Inqilab Logo

বুধবার ২০ নভেম্বর ২০২৪, ০৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ১৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

এ অনাচারের শেষ কোথায়?

ড. মোহা. হাছানাত আলী | প্রকাশের সময় : ১১ অক্টোবর, ২০২০, ১২:০৫ এএম

নোয়াখালীর বেগমগঞ্জে ৩৭ বছর বয়সী এক নারীকে বিবস্ত্র করে নির্যাতনের ভিডিও নিয়ে সরব গোটা দেশ। এনিয়ে চারিদিকে চলছে আলোচনা এবং সমালোচনার ঝড়। ক্ষুদ্ধ মানুষ দোষীদের দ্রুত বিচারের দাবিতে রাজপথে সোচ্চার। এই ন্যাক্কারজনক নারী নির্যাতনের ঘটনায় স্তম্ভিত গোটা জাতি।

আজ বাবা হিসেবে, শিক্ষক হিসেবে অনেকের মতো আমিও লজ্জিত, মর্মাহত। আজ বড়ই জানতে ইচ্ছে করছে, কোন সমাজে আমরা বসবাস করছি? পশুও তো আমাদের দেখে মুখ লুকাবে। এদের বিচার কার্যকর না করা গেলে মানুষ হিসেবে আমরা অমানুষদের কাছে পরাজিত হবো। অনেক ক্ষেত্রে মানুষ বিচার না পেয়ে অসহায় বোধ করছে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে মানুষ বিচারের আশাই ছেড়ে দিয়েছে। এক দম বন্ধ করা ধর্ষণের সংস্কৃতি চালু হয়েছে আমাদের এই প্রিয় দেশে। জাতির সামনে সবচেয়ে বড় প্রশ্ন হলো, এই সমস্ত ধর্ষককে নিয়ন্ত্রণ করবে কে? একের পর এক ঘটনা ঘটেই চলেছে। প্রতিকার যে হচ্ছে না তা কিন্তু নয়। তবে অধিকাংশ ক্ষেত্রে আইনের নিরপেক্ষ প্রয়োগের অনুপস্থিতির কারণে বিচার না পাবার শঙ্কা তৈরি হয়েছে। আমাদের নৈতিকতা আমাদের বিবেক আজ প্রশ্নবিদ্ধ।

ধর্ষকেরা কিন্তু মঙ্গলগ্রহ থেকে আসেনি। কোনো না কোনো পরিবার থেকেই এরা উঠে এসেছে। এরা সমাজেরই অংশ। এখন সময় এসেছে সামাজিকভাবে এদের বয়কট করার। আজ প্রতিটি পরিবারের প্রত্যেককে এই বলে শপথ নিতে হবে যে, আমার পরিবারের কোনো পুরুষ ধর্ষণ কাজে অংশগ্রহণ করবে না। ধর্ষণে সহায়তা করবে না। আমি আমার পরিবারের দায়িত্ব নিলাম, আপনিও আপনার পরিবারের দায়িত্ব নিন। রাষ্ট্রকে দায়িত্ব নিতে হবে যেন একটি ধর্ষণও বিচারবহির্ভূত না থাকে। একটি ধর্ষকও যেন শাস্তির হাত থেকে রেহাই না পায়। এই দেশকে ধর্ষণের নির্মম ব্যাধি থেকে আমাদের মুক্ত করতেই হবে। না হলে আমাদের মা, মেয়ে, বউ কেউ কিন্তু এই হায়েনাদের লোলুপ থাবা থেকে রক্ষা পাবে না।

নোয়াখালীর এই ঘটনা ঘটে মূলত সেপ্টেম্বর মাসের শুরুর দিকে। ঘটনার একমাস পর ভিকটিমের পক্ষ থেকে বেগমগঞ্জ থানায় দুটি মামলা দায়ের করা হয়। একটি নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনে, অন্যটি পর্নগ্রাফি নিয়ন্ত্রণ আইনে। ঘটনার এতদিন পর কেন ভিকটিম থানায় মামলা করলো? কেন ভিকটিম আগে থানায় বা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কাছে প্রতিকার চাইতে গেল না? এসব প্রশ্নের উত্তর জাতি জানতে চায়। অনেকেই দেরীতে মামলা করাকে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর প্রতি ভিকটিমের আস্থাহীনতাকেই দায়ী করছেন। আবার বিশেষজ্ঞরা বলার চেষ্টা করছেন যে, এক্ষেত্রে বিচার ব্যবস্থার প্রতি জনগণের আস্থাহীনতাও হতে পারে অন্যতম কারণ। অনেক ক্ষেত্রে আমাদের দেশে বিচার চাইতে গেলে উল্টো ঝামেলায় পড়তে হয় এই আশঙ্কা থেকেই হয়তো নিগৃহীত মহিলা আইনের আশ্রয় নিতে সাহস পাননি বলেও কেউ কেউ মনে করছেন। জাতি হিসেবে এটা আমাদের চরম লজ্জার।
এখন প্রশ্ন হলো, এসব অপরাধী যদি উপযুক্ত শাস্তি ভোগ না করে তাহলে তারা পরবর্তীতে আরো বড় ধরনের অপরাধ করতে বিন্দুমাত্র ভাববে না। তাদের দৃষ্টান্তমূলক দন্ড হওয়া দরকার। এদিকে অনেকটা অতিষ্ট হয়ে সরকারি দলের এক প্রভাবশালী যুগ্ম-সাধারণ সম্পাদক ধর্ষকের ক্রসফায়ারে মৃত্যদন্ড চেয়েছেন। যদিও আমি বরাবরই বিনাবিচারে মানুষ হত্যার বিপক্ষে। তবে ধর্ষণের বিচার দ্রুত হতে হবে। সাজা হতে হবে কঠোর যাতে, কেউ ধর্ষণের কাছাকাছি যেতেও সাহস না পায়।

ধর্ষণ বা ধর্ষকের বিচার করার পাশাপাশি যারা ধর্ষক তৈরি করে, ধর্ষকদের পৃষ্ঠপোষক তাদেরও আইনের আওতায় আনা প্রয়োজন। কারণ একদিনে তো আর এত বড় অপরাধী তৈরি হয়নি? রাজনৈতিক মদদে বেড়ে উঠে তারা এত বড় ক্রিমিনালে পরিণত হয়েছে।

এদিকে ঘটনার একমাস পর পুলিশের তৎপরতাকে দেশবাসী ভালো চোখে নেয়নি। কারণ, থানা থেকে সামান্য দূরে এত বড় একটি ঘটনা ঘটল কিন্তু কেন ভিকটিম সময়মত থানায় এলো না? কেনই বা ঘটনাটি পুলিশের গোচরীভূত হলো না, তা নিয়ে চারিদিকে সমালোচনার ঝড় বয়ে যাচ্ছে। এসব প্রশ্নের উত্তর খোঁজাটা আজ খুবই জরুরি। এখন প্রশ্ন হলো, এই যে আসামি যারা ধরা পড়ল তাদের বিচারের কী হবে? মামলা কোর্টে উঠবে। বিচারের দীর্ঘসূত্রিতায় নির্যাতিতা নারী বিভিন্নভাবে আরো নিগৃহীত হবে। বিচারিক প্রক্রিয়ায় আদালতে প্রতিপক্ষের আইনজীবী কর্তৃক ইঙ্গিতপূর্ণ প্রশ্নবাণে জর্জরিত হবে। ধর্ষিতার উপস্থিতিতে ইনিয়ে-বিনিয়ে ধর্ষকের পক্ষে যুক্তিতর্ক উপস্থাপন করা হবে। এতে করে ধর্ষিতা বা নির্যাতিতা মহিলা মানসিক ও সামাজিকভাবে আরেকবার নিগৃহীত হবে। তাই বিচার কার্যের দীর্ঘসূত্রিতা কমিয়ে দ্রুত বিচারকাজ সম্পন্ন করাই হবে রাষ্ট্রের দায়িত্ব।

এমনিতেই এই মামলার বিচার পাওয়া নিয়ে সন্দেহ দেখা দিয়েছে। কারণ, ঘটনার ৩২ দিন পর মামলার আলামত খুঁজে পাওয়াটা বেশ দুষ্কর। সুতরাং এক্ষেত্রে বিচার প্রক্রিয়া কোনদিকে যাবে সেটিও দেখার বিষয়। আজকে যদি এই ভিডিওটি ভাইরাল না হতো তাহলে হয়তো দেশবাসী এই ভয়াবহ ঘটনা সম্পর্কে অবহিত হতো না। এরকম নাম জানা-অজানা বহু মায়েরা প্রতিনিয়ত নিগৃহীত হচ্ছে। সামাজিকভাবে হেয় প্রতিপন্ন হওয়ার ভয়ে অনেকেই আবার আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে তাদের উপর সংঘটিত অনাচারের কথা জানায় না। এতে করে অনেক ক্ষেত্রেই নিগৃহীত মা-বোনেরা নিদারুণ যন্ত্রণা বুকে চেপে দিনাতিপাত করতে বাধ্য হয়। আর ধর্ষকরা বা লম্পটরা বহুগুনে তাদের লাম্পট্য প্রদর্শন করতে উৎসাহিত বোধ করে।

করোনাকালে চারিদিকে সংঘটিত এতসব অনাচার, অবিচার, নারী নির্যাতন, ধর্ষণ, মাদক, স্বাস্থ্যখাতের দুর্নীতির ঘটনা জাতি হিসেবে আমাদের নীতি-নৈতিকতা ও মানবিক মূল্যবোধকে দেশে-বিদেশে ব্যাপকভাবে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে। যে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানকে আমরা পবিত্র অঙ্গন বলে বিবেচনা করে থাকি, যে শিক্ষাঙ্গন আমাদের মধ্যে মানবিক মূল্যবোধের সৃষ্টি করে, আমাদের মানবিক চেতনাকে জাগ্রত করে, গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ তৈরি করে, সেই শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সবুজ চত্বরে যখন নব বিবাহিতা স্ত্রী তার স্বামীর সামনে ধর্ষিত হয়, তখন জাতি হিসেবে আমরা লজ্জিত হই। এ লজ্জা ঢাকার শক্তি কি আদৌ জাতি হিসেবে আমাদের আছে?
লেখক: প্রফেসর, আইবিএ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

আরও পড়ুন