পবিত্র লাইলাতুল বরাত
আজ দিবাগত রাত পবিত্র লাইলাতুল বরাত। পরম করুণাময় আল্লাহতায়ালা তার বান্দাদের গুনাহ মাফ, বিপদমুক্তি ও
শান্তিময় ও যুদ্ধবিহীন বিশ্ব প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে ১৯৮১ সালে জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদে গৃহীত ৩৬/৬৭ নম্বর প্রস্তাব অনুসারে প্রতি বছর সেপ্টেম্বর মাসের তৃতীয় মঙ্গলবারকে ‘আন্তর্জাতিক শান্তি দিবস’ হিসেবে ঘোষণা দেওয়া হয়। পরবর্তীতে ২০০১ সালের ৭ সেপ্টেম্বর, জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদে গৃহীত ৫৫/২৮২ নম্বর প্রস্তাব অনুসারে ২০০২ সাল থেকে প্রতি বছরের ২১ সেপ্টেম্বরে দিবসটি উদযাপনের সিদ্ধান্ত হয়। সেই অনুসারে প্রতি বছর ২১ সেপ্টেম্বর দিবসটি পালিত হয়ে আসছে। বিশ্বের সব দেশ ও মানুষের মধ্যে শান্তির আদর্শ শক্তিশালী করার উদ্দেশ্যেই ‘আন্তর্জাতিক শান্তি দিবস’। তাই এই দিনটির সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে সম্পৃক্ত একটি শ্লোগান হচ্ছে, ‘যুদ্ধ নয় শান্তি চাই, সুরক্ষিত জীবন চাই।’
আন্তর্জাতিক শান্তি দিবস উপলক্ষে প্রথমে জাতিসংঘের মহাসচিব ‘শান্তি ঘণ্টা’ বাজান ও বিশেষ বক্তৃতা প্রদান করেন। এছাড়াও বিভিন্ন দেশের শিল্পী, শিক্ষাবিদ ও মানবাধিকার কর্মীদের ‘শান্তির দূত’ হিসেবে নিয়োগ করেন এবং তাদের বিভিন্ন কর্মকান্ড স্মরণ করেন। এছাড়াও বিভিন্ন দেশ ও সংস্থা তাদের বিভিন্ন অনুষ্ঠান আয়োজন করে।
দিবসটির সূচনালগ্নে এই সুবিশাল বসুন্ধরার কোণে কোণে নিপীড়িত ও নির্যাতিত জাতিরা একটি সবুজ স্বপ্ন দেখেছিল, সোনালি আশায় বুক বেঁধেছিল যে, আজ থেকে পৃথিবীর বুক হতে চিরকালের জন্য বিদায় নিতে চলেছে অন্যায়-অবিচার, মিটতে চলেছে ধর্ম আর বর্ণের বিদ্বেষ, ঘুচে যাবে ধনী-গরিবের ব্যবধান, মুছে যাবে ক্ষমতার দাম্ভিকতা আর আধিপত্যবাদের দাপট, থেমে যাবে সংঘাত আর হানাহানি, ভুলে যাবো যুদ্ধ বিদ্রোহ, তালা পড়বে অস্ত্র উৎপাদনকারী সংস্থাগুলিতে। এর পরিবর্তে শান্তির অজস্র ধারা প্রবাহিত হবে, বহু কাক্সিক্ষত সুখ-শান্তিতে পৃথিবী ভরপুর হয়ে উঠবে, প্রতিষ্ঠিত হবে বহুপ্রত্যাশিত শান্তি ও সম্প্রীতি, স্থাপিত হবে বিভিন্ন জাতি-ধর্মের মানুষে মধ্যে হৃদ্যতা ও সৌহার্দ্য, গড়ে উঠবে একটি নিরাপদ, সংঘাতমুক্ত ও শান্তিপূর্ণ পৃথিবী। যেখানে থাকবে শুধু শান্তি আর শান্তি।
সুদীর্ঘ ৪০ বছর যাবৎ সারা বিশ্বেই দিবসটি পালন করা হচ্ছে। ৪০ বছর সময়টা নেহাৎ কম নয়। আবার ইসলামী দৃষ্টিকোণ থেকে দেখলে সংখ্যাটি অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। তা যাক, এতদিন পর মানুষের এখন শান্তির সুবিশাল ছায়াতলে বাস করা দরকার ছিল কিন্তু দেখছি বিশ্ব জুড়ে সেই অশান্তি আকাশে বাতাসে ঘুরে বেড়াচ্ছে। উৎপীড়িতের ক্রন্দন-রোলে ভারাক্রান্ত হচ্ছে বাতাসের কান। মা ও শিশুদের আর্তনাদে ফেটে যাচ্ছে পৃথিবীর বুক। বর্বরতার নিকষ কালো মেঘে ঢেকে যাচ্ছে আকাশ। আজকের মুসলিম বিশ্ব, বিশেষ করে ফিলিস্তিন, সিরিয়া, দক্ষিণ সুদান, ইরাক, লিবিয়া, লেবানন, আফগানিস্তান প্রভৃতি দেশে অশান্তির উত্তাল তরঙ্গ শান্তির স্বপ্নকে ভেঙেচুরে চুরমার করে দিয়েছে, রোহিঙ্গারা দেশ ছেড়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নিতে বাধ্য হয়েছে। রোহিঙ্গাদের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখাই এখন প্রশ্নের মুখে। যেখানে অস্তিত্ব নিয়েই টানাটানি সেখানে শান্তি একটা দিবাস্বপ্ন ছাড়া আর কী হতে পারে? কেউ ঘটা করে আন্তর্জাতিক শান্তি দিবস পালন করবে আর কেউ কাঁদতে থাকবে আর তার আর্তনাদ তথাকথিত শান্তি স্থাপনকারীদের কর্ণকুহরেই পৌঁছাবে না, তাহলে নজরুলের ভাষায় বলতে হয়- ‘এমনি ক’রে কি জগৎ জুড়িয়া মার খাবে দুর্বল?’
এখন প্রশ্ন হলো, সারা বিশ্বে যখন দিবসটি পালন করা হচ্ছে, তখন এসব অশান্তি করছে কারা? নিশ্চয়ই কোনো শান্তিপ্রিয় বা শান্তিতে বিশ্বাসী মানুষ এগুলো করছে না। তাহলে কি সর্ষের ভিতরেই ভূত? হ্যাঁ, দুই প্রকার স্বার্থ সিদ্ধি করার লক্ষ্যেই উন্নত ও শক্তিশালী দেশগুলিই তো অশান্তির বীজ বপন করে চলছে। আন্তর্জাতিক অঙ্গনে আধিপত্য বিস্তার তথা বিশ্বজুড়ে মোড়লগিরি করা আর অস্ত্র বিক্রি করে অর্থ কামানো। আবার এরাই শান্তি দিবস পালন করছে। বসে আছে শান্তির ঠিকাদারী নিয়ে।
গ্লোবাল রিসার্চ সেন্টার ফর রিসার্চ অন গ্লােবালাইজেশন’ এ প্রকাশিত এক গবেষণা প্রতিবেদনে যে চিত্র উঠে এসেছে তা হলো, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর থেকে বর্তমান সময় পর্যন্ত প্রায় ৩ কোটি নিরীহ মানুষকে হত্যা করেছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। যা প্রথম বিশ্বযুদ্ধে নিহতের প্রায় দ্বিগুণ। ১০০ বছর আগে ভয়াবহ ওই যুদ্ধে নিহত হয় প্রায় দেড় কোটি মানুষ। অর্থনৈতিক ও সামরিক পরাশক্তি দেশটি ১৯৪৫ সাল থেকে বিশ্বে নিজ আধিপত্য কায়েমে এই কাজ করেছে। প্রতিবেদনে আরো বলা হয়েছে, যুক্তরাষ্ট্রের চাপিয়ে দেয়া অবৈধ যুদ্ধ, সামরিক অভ্যুত্থান ও গোপন সামরিক অভিযানের শিকার হয়েছে বিশ্বের অন্তত ৩৭টি দেশ বা জাতি। এর মধ্যে ২০০১ সাল থেকে ‘সন্ত্রাসবিরোধী যুদ্ধে’র নামে এখন পর্যন্ত এই ধারা অব্যাহত আছে আফগানিস্তানে। সিরিয়া, ইয়েমেন ও লিবিয়াতে মার্কিন সেনাবাহিনী এখনো যুদ্ধ চালাচ্ছে। আর এসব যুদ্ধ ও সংঘাতের ফলে বিপুল সংখ্যক মানুষের প্রাণহানি ঘটছে। মৃত্যুর পাশাপাশি অসংখ্য মানুষ আহত হয়েছে। বিমান হামলা আর অত্যাধুনিক সব অস্ত্রের আঘাতে সারাজীবনের জন্য পঙ্গু হয়েছে এসব মানুষ। বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, যুদ্ধে প্রত্যেক নিহত ব্যক্তির বিপরীতে অন্তত ১০ জন আহত হয়েছে। এর মানে মার্কিন বাহিনীর হাতে আহত হয়েছে আরো অন্তত ২০ থেকে ৩০ কোটি মানুষ। মার্কিন ইতিহাসবিদ জেমস এ লুকাস কয়েক বছর ধরে গবেষণা করে প্রদিবেদনটি তৈরি করেন।
স¤প্রতি এক বিবৃতিতে খোদ মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প পেন্টাগনের ঝাঁপি খুলে দিয়ে বলেন, ‘আমি যুদ্ধ চাই না। তাই পেন্টাগনের কর্তারা আমাকে পছন্দ করেন না।’ পেন্টাগনের কর্মকর্তাদের দিকে আঙ্গুল তুলে তিনি বলেন, ‘প্রতিরক্ষা বিভাগের কর্মকর্তারা অস্ত্র তৈরির কোম্পানিগুলিকে খুশি করতে যুদ্ধ ছাড়া আর কিছু চান না!’ এই প্রথমবার কোনো মার্কিন প্রেসিডেন্ট এমন স্বীকারোক্তি দিলেন। তাহলে আন্তর্জাতিক শান্তি দিবসে বিভিন্ন ধরনের শান্তি আলোচনাসভা কি ‘কাঁঠালের আমসত্ত¡’? মুখে শান্তির খই ফুটবে অন্তরে থাকবে যুদ্ধের পরিকল্পনা!
অস্ট্রেলিয়ার সিডনিভিত্তিক আন্তর্জাতিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান ইনস্টিটিউট ফর ইকোনমিকস অ্যান্ড পিস (আইইপি) প্রতিবছর একটি বিশ্ব শান্তি সূচক-২০২০ প্রকাশ করে। নাগরিকদের শান্তিপূর্ণ জীবনযাপনের নিরাপত্তা ও সুরক্ষা, অর্থনৈতিক মূল্য, ট্রেন্ড ও শান্তিপূর্ণ সমাজ গঠনে দেশগুলোর নেয়া পদক্ষেপের তথ্যের ওপর ভিত্তি করে এই সূচক তৈরি করা হয়। ২০২০ সালের বিশ্ব শান্তি সূচক অনুযায়ী, দক্ষিণ এশিয়ায় সবচেয়ে বেশি উন্নতি ঘটেছে বাংলাদেশের। গত বছর যেখানে বাংলাদেশের অবস্থান ছিল ১০১তম, এ বছর ৪ ধাপ এগিয়ে হয়েছে ৯৭তম। সামগ্রিক স্কোরে বাংলাদেশের উন্নতি ২.৩ শতাংশ। এই সূচকে ভারত ও পাকিস্তান থেকে এগিয়ে রয়েছে বাংলাদেশ। ভারতের অবস্থান ১৩৯ ও পাকিস্তানের ১৫২। যুদ্ধবিধ্বস্ত আফগানিস্তান রয়েছে তলানিতে। আফগানিস্তান ১৬৩তম, সিরিয়া ১৬২তম, ইরাক ১৬১তম, দক্ষিণ সুদান ১৬০তম এবং ইয়েমেন ১৫৯তম অবস্থানে রয়েছে।
লেখক: সহকারী অধ্যাপক ও বিভাগীয় প্রধান, আরবি বিভাগ, শহীদ নুরুল ইসলাম মহাবিদ্যালয়, পশ্চিমবঙ্গ, ভারত
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।