পটুয়াখালীর যুবক ক্বারী সাইয়্যেদ মুসতানজিদ বিল্লাহ রব্বানীর কোরআন তেলাওয়াতে মুগ্ধ যুক্তরাষ্ট্রবাসী
ইসলামি সভ্যতা ও সংস্কৃতি বিকাশে বাংলাদেশের অবদান অনস্বীকার্য। এদেশে ইসলামি সংস্কৃতি চর্চার ইতিহাস অনেক প্রাচীন।
দেশের সবগুলো পত্রিকায় গতকাল গুরুত্বহীনভাবে একটি খবর ছাপা হয়েছে। সংসদের ৫টি আসনের উপনির্বাচনে আওয়ামী লীগের মনোনয়নপ্রত্যাশী ১৪০ জন নেতা ফরম সংগ্রহ করেছেন। প্রতিটি আসনে নৌকা প্রতীক নিয়ে গড়ে ২৮ জন প্রার্থী হতে চাচ্ছেন। অসংখ্য খবরের ভিড়ে মিডিয়াগুলোতে এ খবর তেমন গুরুত্ব পায়নি। কিন্তু এই ছোট্ট খবর প্রমাণ দেয় ক্ষমতাসীন দলটির নেতাকর্মীদের মধ্যে জনপ্রতিনিধি হওয়ার বাসনা কত প্রবল। শুধু আওয়ামী লীগ নয়, বিএনপির চিত্র অভিন্ন। মনোনয়ন বিক্রি শুরুর আগেই বিএনপির অসংখ্য নেতা ফরম ক্রয়ের জন্য মুখিয়ে রয়েছেন। যে দলে একশ সংসদীয় আসনে প্রার্থী দেয়ার অবস্থা নেই, সেই জাতীয় পার্টির নেতাদের মধ্যেও এমপি, মন্ত্রীসহ জনপ্রতিনিধি হওয়ার ঝোক প্রবল থেকে প্রবলতর হয়ে উঠেছে। যে কোনো নির্বাচন এলেই দেশের রাজনৈতিক দলগুলোর নেতাদের মধ্যে মনোনয়ন পেতে দৌড়ঝাঁপ শুরু হয়ে যায়। ঝাঁকে ঝাঁকে নেতা টাকা খরচ করে মনোনয়ন কেনেন। সবাই জনপ্রতিনিধি হতে চান। এমপি, মন্ত্রী, মেয়র, চেয়ারম্যান, কমিশনার হয়ে ‘ভাগ্য বদল’ করতে চান। কিন্তু এসব নেতার কতজন দলের জন্য নিবেদিতপ্রাণ? জনসেবা দূরের কথা; এই নেতাদের কতজনকে দলের দুর্দিনে সাংগঠনিক তৎপরতায় দেখা গেছে?
জানতে চাইলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক রাষ্ট্রবিজ্ঞানী অধ্যাপক ড. নুরুল আমিন ব্যাপারী ইনকিলাবকে বলেন, জনপ্রতিনিধি হলে পারলে দ্রুত নিজের ভাগ্যের বদল ঘটে। প্রভাব-প্রতিপত্তি ছাড়াও বৈধ-অবৈধ পথে প্রচুর অর্থের মালিক হওয়া যায়। উন্নত জীবন যাপন করা যায়। সে জন্যই সবার মধ্যে ঝোক জনপ্রতিনিধি হওয়া। অবস্থা দাঁড়িয়েছে রাজনৈতিক দলগুলোতে কর্মীর চেয়ে নেতা বেশি। আর আওয়ামী লীগের বিষয়টি হলো নমিনেশন পেলেই জনপ্রতিনিধি নিশ্চিত এটার কারণেও মনোনয়নপত্র বেশি বিক্রি হয়ে থাকে। আর কিছু ব্যবসায়ীদের মধ্যে বিশ্বাস জন্মেছে টাকা খবর করলেই রাজনীতি না করেও জনপ্রতিনিধি হয়ে সামাজিক মর্যাদা বৃদ্ধি করা যায়।
সুজনের সম্পাদক ড. বদিউল আলম মজুমদার ইনকিলাবকে বলেন, চলছে এখন লুটপাট তন্ত্র। জনপ্রতিনিধিদের নানা বৈধ-অবৈধ ফায়দা মেলে। সেই ফায়দা লোটার চেইনে যুক্ত হওয়া যায় জনপ্রতিনিধি হলে। সে জন্যই রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কবিতার মতো ‘তোরা যে যা বলিস ভাই/ আমার এমপি (সোনার হরিণ) হওয়া চাই’। বর্তমানে আওয়ামী লীগের নমিনেশন পেলেই নির্বাচিত হওয়া নিশ্চিত। সে কারণে দলটি রনেতাদের পাশাপাশি ব্যবসায়ীদের মধ্যে এমপি হওয়ার প্রতিযোগিতা চলছে।
রাজনীতি হচ্ছে জনসেবার সর্বৎকৃষ্ট মাধ্যম। মানুষের সেবা করাই রাজনীতিকদের কাজ-কারবার। রাষ্ট্রবিজ্ঞানের ধারণা হলো- জনসেবার মানসিকতা নিয়ে রাজনীতির মধ্যে থেকে জাতীয় সংসদ, জেলা পরিষদ, উপজেলা পরিষদ, সিটি কর্পোরেশন, পৌরসভা, ইউনিয়ন পরিষদে জনপ্রতিনিধি নির্বাচিত হয়ে মানুষের সেবা করার কথা। কিন্তু রাজনীতির মাধ্যমে ‘জনগণের ভাগ্য বদল’ এর চেয়ে জনপ্রতিনিধি হয়ে ‘নিজের ভাগ্য বদল’ এর প্রতি ঝোক বেড়ে গেছে। ইদানীং রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে মনোনয়ন কারণে ব্যবসায়ীদের মধ্যেও জনপ্রতিনিধি হওয়ার প্রবণতা বেড়ে গেছে। ৫টি সংসদীয় আসনের উপনির্বাচনে আওয়ামী লীগের ১৪০ জন মনোনয়ন প্রত্যাশীর মধ্যে দেখা যায় ঢাকা-১৮ আসন ৫৬ জন ও ঢাকা-৫ আসন ২০ জন, নওগাঁ-৬ আসন ৩৪ জন, পাবনা-৪ আসন ২৮ জন, সিরাজগঞ্জ-১ আসনে ৩ জন ফরম জমা দেন। বিএনপির মনোনয়নপত্র বিক্রি শুরু না হলেও সম্ভাব্য প্রার্থীদের ঘোরাঘুরি শুরু হয়ে গেছে।
ক্যালেন্ডারের পাতা উল্টালে দেখা যায় একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে তিনশ’ আসনের মধ্যে দেড় শতাধিক আসনে প্রার্থী চূড়ান্ত থাকার পরও আওয়ামী লীগের মনোনয়নপ্রত্যাশীর সংখ্যা ছিল ৪০২৩ জন। প্রতি আসনে ১৩ জনের বেশি। বিএনপির মনোনয়ন সংগ্রহ করেন ৪৫৮০। প্রতি আসনে প্রার্থীর সংখ্যা ১৫ জন। ক্ষমতাসীন দলের বি-টীম খ্যাত জাতীয় পার্টিরও মনোনয়ন বিক্রি হয় ২৮৬৫টি। প্রতি আসনে মনোনয়নপ্রত্যাশী ১০ জন। এর বাইরে ইসলামী ঐক্যজোট, ইসলামী আন্দোলন, সিপিবি, গণফোরাম, জাসদ, বাদস, ওয়ার্কার্স পার্টি, সাম্যবাদী দল, কমিউনিস্ট কেন্দ্রসহ ডান-বাম রাজনৈতিক দলগুলোর ছিল কয়েকশ’ প্রার্থী। এই বিপুল সংখ্যা প্রার্থী যদি নিজ নিজ নির্বাচনী এলাকায় জনগণের প্রতি সহায়তার হাত বাড়িয়ে দিতেন তাহলে বন্যার্ত মানুষকে এতো দুর্দশায় পড়তে হতো না।
স্থানীয় সরকার নির্বাচনগুলোতে দলীয় প্রতীক ব্যবহার হওয়ায় সেখানেও জনপ্রতিনিধি হওয়ার ঝোক বেড়ে গেছে। দেশে ৪৯২টি উপজেলা পরিষদ, ৪৫৭১টি ইউনিয়ন পরিষদ, ১২টি সিটি কর্পোরেশন, ৩৩০টি পৌরসভায় বর্তমানে জনপ্রতিনিধির সংখ্যা প্রায় ৭০ হাজার। এই সব নির্বাচনে কয়েক লাখ প্রার্থী প্রতিদ্ব›িদ্বতা করেছেন।
জাতীয় সংসদ, সিটি কর্পোরেশন, পৌরসভা, উপজেলা, ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচন এলেই প্রার্থী হওয়ার যে প্রতিযোগিতা শুরু হয়; সেইভাবে কিন্তু জনগণের সেবায় জনপ্রতিনিধিদের নামতে দেখা যায় না। এমনকি নিজ দলের সাংগঠনিক তৎপরতায় তাদের দেখা যায় না। রাজনৈতিক দলগুলোতে এখন কর্মীর চেয়ে নেতা বেশি হয়ে গেছে। দলগুলোর অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠনসহ বিভিন্ন কিসিমের কমিটিতে উপনেতা, পাতিনেতা, সহযোগী নেতা নানান প্রজাতির নেতা রয়েছেন। করোনা কেলেঙ্কারির খলনায়ক রিজেন্ট হাসপাতালের মালিক প্রতারক সাহেদ করিম ছিল আওয়ামী লীগের আন্তর্জাতিক বিষয়ক উপ-কমিটির সদস্য। তিনি টিভি টকশোতে হিরো হয়েছিলেন। অথচ ওই কমিটির চেয়ারম্যান মোহাম্মদ জমির এবং দলটির আন্তর্জাতিক বিষয়ক সম্পাদক শাম্মী আহমেদ তাকে চিনতেন না। হালে টিভির টকশো বেড়ে যাওয়ায় অনেকেই পকেটের টাকা খরচ করে বিভিন্ন টিভি টকশোতে অংশ নিয়ে রাতারাতি পরিচিতি পাচ্ছেন। কর্মী না হয়েও দলের নেতা হয়ে যাচ্ছেন। ভোট এলেই তারা নমিনেশন ফরম ক্রয় করে আলোচনায় আসছেন।
দেশে কার্যত রাজনীতি নেই। বৈশ্বিক মহামারি করোনাভাইরাসে সারাবিশ্ব বিপর্যস্ত। সংক্রমণ ঠেকাতে সবকিছুই বন্ধ ছিল দীর্ঘদিন। এ সময় কর্মজীবী মানুষের কাজ না থাকায় নিদারুণ কষ্টে পড়তে হয়েছে। সরকার থেকে ত্রাণ বিতরণ, প্রধানমন্ত্রীর পক্ষ থেকে ৫০ লাখ পরিবারকে মোবাইল ব্যাংকিং এর মাধ্যমে আর্থিক প্রণোদনা দেয়া হয়। জেলা-উপজেলা পর্যায়ে ত্রাণ বিতরণের দায়িত্ব জনপ্রতিনিধিদের দেয়া হলেও প্রায় শতাধিক জনপ্রতিনিধিকে ত্রাণ ‘চুরি’ অপরাধে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়। বাধ্য হয়েই প্রধানমন্ত্রী ৬৪ জেলায় সচিবদের নেতৃত্বে ত্রাণ কমিটি গঠন করে ত্রাণ বিতরণ করেন। এ সময় অনেক এমপি, স্থানীয় জনপ্রতিনিধি এবং আওয়ামী লীগ, বিএনপি, জাতীয় পার্টির নেতাদের দেখা গেছে, করোনা থেকে নিজেদের নিরাপদ নিশ্চিত করতে নিজেরাই কোয়ারেন্টিন, আইসোলেশনে গেছেন। জনগণের কাছে গেলে করোনায় আক্রান্ত হতে পারেন, সে ভয়ে নিজেরা নিরাপদ থেকেছেন। এবারের বন্যা গত কয়েক বছরের মধ্যে সবচেয়ে দীর্ঘস্থায়ী। ’৮৮ সাল ও ’৯৮ সালের বন্যার চেয়েও এবারের বন্যায় মানুষকে বেশি দুর্ভোগ পোহাতে হয়েছে, হচ্ছে। অথচ বন্যাদুর্গত মানুষের পাশে কোনো দলের নেতাদের দেখা যাচ্ছে না। এক সময় নেতাদের মধ্যে দুর্গত মানুষের পাশে দাঁড়ানো এবং ত্রাণ বিতরণের প্রতিযোগিতা দেখা যেত। কিন্তু এখন নেতারা মানুষের পাশে দাঁড়ানোর আগ্রহ দেখান না। বরং এমপি, মেয়র, চেয়ারম্যান, কমিশনার হয়ে নিজেদের ভাগ্য পরিবর্তনের প্রতি বেশি উৎসাহী।
এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে নির্বাচন পর্যবেক্ষক ড. বদিউল আলম মজুমদার বলেন, এখন ভোটের জন্য জনগণের কাছে যাওয়ার দরকার পড়ে না। বিশেষ বাহিনী আর নির্বাচন কমিশন হাতে থাকলে নির্বাচিত হওয়া যায়। সে কারণে নেতারা আর দুর্গতদের পাশে যান না। আর টাকা হলেই সব হয় বুঝতে পেরে একশ্রেণির ব্যবসায়ীও নির্বাচনে বিভিন্ন দলের মনোনয়ন প্রতিযোগিতায় নেমে পড়েন। রাষ্ট্রবিজ্ঞানী অধ্যাপক নুরুল আমিন ব্যাপারী বলেন, নির্বাচনে জনগণের ভোটের প্রয়োজন না হওয়ায় নেতাদের মধ্যে জনসেবার মানসিকতা হ্রাস পাচ্ছে। আওয়ামী লীগ, বিএনপির দুই দলের নেতাদের মানসিকতা অভিন্ন। কেউ এখনই এমপি হতে চান, কেউ সামনে এমপি হওয়ার জন্য রাস্তা পরিষ্কার রাখতে চান। বিগত দিনে বন্যা, জলোচ্ছ্বাস, ঘূর্ণিঝড়, সিডর, আইলায় বিপন্ন মানুষের পাশে নেতাদের দেখা গেছে। এবার আম্পানে দুর্গতদের পাশে কোনো দলের নেতাকে দেখা যায়নি। দীর্ঘস্থায়ী বন্যায় মানুষের পাশে দাঁড়াচ্ছেন না নেতারা। আর ভোটে প্রার্থী হওয়ার বিষয়টি কার্যক ‘বাণিজ্যিকীকরণে’ চলে গেছে।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।