Inqilab Logo

শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

বাবরি মসজিদভাঙা মামলায় প্রশ্নবিদ্ধ রায়

| প্রকাশের সময় : ২ অক্টোবর, ২০২০, ১২:০৬ এএম

বাবরি মসজিদের স্থানে এক সময় রামমন্দির ছিল, এমন ভিত্তিহীন ও কাল্পনিক অভিযোগ তুলে ১৯৯২ সালের ৬ ডিসেম্বর হিন্দুত্ববাদী বিশ্বহিন্দু পরিষদ,আএসএস ও বজরং দলের নেতা-কর্মীরা সাধারণ হিন্দুদের উস্কে দিয়ে ৫শ বছরের পুরনো বাবরি মসজিদটিকে ভেঙ্গে গুড়িয়ে দেয়। সেই থেকে সারা ভারত জুড়ে বাবরি মসজিদ ও রামমন্দির বিতর্ক ও উত্তেজনায় বহু দাঙ্গা ও রক্তপাতের ঘটনা ঘটে। এসব ঘটনায় গত ২৮ বছরে হাজার হাজার মানুষের প্রাণহানি ঘটেছে। নিহতদের বেশিরভাগই মুসলমান। বাবরি মসজিদকে ভারতের বিশাল সংখ্যক মুসলমান তাদের ধর্মীয় ঐতিহ্য ও চেতনার একটা প্রতিক হিসেবে মনে করে। শুধু মুসলমানরাই নয়, গণতন্ত্র ও আইনের শাসন ও সাংবিধানিকভাবে ধর্মনিরপেক্ষতায় বিশ্বাসী মুক্তমনা হিন্দুরাও ঐতিহাসিক এই মসজিদ ভাঙ্গার সাথে যারা জড়িত তাদের বিচারের জন্য দীর্ঘদিন ধরে একটি ঐতিহাসিক রায়ের জন্য অপেক্ষা করেছিল। এত বছরের বিচারিক প্রক্রিয়াশেষে গত বুধবার বাবরি মসজিদ ভাঙ্গা মামলার রায় ঘোষিত হয়েছে। রায়ে মসজিদ ভাঙ্গার দায়ে অভিযুক্ত সম্মুখসারির ৩২জন আসামির সবাইকে খালাস দেয়া হয়েছে। ভারতের বিচারিক ইতিহাসে এটি একটি বিষ্ময়কর নজির। এই রায়ে ভারতের ক্ষমতাসীন বিজেপি উল্লাস প্রকাশ করলেও চরমভাবে হতাশ হয়েছে মুসলমানরা। এমন রায়ে ভারতের তৎকালীন স্বরাষ্ট্র সচিব মাধব গোডবোলেও বিষ্ময় প্রকাশ করেছেন।

বাবরি মসজিদ ও রামমন্দির সংক্রান্ত বিতর্ক ও আইনগত প্রক্রিয়ায় এটিই প্রথম বিষ্ময় নয়। ইতিপূর্বেও মসজিদের জমির উপর রামমন্দির কমিটির অধিকার প্রতিষ্ঠা এবং ভ’মি বিরোধে মুসলমানদের বঞ্চনার রায় দিয়েছিল ভারতের আদালত। বাবরি মসজিদ ভেঙ্গে রামমন্দির নির্মানের সামগ্রিক কর্মসূচিটি ছিল হিন্দুত্ববাদী রাজনৈতিক প্রক্রিয়ার অংশ। ভারতের দ্বিতীয় বৃহত্তম জনগোষ্ঠি হিসেবে মুসলমানদের ঐতিহাসিক দাবিকে অগ্রাহ্য করার কোনো আইনসম্মত বা রাজনৈতিক ভিত্তি নেই। বাবরি মসজিদ ভাঙ্গার জন্য বিশ্বহিন্দু পরিষদসহ হিন্দুত্ববাদী নেতাদের উস্কানিমূলক বক্তব্য, সহিংসতা ছড়িয়ে মসজিদ ভাঙ্গার জন্য সংগঠিত করা ও নেতৃত্ব দেয়ার ঘটনাবলী সারাবিশ্বের মানুষ দেখেছে। ন্যায়বিচারের দাবি এবং আইনগত স্বচ্ছতার খাতিরে ১৯৯২ সালে ১৬ ডিসেম্বর বাবরি মসজিদ ভাঙ্গার ঘটনা তদন্তের জন্য ভারতীয় ইউনিয়নের তৎকালীণ স্বরাষ্ট্র মন্ত্রনালয়ের নির্দেশনা অনুসারে এমএস লিবারহান বা মনমোহন সিং লিবারহান নামের একজন সাবেক বিচারপতির নেতৃত্বে একটি তদন্ত কমিশন গঠন করা হয়। প্রায় ১৭ বছর সময় নিয়ে তদন্তের পর ২০০৯ সালে লিবারহান কমিশনের রিপোট প্রকাশিত হলেও কোনোভাবে রিপোর্টটি গণমাধ্যমে ফাঁস হয়ে না পড়লে তা আলোর মুখ দেখত কিনা সে বিষয়ে অনেকেই সংশয় প্রকাশ করেছিলেন। এই তদন্ত কমিশন রিপোর্টে যাই থাকুক, উপসংহারে সেখানে বলা হয়েছিল, ‘ইট ওয়াজ নট স্পনটেনাস, নর আনপ্লানড’-বাবরি মসজিদ ধ্বংসের ঘটনাটি কোনো স্বতস্ফুর্ত বা অপরিকল্পিত ঘটনা ছিল না।

বাবরি মসজিদ ডিমোলিশন মামলার রায় ভারতের রাজনীতি ও বিচারিক ইতিহাসে অন্যতম আলোচিত ঘটনা হিসেবে চিহ্নিত হয়ে থাকবে। কারা কিভাবে প্রতিক্রিয়া দেখাল সেটা খুব মূখ্য বিষয় নয়। বিচারের রায়ে সত্য উন্মোচিত হল কিনা, প্রকৃত অপরাধিরা শাস্তি পেল কি না, আইনের শাসনের প্রতিফলন ঘটল কি না, কালের বিচারে তাই একদিন বিবেচ্য বিষয় হয়ে দাঁড়াবে। ভারতের সামাজিক-রাজনৈতিক বাস্তবতা যাই হোক, একটি বহুত্ববাদী গণতান্ত্রিক সমাজে বিচারবিভাগের প্রতি সব মানুষের আস্থা রাষ্ট্রীয় সংহতি, ঐক্য অখন্ডতার প্রশ্নে একটি বড় ভিত্তি হিসেবে গণ্য। সেখানে বাবরি মসজিদ ভাঙ্গার দায়ে প্রধান অভিযুক্তরা ক্ষমতাসীন বিজেপির প্রভাবশালী নেতা হওয়ায় আদালতের রায়ে তার প্রভাব পড়ল কিনা তা নিয়ে এরই মধ্যে বির্তক শুরু হয়ে গেছে। লিবারহান কমিশনের রিপোর্টে বাবরি মসজিদ ভাঙ্গার ঘটনাকে ‘পরিকল্পিত’ বলে অভিহিত করা হয়েছিল, সেখানে মামলার রায়ে বলা হয়েছে, ‘বাবরি মসজিদ ধ্বংসের ঘটনা কোনো পূর্ব পরিকল্পনা ছিল না’। এলকে আদভানি, এমএম যোশি, উমা ভারতী, কল্যাণ সিং, সাক্ষী মহারাজসহ অভিযুক্ত সকলকে বেকসুর খালাস দেয়ার মধ্য দিয়ে আদালতের উপর রাজনৈতিক প্রভাবের বিষয়টি এখন আলোচ্য বিষয়ে পরিনত হয়েছে। খোদ তৎকালীণ কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র সচিব গোডবোলে রায়ের বস্তুনিষ্ঠতা নিয়ে দ্বিমত পোষণ করার পাশাপাশি এ রায়ে দেশের ফৌজদারি বিচারব্যবস্থাকে প্রশ্নবিদ্ধ করবে বলে তিনি মনে করেন। যেখানে ভারতীয় সুপ্রীম কোর্ট বাবরি মসজিদ ভাঙ্গার ঘটনাকে সুস্পষ্টভাবে অপরাধ হিসেবে গণ্য করে রায় দিয়েছিল, সেখানে সিবিআই বিচারক এমন একটি সংঘবদ্ধ ঘটনার সাথে কোনো পরিকল্পনা বা অপরাধমুলক তৎপরতা খুঁজে পাননি। মামলার অভিযোগের সাথে তথ্য প্রমাণ হিসেবে যে সব অডিও-ভিডিও ডক্যুমেন্ট জমা দেয়া হয়েছিল সে সব তিনি প্রথমেই খারিজ করে দিয়েছিলেন। এরপর চুড়ান্ত রায়ে সব অভিযুক্তকে খালাস দিলেন। মুসলমান নেতারা বাবরি মসজিদ মামলার রায়ের এই দিনকে ‘ভারতীয় বিচারব্যবস্থার জন্য একটি কালো দিন’ বলে অভিহিত করেছেন।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

আরও পড়ুন