Inqilab Logo

শুক্রবার ২৩ নভেম্বর ২০২৪, ০৮ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২০ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচি বাড়াতে হবে

উম্মে ফারুয়া | প্রকাশের সময় : ৫ অক্টোবর, ২০২০, ১২:০৯ এএম

বাংলাদেশের সংবিধানের ১৫ নম্বর অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, রাষ্ট্রের অন্যতম মৌলিক দায়িত্ব পরিকল্পিত অর্থনৈতিক বিকাশের মাধ্যমে উৎপাদনশক্তির ক্রমবৃদ্ধি সাধন এবং জনগণের জীবনযাত্রার বস্তু ও সংস্কৃতিগত মানের দৃঢ় উন্নতি সাধন- যাতে নাগরিকের জন্য অন্ন, বস্ত্র, আশ্রয়, শিক্ষা ও চিকিৎসাসহ জীবনধারণের মৌলিক উপকরণের ব্যবস্থা নিশ্চিত করা যায়। গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে কোনো মানুষ না খেয়ে মারা যাবে, আর্থিক অনটনে জীবনের মৌলিক চাহিদা পূরণ করতে পারবে না বা বাসস্থানের অভাবে বাস্তুহীন বসবাস করবে এটা কাম্য হতে পারে না। তাই কল্যাণ রাষ্ট্রে সামাজিক নিরাপত্তা বলতে সমাজে বসবাসের জন্য আইনগত অধিকারকে ছাপিয়ে মানুষের আর্থিক, বাসস্থান, শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও খাদ্যের নিরাপত্তা সামনে চলে এসেছে।

বাংলাদেশের সংবিধানের অনুচ্ছেদ ২৮(১) এ আছে: কেবল ধর্ম, গোষ্ঠী, বর্ণ, নারীপুরুষ ভেদে বা জন্মস্থানের কারণে কোনো নাগরিকের প্রতি রাষ্ট্র বৈষম্য প্রদর্শন করবে না। সে প্রেক্ষিতে সরকার সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির মাধ্যমে সকল প্রকার বৈষম্য হ্রাসে উল্লেখযোগ্য কর্মসূচি গ্রহণ করেছে। এর মধ্যে রয়েছে বয়স্কভাতা, বিধবা ও স্বামী নিগৃহীতা মহিলাদের ভাতা, অসচ্ছল প্রতিবন্ধী ভাতা, প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থীদের শিক্ষা উপবৃত্তি, হিজড়া জনগোষ্ঠীর জীবনমান উন্নয়ন কর্মসূচি, বেদে ও অনগ্রসর জনগোষ্ঠীর জীবনমান উন্নয়ন কার্যক্রম, ক্যান্সার কিডনী ও লিভার সিরোসিস রোগীদের আর্থিক সহায়তা কর্মসূচি, চা শ্রমিকের জীবনমান উন্নয়ন কর্মসূচি, সুদমুক্ত ঋণ ইত্যাদি। সামাজিক নিরাপত্তা ব্যবস্থাকে বিভিন্ন সময়ে সরকার বিভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গীতে বিবেচনা ও উপস্থাপন করেছে। তবে এর মূল লক্ষ্য ছিল সমাজের পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীর শিক্ষা, স্বাস্থ্য, খাদ্য, বাসস্থান ইত্যাদির নিশ্চয়তা বিধান করা।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচিকে তাঁর প্রধান দশটি অগ্রাধিকার কর্মসূচির অন্যতম হিসেবে গ্রহণ করেছেন। বর্তমানে সামাজিক নিরাপত্তা ব্যবস্থার মূল অংশীজন হলো জলবায়ুর বিরূপ প্রভাব ও প্রাকৃতিক দুর্যোগে ক্ষতিগ্রস্ত জনগোষ্ঠী এবং বিভিন্ন কারণে সমাজের পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠী। এদের জীবনমানের উন্নয়ন ব্যতীত উন্নয়নশীল বাংলাদেশ বা উন্নত বাংলাদেশ বিনির্মাণ সম্ভব নয়। সে আলোকে সরকারের জাতীয় সামাজিক নিরাপত্তা কৌশল ঠিক করা হয়েছে। এ কৌশল অনেকটা মানবিক ও সামাজিক মূল্যবোধতাড়িত।

বর্তমানে সামাজিক নিরাপত্তা খাতে ১৪৫টি কর্মসূচি বাস্তবায়ন করা হচ্ছে। ১৪৫টি কর্মসূচি বাস্তবায়ন মানে হলো ১৪৫ শ্রেণির মানুষ এ খাত থেকে উপকৃত হচ্ছে। অর্থ মন্ত্রণালয়ের হিসাব মতে, ২০১৪-১৫ অর্থবছরে ১৪৫টি কর্মসূচির মাধ্যমে ৮ কোটি ১০ লক্ষ লোক কোনো না কোনোভাবে উপকৃত হয়েছে। সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির প্রধান ৯টি খাত হলো: কর্মকর্তা-কর্মচারীদের পেনশন, খোলাবাজারে খাদ্য শস্য বিক্রয় (ওএমএস), কাজের বিনিময়ে খাদ্য/টাকা, টেস্ট রিলিফ, ভিজিএফ, অতি দরিদ্রদের জন্য কর্মসৃজন কর্মসূচি, শিক্ষাবৃত্তি, উপবৃত্তি, বয়স্কভাতা ও ভিজিডি। এ ৯টি খাতে সরকারের ব্যয় হয় বরাদ্দের প্রায় ৭০ শতাংশ। আর সুবিধাভোগীর ৭০ শতাংশ হলো খোলা বাজারে খাদ্যশস্য বিক্রয়, ভিজিএফ, জিআর, উপবৃত্তি ও অতি দরিদ্রদের জন্য কর্মসূচি-এ ৫টি খাতে।

সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির প্রভাবে উত্তরাঞ্চলের ‘মঙ্গা’ দুরীভূত হয়েছে। ২০০০ সালে দারিদ্র্যের হার ৪৮.৯ শতাংশ, ২০০৫ সালে ৪১.৫ শতাংশ, ২০১০ সালে ৩১.৫ শতাংশ, ২০১৫ সালে ২৪.৮ শতাংশ ও সর্বশেষ ২০১৯ সালে ২০.৫ শতাংশে নেমে এসেছে। যে দেশে এক সময়ে মানুষ কাজ না পেয়ে অনাহারে দিন কাটিয়েছে সেখানে এখন গ্রামগঞ্জে কাজের লোক পাওয়া কষ্টকর হয়ে পড়েছে। দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয় ২০০৯ সাল থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত সময়ে অতিদরিদ্রদের জন্য কর্মসংস্থান কর্মসূচি (ইজিপিপি) এর আওতায় ৭৮ লক্ষ গ্রামীণ বেকার মজুরের জন্য ৪০ দিনের কর্মসংস্থান করেছে। গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর কর্মসংস্থানের আরেকটি উৎস কাবিখা/কাবিটা কর্মসূচি। এ কর্মসূচির মাধ্যমে ২০ লক্ষ ৩১ হাজার মেট্রিকটন খাদ্যশস্য ও ৪১৬৬ কোটি টাকার বিনিময়ে বিগত ১০ বছরে ১ কোটি ৬২ লক্ষ লোকের কর্মসংস্থান হয়েছে। এসময়ে বিভিন্ন দুর্যোগ-দুর্বিপাকে বিশেষত বন্যা, ঘূর্ণিঝড়, নদীভাঙ্গন, অগ্নিকান্ড ইত্যাদি দুর্যোগে ক্ষতিগ্রস্ত ৬ কোটি ৩৩ লক্ষ মানুষ খাদ্য সহায়তা পেয়েছেন এবং ১ কোটি ৯ লক্ষ ৭৬ হাজার মানুষ ১৯৩ কোটি টাকার অর্থ সহায়তা পেয়েছেন। সরকারের একটি প্রতিশ্রুতি ছিল, কোনো মানুষ যাতে দুর্যোগ-দুর্বিপাকে খাদ্যকষ্ট না পায়।

কোভিড-১৯ এ যখন পুরো পৃথিবী বিপর্যস্ত ঠিক সেসময় দেশের দরিদ্র ও অসহায় জনগণের অর্থনৈতিক মুক্তি দিতে সরকার ২০২০-২০২১ অর্থবছরে ১০০টি উপজেলায় শতভাগ বয়স্ক ভাতা, বিধবা ভাতা এবং প্রতিবন্ধী ভাতা প্রদানের ঘোষণা দিয়েছেন। এই তিনটি ভাতায় নতুন করে উপকাভোগী যুক্ত হবেন ১১ লাখেরও অধিক দরিদ্র ও অসহায় জনগণ। করোনাকালে ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় রয়েছে প্রান্তিক পর্যায়ে দরিদ্র ও অসহায় জনগণ। তাদের মধ্যে বয়স্ক, বিধবা ও প্রতিবন্ধীরা সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিতে রয়েছে। এদের কথা বিবেচনায় নিয়ে সরকার বিভিন্ন ধরনের ভাতাভোগীর সংখ্যা বৃদ্ধি করেছে, যা করোনায় এই ক্রান্তিকালে দরিদ্র জনগণের খাদ্যের নিশ্চয়তা দিয়ে তাদেরকে অনেকটা নির্ভর রাখতে সক্ষম হবে। করোনা পরিস্থিতিতে সৃষ্টি দুর্যোগ সারাদেশে সাধারণ মানুষের কষ্ট লাঘবে মানবিক সহায়তা হিসেবে ত্রাণ বিতরণ অব্যাহত রেখেছে সরকার।

সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচি বিশ্বের প্রায় সকল দেশে বিভিন্ন আকারে ও ধরনের বিদ্যমান আছে, বিদ্যমান থাকবে। বাংলাদেশে এখন পর্যন্ত গরিব ও অসহায় মানুষদের নিয়ে সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচি আবেষ্টিত। আবার সামরিক-বেসামরিক কর্মকর্তা-কর্মচারীদের পেনশনসহ অন্যান্য সুবিধাও দেওয়া হয় সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির আওতায়। সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির প্রয়োজনীয়তা আছে বলেই উন্নত দেশেও এর প্রচলন রয়েছে। বাংলাদেশে বিশেষ করে জলবায়ু পরিবর্তন ও দুর্যোগ ঝুঁকিতে থাকা মানুষের জন্য এর পরিধি বিস্তৃত হোক, এ প্রত্যাশা আমাদের সকলের।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: সামাজিক-নিরাপত্তা
আরও পড়ুন