পবিত্র লাইলাতুল বরাত
আজ দিবাগত রাত পবিত্র লাইলাতুল বরাত। পরম করুণাময় আল্লাহতায়ালা তার বান্দাদের গুনাহ মাফ, বিপদমুক্তি ও
(শুক্রবার প্রকাশিতের পর)
শত্রুর অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির উৎসে আঘাত, আক্রমণাত্মক দুশমনের বিরুদ্ধে লড়াই, সহচরদের পরামর্শ ও অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগানো, ভিনদেশি প্রক্রিয়া প্রযুক্তির ব্যবহার, কর্মতৎপরতায় নিজে অংশগ্রহণ ইত্যাদি থেকেও উত্তম কর্মকৌশল ও সুন্দর পরিকল্পনার নিদর্শন উদ্ভাসিত হয়ে ওঠে।
বদরের বন্দীদের মধ্যে যারা মুক্তিপণ পরিশোধে অক্ষম তাদের জন্য হুযুর শর্ত জুড়ে দেন, ওরা প্রত্যেকে যেন মদীনার দশজনকে স্বাক্ষর ও শিক্ষিত করে তোলে। এই হলো তাদের মুক্তিপণ। এ কেমন কর্মনৈপুণ্য! কত সুন্দর সমাধান! হুদায়বিয়ার সন্ধিতে সর্বাপেক্ষা উজ্জ্বল কৌশলগুলো ইতিহাসে সংরক্ষিত করেছে। হুযুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সহস্রাধিক সাহাবীকে নিয়ে মক্কা সীমান্তে হুদায়বিয়ায় গিয়ে পৌঁছলেন। হযরত ওসমান রাযি. গেলেন মক্কার নেতৃবর্গের সাথে বৈঠকে যোগ দিতে। প্রস্তাব-এ বছর মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তার সাহাবাদের নিয়ে আল্লাহর ঘর তওয়াফ তথা উমরা করবেন। আত্মরক্ষার তরবারি তাদের কোষবদ্ধ থাকবে। সমরসজ্জা থাকবে না। কিন্তু না, কাফেররা এতে রাজী হলো না। হুদায়বিয়ার নেতা সোহায়ল এলো সন্ধি চুক্তিতে সই করতে। শর্ত-এ বছর নয় আগামী বছর উমরা করবেন তারা। কোনো ব্যক্তি ইসলাম গ্রহণ করে মদীনায় পালিয়ে গেলে তাকে মক্কাওয়ালাদের হাতে তুলে দিতে হবে। তবে কেউ মদীনা থেকে মুরতাদ হয়ে মক্কায় এলে তাকে ফিরিয়ে দেয়া হবে না ইত্যাদি। উমরা এবং মাতৃভ‚মি ভ্রমণের উদ্বেলিত উৎসাহে বিপত্তি আর বিনীত সন্ধিচুক্তির শোকে সাহাবীরা ক্ষুব্ধ এবং শোকাহত। হযরত উমর রাযি. উচ্ছ্বসিত আবেগে আপ্লুত হয়ে নবীজিকে জড়িয়ে ধরে অবুঝ শিশুর মতো বলে উঠলেন, ‘ও নবী আমাদের মিশন কি সত্যনিষ্ঠ নয়? আপনি কি সত্য নবী নন? তবে কেন এত অবমাননা, এত গ্লানি স্বেচ্ছায় মেনে নিতে হবে আমাদের?’ অব্যক্ত উচ্চারণে সব সাহাবী সোচ্চার ‘মর্যাদার লড়াইয়ে আমরা জীবন দিতে প্রস্তুত।’
অপূর্ব ধৈর্য ও অফুরন্ত স্থিরতা! শান্ত-সৌম্য অবয়বে, আনত নয়নে প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কেবলই অন্তর্মুখী, ‘এতেই রয়েছে আমাদের সুস্পষ্ট বিজয়। মহা প্রাপ্তি।’ এখানে শক্তির নয় যুক্তির হবে জয়। আবেগের নয় ত্যাগের। প্রাবল্যের নয় বিনম্রতার, সদাচারের।
তিনি সাহাবীদের বললেন, এখানেই মাথা মুড়িয়ে বা ছেঁটে পশুগুলো কোরবানী করা হোক। শোক ও অবদমিত উদ্বেলতায় সব অনড় নিশ্চল। হুযুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁবুতে গিয়ে, বিবি উম্মে সালমাকে বললেন, ওরা যে আমার নির্দেশ শুনছে না। কী সর্বনাশ, যদি আল্লাহর গযব নেমে আসে! বিবি বললেন, আপনি মৌখিক নির্দেশ আর দেবেন না। নিজে গিয়ে এ আমলগুলো শুরু করে দিন। দেখবেন, জানবায সাহাবীরা কর্মচঞ্চল হয়ে উঠবে নিমিষেই। আর হলও তাই।
হুদায়বিয়া থেকে হুযুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ফিরে এলেন। দুটো বছরও গড়ায়নি। এরিমধ্যে এ সন্ধিচুক্তির সর্বপ্লাবী সুফল ইসলামকে বহুদূর এগিয়ে নিয়ে গেল। দু’হাজারের কম সাথী নিয়ে হুদায়বিয়ার অভিযাত্রী এবার দশ সহস্র সঙ্গী নিয়ে চলছেন মক্কা বিজয়ে। আল্লাহ কতই শক্তিমান, কত মহান!
শত্রুর সাথে সংঘাতের চেয়ে কৌশলগত সমঝোতা ভালো। নীতিহীন প্রতিপক্ষের সাথে চুক্তিই উত্তম। কেননা, এটা তারা সহজেই ভঙ্গ করে এবং প্রতিপক্ষকে অ্যাকশানে যাওয়ার বৈধতা দিয়ে দেয়। নিপীড়িত হয়ে জনসমর্থন পাওয়া সহজ, আক্রমণের চেয়ে বিনম্র প্রত্যাবর্তন এক্ষেত্রে জনপ্রিয়তা বৃদ্ধি করে সংগঠনকে গণমুখী করে। এসব কর্মকৌশলের ফলে হুদায়বিয়ার আপাত নতজানু সন্ধি বৃহত্তর ও চূড়ান্ত বিজয়ের ভূমিকারূপে প্রতিষ্ঠিত হলো। সহকর্মীদের উচ্ছ্বসিত আবেগ নিরুত্তরে স্তিমিত করে সময়ে এর সঠিক ব্যবহার প্রকৃত নেতার জন্য অবশ্য অপরিহার্য। কৌশলগত প্রয়োগে এ আদর্শও কর্ম গুরুত্ববহ নয়।
মক্কা বিজয়ের পর সাধারণ ক্ষমা, আল্লাহর ঘরে আশ্রয় গ্রহণকারীদের সুরক্ষা, অস্ত্র সংবরণকারী স্বগৃহে অবস্থানকারীদের নিরাপত্তা প্রদানের পাশাপাশি এককালের চরম দুশমন আবু সুফিয়ানের বাড়িকেও নিরাপদ এলাক বলে ঘোষণা করা কত বড় কৌশল ছিল তা কি বলে বোঝাতে হয়?
হুনায়নের যুদ্ধে প্রাপ্ত গনীমতের মাল বণ্টনে নও মুসলিম মক্কার বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গ এবং অতীত প্রতিপক্ষ পরিবারের নববন্ধু সদস্যদের অগ্রাধিকার প্রদানও কৌশলগত প্রজ্ঞার সর্বোৎকৃষ্ট পর্যায়ে পড়ে।
তদানীন্তন বিশ্বের দুই পরাশক্তি, পার্শ্ববর্তী রাজ্যের শাসকবর্গ এবং প্রাদেশিক গভর্নরদের প্রতি পত্র দেয়ার মাধ্যমে তাদের সাথে ইসলামের প্রথম লেনদেন, শান্তি-যুদ্ধ ও আন্তর্জাতিক সম্পর্কের সূত্রপাত করে দিয়ে তিনি তাঁর ভবিষ্যৎ উত্তরাধিকারী খলীফাগণের কর্মপন্থা নির্দেশ করে গিয়েছেন। আদর্শ কল্যাণ রাষ্ট্রের রাজধানী মদীনার কেন্দ্রীয় নিয়ন্ত্রণে প্রদেশ ভিত্তিক শাসক, বিচারক, রাজস্ব আদায়কারী, শিক্ষা-সংস্কৃতি কর্মকর্তা ও নিরাপত্তা কর্তৃপক্ষ নিযুক্ত করে ইসলামী রাষ্ট্রের প্রাতিষ্ঠানিক অবকাঠামো গড়ে দিয়ে তিনি তার সকল দায়িত্ব সমাপ্ত করে হযরত আবু বকর রাযি.-কে জাতির ইমাম নিযুক্ত করে যান। খোলাফায়ে রাশেদীনকে দিয়ে যান অনুসরণীয় আদর্শের প্রবক্তার স্বীকৃতি। বলে যান ‘দুটি জিনিস রেখে যাচ্ছি তোমাদের জন্য। এ দুটি শক্ত করে আঁকড়ে থেকো, পথচ্যুত হবে না। এক. আল্লাহর কিতাব, দুই. আমার সুন্নাহ।’ বিদায় হজে দিয়ে গেলেন দীনের পূর্ণতার ঘোষণা। শেষ ভাষণ পরিগণিত হলো, মানবতার মুক্তির চূড়ান্ত সনদ রূপে।
তেইশ বছরে নবুওতী কর্মসাধনার স্বর্ণসৌধ যখন নিটোল পূর্ণ, তখন বললেন, ‘পরম বন্ধুর সাথে মিলিত হতে চাই।’ আল্লাহ রফীকে আলার সাথে। এবার পার্থিব জীবনাবরণ থেকে ‘মাকামে মাহমূদ’— এর পথে মহাপ্রয়াণ।
প্রবন্ধের শুরুতেই বলেছি, ওহীর দ্বারা পরিচালিত নবী জীবনে কর্মকৌশল ও পরিকল্পনার গুরুত্ব একেবারেই শূন্য। সকল নবী-রাসূলের বেলায়ই একথা সত্য। সুতরাং বিষয়বস্তুর অভিনবত্বে আর আলোচিত জীবনের পবিত্রতম নাজুকত্বে এ নগণ্য অধম দারুণ কুণ্ঠিত। তথাপি আড়ষ্ট ভীরুতার কালিতে ফুটিয়ে তুলতে সচেষ্ট হলাম প্রিয়তমের জীবনের আলোকময় কিছু কর্ম ও পদক্ষেপের বাহ্যিক নৈপুণ্য ও কৌশল। আমার অনিচ্ছাকৃত কোনো অবমূল্যায়ন বা অনুভব অভিব্যক্তির হীনতা যেন স্পর্শ না করে মহান রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর পদধুলিকেও। পরিকল্পনা ও কর্মকৌশল নিয়ে কলম ধরার প্রেরণা অবশ্য পেয়েছি আল্লাহ পাকের এ বাণী থেকে— ‘যিনি তার রাসূলকে নিরক্ষর (প্রাকৃতজন) সম্প্রদায়ের মধ্যে প্রেরণ করেছেন। তিনি তাদের সামনে তার (আল্লাহর) আয়াত তিলাওয়াত করবেন। তাদের শুদ্ধ ও পবিত্র করবেন এবং তাদের কিতাব ও হিকমত শিক্ষা দেবেন।’ হিকমত শব্দটির ব্যাপক অর্থের মাঝে কর্মকৌশলও যে রয়েছে এতে আশা করি কেউই ভিন্নমত পোষণ করবেন না। (সমাপ্ত)
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।