পবিত্র লাইলাতুল বরাত
আজ দিবাগত রাত পবিত্র লাইলাতুল বরাত। পরম করুণাময় আল্লাহতায়ালা তার বান্দাদের গুনাহ মাফ, বিপদমুক্তি ও
২০১৯ সালের জরিপ মতে, বিশ্বের ১১৮টি দেশের মধ্যে ধর্ষণের সংখ্যা প্রতি লাখে: সাউথ আফ্রিকা ১৩২ জন, বোতসোয়ানা ৯৩, লেসেথো ৮৩, সোয়াজিল্যান্ড ৭৮, বারমুডা ৬৭, সুইডেন ৬৩, সুরিনাম ৪৫, কোস্টারিকা ৩৭, নিকারাগুয়া ৩২, গ্রেনাডা ৩১, বাংলাদেশ ১০ (তালিকায় ৪০তম) ও ভারত ১.৮ জন। এছাড়া, এ তালিকায় যুক্তরাষ্ট্র ১৪তম, জার্মানি ৪২তম বলে গত ৯ অক্টোবর ডয়চে ভেলের খবরে প্রকাশ। গত ৩ অক্টোবর ভোয়ার খবরে প্রকাশ, ‘একটির পর একটি গণধর্ষণের ঘটনা ঘটে যাচ্ছে। এ ধরনের অপকর্ম পুরো বিশ্বজুড়ে বৃদ্ধি পেয়েছে, বিশেষ করে এই করোনা মহামারির সময়েও। অনেকে বলছেন, নারীরা যেন ভোগ্যপণ্য হয়ে দাঁড়িয়েছে। ধর্ষণ নিয়ে বহু আলোচনা-সমালোচনা তর্কবিতর্ক চলছে। কিন্তু এ থেকে পরিত্রাণ মিলছে না। ছোট্ট একটি শিশু যে নাকি জীবিকার তাকিদে পথে ফুল বিক্রি করছে, সে পর্যন্ত ঐ ছোবল থেকে ছাড়া পাচ্ছে না। আশ্চর্যের বিষয় হচ্ছে, এই ধর্ষণগুলোর জন্য ক্রমাগত নারীদেরকেই দোষারোপ করা হচ্ছে।’ ভোয়া ও এনসিআরবি’র রিপোর্ট মতে, ‘ভারতে প্রতি ষোলো মিনিটে একটি করে ধর্ষণ হয়, পণঘটিত কারণে প্রতি ঘণ্টায় একজন করে মহিলার মৃত্যু হয়, প্রতি চার ঘণ্টায় একজন করে মেয়েকে পাচার করা হয়, প্রতি ৪ মিনিটে একজন গৃহবধূ তাঁর শ্বশুর বাড়িতে নির্যাতনের শিকার হয়।’ বাংলাদেশের পরিস্থিতিও প্রায় অনুরূপ। গত ৭ অক্টোবর বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সাবেক উপদেষ্টা ও বিশিষ্ট অপরাধ বিজ্ঞানী ড. মোজাহেরুল হক বলেন, ‘বাংলাদেশে গত সাড়ে চার বছরে সাড়ে সাত হাজার নারী ধর্ষিত হয়েছে। আর গত চার মাসে ধর্ষিত হয়েছে ৮ শতাধিক নারী।’ ইউএন উইমেনের বাংলাদেশ প্রতিনিধি শোকো ইশিকাওয়া গত ১১ অক্টোবর প্রকাশিত এক দৈনিককে বলেন, ‘২০১১ সালের এক গবেষণায় আমরা দেখেছি, নারীকে যৌন নির্যাতন করেছেন এমন পুরুষদের প্রায় ৩০% বলেছেন, তাঁরা মনে করেন নারীদের সঙ্গে এ রকম আচরণ করার অধিকার তাদের আছে। তারা বলেছেন যে তারা নারীদের শাস্তি দিয়েছেন এবং শাস্তি দেওয়ার মাধ্যমে নিজের ক্রোধ মিটিয়েছেন, এ অধিকার তাদের আছে। ৭৭% শহুরে পুরুষ এবং ৮১% গ্রামাঞ্চলের পুরুষ বলেছেন, তারা মনে করেন যে যৌনতা হলো পুরুষের অধিকার। এ মানসিকতা হলো টক্সিক ম্যাসকুলিনিটি বা বিষাক্ত পৌরুষ্যের মানসিকতা। নারীকে ধর্ষণসহ অন্যান্য সহিংসতা এবং অপমান থেকে রক্ষা করতে হলে সমাজকে এ বিষাক্ত পৌরুষ্য থেকে মুক্ত করতে হবে।’ বাংলাদেশের পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী গত ১২ অক্টোবর বলেছেন, ‘দেশে নারী এবং শিশুদের প্রতি যৌন হয়রানি এবং সহিংসতা একটি সংক্রামক রোগে পরিণত হয়েছে।’ অর্থাৎ বাংলাদেশে ধর্ষণের ঘটনা ভয়াবহ রূপ নিচ্ছে। বাড়ছে ধর্ষণের পর হত্যা করার মতো নৃশংস ঘটনা। শহরে, বন্দরে, গ্রামে, কর্মস্থলে, গণপরিবহনে তথা দেশের সর্বত্রই ঘটছে ধর্ষণের ঘটনা। বাদ যাচ্ছে না কন্যাশিশু, বৃদ্ধা ও প্রতিবন্ধীরাও। নারীর প্রতি পুরুষের এ মানসিকতা কম-বেশি বিশ্বব্যাপীই বিদ্যমান, যা সভ্যতার কলঙ্ক!
ধর্ষণের বিরুদ্ধে প্রায় সব দেশে বহু আইন রয়েছে। তাতে রয়েছে কঠোর শাস্তি। যেমন: ভারত, ইরান, চীন, গ্রিস ও রাশিয়াসহ ইউরোপের বিভিন্ন দেশে ধর্ষণের সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদন্ড। যুক্তরাষ্ট্র, নরওয়েসহ উন্নত দেশগুলোতে ধর্ষণের সর্বোচ্চ শাস্তি ৩০ বছর কারাদন্ড। বাংলাদেশের আইনে ধর্ষণের সর্বোচ্চ শাস্তি যাবজ্জীবন কারাদন্ড থাকলেও কদিন আগে মৃত্যুদন্ড করা হয়েছে। অর্থাৎ প্রায় সব দেশেই ধর্ষণের কঠোর শাস্তির বিধান আছে। কিন্তু তবুও এ চরম পৈশাচিক কর্ম বন্ধ হয়নি। বরং দিন দিন বেড়েছে। সাম্প্রতিক সময়ে তা মহামারির আকার ধারণ করেছে। বিশেষ করে বাংলাদেশ ও ভারতে!
বাংলাদেশের সংশ্লিষ্ট আইনে সংশোধন করে মৃত্যুদন্ডের বিধান অধ্যাদেশ আকারে কার্যকর করায় অনেকেইে সন্তোষ প্রকাশ করেছেন। উল্লেখ্য, এই আইনে প্রথম রায়ও হয়েছে, যাতে ৫ জন ধর্ষণকারীর মৃত্যুদন্ড দেয়া হয়েছে। পর্যবেক্ষকদের মতে, এ আইন সঠিকভাবে বাস্তবায়িত হলে দেশে ধর্ষণ বন্ধ হবে। অবশ্য, নারী ও শিশু নির্যাতনের মিথ্যা বা হয়রানিমূলক মামলার সংখ্যাও বিস্তর রয়েছে দেশে। পুলিশের ভাষ্যমতেই জানা যায়, এসব মামলার ৮০ ভাগেরই কোনো বাস্তব ভিত্তি পাওয়া যায় না। তাই এ ব্যাপারে সাবধান থাকা আবশ্যক। মিথ্যা মামলাকারীর বিরুদ্ধেও কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করা দরকার। নতুবা আইনের অপব্যবহার হতে পারে। কিছু আইন বিশেষজ্ঞ বলেছেন, আইনে শাস্তি বাড়ালেই অপরাধ কমবে তার নিশ্চয়তা নেই। তাছাড়া, আইনের প্রয়োগ যদি যথাযথ না হয়, তদন্ত যদি সুষ্ঠু না হয়, মামলার ভিকটিম বা সাক্ষীদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা না হয়, তাহলে ন্যায়বিচার নিশ্চিত করা যাবে না। দেশের ৯৫টি নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালে বর্তমানে প্রায় পৌনে দুই লাখ মামলা বিচারাধীন রয়েছে। এর মধ্যে ৫ বছরের পুরনো মামলাও রয়েছে, যার সংখ্যা অন্তত ৪০ হাজার। অথচ, বিদ্যমান নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনে সর্বোচ্চ ৯০ কার্যদিবসের মধ্যে ট্রাইব্যুনালে প্রতিবেদন দাখিলের সুস্পষ্ট নির্দেশনা ছাড়াও ১৮০ দিনের মধ্যে বিচারকাজ সম্পাদনের কথা বলা হয়েছে, কিন্তু বাস্তবতা সম্পূর্ণ ভিন্ন। এসব বিষয় বিবেচনা করে অনেক পন্ডিত ব্যক্তির অভিমত হচ্ছে, প্রমাণিত ধর্ষকদের তাৎক্ষণিক দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি প্রদান করা উচিৎ। ধর্ষণ ও নির্যাতন ছাড়াও নারীরা নানা অবিচারের সম্মুখীন হচ্ছে অনবরত। গত ৭ অক্টোবর প্রকাশিত ইউনিসেফের প্রতিবেদন মতে, ‘বাংলাদেশে বাল্যবিয়ের হার কমে এখন ৫১% হয়েছে, যা সংখ্যায় ৩.৮০ কোটি। বাল্যবিবাহের হার বেশি, বিশ্বের এমন ১০টি দেশের একটি বাংলাদেশ। আর দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে সবেচেয়ে বেশি। এর আগে বাংলাদেশে বাল্যবিবাহের হার ছিল ২০১১ সালে ৫২% ও ২০১৮ সালে ৫৯%। আইএলও’র গ্লােবাল ওয়েজ রিপোর্ট-২০১৮’ মতে, বিশ্বে লিঙ্গ ভিত্তিক আয় বৈষম্যের গড় ২১.২%। উপরন্তু পুরস্কারের ক্ষেত্রেও নারীরা চরম অবহেলার শিকার। যার প্রকৃষ্ট উদাহরণ, নারীদের নোবেল প্রাপ্তি মোট সংখ্যার মাত্র ৫%। আর যে কমিটিগুলো এই নোবেলের জন্য মনোনীত করে, সেই কমিটিতেও নারীর উপস্থিতি কম! বিশ্বব্যাংকের ‘নারী, ব্যবসা ও আইন’ শীর্ষক রিপোর্ট-২০১৯ মতে, গড়ে সারা বিশ্বে পুরুষদের তিনভাগের একভাগ অধিকার ভোগ করে নারীরা। বিশ্বের ১৮৭টি দেশের মধ্যে মাত্র ৬টিতে নারী-পুরুষের সমতা বিরাজ করছে। দাসত্ব বিরোধী সংস্থা ওয়াক ফ্রি’র সহ-প্রতিষ্ঠাতা গ্রেস ফরেস্ট গত ৯ অক্টোবর জাতিসংঘের এক সংবাদ সম্মেলনে বলেন, ‘বিশ্বের ২.৯০ কোটি নারী ও কিশোরী জোরপূর্বক শ্রম, বিয়ে, যৌতুক ও অভ্যন্তরীণ দাসত্বের তথা আধুনিক দাসত্বের শিকার। তন্মধ্যে ৯৯% নারী জোরপূর্বক যৌন নিগ্রহ, ৮৪% জোরপূর্বক বিয়ে এবং ৫৮% জোরপূর্বক শ্রমের শিকার। প্রতি ১৩০ জন নারী ও কন্যাশিশুর অন্তত একজন আধুনিক দাসত্বের শিকার।’ জাতিসংঘের মতে, জোর করে ও ভয়ভীতি দেখিয়ে কাজে বাধ্য করাই এক ধরনের দাসত্ব। আগামী ২০৩০ সালের মধ্যে এ ধরনের দাসত্ব বন্ধের অঙ্গীকার করেছে জাতিসংঘ। অপরদিকে, নারীর দ্বারা নারী নির্যাতনের সংখ্যাও ব্যাপক। এসব নির্মূল করতে না পারলে প্রতিবছর বিশ্বব্যাপী আড়ম্বরপূর্ণভাবে শিশু দিবস, নারী দিবস ও কণ্যাশিশু দিবস পালন করা বৃথা।
নারীর বর্ণিত অবর্ণনীয় দুর্দশার মধ্যেও তাদের অগ্রযাত্রা বন্ধ হয়ে যায়নি। তারা সুযোগ পেলেই বিভিন্ন ক্ষেত্রে ঈর্ষণীয় সাফল্য অর্জন করেছেন এবং তা ক্রমান্বয়ে ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পাচ্ছে। তাই নারীর প্রতি অবিচারগুলো বন্ধ করে শিক্ষা ও ক্ষমতায়নে পুরুষের সমান করা হলে বিশ্বের শান্তি ও উন্নতি ত্বরান্বিত হবে নিঃসন্দেহে। স্মরণীয় যে, বর্তমানে যে পরিবারে নারীর শিক্ষা ও ক্ষমতায়ন হয়েছে, সে পরিবারের আর্থিক উন্নতি ও সন্তানের শিক্ষা বেশি। উপরন্তু জন্মহারও কম এবং তা পরিকল্পিতভাবে। পশ্চিমা দেশগুলোতে নারীর শিক্ষা ও ক্ষমতায়ন প্রায় পুরুষের সমান। তাই সেখানে উন্নতি সর্বাধিক এবং তা টেকসই। একই অবস্থা এশিয়ার সিঙ্গাপুর, জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া ও চীনেও। সর্বোপরি সম্প্রতি বিজ্ঞানীরা গবেষণা করে জানিয়েছেন, একজন শিশুর বুদ্ধিমত্তা নির্ভর করে তার মায়ের জিনের ওপর। সেখানে বাবার জিনের কোনো ভূমিকা নেই। মায়ের জিন থেকেই শিশুর মস্তিষ্কে বুদ্ধিমত্তার বিকাশ ঘটে। অর্থাৎ এতদিন like father like son বলে যে ধারণা ছিল জনমনে, তা ভুল, অবৈজ্ঞানিক। বর্তমানে বৈজ্ঞানিক থিউরি হচ্ছে, like mother like son. কিন্তু মা যদি শিক্ষিত ও বুদ্ধিমত্তাসম্পন্ন না হন, তাহলে তার সন্তান বুদ্ধিমান হবে কীভাবে? তাই সংসারের তথা দেশের, এমনকি বিশ্বের সার্বিক উন্নতি ও সন্তানদের উজ্জ্বল ভবিষ্যতের জন্য নারীর শিক্ষা ও ক্ষমতায়ন জরুরি। নতুবা মোট জনসংখ্যার অর্ধেক নারী, তাদেরকে শিক্ষা ও ক্ষমতায়নে পিছিয়ে রেখে কাক্সিক্ষত উন্নতি সম্ভব নয়। উল্লেখ্য যে, নারীদের প্রতি অবিচার বন্ধ করার জন্য পুরুষের মানসিকতার পরিবর্তন করা আবশ্যক। নারীর প্রতি অবিচারগুলো বন্ধ করার জন্য সরকারের সংশ্লিষ্ট আইনগুলো কঠোরভাবে বাস্তবায়ন করা দরকার। উপরন্তু এ ক্ষেত্রে রাজনৈতিক, সামাজিক, মিডিয়ায়ও বলিষ্ঠ ভূমিকা পালন করা প্রয়োজন।
লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।