পবিত্র লাইলাতুল বরাত
আজ দিবাগত রাত পবিত্র লাইলাতুল বরাত। পরম করুণাময় আল্লাহতায়ালা তার বান্দাদের গুনাহ মাফ, বিপদমুক্তি ও
দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোতে চীনের ক্রমবর্ধমান প্রভাব বিস্তার যে যুক্তরাষ্ট্র ও ভারতের মধ্যে উদ্বেগ ও উৎকণ্ঠা সৃষ্টি করেছে, তা বেশ ভালভাবেই বোঝা যাচ্ছে। এ অঞ্চলে চীনের প্রভাব মোকাবেলা করে তাদের আধিপত্য প্রতিষ্ঠায় সাম্প্রতিক সময়ে দেশ দুটি বেশ তৎপর হয়ে উঠেছে। করোনা আগামী বিশ্বের রাজনীতি ও অর্থনীতিকে আমূল পরিবর্তন করে দেবে এবং বিশ্ব রাজনীতির নিয়ন্ত্রক হিসেবে নতুন শক্তির আবির্ভাব ঘটাবে, তা আগাম ধারণা করা গিয়েছিল। এই ধারণাই এখন বাস্তবে প্রতিফলিত হতে দেখা যাচ্ছে। নতুন শক্তি হিসেবে চীনের আবির্ভাব সে ধারণাই প্রতিষ্ঠিত করছে। বিশেষ করে নিউ নরমাল বা নতুন স্বাভাবিক বিশ্বে চীন যেভাবে তার প্রবল অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক শক্তি নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে, তাতে তার প্রভাব-প্রতিপত্তির বিষয়টি স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। দেশটি তার অর্থনৈতিক শক্তি নিয়ে বিশ্বের বিভিন্ন দেশসহ উপমহাদেশে প্রভাব বিস্তার করে চলেছে। করোনায় বিধ্বস্ত হওয়া দেশগুলোর অর্থনীতি পুনরুজ্জীবিত করতে অর্থের ঢালি নিয়ে হাজির হচ্ছে। দেশগুলোও বুঝে-শুনে চীনের বাড়িয়ে দেয়া সহযোগিতার হাতে হ্যান্ডশেক করছে। বলা যায়, করোনার উৎপত্তি চীনে হলেও এই করোনাই তাকে বিশ্ব রাজনীতি ও অর্থনীতি নিয়ন্ত্রণের পথ প্রশস্ত করে দিয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র বিষয়টি আগাম টের পেয়ে করোনার জন্য চীনকে দায়ী করা শুরু করলেও চীন করোনা থেকে মুক্ত হয়ে বিশ্ব রাজনীতিতে আগেভাগেই নেমে পড়েছে। যুক্তরাষ্ট্র করোনা মোকাবেলা করতে গিয়ে নাকাল পরিস্থিতিতে পড়ে বিশ্ব রাজনীতি থেকে অনেকটাই পিছিয়ে পড়ে। কিছুটা সামাল দিয়ে যখন বিশ্বের দিকে দৃষ্টিপাত করে, ততক্ষণে বেশ দেরি হয়ে গেছে। অন্যদিকে চীন অনেকটা কচ্ছপ গতিতে এগিয়ে বিশ্বপরিস্থিতি তার অনুকূলে নিয়ে আসার পথে চলতে শুরু করে। নতুন বিশ্ব রাজনীতির পরিস্থিতির সুযোগটি সে বেশ ভালভাবে কাজে লাগিয়ে যাচ্ছে। প্রথমে প্রতিবেশী দেশগুলোর অর্থনীতি পুনরুদ্ধারে বন্ধুত্বসুলভ আচরণের মাধ্যমে আন্তরিকভাবে পাশে দাঁড়িয়েছে এবং দাঁড়াচ্ছে। তার এই আচরণে কোনো হুমকি-ধমকি নেই। ফলে দেশগুলোও তার বাড়িয়ে দেয়া সহযোগিতার হাত আঁকড়ে ধরেছে এবং ধরছে। চীনের এই সহযোগিতামূলক আচরণকে যদি দেশগুলোর ‘দুর্বলতার সুযোগ’ হিসেবেও ধরে নেয়া হয়, তাতেও কারো আপত্তি থাকার কথা নয়। কারণ, দেশগুলোর কাছে অর্থনীতিকে দাঁড় করাতে ‘স্বার্থ’ এবং ‘প্রয়োজন’ই সবচেয়ে বড় হয়ে দেখা দিয়েছে। বলার অপেক্ষা রাখে না, টিকে থাকার জন্য ‘প্রয়োজন’ কোনো আইন মানে না। এক্ষেত্রে কেউ যদি ‘পারস্পরিক স্বার্থ এবং প্রয়োজন’ বিবেচনায় এগিয়ে আসে তাতে কারো আপত্তি থাকার কথা নয়। চীনের এই ‘পারস্পরিক স্বার্থ’ নীতির ফলে স্বাভাবিকভাবেই উপমহাদেশে তার একটি প্রভাববলয় সৃষ্টি হয়েছে। এটা যুক্তরাষ্ট্র বিশেষ করে ভারতের জন্য যথেষ্ট উদ্বেগের কারণ হয়ে দেখা দিয়েছে। দেশ দুটির মধ্যে উপমহাদেশে নিয়ন্ত্রণ হারানোর শঙ্কা দেখা দিয়েছে। ফলে উভয় দেশ চীনকে ঠেকানোর জন্য বেশ তোড়জোড় শুরু করেছে।
দুই.
বিশ্ব রাজনীতিতে চীনের আবির্ভাব অনেকটা ‘সুবোধ বলকে’র মতো, যে তার আচার-আচরণ ও সহযোগিতার মনোভাব নিয়ে সকলের সাথে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক সৃষ্টিতে মনোযোগী। তার আচরণে কোনো উগ্রতা, আগ্রাসন, যুদ্ধংদেহী বা যুদ্ধ বাঁধিয়ে ধ্বংস করে দেয়ার মতো মনোভাব নেই। যার যা প্রয়োজন, তা মিটিয়ে দেয়ার নীতি নিয়ে এগিয়ে চলেছে। এতে অটোম্যাটিক্যালি তারা চীনের প্রতি ঝুঁকছে। স্বার্থের এই দুনিয়ায় এটাই স্বাভাবিক। নিজ স্বার্থে যে দেশ যার কাছ থেকে সুবিধা পাবে, তার কাছেই যাবে। চীন মূলত ‘প্রয়োজনে’র এই রাজনীতিই অবলম্বন করছে। কেবল আমাকেই দিতে হবে কিংবা আমার কথা শুনতে হবে-এমন আগ্রাসী মানসিকতা প্রদর্শন করছে না। এ ধরনের মানসিকতা যুক্তরাষ্ট্র ও ভারতের মধ্যে দেখা যায়। মধ্যপ্রাচ্যে যুক্তরাষ্ট্র নিজে এবং তার বলয়ভুক্ত দেশগুলোকে দিয়ে যেভাবে ধ্বংসযজ্ঞ চালিয়ে ‘ঘোলা পানিতে মাছ শিকার’ করেছে, তা বিশ্ববাসীর অজানা নয়। শুধু মধ্যপ্রাচ্যে নয়, বিশ্বের অন্যান্য দেশেও তার এই আগ্রাসী মনোভাবের দৃষ্টান্ত রয়েছে। দেশটি বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্কের চেয়ে হুমকি-ধমকি দিয়ে বিশ্ব রাজনীতি নিয়ন্ত্রণের পন্থা এবং মনোভাব পোষণ কারাকেই প্রধান্য দিয়ে চলে এবং চলছে। আবার যেসব দেশের সাথে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক রয়েছে বলে ঘোষণা দেয়, সেসব দেশ যে খুব একটা উপকৃত হয়, তা বলা যায় না। বিশ্বে এ কথা বহুল প্রচলিত, ‘যুক্তরাষ্ট্র যার বন্ধু, তার শত্রæর প্রয়োজন নেই।’ প্রবাদসম এ কথা সকলের জানা থাকলেও দেশটির আগ্রাসী মনোভাবের কারণে অনেক দেশই চুপ হয়ে থাকে কিংবা তোষামোদী করে চলে। উপমহাদেশে ভারতের ক্ষেত্রেও একই কথা প্রযোজ্য। দেশটি তার প্রতিবেশীর সাথে বরাবরই আগ্রাসী মনোভাব নিয়ে কথা-বার্তা বলে। দুয়েকটি দেশ বাদে অন্যদেশগুলো তার দাদাগিরি নীরবে সয়ে যায়। মুখে মুখে বন্ধুত্বের কথা বললেও ভেতরে ভেতরে ভারতের প্রতি তারা সবসময়ই বিরক্ত। এখন এ দৃশ্যপট অনেকটাই বদলে গেছে। করোনা এসে বিশ্বে যে পরিবর্তন ঘটিয়েছে, তাতে উন্নয়নশীল দেশসহ অন্যান্য দেশের মনোভাবে বেশ পরিবর্তন এসেছে। এ পরিবর্তনে অনুঘটক হিসেবে কাজ করেছে চীন। করোনার জন্য চীনকে দায়ী করে যুক্তরাষ্ট্র হম্বিতম্বি করলেও চীন তার নতুন নীতি নিয়ে এগিয়ে চলেছে। কোনো হুমকিই তার পথে বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারছে না। যুদ্ধ জাহাজ নিয়ে চীন সাগরে যুক্তরাষ্ট্রের মহড়া দেয়া নিয়ে তেমন একটা গা করেনি। তবে বাড়াবাড়ির মাত্রা বেশি হয়ে গেলে জবাব দিতে সে ভুল করে না। কিছুদিন আগে যুক্তরাষ্ট্রের মহড়ার মধ্যেই ক্ষেপনাস্ত্র ছুঁড়ে দিয়েছে। বলা যায়, যতক্ষণ না পর্যন্ত কেউ চীনের ধৈর্য্যসীমা অতিক্রম করছে, ততক্ষণ পর্যন্ত সে পাল্টা আক্রমণে যায় না। কারণ হচ্ছে, সে যুদ্ধ নীতিতে বিশ্বাসী নয়, অর্থনীতিতে বিশ্বাসী। অর্থের পসরা নিয়ে বনিক হয়ে বিভিন্ন দেশে হাজির হয় এবং বন্ধুত্বসুলভ আচরণের মাধ্যমে সেই অর্থ গ্রহণের আহবান জানায়। দেশগুলোও তার আচরণে সন্তুষ্ট হয়ে সাদরে গ্রহণ করে এবং করছে। বলা যায়, ‘অস্ত্রনীতি’ দ্বারা পরিচালিত পুরনো বিশ্বরাজনীতির আমূল পরিবর্তন ঘটিয়ে অধিক গ্রহণযোগ্য ‘অর্থনীতি’ দ্বারা পরিচালিত হওয়ার রাজনীতির সূচনা করেছে চীন। উপমহাদেশে চীনের প্রভাববলয় বৃদ্ধি পাওয়ার মূল কারণই হচ্ছে, তার এই অর্থনৈতিক রাজনীতি। নেপাল, ভুটান, শ্রীলঙ্কা, পাকিস্তান, মিয়ানমার, আফগানিস্তান ও বাংলাদেশের সাথে তার ঘনিষ্টতা বৃদ্ধি করেছে তার অর্থনৈতিক নীতি দিয়ে। ইতোমধ্যে পাকিস্তান, আফগানিস্তানকে নিয়ে একটি জোটও গঠন করেছে। পাকিস্তান তো উচ্ছ্বসিত হয়ে বলেই দিয়েছে তার অর্থনৈতিক উন্নয়নে ঐতিহাসিক ভূমিকা রেখে চলেছে চীন। দেখা যাচ্ছে, চীনের এই প্রভাব বিস্তারকারী অর্থনৈতিক নীতিতে কোনো ধরনের আগ্রাসী ও হুমকি-ধমকির নীতি নেই। রয়েছে পারস্পরিক অর্থনৈতিক স্বার্থ। আবার সমরশক্তিতেও যে চীন পিছিয়ে তা ভাবার কারণ নেই। এর প্রমাণ পাওয়া যায়, কিছুদিন আগে যুক্তরাষ্ট্রের নীতিনির্ধারক পর্যায়ের একজনের মন্তব্যে। তিনি বলেছেন, চীন যখন সমরাস্ত্রে শক্তিশালী হয়ে উঠছিল, তখন যুক্তরাষ্ট্র ঘুমিয়ে ছিল। কখন চীন সমর শক্তিতে বলিয়ান হয়ে উঠেছে যুক্তরাষ্ট্র তা টের পায়নি! যুক্তরাষ্ট্রের নীতিনির্ধারকদের একজন যখন এমন মন্তব্য করেন, তখন বুঝতে অসুবিধা হয় না, শুধু অর্থনৈতিকভাবেই চীন শক্তিশালী হয়ে উঠেনি, সমরাস্ত্রেও সে বিশ্বের অন্যতম বড় শক্তি হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। সাম্প্রতিক সময়ে নেপাল ও ভুটান যে ভারতের আগ্রাসী আচরণের বিরুদ্ধে কঠোর মনোভাব পোষণ করেছে, তার নেপথ্যের শক্তিই হচ্ছে চীন।
তিন.
উপমহাদেশসহ বিশ্বে চীনের ক্রমবর্ধমান প্রভাব বিস্তারে যুক্তরাষ্ট্রের চিন্তিত হওয়ার যথেষ্ট কারণ রয়েছে। চীনের এই প্রভাবের কারণে বিশ্ব রাজনীতিতে তার আধিপত্য হুমকির মুখে পড়েছে। বলা যায়, ছিটকে পড়ার উপক্রম হয়েছে। স্বাভাবিকভাবেই দেশটি তার আধিপত্য ধরে রাখার জন্য তৎপর হয়ে উঠবে। দক্ষিণ এশিয়ায় চীনের প্রভাববলয়ের বিস্তৃতি যুক্তরাষ্ট্র ও ভারতের আধিপত্যে চরম আঘাত হেনেছে। ফলে ভারত তো বটেই যুক্তরাষ্ট্রও এ নিয়ে উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছে। এখন ভারত তার এই আধিপত্য ফিরিয়ে আনতে প্রকারন্তরে যুক্তরাষ্ট্রের ওপর ভর করেছে। চীনের প্রভাব ঠেকাতে সে যুক্তরাষ্ট্রকে ডেকে এনেছে। বিশ্বরাজনীতির নেতৃত্ব নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের সাথে যেহেতু চীনের দ্ব›দ্ব বেঁধেছে, তাই সেও ভারতের সাথে যুক্ত হয়েছে। এই দুই শক্তি মিলে এখন উপমহাদেশে ‘চীন ঠেকাও’ নীতি অবলম্বন করেছে। এতে উপমহাদেশে এক ধরনের ‘স্নায়ুযুদ্ধ’র সূচনা হয়েছে। অবশ্য উপমহাদেশে চীনের প্রভাব বিস্তারের বিষয়টি ভারত ও যুক্তরাষ্ট্র অনেক আগেই টের পেয়েছিল চীনের বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ (বিআরআই) প্রণয়নের মধ্য দিয়ে। বাংলাদেশসহ ৭০টি দেশের মধ্যে যোগাযোগ অবকাঠামো নির্মাণ এবং আন্তর্জাতিক অর্থনৈতিক অঞ্চল প্রতিষ্ঠায় চীন যখন বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনেশিয়েটিভ প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নেয়, তখনই যুক্তরাষ্ট্র ও ভারতের টনক নড়ে উঠে। তারা আরও সচেতন হয়ে উঠে ২০১৬ সালে বাংলাদেশ যখন এই চুক্তিতে স্বাক্ষর করে যুক্ত হয়। এর পাল্টা ব্যবস্থা হিসেবে পরের বছরই (২০১৭) যুক্তরাষ্ট্র জাতীয় নিরাপত্তা কৌশল ইন্দো-প্যাসিফিক স্ট্র্যাটেজি (আইপিএস) প্রণয়ন করে। উপমহাদেশে ভৌগলিক গুরুত্বপূর্ণ অবস্থানে থাকা বাংলাদেশকে আইপিএসে যোগ দেয়ার জন্য যুক্তরাষ্ট্র বিভিন্নভাবে অনুরোধ করতে থাকে। তার আগে ২০১৪ সালে জাপান বিগ বি বা বে অফ বেঙ্গল ইন্ডাস্ট্রিয়াল গ্রোথ বেল্ট (বঙ্গোপসাগরের শিল্প প্রবৃদ্ধি অঞ্চল)-এর উদ্যোগ নেয়। তাতে বাংলাদেশ সমর্থন জানায়। তবে যুক্তরাষ্ট্রের আইপিএস ও জাপানের বিগ বি নিয়ে বাংলাদেশ অনেকটা নীরব থাকার নীতি অবলম্বন করে চলেছে। কারণ, বাংলাদেশ কোনো নিরাপত্তা ও প্রতিরক্ষা বিষয়ক কৌশলে থাকতে আগ্রহী নয়। যেখানে বিনিয়োগ ও অর্থনৈতিক স্বার্থ রয়েছে, সেখানেই যুক্ত থাকতে চায়। যেহেতু চীনের বিআরআই যোগাযোগ ও অর্থনৈতিক উন্নয়নের একটি উদ্যোগ এবং এতে বাংলাদেশ ব্যাপকভাবে লাভবান হবে, তাই সে এতে আনুষ্ঠানিকভাবে স্বাক্ষর করে। এতে ভারতের যেমন মাথাব্যাথা শুরু হয়েছে, তেমনি যুক্তরাষ্ট্রেরও অস্বস্তি সৃষ্টি হয়েছে। এর মূল কারণ চীন। দেশ দুটি দেখছে উপমহাদেশে প্রভাব বিস্তারের কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছে বাংলাদেশ। বাংলাদেশকে যদি তাদের আইপিএসে অন্তর্ভুক্ত করা না যায়, তবে তাদের এই কৌশল বাস্তবায়ন এবং চীনের প্রভাব বিস্তার কোনোভাবেই ঠেকানো যাবে না। বিষয়টি ভারত ভালভাবেই উপলব্ধি করছে। এই করোনাকালের দুঃসময়ে চীন তার অন্যান্য প্রতিবেশীসহ যেভাবে ভারতকে চেপে ধরেছে, তাতে তার নাভিশ্বাস উঠেছে। একে একে সব প্রতিবেশীর সঙ্গে দূরত্ব সৃষ্টি হওয়া বা তার প্রভাববলয় থেকে বের হয়ে যাওয়ায় অনেকটা একা হয়ে পড়েছে। বাংলাদেশও অত্যন্ত সুকৌশলে কূটনৈতিক দক্ষতার মাধ্যমে ভারতের সাথে চেক অ্যান্ড ব্যালেন্স নীতি অবলম্বন করে চলেছে। পাশাপাশি নিজ অর্থনৈতিক স্বার্থে চীনের দেয়া ব্যবসা-বাণিজ্য ও বিনিয়োগ সহযোগিতা বাড়িয়ে দিয়েছে। এতে ভারতের কিছু বলার থাকছে না। এই বলতে না পারার যন্ত্রণায়ই সে অস্থির হয়ে উঠেছে। এটা চীন, পাকিস্তান, নেপাল, ভুটান ও শ্রীলঙ্কার কূটনৈতিক কৌশলের কাছে পরাস্ত হয়ে ‘কাটা দেহে লবনের ছিঁটা’ দেয়ার মতোই তার কাছে মনে হচ্ছে। ফলে সে নিজ অবস্থান পুনরুদ্ধার, সর্বোপরি উপমহাদেশে তাকে টপকে চীনের প্রভাব বিস্তার ঠেকাতে যুক্তরাষ্ট্রের দ্বারস্থ হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রও তার প্রবল প্রতিদ্বন্দ্বীর এই প্রভাব ঠেকাতে উঠেপড়ে লেগেছে। সে তার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ব্যক্তি উপপররাষ্ট্র মন্ত্রী স্টিফেন বিগানকে ভারত সফর করিয়ে বাংলাদেশে পাঠিয়েছে। পাশাপাশি এ সপ্তাহে দেশটির পররাষ্ট্রমন্ত্রী মাইক পম্পেও ভারত, শ্রীলঙ্কা ও মালদ্বীপ সফরে আসছে। এ থেকে বুঝতে অসুবিধা হয় না, উপমহাদেশে চীনের ক্রমবর্ধমান প্রভাব ঠেকাতে ইন্দো-মার্কিন বলয় বেশ তৎপর হয়ে উঠেছে। তবে চীনের প্রভাব ঠেকানোর জন্য বাংলাদেশকে যে তাদের খুবই প্রয়োজন, তা স্টিফেন বিগানের বক্তব্যে স্পষ্ট হয়েছে। বাংলাদেশ সফরকালে তিনি বলেছেন, আইপিএসের কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছে বাংলাদেশ। এতে বাংলাদেশকে যুক্ত করা জরুরি। এটা যে শুধু যুক্তরাষ্ট্রের চাওয়া তাই নয়, ভারতেরও চাওয়া। মূলত বাংলাদেশকে রাজী করাতে ভারত মরিয়া হয়ে যুক্তরাষ্ট্রের কাছে ধর্ণা দিচ্ছে। বিগানের সফরের লক্ষ্যও ছিল তাই। তবে বাংলাদেশ সফরে তার প্রধান এজেন্ডা আইপিএসে বাংলাদেশকে যুক্ত করার লক্ষ্য হলেও এ নিয়ে তার সঙ্গে কোনো আলাপ হয়নি বলে পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ. কে. আব্দুল মোমেন সাফ জানিয়ে দিয়েছেন। এ থেকে প্রতীয়মাণ হয়, বাংলাদেশ আইপিএসের মতো নিরাপত্তা ও প্রতিরক্ষা সংক্রান্ত কৌশলে যুক্ত হতে আগ্রহী নয়। আবার যুক্তরাষ্ট্র বা ভারতকেও অসন্তুষ্ট করতে চায় না। পরারাষ্ট্রমন্ত্রী অত্যন্ত কূটনৈতিক দক্ষতা দেখিয়ে বলেছেন, ‘দিল্লির চোখে যুক্তরাষ্ট্র দেখে না।’ তার এ কথার সারমর্ম এই, যুক্তরাষ্ট্র ও ভারত যার যার অবস্থান এবং কূটনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে বাংলাদেশের সঙ্গে সুসম্পর্ক বজায় রেখেছে। এ বক্তব্যের মধ্য দিয়ে তিনি বাংলাদেশকে একটি ভারসাম্যমূলক কূটনীতির মধ্যে রেখেছেন, যা সবসময়ের জন্যই প্রযোজ্য। অন্যদিকে চীন, ভারত, যুক্তরাষ্ট্র-এই ত্রয়ী মহাশক্তির মধ্যকার দ্বন্দ্বের মধ্যে না গিয়ে ‘ধরি মাছ না ছুঁই পানি’ এমন এক কূটনৈতিক বাতাবরণ সৃষ্টি করতে সক্ষম হয়েছেন।
চার.
বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতিই হচ্ছে, সকলের সাথে বন্ধুত্ব, কারো সাথে বৈরিতা নয়। করোনায় বিশ্ব অর্থনীতি বিধ্বস্ত হওয়া এবং বাংলাদেশের অর্থনীতিতে তার প্রভাব পড়ায় সরকার এ নীতি এখন যথাযথভাবে আঁকড়ে ধরেছে। বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশের অর্থনীতি পুনরুদ্ধারে এখন সব দেশের সহযোগিতা প্রয়োজন। যে দেশ থেকে সবচেয়ে বেশি অর্থনৈতিক সুবিধা ও বিনিয়োগ পাওয়া যাবে, সে দেশের কাছে ছুটে যাওয়াই স্বাভাবিক। চীন তার এবং বাংলাদেশের পারস্পরিক স্বার্থে সহযোগিতামূলক কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে। এতে কারো আপত্তি থাকার কথা নয়। শুধু চীন নয়, প্রতিবেশীসহ বিশ্বের অন্যান্য ক্ষমতাধর দেশের পারস্পরিক সহযোগিতাও বাংলাদেশের প্রয়োজন। এ প্রেক্ষিতে, ক্ষমতাধর দেশগুলোর মধ্যকার বিশ্ব রাজনীতি ও অর্থনীতি নিয়ন্ত্রণের স্নায়ুযুদ্ধে বাংলাদেশের জড়িত হওয়ার প্রয়োজন নেই। ক্ষমতাধর দেশগুলোর দ্বন্দ্বের মধ্যে পড়ে একমুখী হয়ে পড়াও কাম্য নয়। বরং ভারসাম্যমূলক সম্পর্ক সৃষ্টি এবং কাউকে না চটিয়ে বা অসন্তুষ্ট না করে নিজের সুবিধা আদায় করে নেয়াই যুক্তিযুক্ত। আশার কথা, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তার দূরদর্শী নেতৃত্ব এবং দক্ষতার মাধ্যমে পররাষ্ট্রনীতির ক্ষেত্রে এই ভারসাম্য সৃষ্টি করতে সক্ষম হয়েছেন। বলা যায়, পররাষ্ট্রনীতির ক্ষেত্রে বাংলাদেশ সঠিক পথেই রয়েছে।
[email protected]
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।