পবিত্র লাইলাতুল বরাত
আজ দিবাগত রাত পবিত্র লাইলাতুল বরাত। পরম করুণাময় আল্লাহতায়ালা তার বান্দাদের গুনাহ মাফ, বিপদমুক্তি ও
ধর্ষণের বিরুদ্ধে দেশব্যাপী গণজাগরণ সৃষ্টি হয়েছে। এর একটি ইতিবাচক দিক হলো, ধর্ষক নামক নরপশুদের বিরুদ্ধে দেশের সমস্ত রাজনৈতিক দল আওয়াজ তুলেছে। এসব রাজনৈতিক দল ঐক্যবদ্ধ না হলেও নিজ নিজ প্ল্যাটফর্ম থেকে এই পাশবিকতার বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়েছে। আরো ইতিবাচক দিক হলো, ইসলামী দলগুলোও এবার পিছিয়ে নেই। জামায়াতে ইসলামী, চরমোনাইয়ের পীর সাহেবের ইসলামী আন্দোলন, নূর মোহাম্মদ কাসেমীর নেতৃত্বে হেফাজতে ইসলামের একটি অংশ ধর্ষণ এবং নারী ও শিশু নির্যাতনের বিরুদ্ধে সমাবেশ এবং মিছিল করেছে। বিএনপি এবং এর অঙ্গ সংগঠনসমূহ যথা মহিলা দল, মুক্তিযোদ্ধা প্রজন্ম দল প্রভৃতি সংগঠন একাধিক মানব বন্ধন এবং অবস্থান কর্মসূচী পালন করেছে। মাহমুদুর রহমান মান্নার নেতৃত্বাধীন নাগরিক ঐক্য প্রেসক্লাবের সামনে একাধিক সমাবেশ করেছে। ডাকসুর সদ্য সাবেক ভিপি নুরুল হক নূরের নেতৃত্বাধীন ছাত্র অধিকার পরিষদ শাহবাগ মোড়ে এবং প্রেসক্লাবের সামনে লাগাতার কর্মসূচী পালন করে যাচ্ছে। যে সংগঠনই হোক না কেন, প্রত্যেকের কর্মসূচীতেই লোক সমাগম হচ্ছে। করোনা মহামারীর কালেও এসব কর্মসূচীতে যে লোকজন আসছে সেটিই সবচেয়ে আশাব্যাঞ্জক।
বামপন্থী সংগঠনসমূহেরও অনেকে প্রতিবাদে এগিয়ে এসেছেন। সিপিবির সাংস্কৃতিক উইং উদীচী শাহবাগ মোড়ে সমাবেশ এবং সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের মাধ্যমে প্রতিবাদ জ্ঞাপন করেছে। সামাজিক সংগঠনগুলোও পিছিয়ে নেই। ছাত্র অধিকার পরিষদ, নিরাপদ সড়ক আন্দোলন, সেভ আওয়ার উইমেন, বাংলাদেশ মহিলা আইনজীবী সমিতিসহ অনেক প্রতিষ্ঠান মানববন্ধন ও অবস্থান কর্মসূচী পালন করেছে।
শুধুমাত্র ঢাকাতেই নয়। ধর্ষকদের বিরুদ্ধে জনতার ধিক্কার মফস্বলেও ছড়িয়ে পড়েছে। বগুড়া, চাপাইনবাবগঞ্জ, ব্রাহ্মণবাড়ীয়া, চাঁদপুর, মানিকগঞ্জ, নারায়ণগঞ্জসহ অনেক জেলা শহর এবং কয়েকটি উপজেলাতেও বিক্ষোভ সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়েছে। এসব সমাবেশ ও কর্মসূচীতে যে সব দাবি উত্থাপিত হয়েছে তার মধ্যে কয়েকটি অভিন্ন দাবি নিম্নরূপ-
১. ধর্ষণের বিরুদ্ধে বর্তমান আইন সংশোধন করে মৃত্যুদন্ডসহ নতুন আইন প্রণয়ন।
২. সমস্ত ধর্ষণ মামলা দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালে বিচার।
৩. ভিকটিমদের দ্রুত সেবা দানের জন্য হট লাইন প্রতিষ্ঠা।
৪. ধর্ষণের প্রতিটি কেস রেকর্ড করার জন্য প্রতিটি থানায় একজন নারী পুলিশ অফিসার নিয়োগ।
৫. ধর্ষণ কেসের তদন্ত টিমে একজন নারী সদস্যের অন্তর্ভুক্তি এবং
৬. অপরাধীদেরকে যেসব অফিসার মদদ দিচ্ছে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ।
দুই
এইসব ধর্ষক এবং পাষন্ড নারী ও শিশু নির্যাতকরা যে শুধুমাত্র নারী ও শিশুদেরই অপূরণীয় ক্ষতি করেছে তাই নয়, বরং ওরা বাংলাদেশের কপালে কলঙ্কতিলক এঁটে দিয়েছে। বিশ্ব সংস্থা জাতিসংঘ বাংলাদেশে বেপরোয়া ধর্ষণ এবং নারী নির্যাতনে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। গত বুধবার ৭ অক্টোবর জাতিসংঘ বাংলাদেশে নারীদের ওপর ক্রমবর্ধমান নির্যাতনে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। এব্যাপারে বাংলাদেশে নিযুক্ত জাতিসংঘের আবাসিক সমন্বয়ক মিঞা সেপ্পো এক টুইট বার্তায় বলেন, ‘এগুলো জঘন্য অপরাধ। এগুলো মানবাধিকারের গুরুতর লঙ্ঘন।’ টুইট বার্তায় আরো বলা হয়, ‘নোয়াখালীর ঐ মহিলার যে কাহিনী সামাজিক মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়েছে সেটা দেখিয়ে দিয়েছে যে বাংলাদেশের সমাজ, আচরণ ও কাঠামোতে কী প্রচন্ড নারী বিদ্বেষ রয়েছে।’ টুইট বার্তায় আরো বলা হয়, ‘বাংলাদেশের জনগণ এবং নাগরিক সমাজ ন্যায় বিচারের জন্য যে আওয়াজ তুলেছেন তার সাথে জাতিসংঘ একাত্মতা ঘোষণা করেছে। তবে আমরা মনে করি যে, এগুলো কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। নারীর অধিকার জোরদার করার জন্য আমরা (জাতিসংঘ) একটি সুসংগঠিত পদ্ধতি উদ্ভাবন করতে চাই। ফৌজদারী অপরাধ বিধি সংশোধেনের জন্য জাতিসংঘ জোর সুপারিশ করছে। এই সংস্কারের উদ্দেশ্য হবে মন্থর বিচার পদ্ধতিতে গতি সঞ্চার এবং ভিকটিম ও তার পক্ষের স্বাক্ষীগণকে সমর্থন দেওয়া এবং তাদের নিরাপত্তা বিধান।’
শুধু জাতিসংঘ নয়, হিউম্যান রাইটস ওয়াচও এই ধর্ষণের বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়েছে। দক্ষিণ এশিয়া হিউম্যান রাইটস ওয়াচের পরিচালক মীনাক্ষি গাঙ্গুলী এক বিবৃতিতে বলেন, ‘ধর্ষণের পর যেসব নারী বেঁচে থাকে তাদেরকে সব রকমের সাপোর্ট দেওয়ার জন্য বাংলাদেশ সরকারের সর্বাত্মক পদক্ষেপ গ্রহণ করা উচিত। তাদেরকে যথা সময় সম্মানের সাথে চিকিৎসা করা উচিত। যৌন হয়রানির বিরুদ্ধে যেসব সংস্থা সংগ্রাম করছে, নির্যাতিতা নারীরা যেন সহজেই তার সেবা পেতে পারে।’ বিবৃতিতে আরো বলা হয়, বাংলাদেশি নারীদের বারংবার ধর্ষণ মোকাবেলায় সরকার প্রচুর ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছে। এখন বাংলাদেশ সরকারের উচিত, এসব ধর্ষণ মোকাবেলায় যেসব ফাঁকা বুলি আওড়ানো হয়েছে সেগুলোও কার্যকর করা। এখন ধর্ষণের পর যেসব নারী বেঁচে গেছেন তাদেরকে পর্যাপ্ত নিরাপত্তা দেওয়া এবং নারী অধিকার এবং মানবাধিকার কর্মীরা যেসব পদক্ষেপ নিতে বলছেন সেসব পদক্ষেপ নেওয়া। বিবৃতিতে বলা হয়, নোয়াখালীর বেগমগঞ্জের যে নারীকে বিবস্ত্র করে ধর্ষণ করা হয়েছে সেই ভিডিও উঠিয়ে নেওয়ার জন্য বাংলাদেশ টেলিফোন রেগুলেটরি কর্তৃপক্ষ নির্দেশ দিলেও এখনও সেটি ভাইরাল হয়েই আছে।
দক্ষিণ এশীয় হিউম্যান রাইটস ওয়াচের ঐ বিবৃতিতে বলা হয়, বাংলাদেশ হাইকোর্ট ৩০ দিনের মধ্যে একটি কমিশন গঠনের জন্য গত জানুয়ারি মাসে আইন মন্ত্রণালয়কে নির্দেশ দিয়েছিল। কমিশন গঠনের কাজ হবে, দেশে উদ্বেগজনক হারে যৌন নির্যাতন বৃদ্ধির কারণ অনুসন্ধান এবং সেটি কার্যকরভাবে মোকাবেলা করার জন্য সরকারের নিকট সুপারিশমালা দাখিল করা। হাইকোর্টের নির্দেশ মোতাবেক সেই কমিশন গঠন করা হয়েছে কিনা এবং হয়ে থাকলে তাদের কাজের অগ্রগতি কী, সে সম্পর্কে বাংলাদেশের মানুষকে কিছুই জানানো হয়নি। সরকারকে নারীদের কথা শুনতে হবে। বেগমগঞ্জের এই মহিলাসহ আরো অসংখ্য মহিলা যারা নির্যাতিত হয়েছেন তাদেরকে মর্যাদার সাথে চিকিৎসা দেওয়া উচিৎ এবং ধর্ষক ও তাদের সহযোগী পান্ডারা জামিনে বের হয়ে তাদেরকে যে হুমকি-ধামকি দিচ্ছে তার বিরুদ্ধে নির্যাতিতদের যথেষ্ট নিরাপত্তা দেওয়া উচিত এবং হুমকি-ধামকি দাতাদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ করা উচিৎ।
তিন
রবিবার এই লেখাটি যখন শেষ পর্যায়ে এসেছে তখনও পত্রপত্রিকায় দেখলাম, আন্দোলন চালু থাকা সত্তে¡ও ধর্ষণ থামছে না। রবিবারের ‘ইনকিলাবেও’ প্রথম পৃষ্ঠায় শিরোনাম, ‘রাতভর গণধর্ষণ’ ছাগল নাইয়ায় ৪ বছর বয়সী শিশু সহ শিকার আরো ১৮। আটক ১৫। এই ধরনের খবর শুধুমাত্র ইনকিলাব নয়, অন্যান্য পত্র-পত্রিকায় প্রথম পৃষ্ঠা, শেষ পৃষ্ঠা এবং ভেতরের পৃষ্ঠাতেও বের হয়েছে। অর্থাৎ কোনো অবস্থাতেই ধর্ষণ থামানো যাচ্ছে না। জনগণের আন্দোলন এবং প্রতিবাদের মুখেও যদি এই নারকীয় কান্ড চলতে থাকে তাহলে তার পরিণতি ভয়ঙ্কর হতে পারে। দ্রুত গতিতে সরকার যদি কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ না করে তাহলে নির্যাতিত মা-বোনদের ভাইরা এবং পাড়া প্রতিবেশী যদি একদিন আইন নিজের হাতে তুলে নেয় তাহলে সমাজ ও রাষ্ট্রে শুরু হবে চরম বিশৃঙ্খলা।
পাঠকরা হয়তো দস্যুরাণী ফুলনের কথা ভুলে যাননি। সেই ফুলন দেবীকে সমাজের উচ্চ বর্ণের একদল লোক গণধর্ষণ করেছিল। এই অপমানের প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য ফুলন দেবী নিজেই ডাকাত হয়ে যান এবং জঙ্গলে গিয়ে নিজস্ব বাহিনী গঠন করেন। তাঁর নতুন নাম হয় দস্যুরাণী ফুলন। এক সময় ফুলন দেবীকে যারা ধর্ষণ করেছিল তারাসহ ২৫ জন ধর্ষক ও ডাকাতকে তিনি ধরে নিয়ে আসেন এবং ঐ ২৫ জনকে সারিবদ্ধভাবে দাঁড় করিয়ে গুলি করে মেরে ফেলেন। পরবর্তীতে ফুলন দেবীকে ভারত সরকার ক্ষমা করেন এবং মর্যাদার আসনে প্রতিষ্ঠিত করেন।
আন্দোলনকারী তথা জনগণ ধর্ষকদের মৃত্যুদন্ডের দাবিতে সোচ্চার। সরকারও এই গণদাবিকে আমলে নিয়েছে। তাই ২০০০ সালের নারী ও শিশু নির্যাতন আইনের সংশোধন আনা হচ্ছে। গতকাল সোমবার মন্ত্রিসভায় এই সংশোধনী উত্থাপিত হয়। ২০০০ সালের আইনে ধর্ষণের জন্য যাবজ্জীবন কারাদন্ডের বিধান রয়েছে। আর ধর্ষণের কারণে, মৃত্যু হলে ধর্ষকের মৃত্যুদন্ডের বিধান রয়েছে। প্রস্তাবিত সংশোধনীতে ধর্ষণের জন্যও মৃত্যুদন্ডের বিধান রাখা হয়েছে।
[email protected]
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।