Inqilab Logo

শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

রসুল (সা.)-এর আগমন সম্পর্কে বাদশাহর অদ্ভুত স্বপ্ন ও নারী জাদুকরের ব্যাখ্যা

খালেদ সাইফুল্লাহ সিদ্দিকী | প্রকাশের সময় : ৬ নভেম্বর, ২০২০, ১২:১৬ এএম

নিদ্রা অবস্থায় অজানা, অদৃশ্য জগতে বিচরণ করা, কল্পিত-অকল্পিত দৃশ্যাবলী অবলোকন করা এবং নানা অদ্ভুত অবস্থা-পরিস্থিতির মুখোমুখি হওয়া ইত্যাদি স্বপ্ন জগতের ব্যাপার। দেখা বা অনুভূত হওয়া অধিকাংশ বিষয় অবাস্তব, নিদ্রাভঙ্গের সাথেই বিলীন হয়ে যায়। কেউ হয়তো স্মৃতিতে পুরোটা ধরে রাখতে পারেন, কারো আংশিক বা কিছুই মনে থাকে না। আম্বিয়ায়ে কেরাম ও আল্লাহর প্রিয় বান্দাদের কথা বাদ দিলে দুনিয়ার রাজা-বাদশাহ থেকে আরম্ভ করে সর্বস্তরের লোকদের ক্ষেত্রে বিষয়টি প্রযোজ্য এবং সকল যুগে, সকল দেশে, সকল সমাজে স্বপ্নের ক্ষেত্রে একই অবস্থা এবং একই পরিস্থিতি লক্ষ করা যায়। এখানে আমরা প্রাচীনকালের এক বাদশাহর অদ্ভুত স্বপ্নের উল্লেখ করতে চাই। স্বপ্নদ্রষ্টা বাদশাহর বিস্তৃত স্বপ্নের বিষয়বস্তু উদ্ঘাটন করা আরেকটি অভাবনীয়, বিস্ময়কর ঘটনা। এ স্বপ্নটির বিষয়বস্তু তথা ব্যাখ্যায় নানা বিষয়ের মধ্যে সর্বশেষ নবী হজরত মোহাম্মদ (সা.) এর আবির্ভাবের ভবিষ্যদ্বাণী নিহিত, তাঁর জন্মেরও বহুকাল পূর্বের কথা।

বাদশাহ মোরছেদ ইবনে আবি উবায় কেলালের অদ্ভুত স্বপ্ন:
ইয়েমেনে সাবা হিমিয়ার বংশের লোকেরা একাধারে দুই হাজার বছর রাজত্ব করে। সব দিক দিয়ে তারা চরম উন্নতি করেছিল। ইতিহাসখ্যাত সাবার রাণী বিলকিসের কাহিনী কোরআনের সূরা নমলে হজরত সুলায়মান (আ.)-এর প্রসঙ্গে বিশদভাবে উল্লেখিত হয়েছে। মোরছেদ ইবনে আবি উবায় (মতান্তরে আবেদ) কেলাল ছিলেন হিমিয়ার বংশের শেষ দিকের বাদশাহ। তার সময় থেকে এ বংশের পতন দেখা দেয়। তাঁর একটি ভুলে যাওয়া স্বপ্ন কাহিনী ও তার ব্যাখ্যা সংক্ষেপে নিম্নরূপ:

বিভিন্ন গ্রন্থের বর্ণনা অনুযায়ী, বাদশাহ একবার ভীতিকর স্বপ্ন দেখেন, নিদ্রাভঙ্গের পর তিনি খুব বিচলিত ও উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েন, ততক্ষণে স্বপ্নে দেখা সবকিছু ভুলে যান। এবার তিনি একটি যুদ্ধ জয়ের ফলে যে আনন্দিত হতে পেরেছিলেন তা সম্পূর্ণ বিলীন হয়ে যাওয়ায় আরো ব্যথিত ও মর্মাহত হয়ে পড়েন। এ হারিয়ে যাওয়া স্বপ্ন পুনরুদ্ধারের জন্য সমস্ত স্বপ্ন বিশারদ, ভবিষ্যদ্বক্তা, নক্ষত্রবিদ এবং যাদুকর, গণক প্রভৃতিকে সমবেত করেন এবং বিস্মৃত স্বপ্নের বিষয়বস্তু কী ছিল তা বলার আহবান জানান সবাইকে। কিন্তু কেউই এ অসাধ্য সাধনে প্রস্তুত হলেন না। বাদশাহ মোরছেদের মাতাও ছিলেন একজন ‘কাহেনা’ বা নক্ষত্রবিদ নারী। তিনিও অপারগতা প্রকাশ করলেন এবং পরামর্শ দিলেন অন্যান্য ‘কাহেনা’ নারীদের নিকট সমস্যাটি উত্থাপন করতে। যথারীতি বিষয়টি সম্পর্কে ‘কাহেনা’ নারীদের সামনে তুলে ধরা হলো এবং তারাও সমাধান দিতে ব্যর্থ হলেন। বাদশাহর হারানো স্বপ্ন পুনরুদ্ধারে সবার ব্যর্থতা দেখে তিনি আরো নিরাশ হয়ে পড়েন।

অতঃপর এক সুন্দরী রমণীর সাথে বাদশহার দেখা হয়। তিনি শিকারে গিয়েছিলেন, প্রত্যাবর্তণের পথে তার সাথে সাক্ষাৎ হয়। বাদশাহকে ক্লান্ত দেখে রমণী তার খুব সমাদার ও উত্তম প্রকারের খাবার ও দুধের শরবত দ্বারা আপ্যায়ন করেন। বাদশাহ তার ঐ উত্তম আচরণে মুগ্ধ হন। প্রথম পরিচয়ে আপ্যায়নে রমণী মোরছাদকে বাদশাহ হিসেবে সম্বোধন করেছিলেন, এ কথা তাঁর মনে ছিল। তিনি জিজ্ঞাসা করলেন, ‘তোমার নাম কী?’ জবাবে রমণী বললেন, ‘আমার নাম আফিরা।’ বাদশাহ বললেন, ‘হে আফিরা! তুমি আমাকে বাদশাহ বলেছ, এর দ্বারা তুমি কোন বাদশাহকে বুঝিয়েছ?’ মহিলা বললেন, ‘আমার উদ্দেশ্য মোরছেদ ইবনে আবি কেলাল, যিনি আমার সামনে, যার সাথে আমি কথা বলছি এবং যিনি একটি জটিল সমস্যার সম্মুখীন হয়ে কাহেনদেরকে দাওয়াত করেছিলেন এবং তার সমাধান দিতে তারা সবাই ব্যর্থ হয়েছেন।’

বাদশাহ জানতে চাইলেন, ‘তুমি কি এ জটিল সমস্যাটি অবগত আছ?’ মহিলা বললেন, ‘তা একটি স্বপ্ন’; বাদশাহ তাকে উদ্দেশ্য করে বললেন, ‘তুমি সত্য বলেছ, আমি কী স্বপ্ন দেখেছিলাম তার বর্ণনা কর।’ মহিলা বাদশাহর স্বপ্ন অবিকল বলে দিলেন এবং বললেন, ‘আপনি স্বপ্নে দেখেছিলেন, তীব্র বাতাস বইছিল এবং বাতাসের ঝাপটা একটার পর একটা ধেয়ে আসছিল এবং নিকটে নদী প্রবাহিত ছিল, আর সেখানে কেউ দাঁড়িয়ে ছিল এবং ঘণ্টার শব্দের আকারে বলছিল, নদীর নিকটে ঘাটে এসে পড়। তখন নদী হতে যে পানি পান করেছে, সে তৃপ্ত হয়েছে এবং যে অস্বীকার করেছে সে ডুবে মরেছে।’

বাদশাহ শুনে বললেন, ‘স্বপ্নে আমি এটাই দেখেছিলাম, হে আফিরা! এ স্বপ্নের ব্যাখ্যা বল।’ মহিলাটি ব্যাখ্যা বলতে আরম্ভ করলেন। স্বপ্নে প্রদর্শিত কয়েকটি বিশেষ শব্দ ব্যবহৃত হয়েছিল। যার একটি অর্থ ছিল ‘হজরত মোহাম্মদ (সা.)’। আফিরার মুখে এ কথা শুনে বাদশাহ বললেন, ‘এ নবী শান্তি ও নিরাপত্তা বিস্তার করবেন, অথবা যুদ্ধ বিগ্রহে লিপ্ত থাকবেন?’ আফিরা জবাবে বললেন, ‘আল্লাহর কসম! সে পয়গম্বর শান্তি ও নিরাপত্তা বিস্তার করবেন এবং দুনিয়া হতে যুদ্ধ বিগ্রহ এবং ঝগড়া-ফ্যাসাদের অবসান ঘটাবেন এবং বন্দিদেরকে মুক্ত করবেন।’

বাদশাহ জিজ্ঞাসা করলেন, ‘তিনি মানুষকে কিসের দিকে আহবান জানাবেন?’ আফিরা বললেন, ‘নামাজ রোজার দিকে আহবান জানাবেন, আত্মীয়সুলভ আচরণের শিক্ষা দিবেন, মূর্তিপূজা নিষিদ্ধ করবেন এবং জুয়ার তীর দ্বারা ভাগ্য নির্ধারণ করাকে নিষেধ করবেন।’ বাদশাহ আবার জিজ্ঞাসা করলেন, ‘তিনি কোন বংশে জন্মগ্রহণ করবেন?’ আফিরা বললেন, ‘তিনি মুযার ইবনে নিযার বংশে জন্মগ্রহণ করবেন এবং তাঁর মহান অস্তিত্বের বদওলতে এ গোত্র খ্যাতি লাভ করবে এবং তিনি বংশগত ঐতিহ্যাবলীকে সমুজ্জ্বল করার কারণ হবেন।’ বাদশাহ জিজ্ঞাসা করলেন, ‘যখন তার কওম হামলা করবে তখন তাঁর সাহায্যকারী হবে কারা?’ আফিরা জবাব দিলেন, ‘তাঁর সাহায্যকারী হবে বিহঙ্গকুল এবং পবিত্র আত্মাসমূহ তাঁর সঙ্গে জেহাদ করবে এবং তাদের মাধ্যমে কোফরের মহলগুলোতে ব্যাকুলতা ও অস্থিরতা ছড়িয়ে পড়বে এবং এ পয়গম্বরের পক্ষে পূর্ণ সাহায্য করবে।’ বাদশাহ আফিরার এসব জবাব শুনে তাকে নিকাহ করার বিষয়ে চিন্তা ভাবনা করতে লাগলেন। আফিরা তার মনোভাব আঁচ করতে পেরে বললেন, ‘আমি আপনার সাথে নিকাহ সূত্রে আবদ্ধ হতে প্রস্তুত নই। কেননা আমার অনুসারীকে মান-মর্যাদার ক্ষেত্রে ঈর্ষাপরায়ণ সাহসী হতে হবে এবং আমার বিষয়গুলোতে অত্যন্ত ধৈর্যশীল হতে হবে। আমার প্রতি যে আসক্ত হবে, তার ধ্বংস অনিবার্য।’ এসব কথা শুনে বাদশাহ মোরছেদ ইবনে আবি উবায়দ কেলাল তাঁর প্রাসাদে প্রত্যাবর্তণ করেন এবং আফিরার জন্য উপহার সামগ্রী হিসেবে একশ’ উটসহ অন্যান্য দ্রব্যের এক বিশাল ভান্ডার প্রেরণ করেন।

এ অদ্ভুত স্বপ্ন কাহিনীর ব্যাখ্যায় অপরিচিত পরম সুন্দরী, যাদুকর রমণী আফিরার সঠিক পরিচয় পাওয়া জায়নি। সে প্রকৃতই কি মানবী ছিলেন নাকি জি¦ন এ প্রশ্নটি থেকে যায়। রাজার স্বপ্ন ব্যাখ্যা করতে গিয়ে মহানবী হজরত মোহাম্মদ (সা.)-এর আবির্ভাব ও তাঁর শিক্ষা সম্পর্কে যে সব গুরুত্বপূর্ণ কথা আফিরা বলেছেন, তা রীতিমতো অদ্ভুত ও বিস্ময়কর। বস্তুত মহানবী (সা.)-এর আবির্ভাব সম্পর্কে সে প্রাচীন যুগেও মনীষীরা বহু ভবিষ্যদ্বাণী করে গেছেন। আসমানী গ্রন্থগুলো তো বটেই, অন্যান্যভাবেও তাঁর আগমন বার্তা তাঁর মোযেযা স্বরূপ।



 

Show all comments
  • মোঃ ফিরোজ খান ১৭ ডিসেম্বর, ২০২০, ১০:৩৫ পিএম says : 0
    সম্পর্ক মোঃ ফিরোজ খান সৃষ্টি থেকেই মানুষের মধ্যে সম্পর্ক বিরাজমান সম্পর্ক মহান আল্লাহর কাছ থেকে পাওয়া সবার তবুও মানুষের মাঝে সম্পর্ক নিয়ে ভেদাভেদ হয় কেউ অহংকার করে অর্থ সম্পদের বড়ই করে। সম্পর্কের বাঁধনে আবদ্ধ একজন নারী ও পুরুষ যে সম্পর্ক কোরআন শরীফে লেখা স্পষ্টভাবে আল্লাহ নারী পুরুষকে মধুর সম্পর্কে বেঁঁধেছেন আমরা তবুও এই সম্পর্কের মূল‍্যায়ন করিনা। সংসার জীবনে স্বামী স্ত্রী দুজনে ঝগড়া হয় সৃষ্টি থেকেই চলে আসছে এক‌ই নিয়ম মেনে আবার স্বামী স্ত্রী ঝগড়া ভুলে গিয়ে একত্রিয হয় ঝগড়া থেকে দুজনকে মধুর সম্পর্ক গড়তে হয়। ঝগড়া থেকে ভালোবাসার বেড়ে যায় সহজে পূণরায় সম্পর্কে আবদ্ধ হন দুজনে মিলে মিশে ঝগড়া ভুলে ভালোবাসার হাত বারিয়ে দিতে হয় স্বামী স্ত্রী দুজনের একজনে দোষ বেশি করে। বেশি রাগ করে থাকতে নেই অন্য একজনকে রাগ ভুলে ভালোবাসা দিতে হয় সংসার জীবনে কোরআন শরীফে লেখা আছে স্পষ্টভাবে কোরআন মেনে দুজনকে সংসার চালাতে হয়।
    Total Reply(0) Reply

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

আরও পড়ুন