Inqilab Logo

রোববার ১৭ নভেম্বর ২০২৪, ০২ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ১৪ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

ক্ষমতার দাপট বন্ধ হবে কি?

তৈমূর আলম খন্দকার | প্রকাশের সময় : ১৩ নভেম্বর, ২০২০, ১২:০৩ এএম

ঘুরেফিরে সরকারি দলের একই কথা: বিএনপির ‘মুরোদ’ নেই, বিএনপি গণতন্ত্রের মুখোশপরা ফেরিওয়ালা, বিএনপিকে বাতি জ্বালিয়ে রাজপথে খুঁজে পাওয়া যায় না প্রভৃতি। সরকারি দলের নেতা ও মন্ত্রীরা আরো অনেক কথাই বলেন। তাদের গায়ে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন বা কোনো আইন আঁচড় কাটে না। অন্যদের ক্ষেত্রে তা অটোমেটিক্যালি প্রযোজ্য হয়ে যায়।

বলা বাহুল্য, বিএনপিকে রাজপথে লাইট দিয়ে খুঁজে না পাওয়া গেলেও দেশবাসী সরকারি দলকে তো মাথার উপরে পাচ্ছে। কোথায় নেই সে দল? সরকারি দলের তুফান সিলেটের এমসি কলেজ থেকে শুরু করে কোথায় নেই? সাম্প্রতিককালে সংঘটিত ধর্ষণ বা গণধর্ষণে কাদের সম্পৃক্ততা পাওয়া যাচ্ছে, তা কি দেশবাসী দেখছে না? নিয়ন্ত্রণে না আনতে পেরে রাষ্ট্রপতি ধর্ষণের শাস্তি মৃত্যুদন্ড ঘোষণা করে অর্ডিন্যান্স নং-৪/২০২০ জারি করেছেন। তারপরও ধর্ষণ-গণধর্ষণ বন্ধ হয়নি। বর্তমানে তো হাওয়া ভবন নেই, তাহলে বিদেশে এখন কারা অর্থ পাচার বা মানিলন্ডারিং করছে? সরকারি এজেন্সির ভাষ্য মতে, ফরিদপুরের ছাত্রলীগ নেতা দুই হাজার কোটি টাকা মানি লন্ডারিং করেছে। ক্ষমতাসীন দলের একজন ছাত্রনেতা এত টাকা পেল কোথায়? কোথায় নেই সরকারি দল? ক্যাসিনো কেলেঙ্কারিতে কারা ধরা পড়েছে? ক্যাসিনো কেলেঙ্কারির হাজার কোটি টাকা কারা মানিলন্ডারিং করল? এ সরকারের সাবেক মন্ত্রী রাশেদ খান মেননের (বর্তমানে এমপি) ভাষ্য মতে, এই সরকারের আমলে ৯ হাজার কোটি টাকা মানিলন্ডারিং হয়েছে। এগুলো কারা করছে, সরকারি উদ্যোগে তারও একটি শ্বেতপত্র প্রকাশ হওয়া দরকার।

বিএনপির ‘মুরোদ’ নেই, কথাটি কোনো রাজনৈতিক ভাষা কি না জানি না, তবে কোনো রাজনীতিবিদের কাছ থেকে যদি রাজনৈতিক অঙ্গনে নতুন শব্দ অনুপ্রবেশ করে, দৃষ্টিকটু হলেও বর্তমানে তাতে কী, কার কী ক্ষতি? এতে ভুক্তভোগী হবে ভবিষ্যৎ প্রজন্ম, কারণ বড় বড় নেতারা যা শেখাবেন প্রজন্ম তো তা-ই অনুসরণ করবে। সব ‘মুরোদ’ ঠেকেছে একটি প্লাটফর্মে। বিএনপিতে একজন পাপিয়া আছে (সাবেক এমপি), তাকে তো ওয়েস্টিন হোটেল পাওয়া যায় না, তাকে পাওয়া যায় সুপ্রিম কোর্টে। ওয়েস্টিন নামক বিলাসবহুল হোটেলে কাদের পাওয়া যায়, মিডিয়ার বদৌলতে তাদের সাথে তো দেশবাসী পরিচিতি লাভ করেছে। ‘ওয়েস্টিন পাপিয়া’র সাথে কারা কারা সম্পর্কিত তা দেশবাসীর অজানা নয়, মিডিয়াতে আদ্যোপান্ত সবই প্রকাশ পেয়েছে।

‘মুরোদ’ওয়ালা নারী-পুরুষ বর্তমানে একটি ছাতার তলে অবস্থান নিয়েছে। বিএনপি মহাসচিব ত্রাণ বিতরণ করতে গিয়েছিলেন, সেখানে মহাসচিবকে শারীরিকভাবে নাজেহাল করা হয়। তার উদোম শরীরও দেশবাসী দেখেছে। একটি বৃহৎ রাজনৈতিক দলের মহাসচিবকে শরীর উদোম করে পেটানোর ক্ষমতা যাদের আছে তাদের ‘মুরোদ’ওয়ালা বলতে হবে? তবে এ ‘মুরোদ’ওয়ালারাই এক সময় দলের বোঝা হয়ে দাঁড়ায়, এদের বেয়াদবিতে সিনিয়র নেতারাও মাঝে মধ্যে বিরক্ত হয়ে পড়েন, শ্রদ্ধাভাজন সিনিয়র নেত্রী সাজেদা চৌধুরী কাকে উদ্দেশ্য করে প্রকাশ্যেই ‘বেয়াদব’ বলতে বাধ্য হয়েছিলেন?

হাজী সেলিমের কথিত জনপ্রিয়তার কথা মানুষ শুনেছে, তার পুত্র কাউন্সিলর নির্বাচিত হওয়ার কথাও মানুষ জেনেছে। এখন তো জানতে পারছে তিনি কত সহস্র্র কোটি টাকার সরকারি-বেসরকারি সম্পত্তি অবৈধভাবে দখল করেছেন এবং চাঁদাবাজির এখন তিনি কত বড় সম্র্রাট। হাজী সেলিম কোন ক্ষমতাবলে এত শত কোটি টাকার সম্পত্তির মালিক হয়েছেন তা-ও দেশবাসী দেখতে পেল। ১৪৭টি খুনের অভিযোগ থাকলেও টেকনাফের কারাবন্দি ওসি প্রদীপের প্রমোশন হয়েছে বলে পত্রিকায় দেখেছি। এ প্রমোশন কি জনগণকে বৃদ্ধাঙুলি দেখানোর নামান্তর নয়?

সরকারি মেগা প্রজেক্টের মেগা চুরির সংবাদ তো প্রতিদিনই পত্রিকায় প্রকাশ পাচ্ছে। মাটির নিচে টাকা, বস্তার মধ্যে টাকা, সিন্দুকের মধ্যে টাকা আর এসব টাকা কাদের কাছে পাওয়া যাচ্ছে? এরাও কি বিএনপি করে? সরকারি দলের দাপটে এখন বিএনপি ঘরোয়া পরিবেশেও কোনো পারিবারিক অনুষ্ঠান পালন করতে পারে না। বন্ধুর জন্মদিন উপলক্ষে দেশনেত্রী খালেদা জিয়ার সুস্থতার জন্য দোয়া এবং দুস্থদের বস্ত্র বিতরণ অনুষ্ঠানে গত ১৯ অক্টোবর নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জ উপজেলার রূপসী খন্দকার বাড়িতে গিয়েছিলেন জাতীয় নেতা ও নাগরিক ঐক্যের আহবায়ক মাহমুদুর রহমান মান্না। সেখানে স্থানীয় এমপির নেতৃত্বাধীন সরকারি ‘রাম দা বাহিনী’ মান্নাকে আক্রমণ ও ৪০ জনকে আহত করে স্টেজ, চেয়ার, মাইক, সাউন্ডবক্স ভাঙচুর করে সামাজিক ঘরোয়া অনুষ্ঠানকে পন্ড করে দেয়। রামদা বাহিনী থানা পুলিশকে নিয়ন্ত্রণ করে। ওই দিন সন্ধ্যা ৬টার খবরে প্রতিটি মিডিয়ায় মান্নার আহত হওয়ার খবর প্রকাশিত হলেও সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে রাত ৯টায় রূপগঞ্জ থানার ওসি বলেন, ‘আমি ঘটনা শুনিনি’। একে অপরের দোসর হয়ে যখন কাজ করেন, তখন প্রশাসনে বা আইনশৃঙ্খলা রক্ষার দায়িত্বে নিয়োজিত কর্মকর্তারা অনুরূপ কথাই বলেন, যা শুনতে দেশবাসী অভ্যস্ত। তবে এর ব্যতিক্রম তো অবশ্যই আছে। যখন ‘ক্ষমতা’ বনাম ‘ক্ষমতা’ (অর্থাৎ উভয় পক্ষ যখন সরকারি হয়) টক্কর লাগে তখন আইন তার নিজস্ব গতিতে চলে। বরং একটু বেশি চলে। তখন ‘শ্যাম রাখি না কুল রাখি’ সমস্যায় পড়েন অনেকে। যেমন- ২৬ অক্টোবর নৌবাহিনীর কর্মকর্তা ও তার স্ত্রীকে মারধরের অভিযোগে গ্রেফতার হয়েছেন সরকারদলীয় প্রভাবশালী এমপিপুত্র যিনি নিজেও দক্ষিণ ঢাকার একজন নির্বাচিত কাউন্সিলর। অনুরূপ ঘটনা যদি এমপিপুত্রের সাথে আমার/আপনার হতো তবে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কর্তাব্যক্তিরা বলতেন, ‘কই, কোথায় এ ঘটনা ঘটেছে, আমরা তো তা শুনিনি।’ তখন এমপি বা এমপিপুত্রের বিরুদ্ধে আইন প্রয়োগ দূরের কথা, অভিযোগ করলে বরং উল্টো হয়রানি হতো। এসব ঘটনাই প্রমাণ করে, স্বাধীনতার সুফল একমাত্র ক্ষমতাসীনদের পকেটে। রাষ্ট্র যখন কারো কারো পকেটস্থ হয়ে যায়, তখন গরিব আরো গরিব এবং ধনীরা আরো বিত্তশালী হতে থাকে, দেশে অনাচার বৃদ্ধি পায়, আইনশৃঙ্খলা মুখ থুবড়ে পড়ে। বস্তুনিষ্ঠ সমালোচনার পরিবর্তে ব্যক্তির চাটুকারী চলতে থাকে, বাংলাদেশে এখন সে অবস্থাই বিরাজ করছে।

বিরোধী দলকে তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করলে এর পরিণাম কী হয় তা প্রজ্ঞাবান রাজনীতিকদের অজানা থাকার কথা নয়। ক্ষমতাসীনরা বিএনপির ঠিকানা করেছে এখন জেলখানায়। হাজার হাজার নেতাকর্মী সরকারসৃষ্ট ‘গায়েবি’ মামলায় জেল খাটছেন, নিরাপত্তাহীনতায় নিজ এলাকায় থাকতে না পারার কারণে অনেক নেতাকর্মী ঢাকা শহরে রিকশা চালিয়ে, হোটেলে বাবুর্চির কাজ করে জীবিকা নির্বাহ করছেন। সরকারি দল স্থানীয়ভাবে বিএনপির জমি ও ব্যবসায়-বাণিজ্য দখল করে নেয়ায় বেকারত্বের কষাঘাতে অনেকে রাস্তায় রাস্তায় ঘুরছে। বাংলাদেশের প্রতিটি থানায় কতটি গায়েবি মামলা হয়েছে তা অনুসন্ধান করলেই বিএনপির ঠিকানা এখন কোথায় তা যে কেউ জানতে পারবেন।

প্রধানমন্ত্রীর নিষেধাজ্ঞা থাকা সত্তে¡¡ও ভূমিদস্যুরা, ব্যাংক লুটেরা তিন ফসলি জমি বালু দিয়ে ভরাট করে পরিবেশকে ধ্বংস করছে। কিন্তু স্থানীয় প্রশাসন উচ্চ আদালতের নির্দেশ কার্যকর করছে না। এটা কিসের আলামত? একটি রাষ্ট্রে কি এভাবে ভূমিদস্যুতা হতে পারে, যেমনটি চলছে রাজধানীর আশপাশে বিশেষ করে রূপগঞ্জ উপজেলায়। সবারই বিবেচনা থাকা দরকার, এ পৃথিবী থেকে আমরা সবাই চলে যাবো, তবে আমাদের কর্ম ভবিষ্যৎ প্রজন্মের মন মগজে এবং কথাবার্তা ইথারে ভাসতে থাকবে। আমাদের কর্ম ও কথাবার্তার ওপরই ভবিষ্যৎ প্রজন্ম আমাদের মূল্যায়ন করবে। ‘ক্ষমতা’ ও ‘ইতিহাসের পাতা’ পরস্পর সম্পর্কযুক্ত হলেও ইতিহাসে মুদ্রাক্ষরে লেখাগুলো অনেক সময় অনেক নির্মম হয়, যা ক্ষমতায় থাকলে বোঝা যায় না। ক্ষমতার দাপটে আমরা যেন ইতিহাসের আঁস্তাকুড়ে না পড়ি, এ জন্য সবার সচেতন থাকা আবশ্যক, নতুবা আঁস্তাকুড় বেশি দূরে নয়।
লেখক: রাজনীতিক, কলামিস্ট ও আইনজীবী



 

Show all comments
  • Monnaf ১৩ নভেম্বর, ২০২০, ১২:২৪ এএম says : 0
    স্বাধীনতার দেশে আজ পরাধীনতার গ্লানি । জানি না কবে এদেশ আবার স্বাধীনতা ফিরে পাবে
    Total Reply(0) Reply
  • Jack Ali ১৩ নভেম্বর, ২০২০, ৪:৪০ পিএম says : 0
    O'Muslim fight for the right of Allah the way our Beloved Prophet and his Four rightly Guided Caliph.. We must establish our Creator Law Who created from despised water.
    Total Reply(0) Reply

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: ক্ষমতা

১৩ ফেব্রুয়ারি, ২০২৩

আরও
আরও পড়ুন