Inqilab Logo

মঙ্গলবার ১৯ নভেম্বর ২০২৪, ০৪ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ১৬ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

জীবন ও প্রযুক্তি যেখানে একাকার

অজয় কান্তি মন্ডল | প্রকাশের সময় : ১৬ অক্টোবর, ২০২০, ১২:০৭ এএম

জ্ঞান অর্জনের জন্য প্রয়োজনে সুদূর চীন দেশে যাও- উক্তিটি কমবেশি সবারই জানা। নিজের অভিজ্ঞতা থেকে বলতে পারি, হ্যাঁ, আসলেই জ্ঞান অর্জনের জন্য জীবনে অন্তত একবার হলেও চীন দেশ ঘুরে যাওয়া প্রত্যেকের উচিত। চীনাদের জীবনযাপনের এমন কোনো দিক নেই, যেখানে তারা অন্যদের থেকে ব্যতিক্রম নয়। বিশেষ করে বর্তমানে তারা তাদের জীবন ব্যবস্থাকে এমনভাবে জড়িয়ে নিয়েছে যা অন্য অনেকের পক্ষে ভাবনারও অতীত। দেশটিতে প্রযুক্তির ছোঁয়া নেই এমন কোনো জায়গা এখানে খুঁজে পাওয়া মুশকিল।

চীন নামটা শুনলেই আমরা বাংলাদেশিসহ আশপাশের অনেক দেশের মানুষ নাক শিটকাই। সেটায় স্বাভাবিক, দেশে কমদামী চীনা পণ্যের রমরমা বাণিজ্য দেখে আমরা ভাবি, চীন ও এই কমদামী জিনিসের মতো নড়বড়ে। কিন্তু বাস্তবতা আসলে মুদ্রার এপিঠ ওপিঠ। ছোট্ট একটা গল্প দিয়ে শুরু করতে চাই, গতবছর আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ে একটা আন্তর্জাতিক সম্মেলন উপলক্ষে দেশ থেকে কিছু পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা আমন্ত্রিত অতিথি হিসাবে এসেছিলেন। দলের বেশিরভাগই ছিলেন প্রথমবার চীনে এসেছেন এমন। তাদের ইচ্ছা ছিল এখান থেকে সস্তায় কিছু চীনা পণ্য কিনে দেশে নিয়ে যাবেন। তাই বলতে গেলে একবারে খালি লাগেজ নিয়ে উনাদের এখানে আসা এবং কমদামী চীনা পণ্যে লাগেজ ভরে দেশে নেওয়ার ইচ্ছা। তাদের অনেকেই ইতোমধ্যে বেশ কিছু উন্নত দেশ ভ্রমণ করছেন কিন্তু এবারের অভিজ্ঞতা নাকি তাঁদের ধারণার বাইরে। রাস্তা, ট্রাফিক ব্যবস্থা আর সু-উচ্চ নজর কাড়া ভবনগুলো স্যারদের খুব বেশি আকর্ষণ করেছিল। এক সন্ধ্যায় আমরা কয়েকজন দেশি বন্ধু মিলে বের হয়েছিলাম উনাদের আবাসিক হোটেলের আশপাশের কিছু মার্কেটে একটু ঘুরে বেড়ানোর উদ্দেশ্যে। কিছু শপিং মল, লোকাল মার্কেট ঘোরার পরে তারা কিছুই মেলাতে পারলেন না, অন্তত যেগুলো দিয়ে লাগেজের অল্প একটু জায়গাও ভরা যায়। একজন স্যার আমাকে ফিস ফিস করে বললেন ‘কমদামী কিছু কম্বল, সিট কাপড় আমার খুব দরকার ছিল’ এখানে পাওয়া যাবে কিনা। আমি স্যারকে বললাম, ‘এখানে যেগুলোর যেমন দাম দেখলেন সবখানে ওই একই রকম হবে, দামের খুব সামান্য হেরফের হতে পারে’। স্যারেরা বললেন, ‘এর থেকে আমাদের দেশেই ভালো, অনেক কম দামে ভালো ভালো চাইনিজ জিনিস পাই’।

আসল বাস্তবতা হচ্ছে এটাই। চীনারা যেদেশ যেমন দামে যেমন পণ্য চায় ঠিক সেই পরিমাণ পণ্য শুধু সে দেশের জন্যই তৈরি করে রপ্তানি করে। রপ্তানি বাণিজ্যে সব দেশকে টপকে নিজেদের বিশ্বের এক নম্বরে রাখার চীনা সরকারের এটা একটা অভিনব কৌশল বললেও ভুল হবে না। তবে, এদের নিজেদের ব্যবহৃত জিনিসের গুণগত মান ওইসব পণ্যের ধারে কাছেও নেই।

ট্রাফিক ব্যবস্থা ও গণ পরিবহন: চীনাদের ট্রাফিক ব্যবস্থা সত্যিই নজর কাড়ার মতো। রাস্তায় ট্রাফিক পুলিশের দেখা মেলে না তবে অফিস টাইমে কিছু ট্রাফিক পুলিশ তাদের নির্দিষ্ট স্থানে দাঁড়িয়ে থাকে। তারপরেও একজন ব্যক্তি ট্রাফিক সিগন্যাল অমান্য করে চলে না। প্রত্যেক সিগন্যাল এবং সমস্ত রাস্তা সিসি ক্যামেরার আওতাধীন, তাই ট্রাফিক নিয়ম অমান্যকারীকে তাৎক্ষণিকভাবে ক্যামেরায় ডিটেক্ট করে উপযুক্ত শাস্তির বিধান রয়েছে। সেজন্য বাধ্যতামূলক ট্রাফিক আইন মেলে চলা সকলের গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব বলে এরা সবাই মনে করে। রাস্তায় হাজার হাজার গাড়ি, কিন্তু কোনো হর্নের শব্দ শোনা যায় না। পথচারী যদি একটু অন্যমনস্ক হয়ে রাস্তা দিয়ে হাঁটেন বা রাস্তা পার হন তাহলে প্রাইভেট কার, বাসসহ অন্যান্য যানবাহনের চালক নিজেরা অপেক্ষা করে পথচারীকে রাস্তা পারের সুযোগ করে দেয়। রাস্তায় বাস, ট্যাক্সি, ই-বাইক, সাইকেল চালানোর সময় কারো ভিতর কোনো প্রতিযোগিতা (কে কার আগে যাবে) নেই।

কোন হেল্পার বা অন্য কারো সাহায্য ছাড়াই বিশাল বড় বড় বিলাসবহুল পাবলিক বাস একজন মহিলা বা পুরুষ চালকের তত্ত্বাবধায়নে যথাসময়ে গন্তব্যে আসা-যাওয়া করছে। প্রতিবার রাউন্ড দেওয়ার পরপরই গ্যারেজে ঢুকলে দায়িত্বরত ব্যক্তি ১-২ মিনিটের ভিতর বাসগুলোকে ধুয়ে মুছে একবারে পরিষ্কার করে দিচ্ছে। সবগুলো বাসে জিপিএস ব্যবস্থা চালু করা, তাই চালক ইচ্ছে করলেই একজায়গায় দাঁড়িয়ে সময় ক্ষেপণ করবে সে সুযোগ নেই। বাসগুলো সবই শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত, ভিতরে টিভি পর্দায় সার্বক্ষণিক বিভিন্ন ভিডিও চলে এবং প্রতিটা স্টপেজ আসার আগেই টিভি পর্দায় যাত্রীদের সতর্কতামূলক ঘোষণা দেওয়া হয়। ১ ইউয়ান (১২.৫ টাকা) দিয়ে ৫০-৬০ কি.মি. রাস্তা যাওয়া যায়। তবে যেখানেই নামবেন ওটাই দিতে হবে সেটা এক স্টপেজ পরে হলেও (প্রদেশভেদে কম বেশি হতে পারে)। বাসের দরজাগুলো খোলা এবং বন্ধ হওয়া চালক তার সিটে বসেই নিয়ন্ত্রণ করে। সামনের দরজায় যাত্রী ওঠা এবং পিছনেরটা দিয়ে নামার কাজে ব্যবহৃত হয়। যাত্রী ওঠার পথে রাখা কিউআর কোড মোবাইলে স্ক্যান করে, ব্যাংক কার্ড পাঞ্চ করে বা নির্দিষ্ট বক্সে টাকা রেখে ভাড়া পরিশোধের ব্যবস্থা আছে। প্রতিটা বাসে কমপক্ষে ৪ থেকে ৫টা ক্যামেরা আছে, যেগুলোর মাধ্যমে যাত্রীদের ওঠানামা, ভাড়া পরিশোধ, চালকের সতর্কতা সার্বক্ষণিক কর্তৃপক্ষ তদারকি করেন। বাসে ওঠার পরেই সিটে বসার জন্য কেউ হুড়োহুড়ি করে না, বরং সবাই দাঁড়িয়ে থাকতেই সাচ্ছন্দ্য বোধ করে।

মাটির নিচে আছে আরেক পৃথিবী সেখানে মেট্রোরেলগুলো প্রতি ৫ মিনিট পর পর আসছে। খুব অল্প সময়ে নির্দিষ্ট গন্তব্যে পৌঁছাতে মেট্রোরেলের জুড়ি মেলা ভার। কর্মস্থল থেকে বাসা শত শত মাইল দূরে হলেও মেট্রোরেলের সাহায্যে খুব সহজেই নির্দিষ্ট সময়ে সেখানে পৌঁছে যাওয়া যায়। প্রতিটা মেট্রোরেলের প্রবেশদ্বার, বের হওয়ার পথে সার্বক্ষণিক চলন্ত সিঁড়ি, পায়ে হেঁটে নামার সিঁড়ি, পাশাপাশি শারীরিক প্রতিবন্ধীদের হুইল চেয়ার নিয়ে ওঠা নামার সুবিধাসহ শীততাপ নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে প্রতিটা মেট্রো স্টেশনে টিকিট কাটা থেকে শুরু করে বের হয়ে আসার আগ পর্যন্ত আছে অত্যাধুনিক প্রযুক্তির ছোঁয়া। কোনো রকম ঝক্কি-ঝামেলা ছাড়াই নির্দিষ্ট সময়ের ভিতর কাক্সিক্ষত গন্তব্যে পৌঁছানোর জন্য মেট্রোরেল ব্যবহার করা যাত্রীর সংখ্যা অন্যান্য গণপরিবহনের যাত্রীর সংখ্যার চেয়ে ঢের বেশি।

রোড অ্যান্ড হাইওয়ে: রাস্তাগুলো প্রায় সব জায়গাতেই ৮ লেনের। প্রত্যেক রাস্তাতেই ই-বাইক, সাইকেল চালানোর আলাদা লেন-সহ পায়ে হেঁটে চলার ব্যবস্থা আছে। সব হাইওয়ে এক্সপ্রেস ওয়ের আদলে তৈরি, মানে কোথাও গাড়ি না থামিয়ে নির্দিষ্ট লেন ধরে শয়ে শয়ে মাইল উচ্চ গতিতে যাওয়া যায়। হাইওয়ের কিছু কিছু জায়গায় টোল দেওয়ার ব্যবস্থা আছে। টোল গেটগুলো আসার মাইল খানিক আগেই চালকের মোবাইলের অ্যাপসে সিগন্যাল দেয় এবং টোলের ভাড়া মোবাইলে পরিশোধ করলেই গাড়ি গেটে আসার কিছুটা আগেই নিজ থেকেই খুলে যায়। যাতে করে ওখানে আসার পর সময় নষ্ট না হয়। চীনের হাই স্পিড (বুলেট ট্রেন) ট্রেনের কথা সবারই জানা। যেটাতে রওনা হয়ে মানুষ বিমানের মতো দ্রুত গতিতে নির্দিষ্ট গন্তব্যে যেতে পারে। এদের এখানে আলাদাভাবে কোনো বর্ষা মৌসুম না থাকায় গ্রীষ্মের চেয়ে শীতের দিনে বৃষ্টির আধিক্য দেখা যায়, সেজন্য গ্রীষ্ম মৌসুমে হাইওয়ে-সহ সমস্ত রাস্তা-ঘাটে বেশি ধুলো ময়লা জমে। এই ধুলো-ময়লা পরিষ্কার করার জন্য সবখানেই অত্যাধুনিক কিছু গাড়ি আছে। গাড়িগুলোর সাহায্যে রাতের শেষ প্রহরে সমস্ত রাস্তা-ঘাট ধুয়ে মুছে এমনভাবে পরিষ্কার করে, দেখলে মনে হবে রাস্তাগুলো এইমাত্র তৈরি করা হয়েছে। রাস্তায় পড়ে থাকা গাছের ঝরা পাতা বা অন্যান্য ময়লা আবর্জনা পরিষ্কারের জন্য সেন্সরের সাহায্যে স্বয়ংক্রিয়ভাবে চলা কিছু মেশিন আছে, সেগুলো কোনো চালক বা অন্য কারো সাহায্য ছাড়া নিজ থেকেই আপন মনে রাস্তা পরিষ্কার করে চলে। ভোরের আলো ফোটার আগেই এসব কাজ সম্পন্ন হয়।

কংক্রিটের সুউচ্চ পাহাড় কেটে তার ভিতর দিয়ে চলে গেছে মাইলের পর মাইল টানেল (গাড়ি যাওয়ার রাস্তা), মেট্রো রেলের লাইন এবং সর্বোপরি পাহাড় কেটে অত্যাধুনিক আবাসান বানানোর চিত্র নানা জায়গাতেই চোখে পড়ে। একদিন পথে যেতে যেতে দেখতে পেলাম, পাহাড়ের তলদেশে ডিনামাইটের বিশাল বিষ্ফোরণ ঘটিয়ে পাহাড় কাটার কাজ শুরু হয়েছে এবং মাস দুই পরে সেই সুউচ্চ কংক্রিটের পাহাড় কেটে পরিষ্কার করে সেখান থেকে চলে গেছে দৃষ্টিনন্দন রাস্তা। কোনো এলাকায় জনবসতি গড়ে তুলতে চাইলে আগে থেকে জনগণের সমস্ত চাহিদা যেমন রাস্তা-ঘাট, বাজার, পানি-বিদ্যুৎ লাইন, যোগাযোগের যথাযথ ব্যবস্থা শেষ করেই তারপরে সেখানে মানুষ বসবাসের অনুমতি মেলে। নির্মাণ কাজের দিকে খেয়াল করলে দেখা যায়, খুবই কম সংখ্যক শ্রমিকের উপস্থিতিতে অত্যাধুনিক সব বিশালাকৃতি যন্ত্রের সাহায্যে অল্প সময়ের ভিতর সুউচ্চ অট্টালিকা, দীর্ঘ সেতু, দৃষ্টি নন্দন হাইওয়ে-সহ নজর কাড়া সব স্থাপত্য তৈরি হচ্ছে। নদীর পাড়গুলো বড়বড় কংক্রিটের পাথর দিয়ে এত সুন্দরভাবে বাঁধানো যে, হাজার বছরেও সেগুলো কিছু হওয়ার নয়। প্রতিটা নদীর পাড় দিয়ে চলে গেছে দৃষ্টিনন্দন সবুজ অরণ্যে ঘেরা অত্যাধুনিক পার্ক এবং মানুষের হাঁটার রাস্তা। (চলবে)
লেখক: গবেষক, ফুজিয়ান এগ্রিকালচার এবং ফরেস্ট্রি ইউনিভার্সিটি, ফুজিয়ান, চীন।
[email protected]



 

Show all comments
  • Jack Ali ১৬ অক্টোবর, ২০২০, ৫:০৭ পিএম says : 0
    Chinese people are like us but we the Bangladeshi people are like.. Allah mentioned in the Qur'an that we are Dumb/Deft and Blind.
    Total Reply(0) Reply

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: জীবন-প্রযুক্তি
আরও পড়ুন