পবিত্র লাইলাতুল বরাত
আজ দিবাগত রাত পবিত্র লাইলাতুল বরাত। পরম করুণাময় আল্লাহতায়ালা তার বান্দাদের গুনাহ মাফ, বিপদমুক্তি ও
ভারতের পররাষ্ট্র সচিব হর্ষ বর্ধন শ্রিংলা গত ১৮ অগাস্ট মঙ্গলবার দেড় দিনের অনির্ধারিত ঝটিকা সফরে ঢাকায় কেন এসেছিলেন সেটা এই সপ্তাহেও ‘সুনিশ্চিতভাবে’ জানা সম্ভব হয়নি। পাঠক, লক্ষ করবেন, আমি কিন্তু একটি শব্দ ব্যবহার করেছি। সেটি হলো ‘সুনিশ্চিতভাবে’। তিনি কেন এসেছিলেন সেটা নিয়ে অনেক ওয়াইল্ড গেজ হচ্ছে। বাংলাদেশের প্রস্তাবিত তিস্তা প্রজেক্টে গণচীন এক বিলিয়ন ডলার অর্থায়ন করতে চেয়েছে এবং চীনের ঠিকাদার এসে কাজটি করে দিতে চেয়েছে। আর তাতেই নাকি ভারতের টনক নড়েছে, এমন কারণও দেখানো হচ্ছে মি. শ্রিংলার ঝটিকা সফরের পেছনে। আরও বলা হচ্ছে যে, করোনা ভ্যাকসিনের তৃতীয় ও ফাইনাল ট্রায়াল চীন বাংলাদেশে করার প্রস্তাব দিয়েছিলো এবং বাংলাদেশের তাতে মৌন সম্মতি ছিলো। তবে আনুষ্ঠানিকভাবে বাংলাদেশ সেটি এখনও জানায়নি। বাংলাদেশের কিছু কিছু মিডিয়ার মতে, এটি নাকি ছিলো ভারতের জন্য ‘ওয়েক আপ’ কল। এসব কারণ সত্য হতেও পারে, আবার নাও হতে পারে। আমরা সে ব্যাপারে কোনো মন্তব্য করতে যাচ্ছি না। তবে আজকের লেখায় তিনটি প্রাসঙ্গিক বিষয়ের উল্লেখ করবো। এগুলো মূল কারণ খুঁজতে সহায়ক হতেও পারে। বিষয় গুলো হচ্ছে, মি. শ্রিংলার সফরের বিষয়ে ভারতীয় পররাষ্ট্র দফতরের মুখপাত্র অনুরাগ শ্রীবাস্তবের বক্তব্য। দ্বিতীয়টি হলো, বিবিসি বাংলার বিশ্লেষণ এবং তৃতীয়টি হলো, মানবজমিনের একটি পোস্টমর্টেমধর্মী নিবন্ধ। প্রথমে ভারতীয় পররাষ্ট্র দফতরের মুখপাত্র মি. অনুরাগ শ্রীবাস্তবের ব্রিফিং।
গত ২০ অগাস্ট বৃহস্পতিবার নয়া দিল্লীর ‘হিন্দুস্তান টাইম’সের শিশির গুপ্ত লিখেছেন, পররাষ্ট্র সচিব হর্ষ বর্ধন শ্রিংলার সাথে বৈঠকে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা অবকাঠামোগত প্রকল্পসমূহকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার ওপর জোর দিয়েছেন। দুই দেশের কানেকটিভিটি সম্পর্কিত ইনফ্রাস্ট্রাকচার প্রজেক্টসমূহও এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার ওপর তিনি বিশেষ গুরুত্ব আরোপ করেছেন। খবরে বলা হয়, বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সফররত ভারতীয় পররাষ্ট্র সচিব হর্ষ বর্ধন শ্রিংলাকে বলেছেন যে, ভারতের স্বার্থের পরিপন্থী কোনো কাজ বাংলাদেশ করবে না এবং ভারতবিরোধী কোনো সন্ত্রাসী কর্মকান্ডকে প্রশ্রয় দেবে না। কোনো বিদ্রোহীকে বাংলাদেশের ভূখন্ড ব্যবহার করতে দেবে না। নাম প্রকাশ না করার শর্তে তথ্যাভিজ্ঞ মহল একথা জানান। ঢাকা ও নয়া দিল্লীতে কর্মরত কূটনীতিকরা বলেন, প্রধানমন্ত্রী সময়মত অবকাঠামো ও কানেকটিভিটি সম্পর্কিত প্রকল্পসমূহ শেষ করার ওপর গুরুত্ব আরোপ করেন। ভারতের স্বাধীনতা দিবস উপলক্ষে প্রদত্ত ভাষণে প্রধানমন্ত্রী মোদি প্রতিবেশীদের সাথে সম্পর্ক জোরদার করার ওপর বিশেষ জোর দেন। শিশির গুপ্ত পরিবেশিত ঐ রিপোর্টে আরও বলা হয় যে, পররাষ্ট্র সচিব শ্রিংলা ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে বাংলাদেশের সেনা প্রধান, আওয়ামী লীগের জেনারেল সেক্রেটারী এবং বাংলাদেশ সরকারের সিনিয়র মন্ত্রীদের সাথেও কথা বলেন।
গত ২১ অগাস্ট দৈনিক ‘প্রথম আলো’র প্রথম পৃষ্ঠায় প্রকাশিত সংবাদের শিরোনাম, ‘শ্রিংলার ঢাকা সফরে তিস্তা প্রসঙ্গ ওঠেনি।’ খবরে বলা হয়েছে, ‘ব্রিফিংয়ে এই সফর নিয়ে একাধিক প্রশ্ন ওঠে।’ ব্রিফিংটি করেন ভারতীয় পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র অনুরাগ শ্রীবাস্তব। আর প্রথমআলোতে রিপোর্ট করেন পত্রিকাটির দিল্লী প্রতিনিধি। প্রথম আলোর রিপোর্ট মোতাবেক অনুরাগ শ্রীবাস্তব বলেন, ‘প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সাথে আলোচনার সময় বাংলাদেশর পক্ষ থেকে তিস্তা প্রসঙ্গ তোলা হয়নি। ভারতের জাতীয় নাগরিক পঞ্জী (এনআরসি) এবং নাগরিকত্ব সংশোধন আইন নিয়েও কোনো প্রশ্ন তোলা হয়নি।’ ভারতীয় মুখপাত্র বলেন, ‘কোভিড প্রতিষেধক উদ্ভাবন এবং তা বণ্টন পরিকল্পনা শেখ হাসিনাকে অবহিত করেন ভারতীয় পররাষ্ট্র সচিব। ঠিক হয়েছে, রামপাল বিদ্যুৎ কেন্দ্র, মৈত্রী পাইপ লাইন, আখাউড়া-আগরতলা, চিলহাটি-হলদিবাড়ি এবং খুলনা-মংলা রেল লাইনের কাজ দ্রুত শেষ করতে হবে।’
দুই্
লক্ষ করার বিষয় হলো এই যে, ভারতের তরফ থেকে যে বক্তব্যগুলো দেওয়া হয়েছে সেগুলো সব ভারতের স্বার্থ সংশ্লিষ্ট। এগুলোতে বাংলাদেশের স্বার্থ সংশ্লিষ্ট কোনো বিষয় নাই। এগুলো হলো চিত্রের একটি পিঠ। অর্থাৎ ভারতীয় পিঠ। চিত্রের আরেকটি পিঠ রয়েছে। সেই দিকটা দেখা যাক।
সাউথ এশিয়ান মনিটর ডট কমে গত ২১ অগাস্ট মানবজমিনের প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরীর একটি নিবন্ধ প্রকাশিত হয়েছে। নিবন্ধটির শিরোনাম, Hasina faces her toughest challenge so far. ধারণা করেছিলাম যে, এই লেখাটি মানবজমিনেও পাবো। কিন্তু ২৩ অগাস্টের মানবজমিনে লেখাটি পেলাম না। যাই হোক, সুদীর্ঘ এই রচনাটি শুরু হয়েছে এভাবে, ‘ভারতীয় পররাষ্ট্র সচিবের বাংলাদেশ সফরকে ঘিরে প্রচুর জল্পনা-কল্পনার সৃষ্টি হয়েছে। প্রশ্ন উঠেছে, এমন হাই প্রোফাইল ভিজিটকে এমন কম গুরুত্ব দেওয়া হলো কেন? এই গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিকে (ডিগনিটারী) রিসিভ করতে বাংলাদেশের কোনো অফিসিয়াল বিমান বন্দরে গেলো না কেন? প্রধানমন্ত্রীর সাথে তার বৈঠকের সময় বার বার পরিবর্তন করা হলো কেন?’ এসব প্রশ্ন তোলা হয়েছে ঐ নিবন্ধে।
নিবন্ধে আরও বলা হয়, এই বৈঠক সম্পর্কে প্রধানমন্ত্রীর অফিস থেকে কোনো বিবৃতি ইস্যু করা হয়নি। শ্রিংলা ও শেখ হাসিনার বৈঠকের কোনো আালোকচিত্রও রিলিজ করা হয়নি। টেলিভিশনেও কোনো নিউজ কভারেজ দেওয়া হয়নি। সরকারি সূত্রে কোনো প্রেস রিলিজও দেওয়া হয়নি। গত মার্চ মাসে শ্রিংলা যখন ঢাকা সফর করেন তখন ছিল বিপুল উৎসাহ উদ্দীপনা, বলেছেন ঐ সম্পাদক। কিন্তু এবারের চিত্র তার সম্পূর্ণ বিপরীত। গবেষণা চলছে, সিলেটে তিনদিন সময় কাটানোর জন্য এই বিশেষ সময়টিকেই বা বেছে নিলেন কেন বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী আব্দুল মোমেন? কূটনৈতিক সূত্র উল্লেখ করে ঐ নিবন্ধে বলা হয়েছে যে, আগে থেকে ভারতীয় সচিবের সাথে কোনো কর্মসূচি নির্ধারণ করা ছিলো না। তাই পররাষ্ট্রমন্ত্রী মোমেন সিলেট যান। ঐ সাময়িকীতে বলা হয়েছে যে, প্রধানমন্ত্রী ও ভারতীয় পররাষ্ট্র সচিবের মধ্যে বৈঠকে ঠিক কোন কোন বিষয়ে আলোচনা হয়েছে সেটি জানা যায়নি।
তবে বরফ যে গলেনি সেটি বুঝতে কোনো অসুবিধা হয় না। তথ্যাভিজ্ঞ কূটনৈতিক মহলের বরাত দিয়ে মতিউর রহমান চৌধুরী বলেছেন যে, বৈঠকটি দুই দেশের মধ্যে সন্দেহ ও অবিশ্বাস সৃষ্টিতে সাহায্য করেছে। আর সেটি সৃষ্টি হয়েছে চীনকে ঘিরে। কারণ ভারত দক্ষিণ এশিয়ায় চীনের ক্রমবর্ধমান উপস্থিতি সহ্য করতে পারে না। যেভাবে চীন বাংলাদেশে তার প্রভাব বৃদ্ধি করছে সেটাতেও ভারত উদ্বিগ্ন। শুধুমাত্র অর্থনৈতিক ক্ষেত্রেই নয়, রাজনৈতিক ক্ষেত্রেও চীন তার উপস্থিতি জোরদার করছে বলে ঐ নিবন্ধে উল্লেখ করা হয়। তার মতে, বাংলাদেশের নির্বাচনে চীনের কোনো ভূমিকা থাকুক, সেটি ভারত চায়নি। কিন্তু ঠিক তার বিপরীতটাই ঘটেছে।
দক্ষিণ এশিয়ায় চীন তার আঞ্চলিক নীতি পরিবর্তন করেছে। তারা বাণিজ্যের সাথে রাজনীতিও যুক্ত করেছে। ফলে এই অঞ্চলের রাজনৈতিক সমীকরণ বদলে যাচ্ছে। দক্ষিণ এশিয়ায় ভারতের যে একচেটিয়া প্রভাব ছিলো, দৃশ্যপটে চীন আসার ফলে সেটি কমে যাচ্ছে। এখন চীন তার প্রভাব খাটাচ্ছে। নেপালের ওপর ভারতের কর্তৃত্ব খর্ব হয়েছে। শ্রীলঙ্কায় ভারতের পছন্দসই কোনো সরকার নাই।
দক্ষিণ এশিয়াতে একমাত্র ব্যতিক্রম ছিলো বাংলাদেশ। বিগত ১১ বছরে বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্ক সর্বোচ্চ সীমায় পৌঁছেছে। এখন চীন বাংলাদেশেও তার প্রভাববলয় বিস্তার করা শুরু করেছে। চীন যদি এই প্রভাববলয় বৃদ্ধি করতে পারে তাহলে দক্ষিণ এশিয়ায় ভারত সম্পূর্ণ এক ঘরে হয়ে পড়বে। বাংলাদেশে ভারত তার সবগুলো আম এক ঝুড়িতে রেখেছিলো। এখন চারদিকে যে গুঞ্জন তার ফলে মনে হয় যে, ঝুড়ির কিছু কিছু আমের স্বাদ আর আগের মতো সুমিষ্ট নয়। লাদাখ সংঘর্ষের পর ভারত তাজ্জব হয়েছে। কাশ্মীর ও লাদাখকে কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল করার পর বাংলাদেশ ভারতীয় পদক্ষেপকে সমর্থন করেছিলো। কিন্তু লাদাখে চীনের হামলার পর বাংলাদেশ সম্পূর্ণ নিরপেক্ষতা অবলম্বন করে। এতে ভারত হতভম্ব হয়ে যায়।
তিন
আবার ফিরে আসছি হর্ষ বর্ধন শ্রিংলার ঝটিকা সফরে। এই সফরের কেন্দ্রবিন্দু ছিলো প্রধানমন্ত্রীর সাথে তাঁর বৈঠক। এই বৈঠকে শেখ হাসিনা এবং শ্রিংলা ছাড়া আর কে কে উপস্থিত ছিলেন সেটিও জানা যায়নি। এ ব্যাপারে একজন ক্যারিয়ার ডিপ্লোম্যাট গত ২৩ অগাস্ট রবিবার ইংরেজি দৈনিক ‘নিউ এজে’ একটি কলাম লিখেছেন। শিরোনাম, Indian foreign secretary’s hasty visit misfires. অর্থাৎ ‘ভারতীয় পররাষ্ট্র সচিবের তড়িঘড়ি সফর বিফলে গেলো।’ লেখক সিরাজুল ইসলাম একজন অবসরপ্রাপ্ত রাষ্ট্রদূত। তিনি লিখেছেন, তিনি ব্যক্তিগতভাবে চেষ্টা করেছেন জানতে যে, ঐ বৈঠকে ভারতীয় রাষ্ট্রদূত রিভা গাঙ্গুলী উপস্থিত ছিলেন কিনা। কোনো কোনো পত্রিকায় প্রধানমন্ত্রী ও শ্রিংলার যে ছবি দেওয়া হয়েছে সেই ছবিতে দেখা যায় যে, দুজনের কারো মুখেই মাস্ক নাই। লেখক বলেছেন যে, বিগত মার্চ মাসে মি. শ্রিংলা ঢাকা এসেছিলেন। আলোচ্য ছবিটি মার্চ মাসে তোলা।
সিরাজুল ইসলাম ভারতীয় ইংরেজি দৈনিক, ‘দি হিন্দু’র উদ্ধৃতি দিয়ে বলেছেন যে, আগামী দুই বছরে বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্ক কী হবে তার রোড ম্যাপ নিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং ভারতীয় পররাষ্ট্র সচিব আলোচনা করেছেন। একজন ক্যারিয়ার ডিপ্লোম্যাট হিসাবে তিনি বলেন যে, দুটি দেশের সম্পর্ক আগামী দুই বছর কী হবে সেই ধরনের রোড ম্যাপ নিয়ে একজন আমলা একজন প্রধানমন্ত্রীর সাথে আলোচনা করতে পারেন না। এটা তাঁর এখতিয়ার বহির্ভূত। এই ধরনের আলোচনা দুটি দেশের রাজনৈতিক নেতৃত্বের মধ্যে হয়।
গত ২২ অগাস্ট বিবিসির বাংলার অনুষ্ঠানে বলা হয় যে, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সাথে শ্রিংলার বৈঠক নিয়ে প্রধানমন্ত্রীর অফিস (পিএমও) অথবা পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে কোনো বক্তব্য না দেওয়ায় বিভ্রান্তির সৃষ্টি হয়েছে। বিবিসির মতে, ভ্যাকসিন কূটনীতির আড়ালে কী ছিলো সেটা নিয়ে ধোঁয়াশা থেকেই যাবে।
[email protected]
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।