পবিত্র লাইলাতুল বরাত
আজ দিবাগত রাত পবিত্র লাইলাতুল বরাত। পরম করুণাময় আল্লাহতায়ালা তার বান্দাদের গুনাহ মাফ, বিপদমুক্তি ও
খিচুড়ি খাননি বা এর রন্ধন প্রক্রিয়া কমবেশি জানেন না এমন মানুষের সংখ্যা দেশে খুবই কম। খিচুড়ি আমাদের দেশের অত্যন্ত প্রিয় একটা খাবার। শহর-গ্রাম সকল জায়গায় এর কদর প্রশ্নাতীত। বৃষ্টির দিন হলে তো কথাই নেই। খিচুড়ির সাথে ইলিশ মাছ ভাজি রসনাবিলাসীদের অতিপ্রিয় খাবার। বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে ডাইনিং এ সকালের নাস্তায় খিচুড়ির সাথে আলু ভর্তা খাননি এমন গ্রাজুয়েট খুঁজে পাওয়া ভার। সেই খিচুড়ি রান্না ও পরিবেশন শিখতে বেশকিছু সরকারি কর্মকর্তাকে এবার বিদেশ যাওয়ার প্রস্তাব করার একটি খবর এখন বেশ আলোচনা হচ্ছে। দেশে এসে তারা নাকি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের স্কুল ফিডিং কার্যক্রমকে আরও উন্নত, কার্যকর ও গতিশীল করতে অবদান রাখবেন। এমন এক অদ্ভুত প্রস্তাব অনুমোদনের জন্য প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তর পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ে পাঠিয়েছে, যা নিয়ে বর্তমানে দেশে ব্যাপক চাঞ্চল্যের সৃষ্টি হয়েছে। এমন প্রস্তাব চারিদিকে ব্যাপক সমালোচনার জন্ম দিয়েছে।
মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তাদের বিদেশ ভ্রমণের বিষয়ে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা প্রতিমন্ত্রী মারফত জানা যায় যে, সারাদেশের সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ‘মিড ডে মিল’ প্রকল্পের আওতায় শিক্ষার্থীদের দুপুরের খাবার হিসেবে স্বাস্থ্যসম্মত খিচুড়ি খাওয়ানো হবে। বর্তমানে দেশের ১৬টি উপজেলায় পাইলট প্রজেক্ট হিসেবে প্রায় ১০০০ বিদ্যালয়ে সপ্তাহে তিন দিন দুপুরে রান্না করা খিচুড়ি শিক্ষার্থীদের খাওয়ানো হয়। চলমান প্রকল্পটি সারাদেশে চালু করতে ১৯ হাজার ২৯০ কোটি টাকার একটি প্রকল্প তৈরি করে তা অনুমোদনের জন্য পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে একনেকে পাঠানো হয়েছে। প্রকল্পের আওতায় ৫০০ কর্মকর্তাকে বিদেশে পাঠিয়ে খিচুড়ি রান্না ও পরিবেশন বিষয়ে প্রশিক্ষণ দেবার কথা বলা হয়েছে, যা বিবেকবান প্রতিটি মানুষের মনকে চরমভাবে নাড়া দিয়েছে। প্রস্তাবনায় প্রাথমিকভাবে ৫০ জন সরকারিভাবে কর্মকর্তাকে পার্শ্ববর্তী দেশে পাঠিয়ে খিচুড়ি রান্না ও পরিবেশন শিখতে ৫০ কোটি টাকার বরাদ্দ চাওয়া হয়েছে, যা রাষ্ট্রীয় সম্পদের চরম অপচয়। বিষয়টি এখন পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ে অনুমোদনের অপেক্ষায় রয়েছে।
এদিকে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় থেকে জানা গেছে, প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তর প্রাথমিকভাবে ৫০ কর্মকর্তার বিদেশ যাওয়ার জন্য প্রায় ৫ কোটি টাকা চেয়েছে। এছাড়া দেশেই প্রশিক্ষণের জন্য আরও ১০ কোটি টাকা চাওয়া হয়েছে। প্রস্তাবিত এই রান্না করা খাবার বিতরণ কর্মসূচির জন্য ব্যয় ধরা হয়েছে ১৯ হাজার ২৮৪ কোটি টাকা। এর আওতায় পাঁচ বছর ধরে প্রায় ১ কোটি ৪৮ লাখ শিক্ষার্থীকে পুষ্টিকর বিস্কুট ও রান্না করা খিচুড়ি পরিবেশন করা হবে। ৫০৯টি উপজেলার শিক্ষার্থীদের মধ্যে এই খাবার পরিবেশন করা হবে। তবে পরিকল্পনা কমিশন এই প্রকল্পের নানাবিধ ব্যয় কমাতে বলেছে। বিদেশ সফরের জন্য দু’টি দলে অল্পসংখ্যক কর্মকর্তাকে পার্শ্ববর্তী দেশে পাঠাতে বলা হয়েছে। এছাড়া দেশে এ ধরনের প্রশিক্ষণ গ্রহণের বিষয়ে যৌক্তিকতা কি, জানতে চাওয়া হয়েছে।
সমালোচনার মুখে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের জ্যেষ্ঠ সচিব আকরাম-আল-হোসেন জানিয়েছেন, খিচুড়ি রান্নার প্রশিক্ষণের জন্য নয়, অন্যান্য দেশ স্কুলে ‘মিড ডে মিল’ বা দুপুরের খাবার কীভাবে বাস্তবায়ন করে সে ক্ষেত্রে অভিজ্ঞতা অর্জনে বিদেশে প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা হয়েছে। তবে এক্ষেত্রে মোট প্রকল্পের অতি অল্প অর্থ ব্যয় ধরা হয়েছে। এই অর্থ ব্যয় কোনো অপচয় নয়, বরং অভিজ্ঞতা অর্জনের জন্য প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা রাখা হয়েছে।
বলতে দ্বিধা নেই যে, এটা দেশের জন্য অত্যন্ত দুঃখজনক একটি ঘটনা। এদেশে বহু বোর্ডিং স্কুল আছে, হেফজখানা আছে, এতিমখানা আছে, লিল্লাহ বোর্ডিং আছে। সেখানে তিন বেলা রান্না করে খাওয়ানো হয়। অত্যন্ত সুচারুরূপে এবং দক্ষতার সাথে দীর্ঘদিন থেকে তারা এই কার্যক্রম পরিচালনা করে আসছে। এদিকে দেশের সকল পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে আবাসিক হলের ডাইনিংসমূহে তিন বেলা রান্না করে শিক্ষার্থীদের মধ্যে খাবার পরিবেশন করা হয়। প্রশিক্ষণের প্রয়োজন হয় না। দেশে বিপুল সংখ্যক ছাত্র-ছাত্রী হোস্টেলে থেকে পড়ালেখা করে। সেখানেও রান্না করা হয়। পরিবেশনও করা হয়। প্রশিক্ষণের কোনো প্রয়োজন হয় বলে আমার জানা নেই। আমি নিজে আমার পূর্বতন বিশ্ববিদ্যালয় ইসলামী বিশ্ববিদ্যালেয়র সর্ববৃহৎ হলের প্রভোস্ট ছিলাম। পাঁচশতাধিক ছাত্রের জন্য ডাইনিং-এ তিনবেলা রান্না হতো। ছাত্রদের মাঝে তা পরিবেশনও করা হতো। প্রায় প্রতিদিন সকালের নাস্তার মেনুতে থাকতো খিচুড়ি আর আলু ভর্তা। কৈ, তাদের কারো জন্য তো কোটি টাকা ব্যয় করে বিদেশ থেকে প্রশিক্ষণের প্রয়োজন হয়নি। আসলে প্রকল্পের টাকায় বিদেশ ভ্রমণ সরকারি কর্মকর্তাদের ফ্যাশনে পরিণত হয়ে গেছে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বারবার অপ্রয়োজনীয় বিদেশ ভ্রমণকে নিরুৎসাহিত করার তাগিদ দিলেও প্রকল্পের টাকায় সরকারি কর্মকর্তাদের অপ্রয়োজনীয় ভ্রমণ রোধ করা যাচ্ছে না।
শুধু খিচুড়ি রান্না করতে অভিজ্ঞতা অর্জন নয় বরং এর আগেও আমরা দেখেছি, অধিকংশ সরকারি প্রকল্প বাস্তবায়নের আগেই প্রকল্পের টাকার একটি উল্লেখযোগ্য অংশ দিয়ে অভিজ্ঞতা অর্জন বা প্রশিক্ষণের নামে সরকারি কর্মকর্তারা দলবেঁধে বিদেশ ভ্রমণ করেন। কিছুদিন আগে পুকুর খননে অভিজ্ঞতা অর্জনের জন্য কিছু কর্মকর্তার বিদেশে যাওয়ার একটি খবর সংবাদপত্রে প্রকাশিত হয়েছিল। নদীমাতৃক বাংলাদেশ পুকুর, নদী-নালা, খাল-বিলে ভরপুর। সেই দেশের মানুষ যখন পুকুর খননের অভিজ্ঞতা অর্জনের জন্য দলবেঁধে সরকারি টাকায় বিদেশ ভ্রমণ করতে যাওয়ার প্রশ্ন উঠে তখন লজ্জায় মাথা হেট হয়ে যায়। যে সব সরকারি কর্মকর্তা এমন সব আজগুবি অভিজ্ঞতা অর্জনের জন্য পিকনিক ম্যুডে বিদেশে গিয়ে আমোদ-ফূর্তি করে রাষ্ট্রীয় অর্থের অপচয় করেন তাদের চিহ্নিত করে বিচারের আওতায় আনা উচিৎ। দেশে এমন কোনো কর্মকর্তা কি আছেন, যিনি পুকুর কীভাবে খনন করেন তা জানেন না? এছাড়া ইদানীং সরকারি প্রায় প্রতিটি প্রকল্পের কেনাকাটায় অতিমূল্য নির্ধারণ করা সরকারি অর্থ হরিলুটের এক অভিনব পন্থায় পরিণত হয়েছে।
করোনাকালে যখন দেশের সার্বিক অর্থনীতি অনেকটা স্থবির। দেশের দীর্ঘমেয়াদী বন্যা, সুপার সাইক্লোন আম্ফানের প্রভাবে গ্রামীণ অর্থনীতির চাকা বেশ মন্থর। বিদেশি বিনিয়োগ অপ্রতুল। চাকরি হারিয়ে দিশেহারা বহুমানুষ। দেশের সামগ্রিক শিক্ষাব্যবস্থা অনেকটাই অচল। বিদেশি শ্রমবাজারের গতি ঋণাত্বক। সরকারের ব্যাংক ঋণের উপর নির্ভরশীলতা যখন দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে, তখন কোটি কোটি টাকা ব্যয় করে খিচুড়ি রান্না, পুকুর খননের অভিজ্ঞতা অর্জনের মতো বিদেশে গিয়ে অপ্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণ গ্রহণ জনগণের ট্যাক্সের টাকার অপচয় ছাড়া কিছুই নয়।
করোনাকালে যারা প্রকল্পের টাকায় অপ্রয়োজনীয় অভিজ্ঞতা অর্জনের নামে বিদেশ যাওয়া প্রাধান্য দিয়ে প্রস্তাবনা প্রণয়ন করতে পারেন তাদের দেশপ্রেম, রুচিবোধ ও বিবেকবোধ নিয়ে প্রশ্ন তোলাই যায়। খিচুড়ি রান্নার অভিজ্ঞতা অর্জনের নামে বিদেশ ভ্রমণ করার পরিকল্পনার সাথে যেসব হর্তাকর্তা জড়িত তাদের বিবেকবোধ বলে কি আর কিছুই অবশিষ্ট নেই? মহামারি করোনাকালে এমন অদ্ভুত প্রস্তাব মানুষের বিবেককে কঠিনভাবে নাড়া দিয়েছে। খিচুড়ি বাংলাদেশের মানুষের অত্যন্ত প্রিয় এবং সুস্বাদু একটি খাবার। এটি রান্না করার জন্য তেমন বিশেষ জ্ঞান বা অভিজ্ঞতা অর্জন করার কোনো প্রয়োজন আছে বলে মনে করার কোনো কারণ নেই। খিচুড়ি রান্না করার রেসিপি নিয়ে তো ৮০’র দশকে নির্মিত বাংলা সিনেমার একটি বিখ্যাত গান সে সময় মানুষের মুখে মুখে ঘুরে ফিরতো যে সমস্ত কর্মকর্তারা বিদেশে গিয়ে খিচুড়ি রান্না শিখবেন বা উন্নত পরিবেশন বিষয়ে জ্ঞানার্জন করবেন তারা কি দেশে ফিরে তাদের অর্জিত অভিজ্ঞতা কাজে লাগিয়ে খিচুড়ি রান্না করবেন? মোটেই না। অন্যদিকে যারা বিদেশে যাবেন তারা নিশ্চয়ই কোনো না কোনো বিশ্ববিদ্যালয় বা কোনো না কোনো কলেজের শিক্ষার্থী। অতএব, এই খিচুড়ি কীভাবে রান্না করা হয় বা কীভাবে তা বণ্টন করা হয় সেটি তাদের মোটেই অজানা নয়। কিন্তু শুধুমাত্র সরকারি টাকা অপচয় করার জন্য বা নয় ছয় করার জন্য অভিজ্ঞতা অর্জনের নামে বিদেশ ভ্রমণ বিলাসিতা ছাড়া আর কিছুই নয়। সরকার করোনাকালীন আর্থিক ব্যবস্থাপনায় বড় ধরনের সমস্যায় নিপতিত। গ্রামীণ অর্থনীতি মন্দার মধ্য দিয়ে অতিক্রম করছে। চাকরি হারিয়ে দিশেহারা নিম্নমধ্যবিত্ত মানুষ। শিল্প-কারখানায় উৎপাদনের গতি মন্থর। রেমিটেন্সের চাকা প্রত্যাশা মাফিক ততটা সচল নয়। বিদেশে কর্মসংস্থান ধীরে ধীরে কমে আসছে। এমন একটি জটিল অর্থনৈতিক পরিস্থিতিতে এ ধরনের বিলাসী প্রস্তাব যারা প্রস্তত করতে পারে তাদের শুধু ধিক্কার নয়, চিহ্নিত করে দ্রুত আইনের আওতায় আনাটা জরুরি। একাজে জড়িতদের বিবেকবোধ এবং জাতির প্রতি তাদের দায়বদ্ধতা আজকে চরমভাবে প্রশ্নের সম্মুখীন হয়েছে। তবে দেশে শুধু এই খিচুড়ি অভিজ্ঞতা অর্জনই নয়, এরকম বহু অপ্রয়োজনীয় কাজে সরকারি কর্মকর্তাদের বিদেশ ভ্রমণ রাষ্ট্রীয় সম্পদের অপচয় ছাড়া আর কিছুই নয়। করোনা আমাদের দৈনন্দিন জীবনের অনেক কিছুকেই স্থবির করেছে সত্য কিন্তু স্থবির করতে পারেনি দুর্নীতিকে, স্থবির করতে পারেনি সরকারি কর্মকর্তাদের অপ্রয়োজনীয় বিদেশ ভ্রমণের নেশাকে।
লেখক: প্রফেসর, আইবিএ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।