Inqilab Logo

শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

এজেন্ট ও ডিজিটাল ব্যাংকিং অর্থনীতিকে গতিশীল করছে

মো. মাঈন উদ্দীন | প্রকাশের সময় : ১৮ সেপ্টেম্বর, ২০২০, ১২:১৮ এএম

চরম দারিদ্র্য নিরসনে বাংলাদেশসহ এশিয়ার অনেক দেশ যখন যথেষ্ট সফলতার দিকে যাচ্ছিল, তখন কোভিড-১৯-এর ধাক্কায় সেই অর্জন হুমকির মুখে পড়ছে। এসডিজি (২০৩০ এজেন্ডা) বা টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রার প্রথম ও দ্বিতীয় অভীষ্ট হচ্ছে পৃথিবী থেকে দারিদ্র্য ও ক্ষুধা দূর করা। বিআইডিএসের হিসাব মতে, প্রতি বছর ৭ শতাংশ প্রবৃদ্ধি হলে ২০৩০ সালের মধ্যে বাংলাদেশ দারিদ্র্যমুক্ত হতো। কিন্তু কোভিট-১৯ তা অনিশ্চিত করে দিয়েছে। বাংলাদেশের মতো এশিয়ার অন্যান্য দেশের অবস্থাও একই রকম। তাই এ পরিস্থিতিতে এসডিজির দারিদ্র্যমুক্তির লক্ষ্যমাত্রা অর্জন হুমকির মুখে পড়ছে।

করোনা ভাইরাসের প্রকোপে বিশ্ব-অর্থনীতি আজ টাল-মাটাল অবস্থায় আছে। অর্থনৈতিকভাবে সমৃদ্ধ দেশগুলো তাদের লক্ষ্য অর্জনে ব্যর্থ হতে চলেছে। করোনার ধাক্কায় তৃতীয় বৃহত্তম অর্থনীতির দেশ জাপানের জিডিপি কমেছে ২৭ দশমিক ৮ শতাংশ। দক্ষিণ আফ্রিকায় অর্থনীতি ৫১ শতাংশ সংকুচিত হয়েছে। নির্মাণ, ম্যানুফ্যাকচারিং ও খনিখাতে স্থবিরতা দেখা দিয়েছে।

করোনার এ মহামারিতে বিশ্ব অর্থনীতির দুর্বলতাগুলো দৃশ্যমান হচ্ছে। বিশ্ব স্বাস্থ্যসংস্থার ভাষ্য মতে, এ মহামারি বিশ্ব থেকে এতো সহজে যাচ্ছে না। পৃথিবীর অনেক দেশ তাদের অর্থনীতিকে পুনরুদ্ধারের জন্য নানা পন্থা-কৌশল অবলম্বন করার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। বাংলাদেশ সরকারও চেষ্টা করছে অর্থনীতিকে কীভাবে গতিশীল করা যায়। বাংলাদেশের অর্থনীতি মূলত ব্যাংক নির্ভর। সংশ্লিষ্টরা মনে করেন, অর্থনৈতিক উন্নতির প্রাথমিক ধাপ হলো শক্তিশালী ব্যাংকিং ব্যাবস্থা। জনগোষ্ঠীর যত বেশি সংখ্যক মানুষ ব্যাংকিং সেবার আওতায় আসবে অর্থনীতির ভিত ততই মজবুত হবে। বাংলাদেশ ব্যাংকের যুগোপযোগী নীতি প্রণয়ন, নীতির উদারীকরণ ও ব্যাংকাদের সচেতনতা বৃদ্ধির কারণে ব্যাংকিং সেবা দিন দিন সম্পসারিত হচ্ছে। তথ্য প্রযুক্তির সম্প্রসারণ ব্যাংকিং খাতে বৈপ্লবিক পরিবর্তন এনেছে। করোনার ধাক্কায় ব্যাংকগুলো প্রযুক্তি উন্নয়নে বিশেষ মনোযোগী হয়েছে। গ্রাহকেরা নিরাপদ দূরত্বে থেকে যাতে লেনদেন করতে পারে সেজন্যই অনলাইন ব্যাংকিংয়ের নানা সুবিধা যুক্ত হয়েছে। বর্তমানে ৬৫ শতাংশের বেশি মানুষ আর্থিক সেবার আওতায় এসেছে। প্রযুক্তিকে কাজে লাগিয়ে আর্থিক খাতে যুক্ত হয়েছে নিত্য নতুন ব্যাংকিং সেবা।

ব্যাংকসমূহ এজেন্ট ব্যাংকিং, বুথ ব্যাংকিং, উপশাখা সৃষ্টির মাধ্যমে প্রত্যন্ত অঞ্চলের মানুষকে আর্থিক অন্তর্ভুক্তির আওতায় নিয়ে আসছে। একই সাথে ব্যাংকগুলো প্রযুক্তিগত উন্নয়নে ব্যাপক মাত্রায় জোর দিয়েছে। ফলে ডিজিটাল ব্যাংকিংয়ের প্রসারতা দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। ব্যাংকিং সেবায় যোগ হয়েছে মোবাইল ব্যাংকিং, ইন্টারনেট ব্যাংকিং, অনলাইন পেমেন্ট সিস্টেম, ক্রেডিট কার্ড, ডেবিট কার্ড ও ভিসা কার্ডের মাধ্যমে ই-বাণিজ্য। প্রযুক্তি ব্যবহার করে মানুষ আর্থিক সেবা যেমন রেমিট্যান্স বিতরণ, ইউটিলিটি বিল পরিশোধ, বেতন ভাতা প্রদান, এটিএম ও সিআরএম মেশিনের মাধ্যমে নগদ টাকা উত্তলন ও জমার মাধ্যমে ব্যাংকিং সেবা গ্রহণ করছে।

ডিজিটাল ব্যাংকিংয়ের সম্প্রসারণে দেশের অর্থনৈতিক গতি সম্প্রসারিত হচ্ছে। করোনা মহামারি এ প্রযুক্তিকে আরও গতিশীল করেছে। ছয় মাস ধরে গ্রাহকরা নিরবচ্ছিন্নভাবে ব্যাংকিং সুবিধা পেয়ে যাচ্ছে। লকডাউনেও গ্রাহকেরা ব্যাংকে না গিয়ে ডিজিটাল প্রযুক্তির মাধ্যমে সেবা নিতে পেরেছে। ব্যাংকগুলো করোনায় মহামারিতেও তাদের অনেক শাখা খোলা রেখেছে। সেবা দিতে গিয়ে অনেক ব্যাংকার করোনায় আক্রান্ত হয়েছে, নিহতও হয়েছে।

ডিজিটাল প্রযুক্তির কারণে ব্যাংক বহির্ভূত বিপুল জনগোষ্ঠী ব্যাংকিং সেবার আওতায় এসেছে, এক্ষেত্রে মোবাইল ফিন্যান্সিয়াল সার্ভিস বা এমএফএস গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। ২০১১ সাল থেকে বাংলাদেশ ব্যাংক এ সেবা চালু করে। গত জুলাই পর্যন্ত এমএফএস সেবার গ্রাহক সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৯ কোটি ২৫ লক্ষ ৭৩ হাজার ২১৩। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য মতে, জুলাইয়ে মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে লেনদেন হয়েছে ৬২ হাজার ৯৯৯ কোটি টাকা। করোনা মহামারিতে রপ্তানিমুখী শিল্পের ২৬ লাখ শ্রমিককে চার মাসের বেতন ভাতা দেয়া হয়েছে মোবাইল ব্যাংকিয়ের মাধ্যমে। প্রণোদনার অর্থ বিতরণেও মোবাইল ব্যাংকিং বড় ভূমিকা রেখেছে।

বাংলাদেশের ব্যাংকের তথ্য থেকে জানা যায়, বর্তমানে দেশে তফসিলি ব্যাংকের সংখ্যা ৬০। এসব ব্যাংকের শাখা রয়েছে ১০ জাহার ৫৮৩টি। ২০০৯ সালে ব্যাংকের শাখা ছিল ৭ হাজার ৩২৭। গত এক দশকের ব্যাংকের শাখা বেড়েছে ৩ হাজার ২৫৬টি। প্রযুক্তির উৎকর্ষতায় শুধু শাখা বৃদ্ধি নয়, বরং ব্যাংকগুলোর আমানতও বৃদ্ধি পেয়েছে কয়েক গুণ। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য বলছে, ২০০৯ সালের শেষে ব্যাংকগুলোতে গ্রাহকের আমানত ছিল ৩ লক্ষ ৪ হাজার ২৭৬ কোটি টাকা। চলতি বছরের মার্চ শেষে ব্যাংক আমানতের পরিমাণ ছিল ১২ লক্ষ ১০ হাজার ৪৯৭ কোটি টাকা। সে হিসাবে আমাদের প্রবৃদ্ধি হয়েছে ২৯৭ দশমিক ৮৩ শতাংশ। শুধুমাত্র ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ লি., যেটি বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় ব্যাংক, যার আমানত জুন ২০২০-এ ১ লাখ কোটি টাকার মাইলফলক অতিক্রম হয়েছে। রেমিট্যান্সের ক্ষেত্রেও ইসলামী ব্যাংকের মাধ্যমে চলতি বছরে জুন পর্যন্ত রেমিট্যান্স এসেছে ৫৮১ মিলিয়ন ডলার। ব্যাংকের ব্যাপক গ্রাহক/জনগোষ্ঠীর অন্তর্ভুক্তি ও ডিজিটালাইজেশনের ফলে এটা সম্ভব হয়েছে।

দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে ব্যাংকিং সেবা পৌঁছে দিতে ভূমিকা পালন করছে এজেন্ট ব্যাংকিং। বাংলাদেশ ব্যাংকের অনুমোদন নিয়ে এ সেবা চালু হয়েছে ২০১৩ সালে। গ্রামের বিশাল জনগোষ্ঠীকে ব্যাংকিং সেবার আওতায় আনার অন্যতম মাধ্যম হলো এজেন্ট ব্যাংকিং। ব্যাংকগুলো এখন তাদের শাখা না বাড়িয়ে এজেন্ট ব্যাংকিং আউটলেট আর বুথের সংখ্যা বাড়াচ্ছে। এজেন্ট ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে হিসাব খোলা, টাকা জমা ও উত্তোলন, রেমিট্যান্স গ্রহণসহ ছোট ছোট বিনিয়োগের অর্থ দেয়া হচ্ছে। ফলে দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলের মানুষ সহজেই ব্যাংকিং সেবার সাথে যুক্ত হচ্ছে। এজেন্ট যেহেতু স্থানীয় তাই গ্রামের লোকেরা তাদের বিশ্বাস করে। ফলে আর্থিক অন্তর্ভুক্তিতে এজেন্ট ব্যাংকিং কার্যক্রম জোরালো ভূমিকা রাখছে। যারা আগে ব্যাংকিং সেবা নেয়ার চিন্তা করতো না, তারা এখন এই সেবায় যুক্ত হচ্ছে। সাত বছরে বিপুল জনপ্রিয়তা অর্জন করছে এ সেবা। চলতি বছরের জুন পর্যন্ত দেশে ২৮টি ব্যাংক এজেন্ট ব্যাংকিং সেবা চালুর অনুমোদন পেয়েছে। জুন শেষ এজেন্টের মাধ্যমে ব্যাংক হিসাব খুলেছে ৭৩ লাখ ৫৮ হাজার ১৯০ জন গ্রাহক। প্রযুক্তির উন্নয়নে করোনা মহামারির মাঝেও দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে ব্যাংকিং সেবা পৌঁছে দিতে এজেন্ট ব্যাংকিং বিরাট ভূমিকা রেখেছ। ভবিষ্যতে প্রযুক্তির উৎকর্ষতার মাধ্যমে ব্যাংকিং সেবাকে আরও উন্নততর করায় সুযোগ সৃষ্টি হচ্ছে। এটা অর্থনীতির চাকাকে আরও গতিশীল ও মজবুত করতে সাহায্য করবে। ডিজিটাল ব্যাংকিংয়ের প্রসারতাকে সুরক্ষার জন্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে। ইদানীং হ্যাকিং বা ডিজিটাল জালিয়াতির মাধ্যমে দেশের ব্যাংকগুলো থেকে অর্থ চুরির আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। আন্তর্জতিক হ্যাকার চক্রের সম্ভাব্য সাইবার হামলা প্রতিরোধে বিশে্বর বিভিন্ন দেশের ব্যাংকগুলোতেও সতকর্তা জারি করা হয়েছে। এজন্য ব্যাংকিং ব্যবস্থায় প্রযুক্তিগত ত্রুটি ও দুর্বলতাগুলো চিহ্নিত করে তা কাটিয়ে উঠতে দক্ষ ও অভিজ্ঞ জনবল গড়ে তোলা উচিত।
লেখক: অর্থনীতি বিশ্লেষক



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: অর্থনীতি

৩ জানুয়ারি, ২০২৩
২১ নভেম্বর, ২০২২
১৭ নভেম্বর, ২০২২

আরও
আরও পড়ুন