পবিত্র লাইলাতুল বরাত
আজ দিবাগত রাত পবিত্র লাইলাতুল বরাত। পরম করুণাময় আল্লাহতায়ালা তার বান্দাদের গুনাহ মাফ, বিপদমুক্তি ও
আলো, বাতাস, পানি ও মাটি মানুষসহ প্রত্যেক প্রাণীর বেঁচে থাকার মূল অবলম্বন। এসবে দূষণ মানুষের আয়ু তথা সুস্থভাবে বেঁচে থাকার ক্ষেত্রে সরাসরি এবং পরোক্ষ প্রভাব রাখে। একটির দূষণ আরেকটির দূষণকে সরাসরি প্রভাবিত করে থাকে। যেমন, বাতাসে ছড়িয়ে পড়া কার্বন ডাই-অক্সাইড বা কার্বন মনোক্সাইড বায়ুমন্ডলের ওজন স্তরকে ক্ষতিগ্রস্ত করার কারণে সূর্যের অতি বেগুনি রশ্মি সরাসরি প্রাণীদেহের উপর প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে, ফলে মানুষের শরীরের ক্যান্সারের মতো জটিল ব্যাধির সৃষ্টি হয়। দূষণের ফলে উষ্ণায়ণ বা গ্লােবাল ওয়ার্মিং ও ক্লাইমেট চেঞ্জের শিকার হয়ে পুরো বিশ্ব অনেক বড় ঝুঁকির মুখে পড়েছে। গত দুই দশক ধরে বিশ্বসম্প্রদায়ের অন্যতম আন্তর্জাতিক এজেন্ডা হয়ে আছে গ্লােবাল ওয়ার্মিং ও ক্লাইমেট চেঞ্জ ইনিশিয়েটিভ। দূষণ ও জলবায়ু পরিবর্তনের মারাত্মক ঝুঁকিগুলোর প্রথম সারির প্রধান শিকার হতে চলেছে বাংলাদেশসহ তৃতীয় বিশ্বের উন্নয়নশীল দেশগুলো। গত দশকে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক ফোরামে জলবায়ু পরিবর্তনজনিত প্রাকৃতিক দুযোর্গ, সমুদ্রপৃষ্টের উচ্চতা বৃদ্ধি এবং কোটি কোটি মানুষের জলবায়ু উদ্বাস্তুতে পরিণত হওয়ার ক্ষেত্রে বাংলাদেশের সামনে থাকা ঝুঁকি ও চ্যালেঞ্জগুলো বার বার উঠে এসেছে। আমাদের সরকারের পক্ষ থেকেও এ ক্ষেত্রে কিছু চমৎকার উদ্যোগ গ্রহণের কথা বলা হয়েছে এবং সে সব ইনিশিয়েটিভ বিশ্বসংস্থায়ও প্রশংসিত হয়েছে। কিন্তু দূষণরোধ ও জলবায়ু পরিবর্তনের অনুঘটক ক্ষেত্রগুলোতে তেমন কোনো কার্যকর পরিবর্তন দেখা যাচ্ছে না।
গত কয়েক বছর ধরেই বায়ুদূষণ, পানিদূষণ, শহরের বসবাসযোগ্যতা ইত্যাদি আন্তর্জাতিক রেটিংয়ে উঠে আসছে বাংলাদেশ ও ঢাকা শহরের নাম। এবারও তার ব্যতিক্রম হয়নি। সম্প্রতি প্রকাশিত ‘স্টেট অব গ্লােবাল এয়ার ২০২০’ রিপোর্টে সারাবিশ্বে এবং বাংলাদেশে বায়ুদূষণের যে ভয়াবহ চিত্র উঠে এসেছে, তা সবার জন্যই উদ্বেগজনক। বিশেষত দক্ষিণ এশিয়ার প্রায় সবগুলো দেশই চরম বায়ুদূষণের শিকার। রিপোর্ট অনুসারে, গত বছর সারাবিশ্বে প্রায় ৬৭ লাখ মানুষের মৃত্যু হয়েছে। বায়ুদূষণের কারণে দক্ষিণ এশিয়ায় প্রায় ২১ লাখ মানুষের মৃত্যু হয়েছে। এর মধ্যে সর্বোচ্চ সংখ্যক ১৬ লাখ ৭০ হাজার মানুষের মৃত্যু হয়েছে ভারতে, পাকিস্তানে ২,৩৫,৭০০, বাংলাদেশে ১,৭৩,৫০০ এবং নেপালে এ সংখ্যা ৪২, ১০০ জন। ইতিপূর্বে প্রকাশিত আন্তর্জাতিক রিপোর্টে ২০১৭ সালে বাংলাদেশে বায়ুদূষণে মৃত্যুর সংখ্যা ছিল ১,২৩,০০, যা সর্বশেষ রিপোর্টের সংখ্যার চেয়ে অর্ধলক্ষ কম। বাংলাদেশে বায়ুর মান বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থার গাইডলাইন অনুসারে ঠিক রাখা গেলে এ দেশে মানুষের গড় আয়ু আরো অন্তত ১.৩ বছর বৃদ্ধি পেতো বলে রিপোর্টে উল্লেখ করা হয়েছে।
বাতাসের গ্রহণযোগ্য মানের হিসেবে যে পার্টিকুলেট ম্যাটার বা পিএম-২.৫ এর মাত্রাকে নির্দেশক হিসেবে গণ্য করা হয়। দক্ষিণ এশিয়ায় ভারত, পাকিস্তান ও বাংলাদেশের শতভাগ মানুষ পিএম-২.৫এর গ্রহণযোগ্য মাত্রার বহুগুণ বেশি দূষণ কবলিত বায়ু সেবন করছে। সমাজের প্রতিটি মানুষ ও প্রাণী জগতে এর বিরূপ প্রতিক্রিয়া দেখা যাচ্ছে। বিশেষত নবজাতক শিশু ও বয়স্ক মানুষের শ্বাসকষ্ট, স্বাস্থ্য জটিলতা ও মৃত্যুর অন্যতম নেপথ্য কারণ হচ্ছে বায়ুদূষণ। ফসিল জ্বালানির অপরিমিত, অপরিণামদর্শি ও নিয়ন্ত্রণহীন ব্যবহার, শিল্পকারখানার রাসায়নিক দূষণ এবং নাগরিক বর্জ্যরে অব্যবস্থাপনার শিকার হচ্ছে আমাদের আগামী প্রজন্ম এবং প্রতিটি মানুষ। বিশ্বের সবচেয়ে দূষিত বায়ুর দেশের তালিকায় প্রথম ১০টিতে স্থান পাচ্ছে বাংলাদেশ, ভারত, চীন, পাকিস্তানসহ দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলো। বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থার নির্দেশক রিপোর্ট অনুসারে কোনো স্থানের বাতাসে পিএম ২.৫ এর সর্বোচ্চ গ্রহণযোগ্য মাত্রা হচ্ছে প্রতি বর্গমিটারে ২৫ মাইক্রোগ্রাম, ঢাকার বাতাসে পিএম-২.৫ এর মাত্রা পাওয়া যাচ্ছে ৪৩.৩ মাইক্রোগ্রাম। এ ক্ষেত্রে দিল্লীর বাতাসে পিএম ২.৫এর ঘনত্ব ৯৮ মাইক্রোগ্রাম। শিল্পোন্নত দেশে পরিণত হওয়ার ক্ষেত্রে এগিয়ে থাকার প্রতিযোগিতায় চীন বড় ভূমিকা পালন করলেও বিশ্বের সবচেয়ে দূষিত বায়ু ও পরিবেশ দূষণে বাংলাদেশের এমন ঝুঁকির মধ্যে পড়ার মূল কারণ হচ্ছে, শিল্পকারখানা স্থাপন ও পরিবেশগত নিরাপত্তার ক্ষেত্রে সরকারের সংশ্লিষ্ট মহলের প্রয়োজনীয় তদারকি ও নিয়ন্ত্রণহীনতা। উন্নয়ন পরিকল্পনা বাস্তবায়ন, বনায়ন এবং কৃষি ব্যবস্থাকে জনস্বাস্থ্য ও পরিবেশগত নিরাপত্তার আওতায় নিয়ে আসার কার্যকর উদ্যোগ নিতে হবে। বিশেষত কলকারখানার দূষণ ও বর্জ্যব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার নিশ্চিত করতে হবে। শহরের নাগরিক বর্জ্যের ভাগাড়গুলোতে আগুন লাগিয়ে যে বিষাক্ত ধোঁয়ার সৃষ্টি করা হয়, তা বন্ধ করা গেলে নগরীতে বায়ুদূষণ প্রায় ৩০ ভাগ কমিয়ে আনা সম্ভব বলে একজন বিশেষজ্ঞ মত দিয়েছেন। পরিবেশগত সুরক্ষা, জনস্বাস্থ্য, জননিরাপত্তা ও অর্থনীতিতে বায়ু, পানি ও মাটি দূষণের ভয়াবহ ঝুঁকি নিরসনে জিরো টলারেন্স নীতি গ্রহণ করে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।