পবিত্র লাইলাতুল বরাত
আজ দিবাগত রাত পবিত্র লাইলাতুল বরাত। পরম করুণাময় আল্লাহতায়ালা তার বান্দাদের গুনাহ মাফ, বিপদমুক্তি ও
রোহিঙ্গা সমস্যার সমাধান নিয়ে বিগত তিন বছর ধরে জাতিসংঘ ও বিশ্বের ক্ষমতাধর দেশগুলো নানা ধরনের কথাবার্তা এবং মিয়ানমারের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার হুমকি-ধমকি দিলেও তাতে কোনো কাজ হয়নি। রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে না নেয়ার বিষয়ে সে একপ্রকার অনড় অবস্থানেই রয়েছে। বছর খানেক আগে বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের সাথে দ্বিপক্ষীয় সমঝোতার মাধ্যমে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন শুরুর দিন-তারিখ চূড়ান্ত করা হলেও মিয়ানমার খোঁড়া অজুহাত দেখিয়ে তা থেকে পিছিয়ে যায়। এখন করোনার অজুহাতে দেশটি প্রত্যাবাসনের সকল প্রস্তুতির কাজ বন্ধ করে দিয়েছে। এমন প্রেক্ষিতে, গত বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ. কে. আব্দুল মোমেনের সঙ্গে চীনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ও স্টেট কাউন্সিলর ওয়াং ই’র টেলিফোনালাপ হয়। আলাপকালে ওয়াং ই পররাষ্ট্রমন্ত্রীকে জানান, রোহিঙ্গাদের ফেরত নেবে বলে মিয়ানমার চীনকে আশ্বস্থ করেছে। করোনা পরিস্থিতির উন্নতি হলে রোহিঙ্গাদের ফেরত নিতে মিয়ানমার কাজ করবে বলে জানিয়েছে এবং এ ব্যাপারে বাংলাদেশের সাথে দ্রুত আলোচনা শুরু করবে। আগামী ৮ নভেম্বর মিয়ানমারের নির্বাচনের পর দুটি উদ্যোগ নেয়া হবে। প্রথমত রাষ্ট্রদূত পর্যায়ে, দ্বিতীয়ত, বাংলাদেশ, চীন ও মিয়ানমারের মন্ত্রী পর্যায়ের ত্রিপক্ষীয় বৈঠকের আয়োজন করা হবে। মিয়ানমার চীনের মাধ্যমে এমন এক সময় রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের নতুন উদ্যোগের কথা জানিয়েছে, যখন উপমহাদেশে প্রভাব বিস্তার নিয়ে চীন, যুক্তরাষ্ট্র ও ভারতের মধ্যে এক ধরনের স্নায়ুযুদ্ধের সূচনা হয়েছে। এ যুদ্ধে বাংলাদেশের অবস্থান নিরপেক্ষ এবং বাংলাদেশকে বাদ দিয়ে উপমহাদেশে প্রভাব বিস্তার সম্ভব নয়। অথচ রোহিঙ্গা সমস্যা নিয়ে মহাবিপদে পড়ে থাকা বাংলাদেশের পাশে দেশগুলোর অবস্থান জোরালো নয়।
রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নেয়ার ক্ষেত্রে মিয়ানমারকে বাধ্য করার ক্ষেত্রে তিনটি দেশের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। দেশ তিনটি হচ্ছে, চীন, রাশিয়া ও ভারত। বিশেষ করে চীনের ভূমিকা মূল নিয়ামক হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। জাতিসংঘসহ যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, ইউরোপীয় ইউনিয়ন, ওআইসি থেকে শুরু করে বিভিন্ন দেশ রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নেয়ার জন্য মিয়ানমারকে চাপ দিয়েও তাকে রাজী করাতে পারেনি। তার পেছনে চীন, রাশিয়া ও ভারতের মতো শক্তি থাকায় এ চাপের তোয়াক্কা সে করেনি। জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদও মিয়ানমারের বিরুদ্ধে কঠোর পদক্ষেপ নিতে পারেনি শুধু চীন ও রাশিয়ার আপত্তির কারণে। ফলে রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধান নিয়ে বিশ্বের অন্যান্য ক্ষমতাধর দেশগুলোর বক্তব্য-বিবৃতি লিপ সার্ভিসে পরিণত হয়েছে। এটা নিয়ে তারা রাজনীতিতে ব্যস্ত। তাদের তৎপরতা সীমাবদ্ধ হয়ে পড়েছে রোহিঙ্গাদের নামমাত্র সাহায্যের মধ্যে। মাঝে মাঝে বৈঠক করে এসব সাহায্যের কথা ঘোষণা করা হয়। গত বৃহস্পতিবার জাতিসংঘের শরনার্থীবিষয়ক সংস্থা ইউএনএইচসিআরের সঙ্গে যৌথভাবে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য ও ইউরোপীয় ইউনিয়ন আয়োজিত এক ভার্চুয়াল সম্মেলনে দাতা দেশ ও সংস্থাগুলো রোহিঙ্গাদের সহায়তায় ৬০ কোটি ডলার দেয়ার অঙ্গীকার করেছে। অন্যদিকে গাম্বিয়া গত বছরের নভেম্বরে আন্তর্জাতিক আদালতে মিয়ানমারের বিরুদ্ধে রোহিঙ্গা গণহত্যার অভিযোগ এনে মামলা করে। মামলার প্রাথমিক শুনানিতে আদালত মিয়ানমারকে গণহত্যা বন্ধে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে আদেশ দেয়। তাতেও মিয়ানমারের কোনো বিচলন হয়নি। গত শুক্রবার গাম্বিয়া মামলার ডকুমেন্টস হিসেবে আদালতে মিয়ানমারের গণহত্যার তথ্যসম্বলিত প্রায় পাঁচ হাজার পৃষ্ঠার স্মারকলিপি পেশ করেছে। তবে স্মারকলিপিতে কি তথ্য উল্লেখ রয়েছে, তা জানা যায়নি। বিশ্লেষকরা মনে করছেন, এটা গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ হলেও মামলার কার্যকর ফল নির্ভর করছে স্মারকলিপির তথ্যের শক্ত ভিত্তির ওপর। তবে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের এসব উদ্যোগ দীর্ঘমেয়াদী। এতে রোহিঙ্গা সংকট সমাধান সহসা হওয়ার সম্ভাবনা কম। যতই দিন যাচ্ছে বাংলাদেশের জন্য এ সংকট গভীর হয়ে উঠছে। প্রায় ১২ লাখ রোহিঙ্গার থাকা-খাওয়ার পুরো ব্যবস্থা বাংলাদেশকেই করতে হচ্ছে। বিপুল সংখ্যক রোহিঙ্গার ভরণ-পোষণ করতে গিয়ে দেশের অর্থনীতি চাপের মধ্যে পড়েছে। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি হুমকির মুখে পড়াসহ বিদেশী বিনিয়োগের ক্ষেত্রে অন্তরায় সৃষ্টি হয়েছে। এ নিয়ে বিশ্বের ক্ষমতাধর দেশগুলোর লোক দেখানো আর্থিক সহযোগিতা ও বক্তব্য-বিবৃতি ছাড়া কার্যকর কোনো ভূমিকা পরিলক্ষিত হচ্ছে না। আঞ্চলিক ভূমিকার ক্ষেত্রে চীনের নির্লিপ্ততা এবং মিয়ানমারের সাথে ভারতের অস্ত্রবাণিজ্যসহ বিভিন্ন ব্যবসা চালিয়ে যাওয়ার কারণেও রোহিঙ্গা সমস্যার সমাধান মুখ থুবড়ে পড়েছে।
বিগত তিন বছরে এটাই প্রতীয়মান হয়েছে, জাতিসংঘসহ বিশ্বের ক্ষমতাধর দেশগুলো মুখে মুখে রোহিঙ্গা সংকট নিরসনে মিয়ানমারকে যতই বলুক না কেন, চীন, রাশিয়া ও ভারত যদি কার্যকর পদক্ষেপ না নেয়, তাতে কোনো লাভ হবে না। আমরা বারবার এ কথা বলেছি, জোরালো কূটনৈতিক তৎপরতা চালিয়ে চীনকে সক্রিয় উদ্যোক্তা করার মাধ্যমে এ সমস্যার সমাধান করতে হবে। পাশাপাশি রাশিয়া ও ভারতকে সঙ্গে নিতে হবে। বলা বাহুল্য, চীনের সাথে মিয়ানমারের যেমন অর্থনৈতিক স্বার্থ রয়েছে, তেমনি সে বাংলাদেশেরও অন্যতম বৃহৎ উন্নয়ন অংশীদার। ভারতের সাথে আমাদের সম্পর্ক অতি উচ্চ অবস্থানে রয়েছে। এসব বিবেচনায় বাংলাদেশের যেমন জোর কূটনৈতিক তৎপরতা চালাতে হবে, তেমনি পারস্পরিক স্বার্থে দেশগুলোর উচিৎ রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধানে এগিয়ে আসা। এক্ষেত্রে মিয়ানমারকেও তার আদিবাসিন্দাদের ফিরিয়ে নিতে সদিচ্ছা নিয়ে এগিয়ে আসতে হবে। তার বাসিন্দাদের নিরাপদে ফিরিয়ে নিতে সর্বাগ্রে তাকেই উদ্যোগী হতে হবে।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।