Inqilab Logo

বুধবার, ০১ মে ২০২৪, ১৮ বৈশাখ ১৪৩১, ২১ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

ঢাকার জলাবদ্ধতা নিরসনে প্রয়োজন টেকসই পদক্ষেপ

নাজমুন্নাহার নিপা | প্রকাশের সময় : ১৩ অক্টোবর, ২০২০, ১২:০৪ এএম

ঢাকা শহরের অন্যতম একটি বড় সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে জলাবদ্ধতা। সামান্যতম বৃষ্টিতেই তলিয়ে যায় ঢাকার রাস্তাঘাটসহ অনেক এলাকা। আবার অনেক এলাকায় দুই-তিন ফুট পর্যন্ত পানি উঠে পড়ে। কিন্তু এই পানি নেমে যেতে তিন থেকে চার ঘণ্টা আবার কোনো কোনো ক্ষেত্রে এক থেকে দু’দিনও লেগে যায়। ফলে রাস্তাঘাটে মানুষ এবং যানবাহন চলাচলে অনেক অসুবিধার মুখোমুখি হতে হয়। গত কয়েক বছর ধরে জলাবদ্ধতায় ঢাকাবাসীকে সীমাহীন দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে। ঢাকা শহরের আধুনিকায়নের সাথে সাথে বাড়ছে জলাবদ্ধতার পরিমাণ এবং তার সাথে সমানুপাতিক হারে বাড়ছে রাস্তার যানজট এবং সাধারণ মানুষের ভোগান্তি।

জলাবদ্ধতা বর্তমানে শুধু ঢাকা শহরেই নয়, প্রায় প্রতিটি বিভাগীয় বা জেলা শহরেও হর-হামেশাই দেখা যায়। প্রতিটি জায়গায় একই চিত্র, ফলে সাধারণ মানুষের ভোগান্তি বাড়ছে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, রাজধানীর পানি নিষ্কাশনের প্রধান মাধ্যম খালগুলো অবৈধ দখল ও কঠিন বর্জ্যে ভরাট হয়ে আছে। নগরের খাল, ড্রেন, বক্স কালভার্ট ও ব্রিক সুয়ারেজ লাইন দিয়ে পানি নদীতে যেতে পারছে না।

বিগত কয়েক দশকের বাস্তবতা থেকে দেখা যায়, বর্তমানে ঢাকার জলাবদ্ধতা সবচেয়ে প্রকট আকার ধারণ করেছে। বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রকাশিত খবর থেকে দেখা যায়, ঢাকার পার্শ্ববর্তী প্রায় সবকটি নদী অস্তিত্ব সংকটে ভোগছে। শুধু তাই নয়, নদী তার স্বাভাবিক অবস্থা হারিয়েছে। ঢাকায় বৃষ্টির পানি সরে যাওয়ার প্রাকৃতিক ব্যবস্থা নষ্ট হয়ে গেছে। আগে বৃষ্টির পানি খাল দিয়ে নদীতে চলে যেত, কিন্তু এখন এইসব খাল বা নদী প্রায় সব ভরাট হয়ে গেছে। এসকল কারণে শহরের পানি নেমে যাবার মতো জায়গা পায় না, ফলে সৃষ্টি হয় জলাবদ্ধতা।

ঢাকার দুর্বল পয়ঃনিষ্কাশন ব্যবস্থাও জলাবদ্ধতার অন্যতম প্রধান কারণ। ঢাকায় যে ধরনের ড্রেনেজ সিস্টেম রয়েছে তাতে খুব সহজেই পানির সাথে বিভিন্ন বর্জ্য যেমন- পলিথিন এবং অন্যান্য অপচনশীল পদার্থ ভেসে গিয়ে নালার মধ্যে আটকে যায়, যে কারণে জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হয়। এছাড়াও নালা দিয়ে পানি জলাশয়ে পৌঁছাতে না পারার কারণে নালা উপচে পানি বাইরে চলে আসে এবং জলাবদ্ধতা সৃষ্টি করে।

সধারণত দেখা যায় যে, ঢাকা শহরে কয়েক ঘণ্টা বৃষ্টি হলেই জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হয়। অলি-গলি থেকে শুরু করে রাজপথ পর্যন্ত এই অবস্থার মুখোমুখি হয়। রাতভর বৃষ্টি হলে দেখা যায়, কোথাও হাঁটু সমান আবার কোথাও কোমর সমান পানি। আবার সেই পানি দ্রুত অপসারণ করাও যাচ্ছে না। এতে শুধু মানুষের ভোগান্তি বাড়তেই থাকে এবং সেখানে নগরবাসীর পোহাতে হয় সীমাহীন দুর্ভোগ। বিশেষ করে নিম্ন আয়ের মানুষের কষ্ট অনেকাংশে বেড়ে যায়। এমনকি তাদের জীবনযাত্রার উপর সামগ্রিক প্রভাব পড়ে। ঢাকার পয়ঃনিষ্কাশন ব্যবস্থার মূল দায়িত্ব ঢাকা ওয়াসার। কিন্তু দেখা যায়, প্রায়শই সরকারি সংস্থাগুলোর মধ্যে সমন্বয়হীনতা কাজ করে এবং যার ফল ভোগ করতে হয় সাধারণ মানুষকে।

ঢাকা শহরে দেখা যায় প্রায় সারা বছর বিভিন্ন সেবা প্রতিষ্ঠানের রাস্তা খোঁড়াখুঁড়ি লেগেই থাকে। কোনো সময় ওয়াসা, কোনো সময় বিদ্যুৎ বিভাগ, কোনো সময় টেলিফোন, গ্যাস লাইন মেরামতের কাজ চলে। ফলে বৃষ্টির সময় বা ভারী বর্ষণে রাস্তা ঘাট যখন ডুবে যায়, তখন এই গর্তগুলো মৃত্যু কূপে পরিণত হয়। দেখা যায়, পথচারী থেকে শুরু করে ছোট আকারের যানবাহন প্রায়ই গর্তে পড়ে বিব্রত অবস্থায় পড়তে হয়। বিশেষ করে যারা রাজধানী শহরে তুলনামূলক নিচু এলাকায় বাস করে তাদের জন্য জলাবদ্ধতা যেন অনেকটা ললাট লিখন হয়ে গেছে। পুরো বর্ষাকালই তাদেরকে পানির মধ্যে বাস করতে হয়।

এই জলাবদ্ধতা জনজীবনে মারাত্মক প্রভাব ফেলছে। এর ফলে কোনো কোনো এলাকায় ছড়াচ্ছে বিভিন্ন পানিবাহিত রোগ। অতি বৃষ্টিতে যখন নালা-ডোবা পানিতে ভরে যায়, তখন সেখান থেকে ময়লা পানি সব জায়গায় ছড়িয়ে পড়ে। এতে রোগজীবাণুর বিস্তার ঘটে। এর ফলে আরো একটি সমস্যায় মানুষকে পড়তে হয় তা হলো, বিভিন্ন ধরনের চর্ম রোগ বিস্তার লাভ করে।

জলাবদ্ধতা নিরসনের কোনো বিকল্প নেই। এর জন্য প্রয়োজন ড্রেনেজ লাইনের পরিপূর্ণ ব্যবহার। দেখা যায়, সামান্য বৃষ্টিতেই ড্রেনগুলো পর্যাপ্ত পানি নদীতে ফেলতে পারে না। প্রথমেই আমাদের এই ড্রেনেজ ব্যবস্থার নিয়মিত তদারকি করতে হবে। সারাবছর নর্দমায় যে ময়লা পড়বে বর্ষা শুরু হওয়ার আগেই তা তুলে ফেলতে হবে। সেই সাথে সব জায়গায় পর্যাপ্ত ড্রেনেজ নির্মাণ করতে হবে। সরকার বিভিন্ন সময় বিভিন্ন প্রকল্প হাতে নেয় নগরবাসীকে জলাবদ্ধতা থেকে মুক্ত করার জন্য। কিন্তু গণমাধ্যমে প্রকাশিত রিপোর্টে প্রায়ই দেখা যায়, হাতে গোনা কিছু প্রকল্প ছাড়া বাকিগুলো সফল হয় না।

ঢাকা শহরের জলাবদ্ধতার মোট পানির ৬০-৭০ শতাংশ আসে বিভিন্ন বাড়ির ছাদে জমে থাকা পানি থেকে। বৃষ্টির পানি আগে বিভিন্ন জলাশয়ে সরে গেলেও বর্তমানে বাড়ির ছাদ থেকে পাইপে করে নেমে তা আর যাবার জায়গা পায় না। ফলে বিভিন্ন নালা উপচে পানি শহরের রাস্তায় জমে যায় এবং জলাবদ্ধতার সৃষ্টি করে।

বৃষ্টির পানি অত্যন্ত উপকারী একটি জিনিস। বাংলাদেশের অনেক এলাকাতেই বৃষ্টির পানি সংরক্ষণ করে তা দৈনন্দিন জীবনের নানা কাজে ব্যবহার করা হচ্ছে। মানুষ ব্যক্তিগতভাবেই তা করে আসছে অনেক আগে থেকে। বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা)’র বিশেষজ্ঞগণ মনে করেন, বৃষ্টি শুরু হবার পাঁচ মিনিট পরই পরিষ্কার পানি ঝরতে শুরু করে, যা সরাসরি পান করা যায়। প্রকৃতি প্রদত্ত এই পানি সংরক্ষণ করা গেলে ঢাকার জলাবদ্ধতার অনেকাংশ নিরসন সম্ভব বলেও দাবি করেন তারা।

ঢাকায় বসবাস করা প্রায় পৌনে দুই কোটি মানুষের পানির চাহিদার সবটুকুই আসে মাটির নিচে থেকে। ভূগর্ভ থেকে এত পরিমাণ পানি উত্তোলন করার ফলে প্রতি বছর প্রায় তিন মিটারের বেশি নিচে নেমে যাচ্ছে পানির স্তর। ফলে সেখানে পানির সঙ্কট দেখা যায় এবং এমন অবস্থা চলতে থাকলে সামনে পানির সঙ্কট আরও বাড়বে। বিশ্বের অনেক দেশ বৃষ্টির পানি সংরক্ষণের উদ্যোগ নিয়েছে এবং সফলও হয়েছে। এমনকি পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতেও বৃষ্টির পানি সংরক্ষণের দৃষ্টান্ত রয়েছে। এমতাবস্থায় বৃষ্টির পানি সংরক্ষণ বাংলাদেশে পানির এ বিপুল চাহিদা মেটাতে বিশেষ ভূমিকা পালন করবে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।

বৃষ্টির পানি সংরক্ষণের গুরুত্বের ওপর জোর দিয়ে এ পানি সংরক্ষণ করলে ঢাকার জলাবদ্ধতা কমার পাশাপাশি ঢাকায় বসবাসরত মানুষের প্রায় ১৫ শতাংশ পানির চাহিদা পূরণ করা সম্ভব হবে বলে বিভিন্ন গবেষণার বরাত দিয়ে উল্লেখ করেন পানি বিশেষজ্ঞরা। আমরা যদি বৃষ্টির পানি সংরক্ষণ করি তাহলে শহরের মানুষের পানির চাহিদা যেমন পূরণ হবে, ঠিক তেমনি অলিতে গলিতে পানি জমে জলাবদ্ধতার সৃষ্টি করবে না। সাধারণ মানুষের পাশাপাশি সরকারকে এ ব্যাপারে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে।

শুধু সরকার বা সিটি কর্পোরেশন জলাবদ্ধতা নিয়ন্ত্রণে কাজ করবে এটি ভেবে বসে থাকলে এর ফল হবে অত্যন্ত ভয়াবহ। কারণ প্রায়ই আমরা ইচ্ছাকৃত বা অনিচ্ছাকৃতভাবে হোক- আমাদেও দৈনন্দিন জীবনে তৈরি হওয়া বর্জ্য ড্রেনে ফেলে দেই। এইভাবে যদি সবাই ফেলতে থাকে অল্প অল্প করে- তাহলে দেখা যায় ড্রেনের প্রায় দুই-তৃতীয়াংশ বর্জ্য দিয়ে পূর্ণ হয়ে যাচ্ছে। ফলে যা হবার তাই হয়, সামান্য বৃষ্টির পানি এই ড্রেনগুলো নিতে পারে না। তখনই দেখা দেয় জলাবদ্ধতা, আর সেই সাথে পানিতে পাওয়া যায় বিভিন্ন ধরনের বর্জ্য।

ঢাকা বর্তমানে মেগাসিটিতে রূপান্তরিত হয়েছে। প্রশাসনিক ও বাণিজ্যিক সকল ধরনের কাজের কেন্দ্রবিন্দু এই শহরেই। যেখানে প্রায় বাস করে দুই কোটির উপরে মানুষ। এই বিশাল জনগোষ্ঠীর সামগ্রিক কর্মকান্ডে ঢাকা শহরকে জলাবদ্ধতার মতো সমস্যার হাত থেকে যত তাড়াতাড়ি মুক্ত করা যাবে ততই কল্যাণ। এই জন্য জনগণ এবং সরকারের এক সাথে কাজ করার বিকল্প নেই। শহরের বাসিন্দারা এর দায় কিছুতেই এড়াতে পারেন না। আবার সরকারি সংস্থাগুলোও দায়িত্ব এড়াতে পারে না। বাড়তি চাপের ফলে নতুন নতুন যে আবাসন তৈরি হচ্ছে সেখানে খেয়াল রাখতে হবে পর্যাপ্ত সুয়ারেজ লাইনের ব্যবস্থার উপর। বৃষ্টির পানি যেন সহজেই নদীতে চলে যেতে পারে সেই অংশটিতে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিতে হবে। সুয়ারেজ লাইনগুলোকে সারাবছর পরিষ্কার এবং পানি চলাচলের উপযুক্ত রাখতে হবে।

আমাদের মনে রাখতে হবে, জলাবদ্ধতা কখনো একটি আধুনিক শহরের বৈশিষ্ট্য হতে পারে না। নগরায়ন হতে হবে পরিকল্পনা মাফিক, যেন একটি শহর তার নাগরিকদের সকল ধরনের নাগরিক সেবা সহজেই দিতে পারে। ঢাকার আশপাশের সকল নালা-খাল, নদীগুলোকে সংরক্ষণ করতে হবে। একটি টেকসই ও বাস্তবসম্মত পরিকল্পনা তৈরি করে এবং এর বাস্তবায়নে সরকারি সংস্থাগুলোকে একসাথে কাজ করতে হবে।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: টেকসই-পদক্ষেপ
আরও পড়ুন