Inqilab Logo

মঙ্গলবার, ৩০ এপ্রিল ২০২৪, ১৭ বৈশাখ ১৪৩১, ২০ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

সড়কে মৃৃত্যুর মিছিল দীর্ঘ হচ্ছে

আমজাদ হোসেন | প্রকাশের সময় : ২৫ আগস্ট, ২০২০, ১২:০১ এএম

ময়মনসিংহের ফুলপুরে সড়ক দুর্ঘটনায় শিশুসহ একই পরিবারের আটজন নিহত হয়েছে। নিহতদের মধ্যে সবচেয়ে কম বয়সী-বুলবুলি। কী নিষ্পাপ শিশু! আদরের বুলবুলিকে বুকে জড়িয়ে ধরে বারবার মূর্ছা যাচ্ছেন সন্তানহারা বাবা। পৃথিবীতে পিতার কাধে সন্তানের লাশের চেয়ে ভারি আর কিছু নেই। বুলবুলিকে চিৎকার করে ডাকছেন বাবা। ঘুম থেকে জাগতে বলছেন। চোখের পাতা খুলতে বলছেন। বাবার আদরের মেয়েটি রাগ করতো, অভিমান করতো। সেই রাগ, অভিমান ভাঙ্গাতে বাবাকে এত বেগ পেতে হতো না। কাছে গিয়ে আদর করে ডাকলেই বাবার বুকে মাথাটা গুঁজে দিত। কিন্তু অভিমানি বুলবুলির নিষ্প্রাণ দেহ বাবার বুকফাটা আর্তনাদেও সাড়া দিতে অক্ষম। এবার বুলবুলির অভিমান বাবার উপর নয়, তার অভিমান এই দেশ, দেশের নীতিনির্ধারকদের উপর। প্রতিদিনই দেশের কোথাও না কোথাও এভাবে সড়ক দুর্ঘটনায় অকালে ঝরে যাচ্ছে অমূল্য প্রাণ। মুহূর্তের মধ্যে নিভে যাচ্ছে মানুষের জীবন প্রদীপ। সন্তানহারা পিতামাতার আকুতি, স্বজন হারা মানুষের আহাজারি সত্যি হৃদয় বিদারক ও মর্মান্তিক। একটি মৃত্যু একটি পরিবারের কাছে সারা জীবনের জন্য গভীর ক্ষতের কারণ হয়ে থাকে।

২০১৮ সালের ২৯ জুলাই পাল্লা দিয়ে বাস চালাতে গিয়ে জাবালে নূর পরিবহনের চালক বিমানবন্দর সড়কে নির্মমভাবে দুই শিক্ষার্থীকে হত্যা করে। বাসচাপায় শিক্ষার্থীদের এ হতাহতের খবর ছড়িয়ে পড়লে ওইদিনই রাস্তায় নামে রমিজ উদ্দিন কলেজসহ আশপাশের কয়েকটি স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীরা। রাজধানীসহ সারাদেশে ছড়িয়ে পড়ে এ আন্দোলনের ঢেউ। সারাদেশের রাস্তায় নামে লাখো শিক্ষার্থী। সেখান থেকে সূত্রপাত হয় নিরাপদ সড়ক আন্দোলনের। নিরাপদ সড়কের দাবিতে শিক্ষার্থীরা আন্দোলনে নামলে সারা দেশ অচল হয়ে পড়ে। রাস্তায় শৃঙ্খলা ফেরাতে শিক্ষার্থীরা নিজেরাই দায়িত্ব কাধে তুলে নেয়। গণপরিবহনসহ ব্যক্তিগত গাড়ির কাগজ চেক করাসহ সব ধরনের যানবাহনকে নিয়ম মেনে চলতে বাধ্য করে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীরা। তাদের এই আন্দোলন চোখ খুলে দিয়েছে বলে স্বীকার করে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ।

নিরাপদ সড়ক আন্দোলনের দুই বছর পেরিয়ে গেছে। ইতোমধ্যে সড়ক পরিবহন আইন-২০১৮ কার্যকর হয়েছে। একের পর এক ট্রাফিক সপ্তাহ, সড়ক দুর্ঘটনা নিয়ন্ত্রণে কমিটি গঠন এবং নিরাপদ সড়কের দাবিতে শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের পরেও ফেরানো যায়নি সড়কের শৃঙ্খলা। সড়কে লেন ব্যবস্থা, ব্যস্ত সময়ে সিটিং সার্ভিস না রাখা, চুক্তিতে বাস চালানো বন্ধ, ট্রাফিক সিগন্যাল মেনে চলা, হাইওয়েতে বিভিন্ন সতর্কতা সাইনবোর্ডসহ বেশকিছু উদ্যোগ নানা সময়ে নেওয়া হয়েছে। তারপরও সড়কের দুর্ঘটনা এখন মহামারি রূপ ধারণ করেছে।

সড়ক দুর্ঘটনা একটি গুরুতর জাতীয় সমস্যায় পরিণত হয়েছে। বাংলাদেশে সড়ক দুর্ঘটনার যে চিত্র তা সত্যি ভয়াবহ এবং দুঃখজনক। আমাদের দেশে কী কী কারণে এত বেশি সড়ক দুর্ঘটনা ঘটে, কী কী পদক্ষেপ নিলে দুর্ঘটনার হার কমিয়ে আনা সম্ভব- এসব বহুল আলোচিত বিষয়। এ নিয়ে অনেক গবেষণা হয়েছে। চালকদের প্রতিযোগিতামূলক মনোভাব, বেপরোয়া গতিতে গাড়ি চালানো, ওভারটেকিং, দৈনিক চুক্তিতে চালক, কন্ডাক্টর বা হেলপারের কাছে গাড়ি ভাড়া দেওয়া, অদক্ষ ও লাইসেন্সবিহীন চালক নিয়োগ, সড়কে চলাচলে পথচারীদের অসতর্কতা, মহাসড়কে উল্টোপথ গাড়ী চালানো, ত্রু টিপূর্ণ যানবাহন, দুর্বল ট্রাফিক ব্যবস্থাপনা, অনিয়ন্ত্রিত গতি, রাস্তা নির্মাণে ত্রু টি, রাস্তার স্বল্পতা ও অপ্রশস্ততা, রাস্তার মধ্যে প্রয়োজনীয় ডিভাইডার না থাকা, রাজনৈতিক সদিচ্ছার অভাব, আইনের যথাযথ প্রয়োগ না হওয়া প্রভৃতি দুর্ঘটনার জন্য সবচেয়ে বেশি দায়ী। সড়ক দুর্ঘটনার জন্য মোটাদাগে আরও কিছু কারণ বিদ্যমান, যেমন ট্রাফিক বিধি লঙ্ঘন করে অতিরিক্ত বোঝাই, বিরতি ছাড়া দীর্ঘ সময় ধরে গাড়ি চালানো, পথচারী ও ছোট গাড়ির চালক বিশেষ করে মোটরসাইকেল চালকদের মধ্যে সচেতনতার অভাব, দূরপাল্লার সড়ক ও জনবহুল এলাকায় ট্রাফিক আইন লঙ্ঘন এবং দেশের বিভিন্ন এলাকায় সড়কের বেহাল দশা, ওভারব্রিজের স্বল্পতা, সড়ক ও মহাসড়কে মোটরসাইকেল ও তিন চাকার যান বেড়ে যাওয়া, সড়কের উপর অবৈধ হাটবাজার ও স্থাপনা, ব্যস্ত সড়কে স্থানীয়ভাবে তৈরি ইঞ্জিনচালিত যান চলাচল প্রভৃতি। তাছাড়া যেখানে স্বাভাবিকভাবে একজন মানুষের কমপক্ষে ছয় ঘণ্টা বিশ্রাম দরকার। সেখানে একজন গাড়িচালক টানা সাত ঘণ্টা গাড়ি চালানোর পরও অতিরিক্ত অর্থ অর্জনের জন্য বিশ্রামের সময়েও তারা গাড়ি চালান। এতে একজন প্রাপ্তবয়স্ক মানুষের শরীরের বিশ্রামের চাহিদা পূর্ণ হয় না। তাই অবসাদগ্রস্ততা থেকেও মারাত্মক সড়ক দুর্ঘটনা ঘটে। সড়ক দুর্ঘটনায় সমস্ত দোষ চাপিয়ে দেওয়া হয় চালকের উপর। অথচ যারা অপরিকল্পিত ও ভাঙাচোরা রাস্তার জন্য দায়ী, যারা যানবাহনের ফিটনেস পরীক্ষার জন্য দায়িত্বপ্রাপ্ত, যারা মুনাফা বাড়াতে অতিরিক্ত যাত্রী নিয়ে বাড়তি সময় ধরে চালকদের গাড়ি চালাতে বাধ্য করে, সেসব মালিক-মহাজনেরা ধরা ছোঁয়ার বাইরে থাকে।

আন্তর্জাতিক অঙ্গনে নিরাপদ সড়কের গুরুত্ব অনুধাবন করে জাতিসংঘ ২০১১ থেকে ২০২০ সাল পর্যন্ত সময়কে ‘সড়ক নিরাপত্তা দশক’ হিসেবে ঘোষণা করেছে। সড়ক দুর্ঘটনা কমিয়ে আনার বিষয়টি টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রায় (এসডিজি) অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। ২০২০ সালের মধ্যে সড়ক দুর্ঘটনার সংখ্যা ও প্রাণহানি অর্ধেকে নামিয়ে আনার বিষয়ে সদস্য দেশগুলো একমতও হয়েছে। এরই মধ্যে বহু দেশে সড়ক নিরাপত্তায় দৃশ্যমান অগ্রগতি লক্ষ করা যাচ্ছে। কিন্তু বাংলাদেশে এ লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে কিছুটা তৎপরতা দৃশ্যমান হলেও তা যথেষ্ট নয়। সরকারের বিভিন্ন অঙ্গপ্রতিষ্ঠান একের পর এক উদ্যোগ নেওয়ার পাশাপাশি যদি বাস্তবায়ন কৌশল শক্তিশালী হতো তাহলে সড়কে দুর্ঘটনা নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হতো, সড়কে শৃঙ্খলাও ফিরতো। পথচারী চলাচল ও চালকদের মধ্যে শৃঙ্খলা আনাটাই এই সময়ের বড় চ্যালেঞ্জ। চালক ও পথচারীদের সচেতন করতে ক্যাম্পেইন অব্যাহত রাখতে হবে। লাইসেন্স প্রদানের পূর্বে চালকের দক্ষতা ও যোগ্যতা ভালভাবে যাচাই-বাছাই করতে হবে। লাইসেন্সবিহীন কেউ যেন গাড়ি চালাতে না পারে সেদিকে লক্ষ রাখাও আবশ্যক। একই সংস্থার মাঠ পর্যাযের কর্মকর্তার সঙ্গে ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার সমন্বয়ের করতে হবে। মাঠে ব্যবস্থাপনায় জড়িত যারা তাদের আরও প্রশিক্ষিত করতে হবে। জনগণকে সচেতন করে কাজগুলোর মধ্যে তাদের সম্পৃক্ত করতে হবে। সড়কে বা মহাসড়কে উল্টোপথে থ্রি হুইলার, মাইক্রোবাস, মোটরসাইকেল সহ যে কোনো চলাচল কঠোরভাবে বন্ধ করতে হবে। ফুটপাত হকারদের দখলমুক্ত করে পথচারী চলাচলের উপযোগী করে তোলার বিষয়গুলো মাথায় রেখে গোটা ট্রাফিক ব্যবস্থার আধুনিকায়ন ও উন্নয়ন ঘটানো অপরিহার্য। অনির্ধারিত স্থানে গাড়ি পার্কিং, ত্রুটিপূর্ণ যানবাহন, ভুয়া লাইসেন্সপ্রাপ্ত চালক ও বেপরোয়া গতিতে গাড়ি চালানো বন্ধ করা হলে সড়ক দুর্ঘটনা অনেক কমতে পারে। সড়ক নিরাপত্তা নিশ্চিতে সড়ক পরিবহন আইন প্রণীত হয়েছে। এতে দায়ীদের শাস্তি বাড়ানো হয়েছে। এটা নিঃসন্দেহে ইতিবাচক। শাস্তি বাড়ালেই হবে না, যথাযথ বিচারিক প্রক্রিয়ায় তা যেন কার্যকর করা হয়, তাও নিশ্চিত করতে হবে। সার্বক্ষণিক তদারকি এবং ব্যবস্থাপনাগত উন্নয়ন নিশ্চিত করতে হবে। সড়ক-মহাসড়কগুলোকে ডিজিটাল নজরদারির আওতায় নিয়ে আসা এক্ষেত্রে ফলপ্রসূ হতে পারে। চালক ও যানবাহনের লাইসেন্স থেকে শুরু করে সড়ক ও ট্রাফিক ব্যবস্থাপনায় বিরাজমান পদ্ধতিগত ত্রুটি-দুর্বলতাগুলো দূর করা গেলে সড়ক দুর্ঘটনার হার ক্রমে কমিয়ে আনা অসম্ভব নয়। সমন্বিত উদ্যোগ সঠিকভাবে বাস্তবায়ন করতে কিছু বিষয় জানতে হবে।

সড়ক নিরাপত্তা বিষয়ে কাজ করার অনেক ক্ষেত্র রয়েছে। যেমন ইঞ্জিনিয়ারিং, জনসচেতনতা, আইন প্রয়োগ ইত্যাদি। রাস্তাগুলো এমনভাবে তৈরি করতে হবে, যেন আইন ভঙ্গের সুযোগ না থাকে। তাহলে দুর্ঘটনার হার কিছুটা হলেও কমে যাবে। সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা দেশের সড়ক ব্যবস্থায় উল্লেখযোগ্যসংখ্যক ব্ল্যাক স্পট চিহ্নিত করেছেন, সেগুলো সংশোধন করতে হবে। বিআরটিএ ও পুলিশের কাজের মধ্যে সমন্বয় সাধন করা জরুরি, অন্যথায় সড়ক দুর্ঘটনা দিনের পর দিন আরও বাড়তে থাকবে, যা দেশ ও জাতির জন্যে ভয়াবহ পরিস্থিতি সৃষ্টি করতে পারে। দুর্ঘটনা রোধে সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন সচেতনতা ও আইন প্রয়োগ। এ ক্ষেত্রে আইন প্রয়োগে বেশি জোর দেওয়া প্রয়োজন। রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ পর্যায় থেকে সড়ক দুর্ঘটনা রোধে যথেষ্ট আন্তরিকতা দেখানো হয়েছে। বিভিন্ন সময়ে খোদ প্রধানমন্ত্রী সড়ক-মহাসড়কে দুর্ঘটনা রোধে কিছু নির্দেশনা দিয়েছেন। সড়ক দুর্ঘটনা রোধে এখন চাই পরিবহন মালিক-শ্রমিক, চালক, যাত্রীসাধারণ, সরকারি কর্তৃপক্ষ, ট্রাফিক পুলিশ ও সংশ্লিষ্ট সবার সম্মিলিত প্রচেষ্টা।
লেখক: ব্যাংকার ও কলামিস্ট



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: মৃৃত্যুর-মিছিল
আরও পড়ুন