পবিত্র লাইলাতুল বরাত
আজ দিবাগত রাত পবিত্র লাইলাতুল বরাত। পরম করুণাময় আল্লাহতায়ালা তার বান্দাদের গুনাহ মাফ, বিপদমুক্তি ও
গত বৃহস্পতিবার লালমনিরহাটের পাটগ্রাম উপজেলার বুড়িমারী স্থলবন্দরে আবু ইউনুস মোহাম্মদ শহীদুন্নবী জুয়েল নামের এক ব্যক্তিকে পবিত্র কোরআন অবমাননার অভিযোগ পিটিয়ে হত্যা ও লাশ আগুনে জ্বালিয়ে দেয়ার যে লোমহর্ষক ও বর্বরোচিত ঘটনা ঘটেছে, তাতে আমরা স্তম্ভিত ও হতবাক। মানুষ যে এত নিষ্ঠুর ও নৃশংস হতে পারে, তা ধারণাও করা যায় না। যা অসম্ভবপর ও কল্পনাতীত, শত শত মানুষের সামনে তাই সংঘটিত হয়েছে। রংপুর শহরের বাসিন্দা দুই সন্তানের জনক শহীদুন্নবী জুয়েল রংপুর ক্যান্টনমেন্ট পাবলিক স্কুল ও কলেজের সাবেক লাইব্রেরিয়ান। বছরখানেক আগে ঠুনকো অভিযোগে তার চাকরি চলে যায়। সেই থেকে তিনি কিছুটা মানসিক ভারসাম্যহীন। যথারীতি চিকিৎসাও চলছিল। ওইদিন তার এক বন্ধুর সাথে তিনি বুড়িমারী গিয়েছিলেন, তার বোনের ভাষায়, মানসিক অসুখের ভারতীয় ওষুধ কিনতে। ফেরার পথে আসরের নামাজ পড়তে গিয়েছিলেন বুড়িমারী বাজার জামে মসজিদে। সেখানেই পবিত্র কোরআন অবমাননার অভিযোগে স্ববন্ধু প্রহৃত হন তিনি। পরে তাদের উদ্ধার করে স্থানীয় ইউপি কার্যালয়ে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানেও হামলা হয়। হামলকারীরা মারতে মারতে শহীদুন্নবী জুয়েলকে মেরেই ফেলে। পুলিশ তার বন্ধুকে উদ্ধার করে নিয়ে যায়। পরে শহীদুন্নবী জুয়েলের লাশ রাস্তায় ফেলে আগুনে পুড়িয়ে দেয়া হয়। এরূপ মধ্যযুগীয় বর্বরতায় দেশের মানুষ একদিকে উদ্বিগ্ন ও বিচলিত, অন্যদিকে ক্ষুব্ধ-বিক্ষুব্ধ। মানুষের জীবন যে কতটা অনিরাপদ ও ঝুঁকিপূর্ণ, এ ঘটনায় তা বিশেষভাবে প্রত্যক্ষ করা গেছে। যে কোনো সময় যে কেউ যে কারো বিরুদ্ধে ধর্ম অবমাননার অভিযোগ এনে কিংবা গুজব রটিয়ে এ ধরনের ঘটনার জন্ম দিতে পারে। আসলে কী কারণে ঘটনাটি ঘটেছে এখনো পরিষ্কার হয়নি। কারা অভিযোগ আনলো, গুজব রটালো এবং হত্যা করলো তা অনুপুংখ তদন্তের দাবি রাখে।
পত্রিকান্তরে প্রকাশিত এক খবরে শীর্ষ স্থানীয় একটি গোয়েন্দা সংস্থার বরাতে বলা হয়েছে, মসজিদের খাদেম, ডেকোরেটরের মালিক, ইউপি মেম্বারসহ কতিপয় অজ্ঞাত ব্যক্তি এঘটনার দায়দায়িত্ব এড়িয়ে যেতে পারবেন না। এইসঙ্গে উপজেলা চেয়ারম্যান, উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ও থানার ওসিও দায়মুক্ত থাকতে পারবেন না। তারা দায়িত্ব পালনে শোচনীয় ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছেন। শুরু থেকেই পুলিশ ও প্রশাসন যদি সক্রিয় হতো, গুজবতাড়িত লোকদের নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারতো এবং ডিকটিমদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে পারতো তাহলে এমন মর্মন্তুদ হত্যাকান্ডের ঘটনা ঘটতে পারতো না। ইতোমধ্যে মানবাধিকার কমিশন ঘটনা তদন্তে ৩ সদস্যের একটি কমিটি গঠন করেছে। তিনটি পৃথক মামলাও হয়েছে। আশা করা যায়, উপযুক্ত তদন্তে, ঘটনার কারণ, কারা দায়ী, কারা ইন্ধনদাতা এবং পুলিশ ও প্রশাসনের ব্যর্থতা কোথায়, কতটুকু তা জানা সম্ভব হবে। অবশ্য এটা জানাই যথেষ্ট নয়। এরূপ ঘটনা যাতে আর না ঘটে, সেটা নিশ্চিত করতে হবে। দ্রুত তদন্ত, বিচার ও দায়ী ব্যক্তিদের শাস্তি হলেই কেবল এরকম ঘটনা নিরূৎসাহিত হতে পারে। বিচারহীনতার একটা সংস্কৃতি দেশে ধীরে ধীরে গড়ে উঠেছে। সংঘবদ্ধ অপরাধ ও দুর্বৃত্তাচার এবং নানারকম ঘৃণ্য অপকর্ম বিস্তারের পেছনে এই বিচারহীনতার সংস্কৃতি বিশেষভাবে দায়ী। কিছু লোক যখন অপরাধ-অপকর্ম করে পার পেয়ে যায়, তখন তদন্ত-বিচার ইত্যাদির ওপর মানুষের আস্থা কমে যায়। তেমন পরিস্থিতি-পরিবেশের মধ্যে আইন হাতে তুলে নেয়ার প্রবণতা মানুষের মধ্যে দেখা দেয়।
আইন হাতে তুলে নেয়া কারো জন্যই সমীচীন নয়। কেউ অপরাধ করলে তার বিচার ও প্রতিকারের দায়িত্ব রাষ্ট্রের। রাষ্ট্রের পক্ষে সরকার সে দায়িত্ব প্রতিপালন করে। রাষ্ট্র-সরকারের দায়িত্ব কেউ নিতে পারে না। নেয়াটাও একটা অপরাধ। তারও উপযুক্ত বিচার হতে হবে। অস্বীকার করা যাবে না, দেশে তুচ্ছ কারণে, সন্দেহ বা গুজবের বশবর্তী হয়ে পিটিয়ে হত্যার ঘটনা বেড়ে গেছে এবং ক্রমাগত বাড়ছে। এক পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, গত ৯ মাসে অন্তত ৩০ জনকে পিটিয়ে হত্যা করা হয়েছে। অপর এক পরিসংখ্যান মোতাবেক, ২০১১ থেকে ২০১৮ পর্যন্ত দেশে গণপিটুনিতে মারা গেছে প্রায় ৮০০ জন। অপরাধ বিজ্ঞানী, আইনবিদ ও মানবাধিকার কর্মীদের মতে, বিচার ব্যবস্থার ওপর অনাস্থার কারণেই আইন নিজের হাতে তুলে নেয়ার প্রবণতা ও ঘটনা বাড়ছে। তাদের অভিমত, বিচারব্যবস্থার ওপর আস্থা পুনপ্রতিষ্ঠিত হলে এ প্রবণতা ও ঘটনা কমবে। অতএব, বিচারব্যবস্থার ওপর যাতে আস্থা সৃষ্টি হয়, তা নিশ্চিত করতে হবে। যে কোনো অপরাধের নিরপেক্ষ তদন্ত, যত দ্রুত সম্ভব বিচার ও শাস্তি নিষ্পন্ন হলেই আস্থা ফিরে আসবে। মানুষ যখন বুঝবে, অপরাধ যাই হোক, যেই করুক তার বিচার হবে তখন আর কারো মধ্যে আইন হাতে তুলে নেয়ার প্রবণতা জাগবে না। এই সঙ্গে জনগণের মধ্যে সচেতনতা বৃদ্ধির উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে। তাদের হুঁশিয়ার করে দিতে হবে যেন কেউ আইন হাতে তুলে না নেয়, নিলে কঠোর শাস্তি ভোগ করতে হবে, এটাও তাদের জানিয়ে দিতে হবে। আমরা আশা করবো, লালমনিরহাটের ঘটনার উপযুক্ত তদন্ত সাপেক্ষে দায়ীদের সমুচিত শাস্তিবিধান করা হবে।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।