পবিত্র লাইলাতুল বরাত
আজ দিবাগত রাত পবিত্র লাইলাতুল বরাত। পরম করুণাময় আল্লাহতায়ালা তার বান্দাদের গুনাহ মাফ, বিপদমুক্তি ও
আমি আগেই এই কলামে একাধিকবার বলেছি এবং আজও বলছি যে, বিশ্ব রাজনীতির দৃশ্যপট অকস্মাৎ বদলে গেছে এবং সেখানেই বাংলাদেশে একটি গুরুত্বপূর্ণ অবস্থানে চলে গেছে। বস্তুত এই দৃশ্যপট বদলানোর প্রক্রিয়া শুরু হয়েছিল ২০/২২ বছর আগে। কিন্তু প্রক্রিয়াটি গতি সঞ্চার করেছে প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের ক্ষমতা গ্রহণের পর। এই প্রক্রিয়াটি একটি কংক্রিট রূপ পরিগ্রহ করেছে গত ২৭ অক্টোবর মঙ্গলবার। তার আগের দিন অর্থাৎ ২৬ অক্টোবর সোমবার প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের পরই যে দুই ব্যক্তি অত্যন্ত ক্ষমতাধর তারা ভারতের রাজধানী নয়াদিল্লী আগমন করেন। এরা হলেন, পররাষ্ট্রমন্ত্রী মাইক পম্পেও এবং প্রতিরক্ষামন্ত্রী মার্ক এসপার। পরদিন ২৭ অক্টোবর মঙ্গলবার আমেরিকার এই দুই শীর্ষ মন্ত্রী ভারতের দুই শীর্ষ মন্ত্রীর সাথে এক ঘণ্টা বৈঠক করেন। এরা হলেন ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী শুব্রামানিয়ম জয়শংকর এবং প্রতিরক্ষামন্ত্রী রাজনাথ সিং। সুব্রামানিয়াম জয় শংকর ইন্ডিয়ান ফরেন সার্ভিস থেকে আগত। ভারতীয় ফরেন সার্ভিসে সুব্রমানিয়মকে একজন জিনিয়াস হিসেবে ধরা হয়। ‘টাইমস অফ ইন্ডিয়া’, ‘হিন্দুস্তান টাইমস’ এবং ‘দি হিন্দু’ দৈনিকের কয়েকজন খ্যাতিমান কলামিস্টের কলাম পড়ে আমার ধারণা হয়েছে যে, মি. জয়শংকর প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির অত্যন্ত আস্থাভাজন একজন ব্যক্তি। তিনি ভারতের পররাষ্ট্রনীতি প্রণয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকেন। মি. রাজনাথ সিং মন্ত্রিত্ব গ্রহণের আগে বিজেপির প্রেসিডেন্ট ছিলেন। ভারত এবং আমেরিকার এই বৈঠককে বলা হয়েছে, ‘টু প্লাস টু’। এই বৈঠকের পর ভারত এবং আমেরিকা একটি সামরিক চুক্তি স্বাক্ষর করে। এই চুক্তির নাম ‘বেসিক এক্সচেইঞ্জ অ্যান্ড কোঅপারেটিভ এগ্রিমেন্ট’। সংক্ষেপে ‘বেকা’। গত ২৮ অক্টোবর বুধবার বাংলাদেশের ইংরেজি দৈনিক ‘দি ডেইলি স্টার’ এটিকে একটি নতুন সামরিক চুক্তি (নিউ ডিফেন্স প্যাক্ট) বলে আখ্যায়িত করেছে।
এই চুক্তিটি এমন সময় স্বাক্ষরিত হলো যখন হিমালয় অঞ্চলের বিস্তৃত পরিসরে চীনের সাথে ভারতের বিরোধ চরম আকার ধারণ করেছে। যখন ভারত মহাসাগরের কর্তৃত্ব নিয়ে আমেরিকা ও ভারতের সাথে চীনের বিরোধ। মার্কিন অস্ত্রভান্ডার থেকে সর্বাধিক প্রযুক্তিসম্পন্ন সর্বাধুনিক মার্কিন অস্ত্র ভারতে সরবরাহ করা হবে। এটি এই চুক্তির অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি দিক। কিন্তু তার চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ যে বিষয়টি বিশেষজ্ঞদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে সেটি হল, সামরিক ও কৌশলগত তথ্য বিনিময়। এই ডিফেন্স প্যাক্ট মোতাবেক সর্বাধুনিক প্রযুক্তি সম্পন্ন মার্কিন গোয়েন্দা উপগ্রহ হিমালয় অঞ্চলে চীনা সৈন্য ও সমরাস্ত্রের গতিবিধি নজরে রাখবে এবং চীনা গতিবিধির ছবি প্রতি মুহূর্তে ভারতের কাছে সরবরাহ করবে। উপগ্রহ থেকে গৃহীত এসব ছবি আমেরিকা ভারতকে সরবরাহ করবে। এসব গোয়েন্দা তথ্য পর্যবেক্ষণ করে ভারত চীনকে মোকাবেলা করার জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করবে। এই চুক্তিতে আরো যে বিষয়টি নিরাপত্তা বিশ্লেষকদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে সেটি হল, প্রয়োজন হলে আমেরিকা ভারতের পাশে দাঁড়িয়ে এই হুমকি মোকাবেলা করবে।
টু প্লাস টু বৈঠক থেকে বেরিয়ে মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী মাইক পম্পেও ঘোষণা করেন যে, চীনের কমিউনিস্ট পার্টি গণতন্ত্রের কোন বন্ধু নয়। এই নতুন প্রতিরক্ষা চুক্তি দুই বন্ধুরাষ্ট্রের সামরিক বাহিনীর মধ্যে সহযোগিতা বৃদ্ধি করবে।
দুই
মার্কিন প্রতিরক্ষামন্ত্রী মার্ক এসপার বলেন, আমেরিকা ভারতের কাছে আরও অধিক সংখ্যক ড্রোন ও জঙ্গী বিমান বিক্রি করবে। আকাশপথে ক্ষেপণাস্ত্র ধ্বংস করা এবং সশস্ত্র ড্রোনকে আক্রমণ করার জন্য যে সামুদ্রিক এবং বৈমানিক তথ্য প্রয়োজন সেগুলোও ভারতকে সরবরাহ করা হবে। মার্কিন প্রতিরক্ষামন্ত্রী আরো বলেন যে, আমেরিকা ভারতকে যে সমস্ত জঙ্গি বিমান বিক্রি করবে সেগুলোতে প্রযুক্তিগতভাবে অগ্রসর নেভিগেশনাল সুযোগ সুবিধা থাকবে।
‘বেকা’ সামরিক চুক্তির মাধ্যমে ভারত দুই দেশের সামরিক সহযোগিতার চারটি স্তর পূরণ করল। প্রথমে ২০০২ সালে তারা যে চুক্তিটি স্বাক্ষর করে সেটি হল ‘জেনারেল সিকিউরিটি অব মিলিটারি এগ্রিমেন্ট’। অর্থাৎ সামরিক তথ্যপ্রযুক্তির নিরাপত্তা বিধান। এর মাধ্যমে সামরিক সহযোগিতার ক্ষেত্রে যেসব গুরুত্বপূর্ণ তথ্য বিনিময় হবে তার গোপনীয়তা ও নিশ্চয়তা বিধান। এরপর ১৪ বছর আমেরিকা ও ভারতের মধ্যে সামরিক সহযোগিতার গতি অত্যন্ত মন্থর হয়ে পড়ে।
কিন্তু ২০১৬ সালে ইন্দো-মার্কিন সামরিক সহযোগিতা গতি লাভ করে। প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প ক্ষমতা গ্রহণের পর ভারতকে আমেরিকার প্রতিরক্ষার অংশীদার হিসাবে ঘোষণা করা হয়। এর মাধ্যমে ট্রান্সফার অব টেকনোলজি বা প্রযুক্তি হস্তান্তরের পথ খুলে যায়। একই বছর আরেকটি চুক্তির মাধ্যমে দুই দেশের সামরিক সহযোগিতার ক্ষেত্রে একটি বড় অগ্রগতি সাধিত হয়। এই চুক্তির নাম ‘লজিস্টিকস এক্সচেঞ্জ মেমোরেন্ডাম অব এগ্রিমেন্ট’। এই চুক্তির মাধ্যমে উভয় দেশের সামরিক ঘাঁটিসমূহে তাদের সমরাস্ত্রের মেরামত ও অন্যান্য আনুষঙ্গিক কর্ম সম্পাদনের ব্যবস্থা করা হয়।
২০১৮ সালে আরেকটি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। এটির নাম হল ‘কমিউনিকেশনস কম্পাটিবিলিটি এ্যান্ড সিকিউরিটি এগ্রিমেন্ট’। এই চুক্তির মাধ্যমে আমেরিকা থেকে ভারতের কাছে সর্বোচ্চ স্তরের প্রযুক্তি (হাই এন্ড টেকনোলজি) বিক্রির ব্যবস্থা করা হয়।
সব শেষে স্বাক্ষরিত হলো এই সেদিন অর্থাৎ ২০২০ সালের ২৭ অক্টোবর মঙ্গলবার ‘বেকা’ নামক সামরিক চুক্তি।
তিন
প্রশ্ন উঠতে পারে যে আজ মঙ্গলবার মার্কিন সময় ৩ নভেম্বর এবং বাংলাদেশ সময় ৪ নভেম্বর মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচন অনুষ্ঠিত হচ্ছে। কে প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হবেন সেটি একদিন পরেই পরিষ্কার হয়ে যাবে। সর্বশেষ প্রাক নির্বাচনী জরিপ থেকে দেখা যায় যে, জো বাইডেন জনমতের দৌড়ে ট্রাম্পের চেয়ে ৮ পয়েন্ট এগিয়ে। যদি জো বাইডেন নির্বাচিত হন তাহলে তিনি কি এই সামরিক চুক্তি মেনে চলবেন? এখানে আরো একটি বড় প্রশ্ন ওঠে। সেটা হলো এই যে, নির্বাচনের মাত্র ৭ দিন আগে ট্রাম্প প্রশাসন এত বড় এবং এত গুরুত্বপূর্ণ একটি চুক্তি করলেন কিভাবে? এর ভবিষ্যৎ কি তিনি চিন্তা করেননি?
এই প্রশ্নের উত্তর দেওয়া সহজ নয়। তবে বড় বড় ও শক্তিশালী দেশে রাষ্ট্রের মধ্যে আরেকটি রাষ্ট্র থাকে। এটিকে বলা হয় ‘ডিপ স্টেট’। রাষ্ট্রের গোয়েন্দা সংস্থা, শীর্ষস্থানীয় মিলিটারি অফিসার, পররাষ্ট্রমন্ত্রণালয়ের শীর্ষ অফিসার - এরা থাকেন এই ডিপ স্টেটে। এটি কোন অফিশিয়াল প্রতিষ্ঠান নয়, অথবা রাষ্ট্রের কোন অফিশিয়াল শাখাও নয়। আমেরিকাতে পেন্টাগন (প্রতিরক্ষামন্ত্রণালয়), পররাষ্ট্রমন্ত্রণালয়, হোম ল্যান্ড সিকিউরিটি এসবের অঘোষিত শীর্ষ কর্মকর্তা বিদেশনীতি ও প্রতিরক্ষানীতি যেভাবে নির্ধারণ করেন সেভাবেই রাষ্ট্র পরিচালিত হয়ে থাকে। রাজনৈতিক নেতৃত্বও নীরবে সেটি মেনে নেয়। ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থা ‘র’, মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থা সি আই এ, রুশ গোয়েন্দা সংস্থা কে জি বি, ইসরাইলি গোয়েন্দা সংস্থা মোসাদ - এই ডিপ স্টেটে বড় ভূমিকা পালন করে। বেকা নামের ইন্দো-মার্কিন সামরিক চুক্তি যদি উভয় দেশের ডিপ স্টেটের মস্তিষ্কজাত ফসল হয়ে থাকে তাহলে বেকা বাইডেনের আমলেও কার্যকর থাকবে।
বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর ২৫ বছর মেয়াদে বাংলা ভারত চুক্তি হয়। সমস্ত বিরোধী দল এবং সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণ এই চুক্তির বিরোধিতা করে। বাংলাদেশের স্বাধীনতার সাড়ে তিন বছর পর যে সব সরকার আসে তারাও এই চুক্তির বিরোধী ছিলো। কিন্তু তারপরেও ২৫ বছর ধরেই চুক্তিটি বলবৎ ছিল, যদিও মৃতবত অবস্থায়। ‘বেকার’ ভাগ্যে কি ঘটবে সেটা এখন বলা যায় না।
চার
গত রবিবার ১ নভেম্বর ‘দৈনিক ইনকিলাবের’ প্রথম পৃষ্ঠায় একটি উদ্বেগজনক সংবাদ প্রকাশিত হয়েছে। সংবাদটির শিরোনাম, ‘চীন ও বাংলাদেশের মধ্যে বিরোধ সৃষ্টি করতে চায় যুক্তরাষ্ট্র/গ্লােবাল টাইমসকে চীনা রাষ্ট্রদূত’। খবরে বলা হয়েছে, যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশকে তাদের চীন বিরোধী ইন্দো-প্যাসিফিক স্ট্রাটেজিতে কাছে পেতে চাইছে। তিনি বলেন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এখন চীন এবং বাংলাদেশের মধ্যে একটি বিরোধ সৃষ্টি করতে চাচ্ছে। ইনকিলাবের ঐ খবরে বলা হয়েছে, ঢাকার কোন সভা বা সাংবাদিক সম্মেলনে নয়, রীতিমত একটি বিশেষ সাক্ষাৎকারে একথা বলেছেন চীনা রাষ্ট্রদূত। রাষ্ট্রদূতের মতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র নতুন করে ঠান্ডা যুদ্ধ শুরু করতে চাচ্ছে। এই সাক্ষাৎকারে চীন পরিষ্কারভাবে জানিয়ে দিয়েছে যে চীন ইন্দো প্যাসিফিক স্ট্রাটেজির ঘোর বিরোধী।
চীনের এই প্রকাশ্য বিরোধিতার পর ইন্দো-প্যাসিফিক স্ট্রাটেজি হোক বা ভারত মার্কিন সামরিক চুক্তি বেকা হোক, বাংলাদেশকে আগামী দিনে খুব সতর্কভাবে পা ফেলতে হবে।
Email: [email protected]
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।