পবিত্র লাইলাতুল বরাত
আজ দিবাগত রাত পবিত্র লাইলাতুল বরাত। পরম করুণাময় আল্লাহতায়ালা তার বান্দাদের গুনাহ মাফ, বিপদমুক্তি ও
নারায়ণগঞ্জে মসজিদে এসি বিস্ফোরণে লাশের সারির ঘটনা অনেকটা তামাদি হওয়ার পথে। অবসরপ্রাপ্ত মেজর সিনহা হত্যাকান্ডও ধীরে ধীরে ম্রিয়িমান হয়ে যাচ্ছে। এসব ঘটনার পরপরই দনাজপুরের ঘোড়াঘাটের ইউএনও ওয়াহিদা খানমের ওপর হামলার ঘটনা ঘটেছে।
ইউএনও একটি উপজেলা প্রশাসনের সর্বোচ্চ ব্যক্তি। দৃর্বৃত্তরা যখন প্রশাসনের সর্বোচ্চ ব্যক্তির গায়ে হাত তোলার সাহস পায়- তখন ওই জনপদেরই কেবল নয়- রাষ্ট্রের সার্বিক আইন শৃংখলা পরিস্থিতি নিয়ে উদ্বিগ্ন হতে হয়। পরিস্থিতি কোন পর্যায়ে গেলে দুর্বৃত্তরা উপজেলা প্রশাসনের সর্বোচ্চ পদে থাকা একজন ব্যক্তির গায়ে হাত তোলার সাহস পায়, এ প্রশ্ন এড়ানো যায় না। দৃর্বৃত্তরা দিনাজপুরের ঘোড়াঘাট উপজেলার ইউএনও ওয়াহিদাকে কুপিয়েছে তার সরকারি বাসভবনে ঢুকে। একজন ইউএনও’র ওপর হামলার ঘটনায় স্থানীয় পুলিশ প্রশাসনের কর্মতৎপরতাকেও কিন্তু পরীক্ষার মধ্যে ফেলেছে। একজন ইউএনও সরকারি বাসভবনে নিরাপদ না থাকলে রাষ্ট্রের সার্বিক চিত্রটা যে কোনো বিবেকবান মানুষের জন্যই ভীতিকর হয়ে ওঠে।
কেউ কেউ বলতে চান ভিন্নমতের কাউকে যখন হত্যা বা নির্যাতন করা হয়েছিল বা হচ্ছে, তখন কার্যকর ব্যবস্থা নিলে তা ইউএনও’র ওপর হামলা পর্যন্ত না-ও পৌঁছাতে পারতো। নারায়ণগঞ্জের মসজিদে বিস্ফোরণের ঘটনার পর গণমাধ্যমে প্রকাশিত খবরে বলা হয়েছে, লাইনের লিকেজ থেকেই গ্যাস চেম্বারে পরিণত হয় মসজিদটি। তিতাস কর্তৃপক্ষের কাছে সেই লিকেজ লাইন মেরামত করার কথা বলা হলে ৫০ হাজার টাকা দাবি করা হয়। মসজিদ কমিটি জানিয়েছে, তারা টাকাটা যোগাড় করতে না পারায় সেটি আর মেরামত করা হয়নি। এ ধরনের অভিযোগ ও তথ্যের আড়ালে আরো কতো জিজ্ঞাসা থেকে যাচ্ছে। ফায়ার সার্ভিসের প্রধানের ভাষ্যমতে, ‘মসজিদের ফ্লোরের নিচ দিয়ে একটি গ্যাসের লাইন গেছে। সেই লাইন থেকে গ্যাস লিক হয়ে বদ্ধ মসজিদের ভেতরে জমা হয়। ফায়ার সার্ভিসের বক্তব্য সত্য হলে প্রশ্ন উঠে- মসজিদের ফ্লোরের নিচ দিয়ে গ্যাস লাইন যায় কিভাবে? নিশ্চয় গ্যাস লাইন আগে গেছে, তারপর সেই লাইনের উপর মসজিদ তৈরি হয়েছে? গ্যাস লাইনের উপর মসজিদ তৈরি কারা করেছে? কারা এই মসজিদ ভবন তৈরির অনুমোদন দিয়েছে? মসজিদ কমিটির দায়িত্বে যারা, স্থানীয় প্রশাসন, তারা কি জানতেন না, মসজিদটি নির্মানের ক্ষেত্রে যথাযথ ব্যবস্থা নেয়া হয়নি?
কেবল গ্যাস নিঃসরণ বা অন্য কোনো কারণ সাব্যস্ত করার মধ্য দিয়ে এ ঘটনার উপসংহারে পৌঁছা যায় না। বিদ্যুৎ, ওয়াসা এবং গ্যাস অফিসের একশ্রেণীর দায়িত্বপ্রাপ্তদের দুর্নীতির বিষয়টি ওপেন সিক্রেট। এটা সবারই জানা। গ্যাসের লাইনের ওপর কীভাবে মসজিদ নির্মাণ হলো তা খতিয়ে দেখা হচ্ছে বলে সংসদে জানিয়েছেন মাননীয় প্রধানমন্ত্রী। যেখানে-সেখানে গড়ে উঠা মসজিদগুলোর অনুমতির বিষয় খতিয়ে দেখতে সংশ্লিষ্টদের নির্দেশ দেয়া হয়েছে বলেও জানান প্রধানমন্ত্রী। নারায়ণগঞ্জ বা এ ধরনের ঘটনায় প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যের পর আর অন্য কারো কথা খাটে না।
গত এক দশকের বেশি সময় ধরে লুটপাট, খুন, ধর্ষণ, দুর্নীতি, জালিয়াতিসহ নানা ঘটনায় ক্ষমতাসীন দলের লোকদের জড়িত থাকার তথ্য রয়েছে। প্রায় সব ঘটনাকেই বিচ্ছিন্ন ঘটনা বলে চালানো হয়েছে। অবসরপ্রাপ্ত মেজর সিনহা হত্যাকান্ডকেও বিচ্ছিন্ন ঘটনা বলে চালানোর চেষ্টা করা হচ্ছে বলে অনেকে মনে করেন। এর আগে বিশ্বজিত, অভিজিৎ, নুসরাত, তনু, মিতু, খাদিজা, মিন্নি, নয়ন বন্ড, একরাম হত্যাসহ বহু ঘটনাকেই বিচ্ছিন্ন ঘটনা নাম দেয়ার চেষ্টা হয়েছে। ওইসব চেষ্টা কম-বেশি সফলও হয়েছে। ডিপ ফ্রিজে চলে গেছে বহু ঘটনা। মানুষও ভুলে গেছে। কয়েকদিন আগে ভেজালে রাজি না হওয়ায় পিডব্লিওডি›র ইঞ্জিনিয়ারকে পিটিয়ে আধমরা করার ঘটনা ধামাচাপা পড়তে সময় লাগেনি। করোনা মহামারিতে দেশ-দুনিয়া লন্ডভন্ডের মধ্যে ধারনা করা হয়েছিল, অন্তত জীবন-মরণের এ সন্ধিক্ষণে অপরাধীরা কিছুটা হলেও হাত গুটিয়ে নেবে। স্রষ্টার ভয়ে বা মরণের ভয়ে বা পাপে-তাপে কিছুটা মানবিকতার তাড়না জাগবে। টান পড়বে অপকর্মের লাগামে। ধারনা বাস্তব হয়নি।
চুরি, ঠকবাজি, কালোবাজারি কোনটাতে কমতি হয়নি। বরং আরো বেড়েছে। তাও বিচ্ছিন্ন নয়, একেবারে নিরবিচ্ছিন্নভাবে। করোনা চিকিৎসায় এমন কি পজেটিভ-নেগেটিভ রিপোর্ট নিয়ে বাণিজ্যেও বুক কাঁপেনি ঠকবাজদের। সুস্থ্ হওয়া করোনা রোগীর প্লাজমা নিয়ে কুব্যবসাও বাদ যায়নি। মহামারী যেন অনেককে আরো বেপরোয়া করে তুলেছে। মওকা করে দিচ্ছে কোটি-কোটি টাকা হাতিয়ে নেয়ার। পুকুর চুরির বদলে বেড়েছে সাগর চুরি। এই দুর্যোগের মাঝেও বোরোর বাম্পার ফলন ফলিয়েছে কারা? কৃষকরা। তাদের কল্যাণে কারো মন গলেছে? ধান-চালের বাজারে নতুন মজুতদার যোগ হয়েছে। ফল-ফলাদির বাজারেও কুকর্মের দাপট।ক্যামিকেলের ছড়াছড়ি। এমন মহামারিতেও দুষ্টুচক্র থেমে নেই। প্রতিদিন মানুষ মরছে, বিভিন্ন নির্যাতনের শিকার হচ্ছে, অব্যাহত চাঁদাবাজির শিকার হচ্ছে, শিশু অপহরণ হচ্ছে, নারীরা ধর্ষিতা হচ্ছে, জমি বেদখল হয়ে যাচ্ছে। কয়টা ঘটনা জনসমক্ষে প্রচারিত হয়? আর বিচারই বা কয়টার হচ্ছে?
এ কেমন ব্যবস্থা? কেমন মানসিকতা? সব মিলিয়ে অবস্থাটা এমন জায়গায় গিয়ে ঠেকেছে, কোনো ঘটনাই আর দেশে ঘটনা নয়। আর দুর্ঘটনাগুলো বিচ্ছিন্ন ঘটনা। দেশে এমন কোন ঘটনা ঘটছেও না যা কখনো ঘটেনি বাংলাদেশে। একদম নতুন তেমন ঘটনা নেই। যা ঘটছে প্রায় সবই নিত্যকার ঘটনায় পরিণত হয়েছে। শেষ পর্যন্ত ঘটনা কি এখানেই বা এমনই থাকবে? নতুন কিছু যদি ঘটে বসে? কোনো ঘটনায় কয়েকজনকে গ্রেফতার, রিমান্ড, দল থেকে বহিস্কার করা কোনো ফয়সালা নয়। এসব করে প্রদীপদের গুলি করে সিনহা হত্যা, ওয়াহিদা, বদরুলদের পঙ্গু করে দেওয়ার ঘটনার ওপর ধামা বসিয়ে চাপা দেওয়ার ক্যারিশমা দেখানো যায়। কথার ছলেও ঘটনাকে হাল্কা করা দেয়া যায়। একটি ঘটনা এসে আরেকটি ঘটনাকে সরিয়ে দেয়। কোনো কিছুরই যেন মীমাংসা হয় না, কোনো ঘটনারই রহস্য উন্মোচন হয় না। মসজিদে বিস্ফোরনের আরো বহু আগে নারায়ণগঞ্জে সাত খুনের ঘটনাকেও বলা হয়েছিল, উদ্বেগের কিছু নেই। এটি বিচ্ছিন্ন ঘটনা। ফেনীর ফুলগাজী উপজেলার চেয়ারম্যান একরামকে গুলি করে হত্যা করে পুড়িয়ে অঙ্গার করে ফেলার ঘটনাকেও বিচ্ছিন্ন বলা হয়েছিল।
আপাত দৃষ্টিতে সবই বিচ্ছিন্ন ঘটনা। সাবেক মেজর হত্যা, ইউএনও’র ওপর হামলা ছাড়াও মিন্নি, নুসরাত, খাদিজা, ত্বকী, ছেলেধরা সন্দেহে মাকে পিটিয়ে মেরে ফেলা, খুনের ঘটনাকে আত্মহত্যা বানানো, খাদ্যে ভেজাল, ওষুধে ভেজাল, অমুক্তিযোদ্ধা ব্যক্তিকে মুক্তিযোদ্ধার তালিকায় যুক্ত করে মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে সার্টিফিকেট দেওয়া, ক্যাসিনো, বালিশ-পর্দা কান্ড, রাস্তা-ব্রিজ-কালভার্টে লোহার জায়গায় বাঁশ দেয়া, বাসে গণধর্ষণ, বাস থেকে যাত্রী ফেলে তার বুকের উপর দিয়ে বাস চালিয়ে দেয়া, সবই যেন একেকটি বিচ্ছিন্ন ঘটনা। মশা মারা শিখতে, পুকুর কাটা শিখতে রাষ্ট্রের কোটি কোটি টাকা খরচ করে সিঙ্গাপুর, নেদারল্যান্ড যাওয়াও যেন বিচ্ছিন্ন ঘটনা। নকল পিপিই, মাস্কের ব্যবসা হাতানো, সাহেদ-সাবরিনাদের করোনা ট্রস্ট জালিয়াতিও যেন বিচ্ছিন্ন ঘটনা। কিন্তু, বিচ্ছিন্ন ঘটনার এই ধারাবাহিকতা আর কতো? এমন বিচ্ছিন্নতাকে কবে অবিচ্ছন্ন বলা হবে? সবকিছু ‘বিচ্ছিন্ন ঘটনা’ বলার মানসিকতা থেকে কবে মুক্তি মিলবে? সবই বিচ্ছিন্ন ঘটনা হলে, আসল ঘটনা জানার সুযোগ জনগণের কবে হবে? কবে আসবে নিরবিচ্ছন্নতা? নাকি বিচ্ছিন্নতার আড়ালে নিরবিচ্ছিন্ন অঘটনের অপখেলা চলছে?
লেখক: সাংবাদিক ও কলাম লেখক।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।