Inqilab Logo

সোমবার ২৫ নভেম্বর ২০২৪, ১০ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২২ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

ইমাম হত্যা : মার্কিন সমাজে অসহিষ্ণুতা বাড়ছে

প্রকাশের সময় : ১৬ আগস্ট, ২০১৬, ১২:০০ এএম

নিউইয়র্কের এক মসজিদের ইমাম ও তার সহকারীকে গুলি করে হত্যা করেছে এক অজ্ঞাত আততায়ী। ইমাম মওলানা আলাউদ্দিন আকুঞ্জি ও তার সহকারী তারাউদ্দিন বাংলাদেশী বংশোদ্ভূত। কুইন্সের আল ফোরকান জামে মসজিদ থেকে জোহরের নামাজ শেষে তারা যখন বাড়ি ফিরছিলেন তখন ওই আততায়ী তাদের লক্ষ্য করে গুলি করে। ঘটনাস্থলে মারা যান মওলানা আকুঞ্জি। হাসপাতালে মারা যান তারাউদ্দিন। এই সন্ত্রাসী হামলা ও হত্যাকা-ের ঘটনায় নিউইয়র্কের বাংলাদেশী কমিউনিটিতে শোকের ছায়া নেমে এসেছে। ব্যাপক উদ্বেগ ও উৎকণ্ঠা দেখা দিয়েছে। মওলানা আকুঞ্জি ও তারাউদ্দিন অত্যন্ত সৎ, সজ্জন, নিরীহ ও ধর্মপ্রাণ মানুষ ছিলেন। তাদের কোনো শত্রু বা অমিত্র ছিল না। বর্ণবাদী ও ধর্মীয় বিদ্বেষ থেকে এই বর্বরোচিত হত্যাকা- ঘটানো হয়েছে বলে ধারণা করা হচ্ছে। ঘাতক পলাতক; তাকে খুঁজে বের করার চেষ্টা চলছে। বর্ণবাদী ও ধর্মীয় বিদ্বেষ কোন পর্যায়ে উপনীত হয়েছে, হত্যাকা-ের এ ঘটনা তারই এক জ্বলন্ত উদাহরণ। নিউইয়র্কের বাংলাদেশী কমিউনিটির নেতারা একে বর্ণবাদী ও সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষের ফল বলে অভিহিত করেছেন। তারা হত্যাকা-ের নিন্দা ও সুবিচার দাবি করেছেন। আমরাও এ হত্যাকা-ে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করছি, নিন্দা ও ধিক্কার জানাচ্ছি এবং দ্রুত বিচার ও ঘাতকের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দাবি করছি।
সাম্প্রতিককালে ইউরোপের বিভিন্ন দেশে যেসব সন্ত্রাসী হামলার ঘটনা ঘটছে তার বিরূপ প্রতিক্রিয়া যুক্তরাষ্ট্রেও দেখা দিয়েছে। সেখানে মুসলমানমাত্রকেই সন্দেহভাজন হিসেবে দেখা হচ্ছে। অন্যদিকে রিপাবলিকান দলের প্রেসিডেন্ট পদপ্রার্থী ডোনাল্ড ট্রাম্প শুরু থেকেই যেভাবে বর্ণবিদ্বেষ ও ইসলামবিদ্বেষ ছড়াচ্ছেন তাতে গোটা যুক্তরাষ্ট্রে অসহিষ্ণুতা বৃদ্ধি পেয়েছে। অনেকে মনে করেন, ডোনাল্ড ট্রাম্পের ছড়ানো ইসলামভীতি ও মুসলিমবিদ্বেষ এই হত্যাকা-ের পেছনে প্ররোচনা হিসেবে কাজ করে থাকতে পারে। এর আগে মুসলমানদের প্রতি অপমানজনক ও বিদ্বেষপ্রসূত আচরণ প্রদর্শন, হামলা ও নির্যাতনের বেশ কিছু ঘটনা ঘটলেও এ ধরনের টার্গেট কিলিং হয়নি। অহিষ্ণুতা, বর্ণবিদ্বেষ ও ধর্মীয় সাম্প্রদায়িকতা অবশেষে সহিংসতা ও হত্যাকা-ে রূপ নিয়েছে বলেই এ ঘটনায় প্রতীয়মান হচ্ছে। স্মরণ করা যেতে পারে, কিছুদিন আগে প্যারিসে মার্কিন ডেল্টা এয়ারলাইন্সের একটি ফ্লাইট থেকে ওহাইওগামী এক মুসলিম দম্পতিকে জোর করে নামিয়ে দেয়া হয়। ওই দম্পতি ঘেমে ‘আল্লাহ’ শব্দ উচ্চারণ করেছিলেন এবং কাউকে মোবাইলে মেসেজ পাঠাচ্ছিলেন। এই ‘অপরাধে’ তাদের ফ্লাইট থেকে নামিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয় এবং শেষ পর্যন্ত বহন করতে অস্বীকৃতি জানানো হয়। ডেল্টা এয়ারলাইন্সের পাইলট ও ক্রুরা ওই মুসলিম দম্পতির সঙ্গে যে আচরণ করেছেন তাকে কি বর্ণবাদী ও ধর্মীয় বিদ্বেষ ছাড়া আর কিছু বলা যায়? অন্য একটি ঘটনায় শিকাগোতে এক সাবওয়ে স্টেশনে যানবাহনের জন্য অপেক্ষারত এক মুসলিম মহিলাকে পুলিশ সন্ত্রাসী সন্দেহে স্টেশনের সিঁড়িতে ফেলে দেয়, হিজাব খুলে ফেলে এবং গ্রেফতার করে। পরে তিনি নির্দোষ বলে ছাড়া পান। এই তো সেদিন বলিউডের সুপারস্টার শাহরুখ খান লস এঞ্জেলেস বিমানবন্দরে হয়রানির শিকার হয়েছেন। তাকে আটকানো হয়, জিজ্ঞাসাবাদ করা হয় এবং পরে ছেড়ে দেয়া হয়। এর আগে আরো দু’বার একই ধরনের পরিস্থিতির শিকার হন তিনি।
যুক্তরাষ্ট্রে বর্ণ, ধর্ম নির্বিশেষে সকল মানুষের সমানাধিকার সাংবিধানিকভাবে স্বীকৃত। কিন্তু কখনোই এ অধিকার নিশ্চিত হয়নি। মার্কিন সমাজের মধ্যেই এই বর্ণ ও ধর্মবিদ্বেষ প্রথিত রয়েছে। সাম্প্রতিককালে তা মারাত্মক রূপ পরিগ্রহ করেছে। সমাজের ভিত ভয়ঙ্কর ভাঙনের মুখে এসে দাঁড়িয়েছে। ডোনাল্ড ট্রাম্পের মতো বর্ণবিদ্বেষী, ইসলাম ও মুসলিমবৈরী ব্যক্তি যখন প্রেসিডেন্ট পদপ্রার্থী হন এবং প্রকাশ্যে বর্ণ ও মুসলিমবিদ্বেষী বক্তব্য দেন তখন বোঝা যায়, মার্কিন সমাজ কতটা অসহিষ্ণু, অশান্ত ও ভঙ্গুর অবস্থায় এসে উপনীত হয়েছে। আজকে যুক্তরাষ্ট্রের কোথাও যদি যাজক হত্যার ঘটনা ঘটত এবং তিনি যদি শ্বেতাঙ্গ হতেন তাহলে যুক্তরাষ্ট্রেই নয়, গোটা পাশ্চাত্যে তোলপাড় হয়ে যেত, হুমকি উচ্চারিত হতো এবং নিন্দার ঝড় বয়ে যেত। কোনো শ্বেতাঙ্গ দম্পতিকে যদি তার গায়ের রঙ ও ধর্মীয় বিশ্বাসের কারণে বিমান থেকে নামিয়ে দেয়া হতো তাহলে কী হতো, সহজেই অনুমান করা যায়। কোথাও সন্ত্রাস, বর্ণবাদী আচরণ ও ধর্মীয় বিদ্বেষজাত ঘটনা ঘটলে যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপ ‘মানবাধিকার গেল গেল’ বলে চিৎকার জুড়ে দেয়। অথচ ওই সব দেশে এ ধরনের কিছু ঘটলে তাদের প্রায়ই নিশ্চুপ থাকতে দেখা যায়। ওই দ্বৈতনীতি আজ মার্কিন ও ইউরোপীয় সমাজকেই প্রশ্ন এবং হুমকির মুখে দাঁড় করিয়ে দিয়েছে। অন্যকে উপদেশ দেয়ার আগে কিংবা অন্যের সমালোচনা করার আগে পাশ্চাত্যের উচিত নিজ নিজ ঘর ও সমাজের দিকে দৃষ্টি ফেরানো। শান্তিপূর্ণ, সহিষ্ণু, সহনশীল ও পারস্পরিক শ্রদ্ধাপূর্ণ সমাজ নির্মাণ নিশ্চিত করা, সমাজকে সংস্কৃত করা। বিশ্বের শান্তি, নিরাপত্তা ও অগ্রগতির জন্য এটা অপরিহার্য। আমরা আশা করব, পশ্চিমা দেশগুলোর নেতৃবৃন্দ, তাদের বিদ্বৎসমাজ ও মিডিয়া দ্বৈতনীতি এবং দ্বিমুখী আচরণ পরিহার করবে, সর্বমানবিক দৃষ্টিভঙ্গি ও নীতি অনুসরণ করবে।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: ইমাম হত্যা : মার্কিন সমাজে অসহিষ্ণুতা বাড়ছে
আরও পড়ুন