Inqilab Logo

শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

মৎস্যচাষের সম্ভাবনা কাজে লাগাতে পারলে কর্মসংস্থান বাড়বে, অর্থনীতি শক্তিশালী হবে

সরদার সিরাজ | প্রকাশের সময় : ৬ সেপ্টেম্বর, ২০২০, ১২:০৩ এএম

মাছে-ভাতে বাঙালি, এটি বহুল প্রচলিত প্রবাদবাক্য। কিন্তু কালপরিক্রমায় মাছ অনেকের কাছেই আক্রা হয়ে পড়েছে। বিশেষ করে সাধারণ মানুষের কাছে। কারণ, মূল্য অত্যধিক। কেজিপ্রতি মূল্য ছোট মাছ পাঁচ শত টাকা, শিং-মাগুরও তাই, ইলিশ মাছ হাজার টাকার উপরে, শুঁটকিও তাই, রুই-কাতলা তিন শত টাকার মতো, বোয়াল, শোল ছয় শত টাকার উপরে, সামুদ্রিক মাছ আট শত টাকার মতো, চিংড়ির মূল্যও তাই। কম দামের মধ্যে আছে শুধুমাত্র চাষের পাঙ্গাশ, কই ও তেলাপিয়া। এদের মূল্য দুই শত টাকার কম নয়। এতো মূল্য দিয়ে দেশের কতজন মানুষ মাছ খেতে পারছে প্রতিদিন? নিশ্চয় সামান্য। আর বেশিরভাগ মানুষ মাছ খাওয়া ছাড়াই দিনের পর দিন অতিবাহিত করছে। দেশের অসংখ্য মানুষ যে পুষ্টিহীনতার শিকার হয়েছে, তন্মধ্যে শিশুরা বেশি। তার অন্যতম কারণ নির্দিষ্ট পরিমাণে মাছ না খাওয়া। তবুও বলা হচ্ছে, মাছ উৎপাদনে দেশ স্বয়ংসম্পন্ন হয়েছে। তাই যদি হয় তাহলে, বিদেশ থেকে বিপুল মাছ আসছে কেন? দ্বিতীয়ত: মাছের অগ্নিমূল্য কেন? নিশ্চয় এর মধ্যে একটা ঘাপলা আছে। অর্থাৎ হয় মাছের উৎপাদনের তথ্য ঠিক নয়, অথবা চাহিদার পরিমাণ যা বলা হয়, তা ঠিক নয়। কিংবা মাছ পরিবহনের সময় ব্যাপক চাঁদাবাজি হয়, অথবা বিক্রেতাদের অতি মুনাফার কারণে মাছের মূল্য অত্যধিক। মাছের মূল্য অত্যধিক হওয়ার কারণ যেটাই হোক, তা নির্ণয় করা দরকার। মাছের অগ্নিমূল্য শুধুমাত্র ঢাকা শহরেই নয়, সারা দেশের গ্রাম-গঞ্জেও। ক্ষেত্র বিশেষে বেশি। কারণ, সরবরাহ কম। যে মাছ ধরা হয়, তার বেশিরভাগই চলে আসে ঢাকায়। তাই গ্রামাঞ্চলে মাছের সরবরাহ কম। মূল্য বেশি। এ অবস্থা আজ নতুন নয়, কয়েক বছর যাবত চলছে। অপরদিকে, ঢাকার বিভিন্ন বাজারে গেলেই দেখা যাবে, খুব বড় বড় রুই, কাতলা ও চিতল মাছ বিক্রি হচ্ছে। কিন্তু এ দেশের রুই, কাতলা ও চিতল মাছ এতো বড় হয় না। তাই এসব বিদেশি মাছ। উপরন্তু ঢাকার প্রায় সব এলাকার রাস্তায় দেখা যায়, গোটা ইলিশ ও কাটা-পিস করা ইলিশ বিক্রি হচ্ছে। দামও কম। এই মাছগুলো দেখলেই মনে হয় কোল্ড স্টোরেজের মাছ। কিন্তু এ দেশে মাছ সংরক্ষণ করার মতো তেমন কোল্ড স্টোরেজ নেই। ঢাকার বাজারে এখন আর মাছ কেটে পিস করে বিক্রি হয় না তেমন। তাই এই মাছগুলো বিদেশি, যা বার্মিজ বলে বিক্রেতাদের অভিমত। নিশ্চিত এই মাছগুলো ঢাকা শহরের ন্যায় সারা দেশেও বিক্রি হচ্ছে এবং তা বিপুল পরিমাণে। আর এই মাছগুলো না এলে দেশে মাছের মূল্য আরও বেড়ে যেত। গত ২৩ জুলাই এক দৈনিকে প্রকাশ, ‘বিভিন্ন কারণে দেশে উন্মুক্ত জলাশয়ের পরিমাণ ক্রমশঃ কমছে। এছাড়া, মাছের উৎপাদন ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে নানা কারণে। ফলে উন্মুক্ত জলাশয় থেকে মাছের উৎপাদন ১০ হাজার টন কমে গেছে। দেশের সমগ্র জনগোষ্ঠির সর্বনিম্ন দৈনিক গড় মাছের চাহিদা ৪৬ গ্রাম। এটা মেটাতে হলে প্রতি বছর অতিরিক্ত ৫ লাখ টন করে মাছের উৎপাদন বাড়াতে হবে।’
এ কথা ঠিক যে, দেশে মাছে উৎপাদন অনেক বেড়েছে। জাতীয় অর্থনীতিতে অবদান বেড়েছে মাছের। বিভিন্ন সূত্রে প্রকাশ, ২০০৯ সালে দেশে মাছের উৎপাদন ছিল ৩২.২০ লাখ টন। আর ২০১৯ সালে যার পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৪২.৭৬ লাখ টনে। অর্থাৎ গত দশ বছরে মাছের উৎপাদন প্রায় ১০ লাখ টন বেড়েছে। ২০২০-২১ অর্থবছরে মাছের উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ৪৫.৫২ লাখ টন। মাছের মূল্য অধিক হওয়ায় বিপুল সংখ্যক মানুষ মাছ চাষে ঝুঁকে পড়েছে। অনেক মানুষ ফসলের জমি কেটে পুকুর বানিয়ে মাছ চাষ করছে। এভাবে দেশে মাছের উৎপাদন ক্রমান্বয়ে বাড়ছে। ফাও এর তথ্য মতে, বাংলাদেশ ২০১৯ সালে মৎস্যসম্পদ (মাছ, আবরণযুক্ত জলজ প্রাণী ও শামুক) উৎপাদনে বিশ্বে অষ্টম ও প্রাকৃতিক উৎসের মাছ উৎপাদনে তৃতীয়। উপরন্তু বাংলাদেশ বিশ্বে মাছ উৎপাদন বাড়ার দিক দিয়ে দ্বিতীয় স্থানে উঠে এসেছে (বৃদ্ধির হার ৯%। আর প্রথম ইন্দোনেশিয়া,বৃদ্ধির হার ১২%)। বাংলাদেশ ইলিশ উৎপাদনে বিশ্বে শীর্ষে রয়েছে। বর্তমানে বিশ্বের মোট ইলিশের ৮৬% উৎপাদন হচ্ছে বাংলাদেশে। গত অর্থবছরে দেশে ইলিশের উৎপাদনের পরিমাণ ছিল ৫.৩৩ লাখ টন। দেশে বর্তমানে প্রায় ১৩০ বর্গ কিলোমিটার জুড়ে রয়েছে ইলিশের অভয়াশ্রম। ২০০৯ সালে দেশে ইলিশের উৎপাদন ছিল ২.৯৯ টন। বর্তমানে দেশে যে মাছ উৎপাদন হচ্ছে, তন্মধ্যে চাষ থেকে ৫৬%, উন্মুক্ত জলাশয় থেকে ২৮% ও লোনা পানি থেকে ১৬%। অপরদিকে, বর্তমানে দেশে মৎস্যখাতের অবদান মোট জিডিপিতে ৪.৭৩%, কৃষিতে ২৩%, রফতানিতে ৪.০৪%। মোট জনসংখ্যার ১০% মানুষ সংশ্লিষ্ট আছে মৎস্যখাতে। দেশে আমিষের ৫৮% আসে মাছ থেকে। দেশের মানুষ এখন গড়ে বছরে ৩০ কেজি করে মাছ খাচ্ছে। বর্তমানে ৮ লাখ হেক্টর বদ্ধ জলাশয়ে মাছের চাষ হচ্ছে। দেশীয় প্রজাতির মাছের সংখ্যা ৩০০টি। তন্মধ্যে প্রায় ১০০টি বিলুপ্তির পথে রয়েছে। এর মধ্যে প্রজনন ও চাষাবাদ কৌশল উদ্ভাবনের মাধ্যমে মোট ২৩টি প্রজাতির মাছ পুনরায় ফিরিয়ে আনা হয়েছে। এগুলো হচ্ছে- পাবদা, গুলশা, টেংরাশিং মাগুরগুজি আইড়, চিতল, ফলি, মহাশোল, বৈরালী, রাজপুঁটি, মেনি, বালাচাটা, গুতুম, কুঁচিয়া, ভাগনা, খলিশা, বাটা, দেশি সরপুঁটি, কালবাউশ, কই, গজার ও গনিয়া।এ ক্ষেত্রে বেশি অগ্রগতি হয়েছে হাওড় ও মেঘনার অববাহিকায়। আরও ৭টি বিলুপ্তপ্রায় প্রজাতিকে ফিরিয়ে আনার প্রক্রিয়া চলছে। অন্যদিকে, দেশে প্রায় পৌনে পাঁচশ প্রজাতির সামুদ্রিক মাছ আছে। বর্তমানে ৮০০ হ্যাচারিতে মাছের পোনা চাষ করা হচ্ছে। সরকারের বিভিন্ন ইতিবাচক পদক্ষেপ, যেমন- সচেতনতা তৈরি, ডিমপাড়ার মৌসুমে মা মাছ রক্ষায় সাময়িক মাছ ধরা নিষিদ্ধ রাখা, জাটকা বেচাকেনা নিষিদ্ধ ও নিষেধাজ্ঞার মৌসুমে মৎস্যজীবীদের জন্য বিকল্প কাজের ব্যবস্থা করা ইত্যাদি কারণে মাছের উৎপাদন বেড়েছে। আর ইলিশ মাছের উৎপাদন তো রেকর্ড পরিমাণে বেড়েছে। ২১-২৭ জুলাই মৎস্য সপ্তাহ উদ্বোধনকালে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী গত ২১ জুলাই বলেন, ‘দেশ আজ মৎস্য উৎপাদনে স্বয়ংসম্পূর্ণ। বর্তমানে জনপ্রতি দৈনিক ৬০ গ্রাম চাহিদার বিপরীতে ৬২.৫৮ গ্রাম মাছ আমরা গ্রহণ করছি। গত ১১ বছরে মাছের উৎপাদন ৫০ শতাংশের বেশি বেড়েছে। চিংড়ি, কাঁকড়া, শামুকসহ অসংখ্য মৎস্য সম্পদের আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক বাজারে প্রচুর চাহিদা সৃষ্টি হয়েছে। উপরন্তু এই খাতে গত ১১ বছরে বাড়তি প্রায় ৬৫ লাখ মানুষের কর্মসংস্থান হয়েছে এবং বেড়েছে চাষি ও মৎস্যজীবীদের আয়।’ গত ২৭ জুলাই এক দৈনিকে প্রকাশ, ‘এফএও স্ট্যান্ডার্ড অনুযায়ী দেশে মোট প্রাণীজ আমিষে মৎস্যখাতের অবদান ২০.১% ও প্রাণীসম্পদখাতের অবদান ৭৯.৯%। আর জাতীয় সংসদে মৎস্য ও প্রাণীসম্পদ মন্ত্রণালয়ের প্রাক্তন প্রতিমন্ত্রী আশরাফ আলী খান খসরু উপস্থাপিত তথ্য অনুসারে, দেশের মোট প্রাণীজ আমিষের ২৪% আসে মৎস্যখাত থেকে এবং ৭৬% আসে প্রাণীসম্পদ খাত থেকে।’ যা’হোক, গত অর্থবছরে ৪ হাজার কোটি টাকার মৎস্য ও মৎস্যজাত পণ্য রফতানি হয়েছে, যা লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে অনেক কম। রফতানিকৃত মাছের ৮৪% চিংড়ি। ৫০টি দেশে এই রফতানি হয়ে থাকে। সরকার রফতানিতে ভর্তুকি প্রদান করে চিংড়িতে ১০% ও সাদা মাছে ৫%। দেশে ২টি মৎস্য প্রক্রিয়াজাতকরণ কেন্দ্র আছে। অন্যদিকে, দেশে মাছের উৎপাদন বাড়লেও জেলেদের আর্থিক উন্নতি হয়নি। তাই তারা চরম দৈনদশার মধ্যে দিনাতিপাত করছেন। এই অবস্থায় মাছ ধরা নিষেধাজ্ঞার সময় যে সহায়তা দেওয়া হয়, তা প্রয়োজনের তুলনায় কম হওয়ায় তাদের অভাব-অনটন আরও বেড়ে যায়। তাই এই সহায়তা দ্বিগুণ করা দরকার। তেমনি চলতি বন্যায় মাছ ভেসে যাওয়ায় যে চাষিরা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন, তাদেরকে সহায়তা করা প্রয়োজন।
মৎস্য মন্ত্রণালয় প্রণীত পরিকল্পনা মতে, ‘২০২০-২১ সালে প্লাবন ভূমিতে সমাজভিত্তিক মাছ চাষ কার্যক্রম সম্প্রসারণ করে চাষ এলাকা ১.৭০ লাখ হেক্টরে উন্নীত এবং এতে গড় উৎপাদন হার হেক্টর প্রতি ২৭১ কেজি থেকে বৃদ্ধি পেয়ে ৪৯৫ কেজিতে উন্নীত হবে।’ বর্তমানে পুকুর-দীঘি-খালে মাছের বার্ষিক গড় উৎপাদন হেক্টর প্রতি ২.৬৬ টন। ২০১৫ সালে এলজিইডি’র পক্ষ থেকে সরেজমিনে খাল ও পুকুর যাচাই-বাছাই করে জেলাভিত্তিক তালিকা তৈরি করা হয়।তাতে বলা হয়, সারা দেশে মোট ১৪,৯১০টি খাস পুকুর ও দীঘি এবং ৩,৪৯৩টি প্রাতিষ্ঠানিক ও ৬,৫৩৬টি খাস খাল রয়েছে। এসব পুনঃখননের মাধ্যমে ভূ-উপরিস্থ পানি সংরক্ষণ করতে পারলে সেচ সুবিধা যেমন বৃদ্ধি পাবে, তেমনি মাছ চাষ করতে পারলে মাছের উৎপাদন অনেক বৃদ্ধি পাবে। চলতি অর্থবছরে মৎস্য অধিদপ্তরের ২০টি প্রকল্প রয়েছে মৎস্য উন্নয়নে। এতে ৪০৯ কোটি টাকা বরাদ্দ করা হয়েছে। কিন্তু সরকারের এসব খাল, পুকুর ও দীঘি কি সরকারের দখলে আছে, নাকি রাজধানী ঢাকার খালের মতো অবৈধ দখলদারিদের খপ্পরে রয়েছে তা বলা হয়নি। যদি বেদখলে থাকে, তাহলে এসব দখলমুক্ত ও পুনঃখনন করে মাছ চাষ করা না গেলে দেশবাসীর কোন কল্যাণে আসবে না। তাই অতি সত্বর বর্ণিত সরকারি খাল, পুকুর ও দীঘি দখলমুক্ত (যদি দখল হয়ে থাকে) ও পুনঃখনন করে সর্বশেষ উদ্ভাবিত অধিক উৎপাদনশীল মাছ চাষ করার জন্য ওপেন টেন্ডারের মাধ্যমে লিজ দেওয়া দরকার। তাহলে মাছের উৎপাদন অনেক বৃদ্ধি পাবে। সে সাথে সেচ সুবিধাসহ নানা কল্যাণ হবে।
অপরদিকে, জানা মতে, সারা দেশে ব্যক্তি পর্যায়ে কয়েক লাখ পুকুর, দীঘি, নালা ইত্যাদি রয়েছে। এসবের বেশিরভাগেই বহু ভাগীদার রয়েছে। ফলে অবহেলা বা হিংসাজনিত কারণে সংস্কার না হওয়ায় মজে গেছে। কিন্তু এগুলো সংস্কার করে সর্বশেষ উদ্ভাবিত অধিক উৎপাদনশীল মাছ চাষ করতে পারলে মাছের উৎপাদন অনেক বেড়ে যাবে। উপরন্তু পাড়ে ফলজ গাছ লাগাতে পারলে ফল উৎপাদন বৃদ্ধি পাবে অনেক এবং জ্বালানি, প্রকৃতি ও সেচের সুবিধা হবে। তাই ব্যক্তি পর্যায়ের সব পুকুর, দীঘি, নালা ইত্যাদি সংস্কার করে মাছ ও বৃক্ষ চাষের ব্যবস্থা গ্রহণ করার জন্য কঠোর পন্থা অবলম্বন করা দরকার। এ ক্ষেত্রে ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান ও মেম্বারদের কাজে লাগাতে পারলে সুফল পাওয়া যাবে বেশি। উল্লেখ্য যে, দেশের অনেক স্থানে পুকুরে মাছের সাথে হাঁস চাষ করে ব্যাপক সুফল পাওয়া যাচ্ছে। তাই এ ক্ষেত্রে মানুষকে উদ্বুদ্ধ করা দরকার। দেশের সমুদ্রে রয়েছে বিপুল মৎস্যসহ অফুরন্ত সম্পদ। সেই মাছের বিরাট অংশ যদি আহরণ করা যায়, তাহলে দেশের মাছের উৎপাদন বেড়ে যাবে অনেকগুণ। কর্মসংস্থান ও রফতানিও বৃদ্ধি পাবে। তাই গভীর সমুদ্রসহ সমগ্র উপকুলে অধিক হারে মাছ ধরার জন্য বড় ও আধুনিক প্রযুক্তি সম্বলিত ট্রলার ক্রয় করার জন্য জেলেদের প্রয়োজনীয় ব্যাংক ঋণের ব্যবস্থা করতে হবে স্বল্প সুদে। সাগরে পর্যাপ্ত নিরাপত্তা ব্যবস্থা গড়ে তুলতে হবে। কারণ, বিদেশি দস্যুরা প্রায়ই দেশের জেলেদের মাছ লুট ও অনেক জেলেকে অপহরণ করে। দ্বিতীয়ত: সামুদ্রিক মাছ সংরক্ষণের জন্য প্রতি বছর দুই মাস মাছ ধরা নিষিদ্ধ করা হয়। এ বছর ২০ মে থেকে ২৩ জুলাই পর্যন্ত মাছ ধরা নিষিদ্ধ ছিল সমুদ্রে। চাই এ ব্যাপারে উদ্যোগ গ্রহণ করা দরকার। সম্ভবত ইতোপূর্বে নেদারল্যান্ড এরূপ একটি প্রস্তাব দিয়েছিল ধৃত মাছ অর্ধেক মালিকানায়। কিন্তু সেটা গ্রহণ করা হয়নি। আমরা এখনও গভীর সমুদ্র হতে মৎস্য আহরণ করা শুরু করতে পারিনি। অথচ পার্শ্ববর্তী দেশগুলোসহ বহু দেশ গভীর সমুদ্র হতে বিপুল মৎস্য আহরণ করে।
বিভিন্ন সূত্রে প্রকাশ, খুলনা বিভাগের তিন জেলা খুলনা, বাগেরহাট ও সাতক্ষীরায় প্রায় ১.৫২ লাখ হেক্টর জমিতে চিংড়ির চাষ হয়। আর সারাদেশে মোট ৬৫ হাজার হেক্টর জমিতে গলদার চাষ হয়। দেশে চিংড়ির পোনার প্রয়োজন হয় ১৬০-১৭০ কোটি, যা সংগ্রহ করা হয় প্রাকৃতিক, হ্যাচারি ও ভারত থেকে। এবার আমফানে চিংড়িসহ সব মাছের ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে খুলনা অঞ্চলে। বর্তমানে বিশ্বে রপ্তানি হওয়া চিংড়ির ৭৭% ভেনামি। এটি হচ্ছে হাইব্রিড জাত। সংশ্লিষ্ট রপ্তানিকারকদের অভিমত, রপ্তানি বাজার ধরে রাখতে হলে অধিক উৎপাদনশীল ভেনামি চিংড়ি উৎপাদন করা প্রয়োজন। কারণ, ভেনামি প্রচুর উৎপাদিত হয়। তাই এতে চাষিদের লাভ বেশি। উপরন্তু ভেনামি দামে খুব সস্তা হওয়ায় বর্তমানে এর বৈশ্বিক চাহিদা বেশি। আর সে কারণেই আমাদের চিংড়ির চাহিদা কমে গেছে বিশ্বে। যার নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে রপ্তানিতে। আগে বিশ্ববাজারে আমাদের চিংড়ির অবদান ছিল ৩০%, এখন সেটা ২-৩% হয়েছে।
দেশে ক্রমান্বয়ে মানুষ বাড়ছে। সে সাথে মাছের চাহিদা বাড়ছে। এই চাহিদা পূরণ করার জন্য বছরে কমপক্ষে দুই লাখ টন করে মাছের উৎপাদন বাড়াতে হবে। সে লক্ষ্যে মাছের সর্বদা অধিক উৎপাদনশীল দেশি-বিদেশি জাত উদ্ভাবনে বিশেষ গুরুত্ব দিতে হবে এবং নতুন উদ্ভাবিত জাত দেশের সর্বত্রই চাষ করার দিকে গুরুত্ব দিতে হবে। নদী, খাল, বিল, হাওর, জলাশয় ও সমুদ্রে তথা খোলা পানিতে প্রাকৃতিকভাবেই মাছ উৎপাদন হয়।তাই আহরণ ব্যয় ছাড়া এখানে অন্য ব্যয় তেমন হয় না। তাই খোলা পানির মাছ আহরণে সর্বাধিক গুরুত্ব দেওয়া প্রয়োজন। সম্প্রতি বিভিন্ন দেশে নদী, খাল-বিল, হাওর ও উপকূলে ভাসমান খাঁচায় ও ঘের দিয়ে মৎস্য চাষ করা শুরু হয়েছে। এসব এ দেশেও শুরু হয়েছে। প্রাকৃতিক মাছের সাথে সাথে চাষের মাছও পাওয়া যাচ্ছে খোলা পানিতে। এতে লাভ হচ্ছে বেশি। তাই এদিকে মানুষকে উদ্বুদ্ধ করা দরকার। পাশাপাশি নদী, খাল, বিল,হাওড় ও উপকূলকে দূষণমুক্ত করা প্রয়োজন। সম্প্রতি বাসা-বাড়িতে চৌবাচ্চা করে মাছ চাষ হচ্ছে। বিষয়টি খুবই কল্যাণকর। তাই এ ব্যাপারেও মানুষকে উদ্বুদ্ধ করা দরকার। ওদিকে, মাছের বর্জ্যের ব্যাপক চাহিদা রয়েছে বিভিন্ন দেশে। সামান্য কিছু রফতানি হচ্ছে আমাদের দেশ থেকে। এই অবস্থায় দেশের প্রায় অর্ধ কোটি টন মাছের বর্জ্য সংগ্রহ ও সংরক্ষণ করে রফতানি করতে পারলে বিপুল অর্থ আয় ছাড়াও অনেক প্রান্তিক লোকের কর্মসংস্থান হবে। মাছের উৎপাদন বৃদ্ধি করতে মৎস্য আইনগুলো পূর্ণভাবে বাস্তবায়ন করার কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করা প্রয়োজন। দেশে মাছের ভরা মওসুমে ব্যাপক মাছ ধরা পড়ে। কিন্তু সংরক্ষণের অভাবে অনেক মাছ নষ্ট হয়ে যায়। আবার মাছের অফ সিজনে মাছের আকাল দেখা দেয়। তাতে ক্ষতিগ্রস্ত হয় ভোক্তারা। অথচ মাছ সংরক্ষণ করার মতো প্রয়োজনীয় কোল্ড স্টোরেজ প্রতিষ্ঠা করতে পারলে এসব সমস্যা দূর হয়ে যাবে। একই সঙ্গে মাছ প্রক্রিয়াজাতকরণ কেন্দ্রও বাড়ানো দরকার। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য যে, করোনা মহামারীর কারণে সারা বিশ্বের ন্যায় এ দেশেও ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে প্রায় সব খাতেই। কিন্তু রফতানি কিছু কমে যাওয়া ছাড়া করোনার প্রভাব মৎস্য খাতে পড়েনি। ভবিষ্যতে পড়ার সম্ভাবনাও নেই। তাই মৎস্য খাতের উন্নতির দিকে সর্বাধিক গুরুত্ব দেওয়া আবশ্যক। এ খাতের উন্নতি যত হবে, গ্রামীণ অর্থনীতি তত মজবুত ও টেকসই হবে।
লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

আরও পড়ুন