পবিত্র লাইলাতুল বরাত
আজ দিবাগত রাত পবিত্র লাইলাতুল বরাত। পরম করুণাময় আল্লাহতায়ালা তার বান্দাদের গুনাহ মাফ, বিপদমুক্তি ও
যেকোনো দেশের যেকোনো নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বী দল বা প্রার্থীর মূল একটি নির্বাচনী স্লােগান থাকতে হয়। যে স্লােগানে দেশের মানুষ উদ্বুদ্ধ হয় এবং সেই দল ও প্রার্থীর ওপর আস্থা রাখে। তাদের মধ্যে এ ধারণার জন্ম হয়, পছন্দের প্রতিশ্রুতিমূলক স্লােগানটি তারা বাস্তবায়ন করতে পারবে। এ বিশ্বাসে উদ্বুদ্ধ হয়ে তারা প্রার্থীদের ভোট দেয় এবং বিজয়ী করে। আমাদের দেশের কথা যদি বলি তবে দেখা যাবে, ২০০৮ সালের জাতীয় নির্বাচনে আওয়ামী লীগ যখন ক্ষমতায় আসে তখন ঐ নির্বাচনে দলটির মূল স্লােগানে ছিল ‘দিন বদলের অঙ্গীকার’। মানুষের কাছে স্লােগানটি ভীষণ পছন্দ হয়েছিল এবং তারা আওয়ামী লীগকে বিপুল ভোটে নির্বাচিত করে। আওয়ামী লীগ নির্বাচিত হয়ে এ স্লােগান কতটা বাস্তবায়িত করতে পেরেছে তা ব্যাখ্যা করার প্রয়োজন বোধ করছি না। ২০১৬ সালে যুক্তরাষ্ট্রের নির্বাচনে ব্যবসায়ী ও ধনকুবের ডোনাল্ড ট্রাম্পও একটি স্লােগান দিয়েছিলেন। স্লােগানটি ছিল ‘আই উইল মেক আমেরিকা গ্রেট’ বা ‘আমেরিকা ফার্স্ট’। তার এই স্লােগানে যুক্তরাষ্ট্রের ভোটাররা উদ্বুদ্ধ এবং প্রাণিত হয়ে তাকে বিজয়ী করেছিল। যদিও কেউই ধারণা করেনি হিলারি ক্লিন্টনের মতো শক্ত এক প্রার্থীর বিরুদ্ধে রাজনীতিতে নবীণ, যার কথাবার্তা এলোমেলো ও উগ্র, এমন ব্যক্তি আমেরিকার প্রেসিডেন্ট হবেন। বাস্তবে দেখা যায়, পুরো বিশ্ব হিলারির পক্ষে থাকার পরও এবং ৩০ লাখ পপুলার ভোট বেশি পাওয়া সত্তে¡ও তিনি পরাজিত হন। তার চেয়ে ইলেক্টোরাল ভোট বেশি পেয়ে ট্রাম্প বিজয়ী হন। এর নেপথ্যে ছিল ট্রাম্পের উগ্র জাতীয়তাবাদী স্লােগান। আমেরিকা শুধু শ্বেতাঙ্গদের এখানে বহিরাগত বা অভিবাসীদের কোনো ঠাঁই নেই, স্লােগানের অন্তর্নিহিত কথাটি সংখ্যাগরিষ্ঠ শ্বেতাঙ্গরা লুফে নিয়ে ট্রাম্পের পক্ষে ব্যাপক প্রচারণায় নামে। যার ফল পান ট্রাম্প। যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হওয়ার পর ট্রাম্প তার স্লােগানের অন্তর্নিহিত ভাব উগ্র জাতীয়তাবাদকে বেশ ভালভাবে কাজে লাগান। মেক্সিকোর অভিবাসী ঠেকাতে দেয়াল তুলে দেন। অভিবাসী নীতি কঠোর করেন। ছয়টি মুসলিম দেশের নাগরিকদের যুক্তরাষ্ট্রে প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা দেন। বহুজাতিক দেশ হিসেবে যে আমেরিকার গৌরব ছিল ট্রাম্প শুধু ‘আমেরিকা ফার্স্ট’ স্লােগান দিয়ে তা তছনছ করে দেন। অভিবাসীদের ভাগ্যে দেখা দেয় দুর্যোগের ঘনঘটা। শুধু তাই নয়, শ্বেতাঙ্গের আমেরিকা গড়তে গিয়ে বর্ণবাদের বিষবাষ্প ছড়িয়ে দিয়ে এক বিভীষিকাময় পরিস্থিতির সৃষ্টি করেন। এবারের নির্বাচনে ট্রাম্প নতুন কোনো স্লােগান দেননি। অর্থাৎ যে স্লােগান ২০১৬ তে দিয়েছিলেন, সেই স্লােগানেই নিবদ্ধ ছিলেন। অন্যদিকে নবনির্বাচিত ডেমোক্রেট প্রার্থী জোসেফ রবিনেট বাইডেন জুনিয়র (জো বাইডেন) কে নির্বাচনের আগে দলীয় বা ব্যক্তিগত তেমন কোনো স্লােগান দিতে দেখা যায়নি। নির্বাচিত হওয়ার পর তিনি বলেছেন, ‘আমি হব সব আমেরিকানের প্রেসিডেন্ট।’
দুই.
প্রেসিডেন্ট হিসেবে বিজয় নিশ্চিত হওয়ার পরপরই ৭৭ বছরের বাইডেন তার প্রথম বিবৃতিতে বলেছেন, ‘আমার সামনে যে কাজ পড়ে আছে তা সহজ নয়। তবে আমি প্রতিশ্রুতি দিচ্ছি, আমি সব আমেরিকানের প্রেসিডেন্ট হব। যারা আমাকে ভোট দিয়েছেন এবং যারা দেননি তাদের সবার জন্য আমি সমানভাবে কাজ করব।’ বাইডেনের প্রাথমিক এই বিবৃতি থেকে যুক্তরাষ্ট্রের আগামী দিনগুলো কেমন হবে তার একটা ধারণা পাওয়া যায়। এ ধারণা অত্যন্ত ইতিবাচক। তার এ কথা ট্রাম্পের চার বছরের শাসনামলের বিরুদ্ধে একটি বড় ধাক্কা। ট্রাম্প আমেরিকাকে গ্রেট করতে গিয়ে যে উগ্রবাদী নীতি অবলম্বন, যুক্তরাষ্ট্রের সমাজে বিভেদ ও তিক্ততা সৃষ্টি, বর্ণবাদের মতো নীতি গ্রহণ এবং বাস্তবায়ন করছিলেন বাইডেনের বক্তব্য এই নীতিরই বিরোধিতা করেছে। যে আমেরিকায় ট্রাম্পের শাসনামলের আগে জাতীয়তাবাদ নিয়ে অশান্ত হতে দেখা যায়নি, এত বিভক্তি সৃষ্টি হয়নি, একটি ভারসাম্যমূলক সমাজব্যবস্থার মধ্য দিয়ে এগিয়েছে এবং সব দলের নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট তা ধরে রেখেছেন, তাই পুনর্নিমান করার কথা বলেছেন বাইডেন। বলা যায়, বাইডেন হারানো ঐতিহ্য ফিরিয়ে এনে যুক্তরাষ্ট্রকে একটি অবিভক্ত সমাজ কাঠামো ও স্থিতিশীলতার মধ্যে এনে আগের ‘গ্রেট’ অবস্থায় ফিরিয়ে আনার কথা বলেছেন, যেখানে সাদা-কালো বিভেদ, ধর্মীয় উগ্রবাদ এবং সকল জাতি- গোষ্ঠীর লোকজনের সহবস্থান ও মিলনমেলা থাকবে। বাইডেন তার বিবৃতির শুরুতে ‘সামনে যে কাজ পড়ে আছে তা সহজ নয়’ বলে যে কথা বলেছেন, তা তাকে বলতে হয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের মৌলিক ও আদি কাঠামো ট্রাম্প কর্তৃক ছিন্নভিন্ন হয়ে যাওয়ার কারণে। তিনি ট্রাম্পকে দোষারোপ না করলেও এ বক্তব্যের মধ্য দিয়ে প্রকারন্তরে সেই কথাটিই প্রতিফলিত হয়েছে। বলা যায়, যুক্তরাষ্ট্রের আদি বৈশিষ্ট্য ফিরিয়ে আনতে বাইডেনকে নতুন করে কাজ শুরু করতে হবে এবং এতে তার সময়ও ক্ষেপণ হবে। কারণ হচ্ছে, ট্রাম্প যুক্তরাষ্ট্রকে পিছিয়ে দিয়েছে। এই পিছিয়ে দেয়া যুক্তরাষ্ট্রকে সামনে এনে আদিরূপে প্রতিষ্ঠা করা অত্যন্ত কঠিন কাজ। এ কাজটি বাইডেনকে যেমন করতে হবে তেমনি বিশ্বে যুক্তরাষ্ট্রের ভাবমর্যাদাকে পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করতে হবে। কারণ, ট্রাম্পের নীতিতে যুক্তরাষ্ট্রের গণতান্ত্রিক যে ধারা ও মূল্যবোধ তা বিশ্বে প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রকে তিনি একটি কর্তৃত্ববাদী শাসকের দেশ হিসেবে পরিচিত করেছেন। সাধারণত গণতন্ত্রের কথা বলতে গিয়ে বিশ্বের অন্যান্য দেশ যুক্তরাষ্ট্রের উদাহরণ দেয় এবং তা ফলো করার চেষ্টা করে। ট্রাম্প এসে এ ধারাটি ভেঙ্গে দেন এবং নিজেকে একজন কর্তৃত্ববাদী শাসক হিসেবে তুলে ধরেন। এর প্রভাব পড়ে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে। ভারত, হাঙ্গেরি, ফিলিপাইন, ব্রাজিলের শাসকরা এতে উদ্বুদ্ধ হয়ে কর্তৃত্ববাদী নীতি গ্রহণ করে। ট্রাম্প যে উগ্র জাতীয়তাবাদ এবং বর্ণবাদী নীতি অবলম্বন করে প্রেসিডেন্ট হয়েছিলেন, তা অক্ষরে অক্ষরে বাস্তবায়ন করেছেন। এতে তার শাসনামালের বেশিরভাগ জুড়েই যুক্তরাষ্ট্র অভ্যন্তরীণ কোন্দলে জড়িয়ে পড়ে। এর মূল কারণ, অভিবাসীবিরোধী এবং ভয়ংকর বর্ণবাদী নীতি। করোনার মধ্যেও ট্রাম্প উস্কানি দিয়ে বর্ণবাদ ছড়িয়ে দেন। এ নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রে ব্যাপক সহিংসতার সৃষ্টি হয়। ব্ল্যাক লাইভস ম্যাটার’ আন্দোলনের সূচনা হয়। এ আন্দোলন দমাতে ট্রাম্প শক্তি প্রয়োগ করার পাশাপাশি নিপীড়ন-নির্যাতনের পথ বেছে নেন। অনেকটা স্বৈরতান্ত্রিক নীতি অবলম্বন করেন। ট্রাম্প মনে করেছিলেন, অশ্বেতাঙ্গদের ওপর এই জুলুম সংখ্যাগরিষ্ঠ শ্বেতাঙ্গরা খুশি হবে এবং তা মেনে নিয়ে পুনরায় তাকে নির্বাচিত করবে। অন্যদিকে বাইডেন যুক্তরাষ্ট্রের গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ এবং বহুজাতির সম্মিলনের কেন্দ্রস্থল হিসেবে পরিচিত আমেরিকার চিরায়ত নীতি অবলম্বন করে নির্বাচনী প্রচার-প্রচারণা চালিয়েছেন। তিনি যুক্তরাষ্ট্রের মৌলিক এই চরিত্র ধরে রাখার প্রয়োজনীয়তার বোধ ভোটারদের মধ্যে জাগাতে সমর্থ্য হয়েছেন। ভোটাররা তা উপলব্ধি করে যুক্তরাষ্ট্রের গণতান্ত্রিক কাঠামো ধরে রাখতেই তাকে বিপুল ভোটে নির্বাচিত করেছেন। এর মধ্য দিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের গণতান্ত্রিক চেতনার বিউটি বা সৌন্দর্য প্রকাশিত হয়েছে। এ সৌন্দর্য থেকে সাময়িক সময়ের জন্য ট্রাম্প তাদের সরিয়ে রাখতে পারলেও তাদের চেতনাকে নিঃশেষ করে দিতে পারেননি। যদি পারতেন, তাহলে তারা তাকেই পুনরায় নির্বাচিত করতেন। এই ভোটারদের চেতনার কথাই প্রকাশিত হয়েছে বাইডেনের বিবৃতির শেষ কথায় যেখানে বলেছেন, ‘আমি প্রতিশ্রæতি দিচ্ছি, আমি সব আমেরিকানের প্রেসিডেন্ট হব। যারা আমাকে ভোট দিয়েছেন এবং যারা দেননি তাদের সবার জন্য আমি সমানভাবে কাজ করব।’
তিন.
ট্রাম্প ক্ষমতায় থাকাকালে যে বিপজ্জনক নীতি নিয়ে এগিয়েছিলেন, তা অনেক দেশই অবলম্বন করতে শুরু করে। বিশেষ করে ভারতের বিজেপি সরকার। বলা হয়, ট্রাম্পের অভিবাসীবিরোধী এবং বর্ণবাদী নীতিতে উদ্বুদ্ধ হয়ে মোদী সরকারও ভারত থেকে মুসলমান উচ্ছেদ, বিতাড়ন এবং ধর্মীয় উন্মাদনামূলক নীতি গ্রহণ করেছে। ট্রাম্প যেমন ‘আমেরিকা ফার্স্ট’ গঠনের নীতি অবলম্বন করেছিলেন, তেমনি ভারতও ‘হিন্দু রাষ্ট্র’ গঠনের নীতি নিয়ে মুসলমানদের নির্মূল করার কাজ চালিয়ে যাচ্ছে। হিন্দু ছাড়া বাংলাদেশসহ প্রতিবেশী দেশগুলো থেকে যাওয়া অভিবাসীদের বিতাড়ন করার উদ্যোগ নিয়েছে। বিতর্কিত নাগরিকত্ব আইন প্রণয়ন করার মধ্য দিয়ে তাদের উচ্ছেদের প্রক্রিয়া চালাচ্ছে। এই আইনের মূল লক্ষ্যই যে ভারতীয় মুসলমানদের নির্মূল ও স্টেটলেস করা, তা ইতোমধ্যে বিশ্লেষকরা বলেছেন। তারা বলছেন, মোদী সরকার ভারতকে হিন্দু রাষ্ট্রে পরিণত করার এমন প্রেরণা পেয়েছে ট্রাম্পের কাছ থেকে। আবার ভারতীয় গণতন্ত্রকে সংকুচিত করে মোদীর কর্তৃত্ববাদী হয়ে উঠার পেছনে ট্রাম্পের নীতি বিশেষ অনুপ্রেরণা দিয়েছে। ফলে এই দুই জনের মধ্যে বেশ সুসম্পর্ক গড়ে উঠে। ভারত তার চিরায়ত সোভিয়েত ঘেঁষা নীতি থেকে সরে যুক্তরাষ্ট্রের দিকে ঝুঁকে পড়ে। সাম্প্রতিক সময়ে উপমহাদেশে চীনের প্রভাব বিস্তার ঠেকাতে দেশটি যুক্তরাষ্ট্রের আরও কাছাকাছি চলে যায়। ইন্দো-প্যাসিফিক কৌশল চুক্তিসহ নতুন সামরিক কৌশলগত ‘বেকা’ চুক্তিও সম্পন্ন করে। মূলত ভারত ও যুক্তরাষ্ট্রের ঘনিষ্ঠতা সৃষ্টি করে ট্রাম্পের নীতি ও কর্তৃত্ববাদী আচরণ। দু’জনের মধ্যে যে মধুর সম্পর্কও গড়ে উঠে তার নমুনা পাওয়া যায় গত বছর সেপ্টেম্বরে মোদীর যুক্তরাষ্ট্র সফরকালে। তাদের সম্পর্ক এতটাই মধুর হয়ে উঠে যে, ট্রাম্প গদগদ হয়ে মোদীকে নিয়ে ‘হাউডি মোদী’ নামে একটি অনুষ্ঠানেরও আয়োজন করে ফেলে। গত বছরের ২২ সেপ্টেম্বর যুক্তরাষ্ট্রের টেক্সাসের হিউস্টনে ‘হাউডি মোদী’ নামক অনুষ্ঠানে প্রায় ৫০ হাজার ভারতীয় বংশোদ্ভ‚ত ও প্রবাসী ভারতীয়ের সামনে ক‚টনৈতিক রীতিনীতি টপকে মোদীও ট্রাম্প বন্দনায় মেতে উঠেন। সমাবেশে তার ভূমিকা হয়ে উঠে ট্রাম্পের নির্বাচনী প্রচারণার মুখপাত্র হিসেবে। সমাবেশে মোদী ‘আব কি বার ট্রাম্প সরকার’ বা ‘আসছে আবার ট্রাম্প সরকার’ স্লােগানে মেতে উঠেন। অনুষ্ঠানের মূল উদ্দেশ্য ছিল, ট্রাম্পকে ভোট দেয়ার জন্য ভারতীয় বংশদ্ভুত ভোটারদের উদ্বুদ্ধ করা। তখন এ নিয়ে অনেক সমালোচনাও হয়েছিল। সেই সমাবেশের ভিডিও এবারের নির্বাচনে প্রচার করে ট্রাম্পের রিপাবলিকান শিবির। ট্রাম্পের পরাজয়ের পর এখন এ নিয়ে খোদ ভারতীয়রাও তুমুল ঠাট্টা-মস্করা শুরু করেছে। মোদী এখানেই থেমে থাকেননি, এ বছরের ফেব্রুয়ারিতে ট্রাম্পের ভারত সফরকালে ‘নমস্তে ট্রাম্প’ নামে এক আসরেরও আয়োজন করেন। ফলে ট্রাম্প ও মোদীর মধ্যে এক ধরনের মাখামাখি সম্পর্কের সৃষ্টি হয় এবং মোদী মনেপ্রাণে চেয়েছিলেন ট্রাম্প যেন আবার ক্ষমতায় আসেন। তার সে আশায় গুঁড়ে বালি পড়েছে। ট্রাম্পের পরাজয়ে অবস্থা বেগতিক দেখে তিনি তড়িঘড়ি করে টুইট করে বাইডেনকে অভিনন্দন জানিয়েছেন। টুইট করে মোদি লেখেন, ‘আশা করি, ভারত ও যুক্তরাষ্ট্র দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ককে আরও উচ্চতায় নিয়ে যেতে একত্রে কাজ করবে। ভারত-যুক্তরাষ্ট্র সম্পর্ক শক্তিশালী করে তুলতে আপনার (বাইডেন ভাইস প্রেসিডেন্ট থাকাকালীন) অবদান গুরুত্বপূর্ণ ও অমূল্য ছিল। এ সম্পর্ককে অন্য উচ্চতায় নিয়ে যাওয়ার জন্য আমি আরও একবার আপনার সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে কাজ করার অপেক্ষায় রয়েছি।’ কূটনৈতিক বিচার-বিশ্লেষণে যে কোনো নির্বাচিত প্রেসিডেন্টকে অভিনন্দন জানানো স্বাভাবিক। তবে ট্রাম্পের পরাজয়ে মোদীর জন্য যে একটু অসুবিধা হয়েছে, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। কারণ, তার আচার-আচরণ এবং নীতিগত দিক থেকে বিশ্বের ক্ষমতাধর রাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প ছিল তার কাছে আদর্শস্বরূপ। ট্রাম্পের ক্রিয়া-কর্মে প্রভাবিত হয়েই ভারত শাসন করার নীতি তিনি গ্রহণ করেছেন। ট্রাম্পের পরাজয়ে তিনি যে কিছুটা হলেও হতাশ হয়েছেন, তা বুঝতে বাকি থাকে না। কারণ, বাইডেনের বক্তব্যে বোঝা গেছে, তিনি ট্রাম্পের তৈরি করা বিভক্ত সমাজ, বর্ণবাদ, অভিবাসীবিরোধী নীতির মতো অগ্রহণযোগ্য নীতি অবলম্বন করবেন না। যুক্তরাষ্ট্রকে তার স্বমহিমায় গড়ে এগিয়ে নেবেন। বাইডেনের এ নীতির সাথে ট্রাম্পের নীতির দ্বারা প্রভাবিত মোদীর নীতির সাথে কোনো মিল নেই। স্বাভাবিকভাবেই মোদীর এ নীতি কিছুটা হলেও হোঁচট খাবে। আর বাইডেন ট্রাম্পের মতো চটজলদি মেজাজ বা চপলমতির মানুষ নন। ট্রাম্পের মতো সকালে এক কথা বিকেলে আরেক কথা বলার স্বভাবও তার নেই। আবার ট্রাম্পের মতো নির্বাচনে যেকোনো উপায়ে জেতার মনসিকতা কিংবা অন্য কাউকে (ট্রাম্প চীনকে নির্বাচনে তাকে জিতিয়ে দেয়ার জন্য বলেছিলেন) নির্বাচনে জিতিয়ে দেয়ার জন্য অনুরোধও করেননি। ফলে তার ব্যক্তিত্ব যে প্রখর, তাতে সন্দেহ নেই। এমন প্রখর ব্যক্তিত্বের প্রেসিডেন্টের সাথে মোদীর পক্ষে তাল মেলানো সহজ হবে না। ট্রাম্পের মতো মোদীকে তোষামদ করে ভারতীয় বংশদ্ভুত ভোটারদের ভোট পাওয়ার জন্য ‘হাউডি মোদী’ বলেও নাচবেন না।
চার.
প্রশ্ন হচ্ছে, ট্রাম্প যদি পুনরায় নির্বাচিত হতেন তাহলে কি হতো? এ প্রশ্নের জবাবে বলা যায়, যুক্তরাষ্ট্রের কপালে যেমন আরও দুর্ভোগ নেমে আসত তেমনি বিশ্বের স্থিতিশীলতা চরমভাবে বিঘ্নিত হতো। কারণ, ‘পাগলা রাজা’ আরও কনফিডেন্ট হতেন এবং কখন কি করে বসতেন, তার কোনো ঠিক ঠিকানা থাকত না। সবচেয়ে বড় ক্ষতি হতো যুক্তরাষ্ট্রের। ট্রাম্পের চার বছরের শাসনামলে যুক্তরাষ্ট্রের সমাজে যে বিভক্তি সৃষ্টি হয়েছে, তা আরও সম্প্রসারিত হতো। এমনকি এই বিভক্তির রেশ ধরে দেশটি যদি ভাঙ্গনের কবলে পড়ত, তাহলেও অবাক হওয়ার কিছু থাকত না। অন্যদিকে ট্রাম্পও আরও বেশি কর্তৃত্ববাদী হয়ে উঠতেন। তার এই কর্তৃত্ববাদে উদ্বুদ্ধ হয়ে বিশ্বের অনেক দেশে একনায়কতন্ত্র কিংবা স্বৈরতন্ত্রের জন্ম হতো। তাতে ট্রাম্পের সমর্থন থাকা বিচিত্র কিছু হতো না। এখন বাইডেনের বিজয়ে দেশে দেশে কর্তৃত্ববাদ ও স্বৈরতন্ত্রের উদ্ভব কিছুটা হলেও হ্রাস পাবে। রুদ্ধ হয়ে পড়া যুক্তরাষ্ট্রের গণতন্ত্রও সজীব হবে। বহুজাতিক দেশ হিসেবে পরিচিত যুক্তরাষ্ট্রের সুনাম যেমন বৃদ্ধি পাবে, তেমনি বাংলাদেশসহ বিশ্বের বহু দেশের অভিবাসীদের বসবাসের সুযোগ সৃষ্টি হবে। সবচেয়ে বড় কথা উগ্রবাদী সাদা-কালো দ্বন্দ্বের লাগাম টেনে ধরা যাবে। আমেরিকাকে প্রকৃত অর্থে গ্রেট বানানোর কথা বাইডেন তার বিজয়ী ভাষণেও বলেছেন। তিনি বলেছেন, ক্ষত সারানোর সময় এখন। বিভাজন নয়, আসুন দেশকে ঐক্যবদ্ধ করি। আমি সবার জন্য সমান সুযোগ নিশ্চিত করতে চাই। লাল-নীল রাষ্ট্র নয়, যুক্তরাষ্ট্রকে গড়তে চাই। বলার অপেক্ষা রাখে না, তার এই ভাষণ যুক্তরাষ্ট্র ও বিশ্বের শান্তি ও স্থিতিশীলতার জন্য খুবই ইতিবাচক ভূমিকা পালন করবে।
[email protected]
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।