Inqilab Logo

শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

প্রবাসীদের ভোগান্তি কমাতে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে

রিন্টু আনোয়ার | প্রকাশের সময় : ২৩ সেপ্টেম্বর, ২০২০, ১২:০২ এএম

করোনা মহামারিতে সবকিছু স্থবির হয়ে গেলেও মানব পাচার বন্ধ হয়নি। ক্ষেত্রবিশেষে তা আরো বেপরোয়া হয়ে উঠেছে। পাচারকারিরা পাচারের ধরণ ও কলাকৌশলে পরিবর্তন এনেছে। কেবল বেকার বা কাজ পাগল যুবক নয়, নারী, শিশুরাও তাদের টার্গেটে পরিণত হয়েছে। স¤প্রতি এই চক্রের কিছু দালাল ধরা পড়ায় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কর্মকর্তারাও অবাক হয়েছেন। এই চক্রের কেউ কেউ রাতারাতি কোটি কোটি টাকার মালিক হয়ে সমাজপতি এমনকি রাজনীতিক বনে গেছে। নিজেদের বিশিষ্ট ব্যবসায়ী-দানবীর পরিচয় দিয়ে এলাকায় দাপট দেখিয়ে বেড়াচ্ছে। মন্ত্রী-এমপিসহ স্থানীয় রাজনীতিকদের কাছেও তাদের বেশ কদর। মানব পাচার, ভিসা বিক্রি, অর্থ পাচার ও ঘুষ লেনদেনের অভিযোগে কুয়েতে গ্রেফতার সংসদ সদস্য কাজী শহিদ ইসলাম পাপুল এই শ্রেণীর একটা উদাহরণ মাত্র। এমন বহু পাপুল আনাচে-কানাচে লুকিয়ে রয়েছে। এরা কেবল মানব পাচার-অর্থপাচার নয়, সরকারি কেনা-কাটা, টেন্ডারসহ বহু ধরনের দুর্নীতিতে জড়িয়ে আছে। যদি এদের বিরুদ্ধে বিশেষ অভিযান শুরু হয়, তাহলে পিলে চমকে যাবার মতো ঘটনা ঘটা অস্বাভাবিক নয়। লিবিয়ায় মানব পাচার এবং পাপুলের ঘটনা তদন্তে নেমে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ-সিআইডি যেসব চাঞ্চল্যকর তথ্য পেয়েছে, এভাবে ব্যবস্থা নেয়া শুরু হলে অনেকের থলের বেড়াল বের হয়ে আসবে। একটি রিক্রুটিং এজেন্সি অফিসের পিয়নের ব্যাংক অ্যাকাউন্টে ৩০ কোটি টাকার হদিস পেয়ে বিস্মিত হয়েছেন সিআইডির তদন্তকারী কর্মকর্তারা। এ থেকে বুঝতে বাকি থাকে না, মানব পাচারকারিরা কতটা বেপরোয়া। কেবল সউদী, দুবাই, ব্রæনাইসহ মধ্যপ্রাচ্যে নয়, ভিয়েতনাম- তিউনিশিয়া, ইতালি, এমনকি ইউরোপীয় ছোট ছোট দেশেও মানব পাচারকারী চক্র সক্রিয়। সেখানে পাচার করে কাজ না দিয়ে অনেককে তারা আটকেও রাখছে। কারো কারো ওপর শারীরিক নির্যাতন চালিয়ে দেশে অবস্থানরত পরিবারের কাছ থেকে আদায় করছে মোটা অঙ্কের টাকা। স¤প্রতি লিবিয়ায় ২৬ বাংলাদেশির মৃত্যুর ঘটনার মধ্য দিয়ে এই নারকীয় কাÐের কিছুটা প্রকাশ পেয়েছে মাত্র।

মোটা অংকের রোজগারের প্রলোভনে বিভিন্ন দেশে দেহ ব্যবসায় বাধ্য করানো তরুণীদের খবর খুব কমই পাওয়া যায়। মধ্যপ্রাচ্যসহ বিভিন্ন দেশে এ ধরনের কতো নারী দুর্দশার মধ্যে রয়েছে তার সঠিক হিসাব নেই। এ হিসাব পাওয়া কঠিন। পাসপোর্ট, ভিসা, বিদেশ যাওয়াসহ তাদের সব কাজই হয় গোপনে। একটি আন্তর্জাতিক সংস্থার মতে, বাংলাদেশ থেকে প্রতি বছর প্রায় ৭ লাখ মানুষ অবৈধভাবে বিদেশে পাড়ি জমায়, যাদের একটি বড় অংশ যায় পাচারের মাধ্যমে। বিদেশে ড্যান্স ক্লাবের আড়ালে গত দেড় বছরে সহস্রাধিক নারী পাচার হয়েছে-এমন তথ্য দিয়েছে র‌্যাব। এই তথ্য বাংলাদেশ থেকে মানব পাচারের ভয়াবহ চিত্রের প্রকাশ মাত্র। শুধু ড্যান্স ক্লাবের নামে সহস্রাধিক নারী পাচার হয়ে থাকলে বিদেশে লোভনীয় চাকরি ও অন্যান্য সুযোগ-সুবিধার নামে কত নারী-পুরুষ ও শিশু পাচার হতে পারে, তা অনুমান করা কঠিন নয়। মানবপাচার নিয়ে কাজ করা বিভিন্ন সরকারি ও বেসরকারি সংস্থা বলছে, প্রতি বছর ৫০ হাজার নারীকে বিদেশে কাজ এবং বিয়ে দেওয়ার নামে পাচার করা হয়ে থাকে। তাদের এই হিসাবও ধারনা নির্ভর। কিছু তথ্য ও অভিযোগের ভিত্তিতে সরকার মাঝেমধ্যে কিছু এজেন্সিকে শনাক্ত করে লাইসেন্স বাতিল করে। কিন্তু এতে পাচারকারীদের তেমন কোন সমস্যা হয় না। কারণ, তাদের একাধিক লাইসেন্স থাকে। একটি বন্ধ হলে অন্যটি দিয়ে কাজ শুরু করে। পাশাপাশি নতুন লাইসেন্সও হাতিয়ে নেয় অল্প সময়ের মধ্যে। আর গ্রেফতার হওয়া ব্যক্তিরা কখন ছাড়া পায়, তার খবরও পাওয়া যায় না। এদিকে করোনাকালে দেশে প্রবাস ফেরতদের দুর্গতির খবরও কেউ নিচ্ছে বলে মনে হচ্ছে না। তাদের কারো কারো জীবন কিছু গোষ্ঠীর কব্জায় চলে গেছে। টার্গেট করে হানা দেয়া হচ্ছে প্রবাসীদের ওপর। ধরপাকড়ও চলছে। দেশে ফেরার পর তাদের কাউকে এয়ারপোর্ট থেকে, আবার কাউকে গ্রেফতার করা হয়েছে করোনা ছড়ানোসহ নানা অজুহাতে। সম্প্রতি দেশের বিভিন্ন থানায় বিভিন্ন সময়ে আটক ২৫৫ জন প্রবাসীর মুক্তির দাবিসহ কক্সবাজারের চকরিয়ায় প্রবাসী জাফরকে ক্রসফায়ারের মাধ্যমে হত্যার প্রতিবাদ জানিয়ে ঢাকায় মানববন্ধন হয়েছে। বাংলাদেশ যুব অধিকার পরিষদ এবং বাংলাদেশ সাধারণ ছাত্র অধিকার পরিষদের ব্যানারে জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে মানববন্ধন করে সংগঠন দুটি। মানববন্ধনে জানানো হয়, চকরিয়ায় ওমান প্রবাসী জাফরকে গ্রেফতার করে ৫০ লাখ টাকা চাঁদা চায় পুলিশ ও স্থানীয় চক্র। টাকা না দেয়ায় তাকে ক্রসফায়ারে হত্যা করা হয়েছে। অর্থনীতির চালিকা শক্তি, রেমিটেন্স যোদ্ধাসহ নানা খেতাবে এখন আর মুগ্ধ নয় প্রবাসীরা। বরং বিরক্ত। এতে রেমিট্যান্স পাঠানোতেও ঘাটতি দেখা দেয়ার আশঙ্কা করা হচ্ছে। বলা বাহুল্য, প্রবাসীদের অনেকে চাকরি হারিয়ে দেশে ফেরায় এবং ফেরার অপেক্ষায় থাকার কারণে গত দুই মাসে বেশি রেমিট্যান্স এসেছে। এতে প্রবাসী আয় বা রেমিটেন্স বেড়েছে বলে বলা হচ্ছে। অথচ বাস্তবতা ভিন্ন। ঈদের আগের মাসে জুলাইতে প্রায় ২২ হাজার ৯৫ কোটি টাকা রেমিটেন্স এসেছে। দেশে কোনো একক মাসে এতো বেশি টাকা কখনো আসেনি। তবে সামনের মাসগুলোতে এই পরিমাণে রেমিটেন্স আসার সম্ভাবনা কম বলে জানিয়েছেন বিশেষজ্ঞ মহল। কারণ, দেশে ফিরলে নানা বিড়ম্বনায় তাদের পড়তে হয়। দেশের মাটিতে পা রাখার পরপরই বিভিন্নভাবে হয়রানির শিকার হয়। প্রবাসী পরিবারের কাছ থেকে এক শ্রেণীর পুলিশ ও ক্ষমতাসীন দলের নেতাকর্মীর নিয়মিত চাঁদা-বখরা আদায়, দেশে ফেরা প্রবাসীকে মারধর, তুলে নেয়া এমনকি ক্রসফায়ারে দেয়ার ঘটনা ইদানিং বৃদ্ধি পেয়েছে। দেশে ফেরা প্রবাসীকে ক্রসফায়ারে হত্যার ভয় দেখিয়ে অর্থ আদায়ের অভিযোগে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আখাউড়া থানার পাঁচ পুলিশ সদস্যের বিরুদ্ধে মামলা দেয়ার ঘটনাও ঘটেছে। তারা প্রবাসী হারুন ও তার স্ত্রীকে মাদকের মামলায় ফাঁসিয়ে দেয়ার ভয় দেখিয়ে এক লাখ টাকা দাবি করে। হারুনের ঘরে থাকা নগদ ৪০ হাজার টাকা ছিনিয়ে নেয়। এর বাইরেও নানা ভোগান্তিতে রয়েছে প্রবাসীরা। করোনায় আটকা পড়ে যারা প্রবাসে কর্মস্থলে যেতে পারেননি তারা এখন এক অনিশ্চিত পরিস্থিতে পড়েছেন। কারো ভিসার মেয়াদ শেষ হয়েছে। কারো শেষের পথে। টিকিট চেয়েও পাচ্ছেন না। ফলে বিশ্বে শ্রমবাজারে নেতিবাচক প্রতিক্রিয়ার পড়ার আশঙ্কা করা হচ্ছে। করোনা সংক্রমণ শুরুর আগে প্রায় প্রতিদিন ২ থেকে ৩ হাজারের মতো প্রবাসী দেশে ফিরেছেন। তাদের অধিকাংশ আর বিদেশে যেতে পারেননি। আবার কর্মস্থলে যাওয়ার সম্ভবনাও দিন দিন কমে যাচ্ছে। ফলে বিদেশ যাওয়ার বিকল্প খুঁজতে গিয়ে পড়ছে মানবপাচারকারীদের খপ্পরে। পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ১ এপ্রিল থেকে এ পর্যন্ত ২৩টি দেশ থেকে প্রায় এক লাখ প্রবাসী দেশে ফিরেছে। এর মধ্যে প্রায় ২০ শতাংশ নারী কর্মী। বেশি ফিরেছে সংযুক্ত আরব আমিরাত থেকে। প্রবাস ফেরতদের সংখ্যা নিয়ে সরকারের কাছে হালনাগাদ তথ্য নেই। যারা দেশে ফিরেছেন তাদের প্রকৃত সংখ্যার কোনো সরকারী ডাটাবেজ তৈরি হয়নি। করোনায় প্রবাসে মৃতদের সঠিক তথ্যও নেই সরকারে কাছে। রেমিট্যান্স যোদ্ধারা দেশের সম্পদ। তাদের প্রেরিত অর্থ দেশের অর্থনৈতিক উন্নতিতে বিরাট অবদান রাখছে। এই রেমিট্যান্স যোদ্ধাদের যথাযথ কদর করা আমাদের জাতীয় দায়িত্ব। তাদের সুযোগ-সুবিধা বৃদ্ধি এবং হয়রানি বন্ধে সরকারের উচিৎ কার্যকর পদক্ষেপ নেয়া।
লেখকঃ সাংবাদিক ও কলাম লেখক।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: প্রবাসী


আরও
আরও পড়ুন