পটুয়াখালীর যুবক ক্বারী সাইয়্যেদ মুসতানজিদ বিল্লাহ রব্বানীর কোরআন তেলাওয়াতে মুগ্ধ যুক্তরাষ্ট্রবাসী
ইসলামি সভ্যতা ও সংস্কৃতি বিকাশে বাংলাদেশের অবদান অনস্বীকার্য। এদেশে ইসলামি সংস্কৃতি চর্চার ইতিহাস অনেক প্রাচীন।
বৈশ্বিক রাজনীতি-অর্থনীতিতে স্নায়ুযুদ্ধের ছায়া দৃশ্যমান। অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক আধিপত্য বিস্তারের এই স্নায়ুযুদ্ধে ভৌগলিক অবস্থান ও ভূ-রাজনৈতিক কারণে বাংলাদেশ গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। বাজার অর্থনীতিতে সারাবিশ্বে আধিপত্য প্রতিষ্ঠায় চীন ‘বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ’ (বিআরআই) নিয়ে অগ্রসর হচ্ছে। এতে বাংলাদেশসহ বিশ্বের প্রায় অর্ধশত দেশের মধ্যে যোগাযোগ অবকাঠামো গড়ে উঠবে। তারই পাল্টা পদক্ষেপ হিসেবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এশিয়া ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের দেশগুলো নিয়ে ইন্দো-প্যাসিফিক স্ট্র্যাটেজি (আইপিএস) গ্রহণ করেছে। এ পরিস্থিতিতে ভৌগলিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ অবস্থানে থাকা বাংলাদেশ ‘কারো সঙ্গে বৈরিতা নয়, সবার সঙ্গে বন্ধুত্ব’ নীতি গ্রহণ করেছে। এই ‘চেক অ্যান্ড ব্যালেন্স’ কূটনীতিতে বাংলাদেশ বেশ সাফল্য দেখিয়েছে। কিন্তু প্রশাসনের কিছু কিছু ব্যাক্তির দিল্লিতোষণ মানসিকতা ‘নতজানু পররাষ্ট্রনীতি’ বিতর্কের জন্ম দিয়েছে। যার বহিঃপ্রকাশ দেখা যায় মার্কিন উপ-পররাষ্ট্রমন্ত্রী স্টিফেন বাইগানের ঢাকা সফরের সময় দুই মন্ত্রীর সংবাদ সম্মেলনে। মার্কিন উপমন্ত্রী ইন্দো-প্যাসিফিক স্ট্র্যাটেজি কার্যকরে বাংলাদেশের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা দেখতে চান। অথচ পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. একে আব্দুল মোমেন বলেন, ‘মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশকে দিল্লির চোখে দেখে না’। যুক্তরাষ্ট্র আর বাংলাদেশের মন্ত্রীদের দ্বিপাক্ষিক বৈঠকের পর সংবাদ সম্মেলনে ‘দিল্লির চোখ’ আসলো কেন? উপস্থিত সাংবাদিকদের কেউ পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. মোমেনকে এ নিয়ে প্রশ্ন করেননি; অথচ মন্ত্রী নিজের থেকে এমন বক্তব্য দেন। এটা কী ‘ধর্মের কল বাতাসে নড়ে’ প্রবাদের বহিঃপ্রকাশ?
ওই সংবাদ সম্মেলনে পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. মোমেন বলেছেন, ‘যুক্তরাষ্ট্র দিল্লির চোখে ঢাকা দেখেন এটি আমাদের মিডিয়া বলে। আসলে তারা দিল্লির চোখে বাংলাদেশকে দেখে না। শুধু দিল্লির চেহারা দিয়ে ঢাকা দেখলে তিনি (মার্কিন উপমন্ত্রী) এখানে (ঢাকা) আসতেন না। এখানে তারা এসেছেন, আমাদের ভ‚রাজনৈতিক অবস্থানের জন্য। বাংলাদেশের সঙ্গে তারা বন্ধুত্বটা আরও গভীর করতে চায়’। অবশ্যই যুক্তরাষ্টের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ক অনেক গভীর। কিন্তু পাবলিক পারসেপশন কি বলে? ভারতের এনআরসি ইস্যুতে আসামের ১৯ লাখ মুসলিম বাংলাভাসীকে বাংলাদেশে পাঠিয়ে দেয়াসহ মোদি সরকারের একাধিক মন্ত্রীর ঔদ্ধত্যপূর্ণ নানান হুংকারের কারণে ২০১৯ সালে বাংলাদেশের তিনজন মন্ত্রীর দিল্লি সফর স্থগিত-বাতিল করা হয়। তিস্তা প্রজেক্টসহ বাংলাদেশের বিভিন্ন প্রকল্পে চীনের বিনিয়োগ ইস্যুতে দিল্লির দাদাগিরি অগ্রাহ্য করায় বাংলাদেশের মানুষ দারুণ খুশি। বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহৎ অর্থনীতির দেশ চীন বাংলাদেশে বিপুল পরিমাণ বিনিয়োগ করেছে। সরকারের এসব সময়োপযোগী সিদ্ধান্তে মানুষ সাধুবাদ জানিয়েছে। কিন্তু প্রশাসনের কিছু কিছু ব্যাক্তি ভারতের প্রতি অধিক অনুগত্য দেখিয়ে যাচ্ছেন। তাদের এই অধিক আনুগত্য ও তোষামোদির সুযোগ নিয়ে দিল্লি সব সময় ঢাকার ওপর দাদাগিরি করার সুযোগ পাচ্ছে। যার কারণে দেশের মানুষ মনে করছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র চীনকে সাইজ করতে সব সময় দিল্লির চোখে ঢাকাকে দেখেন। যা কারোই কাম্য নয়। তাছাড়া লাদাখে চীনের কাছে নাস্তানাবুদ ভারত চায় যুক্তরাষ্ট্রকে ব্যবহার করে বাংলাদেশকে সঙ্গে নিয়ে চীনের বিরুদ্ধে শক্ত অবস্থান। কিন্তু ভঙ্গুর অর্থনীতির ভারতের পক্ষ্যে সেটা কঠিন বৈকি!
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে চলছে নির্বাচনী ডামাডোল। করোনা ইস্যু এবং প্রেসিডেন্টের লাগামহীন কথাবার্তার কারণে ডোনাল্ড ট্রাম্প প্রশাসন চরম কোনঠাসা। তারপরও পররাষ্ট্রমন্ত্রী মাইক পাম্পেও চলতি মাসেই শ্রীলংকা, ভারত ও মালদ্বীপ সফর করবেন। সেই সফরের প্রস্তুতি হিসেবে মার্কিন উপ-পররাষ্ট্রমন্ত্রী স্টিফেন বাইগান দিল্লি সফরে এসে ঢাকা ঘুরে যান। শুধু প্রভাব প্রতিপত্তি নয়, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র অর্থনৈতিক কারণেও বাংলাদেশের কাছে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কারণ তৈরি পোশাক রফতানির বিশাল বাজার সে দেশে। এ ছাড়াও কয়েক লাখ বাংলাদেশি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে বসবাস করেন। দেশের শিক্ষিত তরুণ-তরুণীদের বড় অংশ যুক্তরাষ্ট্রে গিয়ে ভাগ্য বদলের স্বপ্ন দেখে থাকেন। তাই অর্থনৈতিক কারণেও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র খুবই গুরুত্বপূর্ণ বন্ধু বাংলাদেশের কাছে। আর ’৭১ মুক্তিযুদ্ধের সময় যুক্তরাষ্ট্রের বিতর্কিত ভূমিকা থাকলেও প্রায় অর্ধশত বছর ধরে দেশটি বাংলাদেশের পাশেই রয়েছে। সেই যুক্তরাষ্ট্রকে এখন দিল্লি ভায়া হয়ে ঢাকার দিকে তাকাতে হবে কেন?
কার্যত অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিকভাবে চীন এখন পরাশক্তি। বিশ্বের দেশে দেশে চীনের বিনিয়োগ যুক্তরাষ্ট্রের জন্য মাথাব্যাথার কারণ হয়ে গেছে। সেই চীনকে ঠেকানোর জন্যই যুক্তরাষ্ট্র ইন্দো-প্যাসিফিক স্ট্র্যাটেজির ওপর জোর দিয়েছে। ওয়াশিংটন চায় আইপিএস জোটে ঢাকার সক্রিয় অংশগ্রহণ। এতে করে চীনকে কিছুটা হলেও ঠেকিয়ে দেয়া যাবে। কিন্তু বাংলাদেশের বাম ধারার রাজনৈতিক দলগুলো ইতোমধ্যেই বাংলাদেশের ইন্দো-প্যাসিফিক স্ট্র্যাটেজিতে যোগ দেয়ার বিপক্ষে অবস্থান নিয়েছে। তাদের বক্তব্য যুক্তরাষ্ট্রের কথায় সউদী আরবের সঙ্গে সামরিক চুক্তি করে বাংলাদেশ ঠিক করেনি। এখন আইপিএসে যোগদান হবে আত্মঘাতি।
গত কয়েক বছরের বৈশ্বিক পরিমন্ডলের বিনিয়োগের চালচিত্রের দিকে তাকালে দেখা যায় বিভিন্ন দেশের বড় বড় উন্নয়ন প্রকল্পে বিনিয়োগ, অবকাঠামো নির্মাণ, আর্থিক ঋণ, অস্ত্র ক্রয়বিক্রয় সবকিছুই ভূ-রাজনীতি ও কৌশলের সঙ্গে সম্পর্কিত। যুক্তরাষ্ট্র এবং চীন দুই বড় দেশের ক্ষেত্রেই একই চিত্র। যার কারণে মাতারবাড়ি বিদ্যুৎ কেন্দ্র প্রকল্পে জাইকা বিনিয়োগের পর জাপান বলছে বাংলাদেশ দ্য বে অব বেঙ্গল ইন্ডাস্ট্রিয়াল গ্রোথ বেল্টে (বঙ্গোপসাগরীয় শিল্প প্রবৃদ্ধি অঞ্চল) যুক্ত হয়েছে। মূলত বাংলাদেশ ২০১৪ সালে এই বিগ বি’তে সমর্থন জানায়। এই দুই বছর পর ২০১৬ সালে বাংলাদেশ চীনের বিআরআইতে আনুষ্ঠানিকভাবে যুক্ত হয়। এটা দেখেই ২০১৭ সালে যুক্তরাষ্ট্র জাতীয় নিরাপত্তা (কার্যত আধিপত্য) কৌশল প্রণয়ন করে। ২০১৮ সালে চীনকে ঠেকাতে যুক্তরাষ্ট্র এশিয়া ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের দেশগুলো নিয়ে ইন্দো-প্যাসিফিক স্ট্র্যাটেজি গ্রহণ করে। ঢাল তলোয়ালবিহীন ভারত সেখানেও বাংলাদেশের গার্জেন সাজতে চায়।
দেশের রাষ্ট্রবিজ্ঞান এবং আন্তর্জাতিক রাজনৈতিক সম্পর্ক নিয়ে যারা গবেষণা করেন তাদের মতে, এই অঞ্চল ঘিরে যে ভূ-রাজনৈতিক মেরুকরণ তৈরি হয়েছে, তাতে বাংলাদেশ খুবই গুরুত্বপূর্ণ অবস্থানে। তাই জাতীয় স্বার্থে দেশের সার্বিক উন্নয়নের বিষয়টি বিবেচনায় নিয়ে বাংলাদেশকে এসব উদ্যোগের ব্যাপারে অবস্থান ঠিক করতে হবে। ‘সবার সঙ্গে বন্ধুত্ব কারো সঙ্গে শত্রুতা নয়’ কৌশল গ্রহণ করেই আন্তর্জাতিক পরিমন্ডলে নিজেদের স্বার্থকে সমুন্নত রাখা আবশ্যক। এ জন্য জাতীয় পর্যায়ে একটি সমন্বিত নীতিগত কৌশল প্রণয়ন বাংলাদেশের জন্য জরুরি। এতে ভ‚রাজনৈতিক মেরুকরণের বাস্তবতায় ভারসাম্য বজায় রাখতে দর-কষাকষির সুযোগ সৃষ্টি হবে। বাংলাদেশ সেটা করেছে। যার কারণে ভারতের বাধা-অপপ্রচার উপেক্ষা করে চীনের সঙ্গে উন্নয়ন সম্পর্কিত সম্পর্ক গড়ে তুলেছে। করোনার মধ্যেই চীন তার বন্ধু দেশগুলোকে প্রয়োজনীয় সহায়তা দিয়ে যাচ্ছে। চীন করোনাকালেও পাকিস্তান, শ্রীলংকা, বাংলাদেশ, আফগানিস্তান, নেপালের প্রতি সহযোগিতার হাত বাড়িয়েছে। নতুন নতুন বিনিয়োগসহ নানাভাবে সহায়তা করে যাচ্ছে। অন্যদিকে মোদি সরকারের হিন্দুত্ববাদী নীতির ‘রামরাজত্ব’ কায়েমের ভারতের বিশৃংখল পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে। এর সঙ্গে বৈশ্বিক মহামারি করোনা পরিস্থিতিতে দেশটির অর্থনৈতিক দূরবস্থা চরম পর্যায়ে চলে গেছে। নিজেদের অর্থনৈতিক বিপর্যয়ের মুখে ভারতের দাদাগিরি বাংলাদেশের মানুষের কাছে গ্রহণযোগ্য নয়। বাংলাদেশ কার্যত দিল্লির ‘নাক গলানো’ সুকৌশলে এড়িয়ে চীনের বিনিয়োগকে প্রাধান্য দিয়ে কূটনৈতিক দূরদৃষ্টির পরিচয় দিয়েছে। কিন্তু কথায় কথায় কিছু মন্ত্রী ও কিছু আমলার ‘দিল্লি তোষণ’ সাধারণ মানুষকে সন্দিহান করে তুলেছে। কারণ ভারত যুগের পর যুগ ধরে তিস্তা চুক্তি ঝুলিয়ে রাখালেও এই ব্যাক্তিদের খারাপ লাগে না। অথচ ভারতকে ট্রানজিট ও নৌ বন্দর ব্যবহার করতে দিয়ে ‘শুল্ক আদায়’ বন্ধুরাষ্ট্রের জন্য অমর্যাদাকর বলে প্রচার করেন। দায়িত্বশীল চেয়ারে থেকে এরা দিল্লির সাউথ ব্লককে খুশি করতে বাংলাদেশ ভারতের বন্ধুত্বের সম্পর্ককে ‘স্ত্রী-স্বামীর’ সম্পর্কের সঙ্গে তুলনা করেন। এদের কাছে ‘মায়ের চেয়ে মাসির দরদ’ বেশি। সরকারের উচিত প্রশাসনের ভিতরের এই দিল্লির তাবেদারদের চিহ্নিত করা। সেটা করতে না পারলে যতই কূটনৈতিক সাফল্য দেখানো হোক না কেন ‘যুক্তরাষ্ট্র দিল্লির চোখে ঢাকা দেখে’ এই পাবলিক পারসেপশন দূর হবে না।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।