পবিত্র লাইলাতুল বরাত
আজ দিবাগত রাত পবিত্র লাইলাতুল বরাত। পরম করুণাময় আল্লাহতায়ালা তার বান্দাদের গুনাহ মাফ, বিপদমুক্তি ও
গেল ২৫ সেপ্টেম্বর সন্ধ্যায় সিলেট এমসি কলেজের ছাত্রাবাসে ক’জন ছাত্র নামধারী যুবক কলেজে স্বামীসহ বেড়াতে আসা এক দম্পত্তিকে ক্যাম্পাসের গেইটে আটকে রাখে। তারা স্বামীকে বেঁধে রেখে তার স্ত্রীকে একটি কক্ষে নিয়ে গণধর্ষণ করে। যারা এ অপরাধের সঙ্গে জড়িত। তারা কিন্তু এই কলেজেরই ছাত্র এবং ছাত্রাবাসে বসবাস করে। গর্হিত এ ঘটনার প্রতিবাদে সারাদেশে তোলপাড় শুরু হয়েছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ দেশের বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও বিভিন্ন রাজনৈতিক দল, সাংস্কৃতিক ও সামাজিক সংগঠন এ ঘটনার তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদ জানিয়ে দোষী ব্যক্তিদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দাবি করছেন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, পররাষ্ট্রমন্ত্রী আব্দুল মোমেন, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল, আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের, সিলেট সিটি কর্পোরেশনের মেয়র আরিফুল হক চৌধুরীসহ দেশের গণ্যমান্য ব্যক্তিবর্গ এমসি কলেজের ধর্ষণের ঘটনার নিন্দা জানিয়ে দোষীদের কঠোর শাস্তি প্রদানের আহবান জানিয়েছেন।
পরিতাপের বিষয়, পত্রিকার পাতা উল্টালেই বা টেলিভিশনে প্রতিদিনই নারী ধর্ষণ এবং ধর্ষণের পর হত্যা এ জাতীয় সংবাদ প্রকাশিত ও সম্প্রচারিত হচ্ছে, যা আমাদেরকে দারুণভাবে আঘাত করে চলেছে। প্রশ্ন জাগে, আমাদের যুবসমাজ আজ কোনদিকে এগুচ্ছে? তাদের উদ্দেশ্যই বা কী। মা-বাবার ঘামের পয়সায় অর্জিত টাকা ব্যয় করে কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ে যারা পড়াশুনা করতে যায় তাদের একি আচরণ! মা-বাবারা তাদের ধর্ষক, খুনী, ছিনতাইকারী হয়ে বেরিয়ে আসার জন্য এসব প্রতিষ্ঠানে পাঠান না নিশ্চয়ই। তারা মনে বড় আশা নিয়ে তাদের পাঠান এ উদ্দেশ্যে যে, তারা মানুষ হয়ে সমাজে প্রতিষ্ঠিত হবে। মা-বাবার মুখ উজ্জ্বল করবে। কিন্তু দেখা যায়, তারা বিপথে পরিচালিত হচ্ছে। এর মূল কারণ, নৈতিকতার অবক্ষয় এবং ধর্মীয় অনুশাসন মেনে না চলা। আগেকার দিনে ছেলে-মেয়েদের মক্তবে/মসজিদে পাঠিয়ে ধর্মীয় শিক্ষা দানের ব্যবস্থা ছিলো। এজন্য তারা কোনো অনৈতিক কাজ করতে সাহস পেত না বা তাদের মন-মানসিকতা এভাবে গড়ে উঠতো না। তাদের জানা থাকতো, তারা মানুষ হবে। কিন্তু পরিতাপের বিষয়, আজ তারা বিপথগামী হচ্ছে। কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ালেখা করে সন্ত্রাস, চাঁদাবাজি, লুটতরাজ, তুচ্ছ কারণে মানুষকে খুন করছে। এসব ঘটনা দেখে এবং শুনে শরীর ও মন শিউরে উঠে।
প্রশ্ন ওঠে, আমরা কি মানুষ? প্রশ্নটি যত সহজ বলে মনে হয় উত্তর তত সহজ নয়, বরং জটিল এর উত্তর। এ প্রশ্নের উত্তরের জন্য আমাদের জানা প্রয়োজন, একজন প্রকৃত মানুষ হতে হলে তার কী কী বৈশিষ্ট্য থাকা প্রয়োজন।
নিজেকে প্রকৃত মানুষ রূপে গড়ে তুলতে হলে সর্বপ্রথম নিজের অন্তর্নিহিত মনুষ্যত্বকে জাগ্রত করতে হবে। অন্তরের অনুভূতি, অন্তরচেতনাকে জাগ্রত করে তুলতে হবে। বর্তমান সমাজে মানুষ হয়ে উঠেছে আত্মকেন্দ্রিক। তারা সর্বদাই নিজেকে নিয়ে ব্যস্ত। তারা নিজের বৈষয়িক চিন্তায় এতই মগ্ন থাকে যে, অন্যের সুখ-দুঃখ নিয়ে চিন্তা করার সময় তাদের থাকে না। এ স্বার্থান্বেষী চিন্তাধারার অনেকে সমাজ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে। প্রকৃত মানুষ হতে হলে আমাদের চাই পরস্পরের প্রতি অন্তরের ভালোবাসা, চাই স্নেহ, করুণা, স্বার্থপরহীনতা। প্রতিদিন খবরের কাগজ খুললে দেখা যায, পৃথিবীর বিভিন্ন স্থানে কীভাবে চলছে হিংসা, বিদ্বেষ, ক্রোধ, লুণ্ঠন, ধর্ষণ ইত্যাদি পাপকর্ম। এটা মোটেই মনুষ্যত্বের পরিচয় নয়? হযরত মোহাম্মদ (সা.) বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি সর্বশক্তিমান আল্লাহকে বিশ্বাস করে এবং মানুষকে ভালবাসে সে প্রকৃত মুসলমান’। এখানে প্রকৃত মুসলমান বলতে প্রকৃত মানুষের কথাই বলা হয়েছে, যার অন্তরে থাকবে পরস্পরের প্রতি স্নেহ, ভালবাসা এবং আল্লাহর প্রতি বিশ্বাস। কিন্তু বর্তমান সমাজের গতি উল্টোদিকে। বর্তমানে মানুষ নিজেকে নিয়েই ব্যস্ত।
বর্তমান জগতে মানুষের প্রতি মানুষের যে ভালবাসা, স্নেহ, মমতা দেখা যায়, তা অতি কৃত্রিম। তাতে থাকে না কোনো আন্তরিকতা, থাকে শুধু কপটতা আর স্বার্থপরতা। এ ভালবাসা শুধু নিজের স্বার্থসিদ্ধির জন্য। বর্তমানে এ জগতের রথ চলছে মিথ্যা এবং ছল নামক ইন্ধনের দ্বারা। এ রথে যারা চলছে, তাদের প্রকৃত মানুষ বলা যায় না। তাদের বলা যেতে পারে ভন্ড, পাষন্ড। এ ভন্ডামির জন্য বর্তমান সমাজ ধূলির সমতলে। এ ধূলিসম অবস্থা থেকে উঠে আসার জন্য চাই প্রকৃত স্নেহ, ভালবাসা, যার দ্বারা আমরা মানুষের মন জয় করে প্রকৃত মানুষ বলে নিজেকে পরিচয় দিতে পারি।
একজন ব্যক্তিকে প্রকৃত মানুষ রূপে গড়ে ওঠার জন্য নিজের ভাবাধারার পরিবর্তন ঘটানো একান্ত প্রয়োজন। যে ব্যক্তি জগতের সকল ব্যক্তিকে নিজের বন্ধু, ভাই, পিতা ও মহিলাদের নিজের বোন, মাতা হিসেবে দেখেন সে ব্যক্তিই প্রকৃত মানুষ হিসেবে গণ্য হতে পারে। অর্থাৎ থাকা দরকার পরস্পর পরস্পরের প্রতি ভ্রাতৃত্ববোধ। কিন্তু বর্তমানে এ ভাবধারার মানুষ নিতান্তই নগণ্য। প্রকৃত মানুষ ধীরে ধীরে লোপ পেয়ে যাচ্ছে। আমরা শিক্ষা-দীক্ষা, জ্ঞান-বিজ্ঞানে যতই উন্নতি করি না কেন প্রকৃত মানুষ না হতে পারলে এ উন্নতির কোনো মূল্য নেই।
আমাদের হারিয়ে যাওয়া এ মনুষ্যত্ববোধ এবং মানবের চারিত্রিক গুণাবলী ফিরিয়ে আনতে চাই পারস্পরিক সম্প্রীতি। পরিতাপের বিষয়, আজ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে সস্প্রদায়গত ভেদবুদ্ধি মানুষের প্রতি আচরণে ঘৃণ্য বর্বরতায় মেতে উঠে মানুষ মানুষের রক্তে নিজেকে রঞ্জিত করছে। সভ্যতা ও সংস্কৃতির উপর কলঙ্ক লেপন করছে। মানবিকতাকে করছে পদদলিত।
বর্তমানের মানুষ মনুষ্যত্বহীন হয়ে পড়ছে। আর এ মনুষ্যত্বহীন মানুষ পানিবিহীন সাগরের ন্যায়। পানিবিহীন সাগরের যেমন পরিচয় পাওয়া যায় না, ঠিক তেমনই মনুষ্যত্বহীন মানবের পরিচয় পাওয়া যায় না। অর্থাৎ সূক্ষ্ম দৃষ্টি দিয়ে দেখতে গেলে মনুষ্যত্ব আর মানুষের সম্পর্ক পানি ও জীবনের সম্পর্কের ন্যায়। মনুষ্যত্ব আমাদের অন্তরের বিষয়। আর এ অভ্যন্তরীণ বিষয়কে জাগ্রত করার জন্য আমাদের চাই আন্তরিক ইচ্ছা। মনুষ্যত্ব গড়ে তোলার জন্য আমাদের চাই মানসিক শক্তি, অন্তরের দৃঢ় বিশ্বাস, যা আমাদের প্রগতির পথে বাধা দান করা বিভিন্ন বিপদের সাথে সংগ্রাম করতে সাহায্য করবে। এ সংগ্রামে জয়ী হলেই আমরা প্রকৃত মানুষ হতে পারব ও নিজেদের গড়ে তুলতে পারব।
এ জগতের বাহ্যিক রূপ অতি সুন্দর, মনোমুগ্ধকর, কিন্তু এর অভ্যন্তরীণ রূপ বড়ই জটিল। বিভ্রান্তিকর মরিচীকার মতো, যা তৃষ্ণার্ত পথিকদের প্রবঞ্চিত করে। বর্তমান জগতের মানবরূপও ঠিক মরিচীকার মতো। তারা নিজের স্বার্থ সিদ্ধির জন্য, লিপ্সা ও আকাক্সক্ষা পূরণের জন্য অন্যকে মিথ্যা প্রলোভনে বিভ্রান্ত করে।
এটি প্রকৃত মনুষ্যত্ব নয়। বর্তমান সমাজের মানুষ বন-মানুষের সমতুল্য। অরণ্যবাসী বন-মানুষের অন্যের প্রতি হিংসা, বিদ্বেষ ও স্বার্থপরতা থাকে। অন্যের মুখের গ্রাস ছিনিয়ে নেওয়ার প্রবণতা তাদের অধঃপতনের মুখে ঠেলে দিয়েছে। বর্তমান সমাজের মানুষও একই দিকে ধাবিত হচ্ছে। আমরা হাজার হাজার বছরের চেষ্টাতেও প্রকৃত মানুষ হতে পারিনি। তাই সময় থাকতে আমরা যদি আমাদের মানসিকতার পরিবর্তন ঘটাতে না পারি তাহলে পাতাল পতন নিশ্চিত।
নৈতিকতা, শালীনতা ও সভ্যতা প্রকৃত মানুষের পরিচয় বহন করে। দিনে দিনে এসব গুণাবলী আমাদের মধ্যে থেকে বিদায় নিচ্ছে। সমাজে একটি জংলি অবস্থা তৈরি হচ্ছে। খুন, সন্ত্রাস, লুণ্ঠন, চাঁদাবাজি, পরস্বোহরণ, ধর্ষণ ইত্যাদি সমাজকে বসবাসের অনুপোযোগী করে তুলেছে। কলেজে পড়া শিক্ষিত তরুণ যখন, বেড়াতে আসা নারীকে তার স্বামীর কাছ থেকে ছিনিয়ে নিয়ে গণধর্ষণের শিকারে পরিণত করে, তখন তাদের এ বর্বরতার শুধুমাত্র নিন্দা করলেই চলে না, তাদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি চাই। তাদের সে শাস্তি, নিশ্চিত করতে হবে।
বলা বাহুল্য, সমাজকে নিরাপদ করতে হলে নৈতিক মূল্যবোধসাশিত মানুষ গড়ে তোলার বিকল্প নেই। যারা শিশু তাদের নিয়ে আদর্শ সমাজ গড়ার কাজটি শুরু করতে হবে। তাদের উপযুক্ত ধর্মীয় শিক্ষার মাধ্যমে শিক্ষিত করে তুলতে পারলে এ কলুষিত জগৎ একটি নির্মল স্বাস্থ্যবান জগতে পরিণত হবে। আর এ প্রজন্মকে উপযুক্ত দিশা দেওয়ার জন্য বর্তমানে প্রাপ্ত বয়স্কদের উপযুক্ত ভূমিকা নিতে হবে। নতুন প্রজন্মকে গড়ে তোলার জন্য শুধু স্কুলে শিক্ষা দিলে চলবে না, তার সাথে সাথে নতুন প্রজন্মকে দিতে হবে ধর্মীয় এবং বাহ্যিক শিক্ষা।
লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।