে। রোহিঙ্গা সংকট নিরসনের পক্ষে এসব কোনোভাবেই ভালো লক্ষণ নয়।
শুধু তাই নয়, গত ২২ অক্টোবর ২০২০ অনুষ্ঠিত দাতাদের এক অনলাইন-নির্ভর আন্তর্জাতিক সম্মেলনে রোহিঙ্গাদের জন্য ৬০০ মিলিয়ন ডলার বা ৬০ কোটি ডলারের মানবিক সাহায্যের প্রতিশ্রুতি দেয়া হয়েছে। একই সাথে যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় ইউনিয়নসহ দাতাদের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, অন্তত ১০ বছরের জন্য রোহিঙ্গাদের মানবিক সহায়তা কার্যক্রম চালিয়ে যাওয়ার নিশ্চয়তা বিধান করা দরকার। প্রশ্ন হলো, দাতাদের মাথায় ১০ বছরের সহায়তা পদ্ধতিবিষয়ক চিন্তা ঘুরপাক খাওয়ার অর্থ কী হতে পারে? তারা কি ধরেই নিয়েছে যে, আগামী ১০ বছর বা তার বেশি সময় রোহিঙ্গারা বাংলাদেশেই থাকবে, আর তারা (দাতাগোষ্ঠী) খোরপোষের ব্যবস্থা করবে? কিন্তু কেন তারা রোহিঙ্গাদের নিজ ভূমিতে দ্রুত পুনর্বাসিত করার পরিকল্পনার পরিবর্তে আগামী ১০ বছর বাংলাদেশের আশ্রয় শিবিরেই রাখার কথা ভাবছে? দাতারা কি প্রত্যাশা করে না যে, রোহিঙ্গারা তাদের নাগরিক এবং মানবাধিকার নিয়ে নিজ বাসভূমিতে স্বাধীনভাবে বসবাস করুক? নাকি দাতারা শুধু খোরপোষের মধ্যেই নিজেদের দায়িত্ব শেষ করার কথা ভাবছে? পেছনের কারণ যাইহোক, দাতাদের এই অবস্থানটি রোহিঙ্গা এবং বাংলাদেশের জন্য খুবই হতাশার। যেখানে বাংলাদেশের পররাষ্ট্র দপ্তর উপর্যুপরি বলেই চলেছে, রোহিঙ্গা সমস্যার একমাত্র সমাধান তাদের স্বদেশে-স্বভূমিতে ফিরে যাওয়ার নিশ্চয়তার মধ্যেই নিহিত, সেখানে দাতাগোষ্ঠী মিয়ানমারকে রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নিতে কার্যকর চাপ না দিয়ে শুধু অর্থ সহায়তার মধ্যেই তাদের দায়িত্ব সীমাবদ্ধ রাখতে চাচ্ছে! এর ফলে মিয়ানমার রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নেয়ার আগ্রহ দেখানোর প্রয়োজনবোধ না-ও করতে পারে, এটা কি দাতারা অনুধাবন করে না? তাছাড়া রোহিঙ্গাদের মানবাধিকার এবং নাগরিক অধিকার প্রতিষ্ঠার দায় কি দাতারা এড়াতে পারে? অথচ, তারাই আবার সাগরে ভাসমান রোহিঙ্গাদের গ্রহণ করে বাংলাদেশকে মানবিকতা দেখানোর নসিহত করে। কেউ কেউ তাদের দেশে থাকা উদ্বাস্তু রোহিঙ্গাদের জন্য বাংলাদেশের পক্ষ থেকে পাসপোর্ট দিয়ে গ্রহণ করার আহবানও জানায়। রোহিঙ্গাদের প্রতি মানবিকতা দেখানোর সব দায়দায়িত্ব কি শুধু বাংলাদেশেরই? ব্যাপারটি আসলে তা নয়, বরং দুর্বলের উপর কর্তৃত্ব ফলাতে সবাই পারে। এ ক্ষেত্রেও তাই হচ্ছে। সবাই বাংলাদেশের কাঁধে বোঝা চাপিয়ে নিজেদের দায়িত্ব এড়াতে চাইছে। আন্তর্জাতিক ভূ-রাজনীতি, ভৌগোলিক অবস্থান, সামরিক এবং আভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সংকটসহ নানা কারণে বাংলাদেশও সেভাবে জোরালো পদক্ষেপ নিতে পারছে না, আর সেই সুযোগটা কাজে লাগাতে চাইছে সকলে।
আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় রোহিঙ্গা সংকট নিরসনে নিজেদের দায়িত্ব যথাযথভাবে পালন না করলেও বাংলাদেশ কী করছে না করছে সে ব্যাপারে খবরদারীর যেন শেষ নেই। রোহিঙ্গারা কক্সবাজারের উখিয়া এবং টেকনাফের ৩৪টি আশ্রয় শিবিরে বসবাস করছে অত্যন্ত ঘিঞ্জি পরিবেশে। কক্সবাজার এমনিতেই একটি ঘনবসতিপূর্ণ জেলা, তার উপর ১১ লক্ষাধিক রোহিঙ্গার চাপ এ এলাকার পরিবেশের উপর মারাত্মক প্রভাব ফেলছে। তাছাড়া, কিছু রোহিঙ্গা মাদক চোরাচালান, মানবপাচার, চুরি, ডাকাতি, ছিনতাইসহ নানা সন্ত্রাসী কর্মাকান্ডে জড়িয়ে পড়েছে। তাদের অপরাধপ্রবণতা শিবির ছাড়িয়ে ছড়িয়ে পড়ছে স্থানীয় অধিবাসীদের মধ্যেও। অনেক সময় সন্ত্রাসী গ্রুপগুলো আধিপত্য বিস্তার করতে গিয়ে পরস্পরের সাথে দ্বন্দ্ব-সংঘাতেও জড়িয়ে পড়ছে। কখনো কখনো তা খুন-খারাবিতেও গড়াচ্ছে। সম্প্রতি এমনই এক সংঘর্ষে রোহিঙ্গা ক্যাম্পে ৮ জন নিহত হয়েছে। অনেক রোহিঙ্গা ক্যাম্প থেকে পালিয়ে গিয়ে মিশে যাচ্ছে স্থানীয়দের সাথে। বাংলাদেশি ভোটার আইডি, এমনকি পাসপোর্ট তৈরি করে পাড়ি জমাচ্ছে সউদি আরব, মালয়েশিয়াসহ বিভিন্ন দেশে। কেউ কেউ আবার স্থানীয়দের সাথে বিয়ে বন্ধনে আবদ্ধ হচ্ছে। এসব সংকট থেকে উত্তরণের জন্য সরকার নোয়াখালীর অদূরে ভাসানচরে রোহিঙ্গাদের জন্য বিশেষ আশ্রয়ের ব্যবস্থা করেছে। সেখানে এক লক্ষ রোহিঙ্গা বসবাসের উপযোগী উন্নতমানের আবাসের পাশাপাশি শিক্ষা, চিকিৎসা, বিনোদেন, বিদ্যুৎ সংযোগ, জীবিকাসহ নানা ব্যবস্থা করেছে। কিন্তু আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় সেখানে রোহিঙ্গাদের পাঠানোর ব্যাপারে অনীহা দেখাচ্ছে। নানা অপরাধের সাথে জড়িয়ে পড়া রোহিঙ্গারাও তাদের প্রভাব এবং আয় কমে যাওয়ার আশঙ্কায় সাধারণ রোহিঙ্গাদের সেখানে যেতে বাধা দিচ্ছে। ফলে অনেক দিন ধরে চেষ্টা করেও সরকার রোহিঙ্গাদের ভাসানচরে পাঠাতে পারেনি। তবে এ ব্যাপারে কারো কারো অভিমত হচ্ছে, উন্নত জীবনব্যবস্থাসহ ভাসানচরে পাঠানো হলে মিয়ানমার আন্তর্জাতিকভাবে এটাও প্রচার চালাতে পারে যে, রোহিঙ্গারা আসলেই বাংলাদেশের নাগরিক। তাই বাংলাদেশ তাদের সেখানে স্থায়ীভাবে বসবাসের ব্যবস্থা করছে। তাছাড়া, ভাসানচরে উন্নত ও নিরাপদ জীবন পেলে রোহিঙ্গারাও রাখাইনে ফিরে যাওয়ার ইচ্ছে হারিয়ে ফেলতে পারে। এ অবস্থায় টেকনাফ এবং উখিয়ার আশ্রয় শিবির থেকে রোহিঙ্গাদের স্থানান্তর করে চাপ কমাতে হলে ভাসানচরের বিকল্প সন্ধান করার পরামর্শ দেন অনেকে। কারো কারো অভিমত, বান্দরবানের সাথে মিয়ানমারের কিছু সীমান্ত এলাকা আছে, যা খুবই দুর্গম। সীমান্তের কাছাকাছি বান্দরবানের জনমানবহীন কোনো এলাকা চিহ্নিত করে ২/৩ লক্ষ মানুষের বসবাসের উপযোগী আশ্রয় শিবির তৈরি করে রোহিঙ্গাদের সেখানেও স্থানান্তর করা যেতে পারে। এতে কক্সবাজারের উপর থেকে অতিরিক্ত মানুষের চাপ যেমন কিছুটা হলেও কমবে, তেমনি নতুন এ আশ্রয় শিবিরে থাকা রোহিঙ্গাদের চোখের সামনেই থাকবে মিয়ানমার। ফলে তাদের পিতৃপুরুষের বসতভিটায় ফিরে যাওয়ার স্বপ্নটাও জেগে থাকবে। অন্যদিকে সীমান্তের কাছেই রোহিঙ্গাদের উপস্থিতি মিয়ানমারের উপর একটা আলাদা চাপও তৈরি করবে।
তবে মূল লক্ষ্য হবে, রোহিঙ্গাদের রাখাইনে পুনর্বাসন। কিন্তু নিরাপত্তা এবং পূর্ণ নাগরিক অধিকার নিশ্চিত না হলে রোহিঙ্গারা কখনোই মিয়ানমারে ফিরে যেতে চাইবে না, সেটা ইতোমধ্যে প্রমাণ হয়ে গেছে। সে কারণেই গত ২২ সেপ্টেম্বর ২০১৭ জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা মিয়ানমারে জাতিগত নিধন চিরতরে বন্ধ, রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নেওয়াসহ সংকট সমাধানে বিশ্বনেতাদের পাঁচ দফা প্রস্তাব দিয়েছিলেন। পরের বছর ২৪ সেপ্টেম্বর ২০১৮ প্রধানমন্ত্রী জাতিসংঘ সদর দপ্তরে ‘হাই লেভেল ইভেন্ট অন দ্য গ্লােবাল কমপ্যাক্ট অন রিফিউজি: এ মডেল ফর গ্রেটার সলিডারিটি অ্যান্ড করপোরেশন’ শীর্ষক বৈঠকে রোহিঙ্গা সংকট সমাধানে তার আগের প্রস্তাবগুলোকে আরও সুনির্দিষ্ট করে তিন দফা সমাধান সূত্রের সুপারিশ তুলে ধরেন। প্রধানমন্ত্রী প্রস্তাব করেন- ‘ক. মিয়ানমারকে রোহিঙ্গাদের প্রতি বৈষম্যমূলক আইন ও নীতি বাতিল এবং বৈষম্যমূলক আচরণ বন্ধ করতে হবে। এ ছাড়া রোহিঙ্গাদের জোরপূর্বক স্থানান্তরিত করার প্রকৃত কারণগুলো খুঁজে বের করতে হবে। খ. মিয়ানমারের রোহিঙ্গাদের নাগরিক সুরক্ষা ও অধিকার নিশ্চিত করে একটি সহায়ক পরিবেশ তৈরি করতে হবে। প্রয়োজনে একটি সেফ জোন (নিরাপদ অঞ্চল) প্রতিষ্ঠা করতে হবে। গ. জাতিসংঘ মানবাধিকার কাউন্সিলের ফ্যাক্ট ফাইন্ডিং মিশনের সুপারিশের আলোকে ন্যায়বিচার ও জবাবদিহি নিশ্চিত করে মিয়ানমারে রোহিঙ্গাদের নৃশংসতার হাত থেকে বাঁচাতে হবে।’ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রস্তাব বাস্তবায়ন করতে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে কার্যকর পদক্ষেপ নিয়ে এগিয়ে আসতে হবে। কিন্তু উপরের আলোচনায় আমরা দেখেছি, রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসনের ব্যাপারে আন্তর্জাতিক মহল কতটা উদাসীন হয়ে পড়েছে। অথচ, বাংলাদেশের সামনে রোহিঙ্গাদের মিয়ানমারে নিরাপদে পুনর্বাসিত করার কোনো বিকল্প নেই।
[email protected]
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।