Inqilab Logo

বুধবার ২০ নভেম্বর ২০২৪, ০৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ১৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

আমিরাত-ইসরাইল চুক্তিতে কার কী লাভ হলো?

সরদার সিরাজ | প্রকাশের সময় : ২৪ আগস্ট, ২০২০, ১২:০১ এএম

সংযুক্ত আরব আমিরাত ও ইসরাইলের মধ্যে শান্তি চুক্তি হয়েছে গত ১৩ আগস্ট। ইসরাইলকে স্বীকৃতি দেয়নি বেশিরভাগ মুসলিম দেশ। তাই এই শান্তি চুক্তিতে হতচকিত হয়ে পড়েছে মুসলিম দেশগুলো ও মুসলমানরা। কারণ, আমিরাত একটি মুসলিম রাষ্ট্র। বিশ্বের বেশিরভাগ মানুষও হতভম্ব হয়েছে আকস্মিক এই চুক্তির খবরে। অবশ্য, মধ্যপ্রাচ্যের কতিপয় দেশ ও ইসরাইলের মধ্যে গোপনে সখ্য চলছে বলে প্রায়ই মিডিয়ায় খবর প্রকাশিত হতে দেখা যায়। এতে বিশ্বাস ছিল না মুসলমানদের। তারা মনে করত, মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোর মধ্যে অনৈক্য সৃষ্টি করে তার ফায়দা লাভের অপকৌশল গ্রহণ করেছে আমেরিকা-ইসরাইল। কিন্তু আমিরাত ও ইসরাইলের মধ্যে কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপনের চুক্তি হওয়ার পর মনে হচ্ছে এটা ষড়যন্ত্র নয়, সত্য। গোপনে এই তৎপরতা চলছে বহুদিন থেকেই এবং এতে মধ্যপ্রাচ্যের আরও কিছু দেশ সংশ্লিষ্ট আছে, যা যে কোনো সময়ে প্রকাশ্য রূপ পাবে। ইতোমধ্যেই ট্রাম্পের জামাতা ও উপদেষ্টা কুশনার সে ইঙ্গিত দিয়েছেন। যা’হোক, আমিরাত ও ইসরাইলের মধ্যে শান্তি চুক্তি সংক্রান্ত এক যুক্ত বিবৃতিতে বলা হয়েছে, ‘মধ্যপ্রাচ্যের সবচেয়ে গতিশীল দুটি সমাজ এবং অগ্রসর দুটি অর্থনীতির মধ্যে এই সরাসরি সম্পর্কের সূচনা পুরো অঞ্চলকে বদলে দেবে। এর ফলে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি বাড়বে, প্রযুক্তিগত উদ্ভাবন ত্বরান্বিত হবে এবং মানুষে-মানুষে সম্পর্ক তৈরি হবে। একটি আরব রাষ্ট্রের সঙ্গে এই সম্পর্কের বিনিময়ে ইসরাইল পশ্চিম তীরের যেসব ফিলিস্তিনি এলাকা তার সীমানায় ঢোকানোর পরিকল্পনা করছিল, তা আপাতত স্থগিত রাখবে।’ অর্থাৎ এই চুক্তির ফলে আগামীতে ইসরাইল ও আমিরাতের প্রতিনিধিরা নিয়মিত মিলিত হবেন নানা বিষয়ে দ্বিপাক্ষিক চুক্তি করতে। এর মধ্যে বিনিয়োগ, পর্যটন, সরাসরি ফ্লাইট, নিরাপত্তা, টেলিযোগাযোগ, প্রযুক্তি, জ্বালানি, স্বাস্থ্য, সংস্কৃতি, পরিবেশ, দূতাবাস স্থাপন ইত্যাদি প্রাধান্য পাবে। এই সমঝোতার ক্ষেত্রে মধ্যস্থতা করেছেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প। তাই তিনিই প্রথম এক বিবৃতিতে এই ঘটনাটি জানিয়ে বলেছেন, ‘পুরো আলোচনাটি চলছিল বেশ গোপনে। এতটাই গোপনে যে, ইসরাইলের প্রতিরক্ষামন্ত্রী ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী পর্যন্ত এ বিষয়ে কিছুই জানতেন না।’ ইসরাইলি প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহু এবং আবুধাবির ক্রাউন জায়েদের মধ্যে সম্পাদিত এই চুক্তিকে এক ঐতিহাসিক মূহুর্ত বলে বর্ণনা করে ট্রাম্প সাংবাদিকদের বলেন, ‘বরফ যেহেতু গলেছে এখন আমি আশা করবো আরও অনেক আরব এবং মুসলিম দেশ আমিরাতকে অনুসরণ করবে।’ উপরন্তু তিনি এই সমঝোতাকে মার্কিন পররাষ্ট্রনীতির বিজয় বলে উল্লেখ করেছেন। প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের উক্ত ঘোষণার পরপরই ইসরাইলি প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহু এক টুইটে বলেন, ‘আজ এক ঐতিহাসিক দিন’। আর আমিরাতের পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী গারগাশ বলেন, ‘ইসরাইলকে স্বীকৃতি দেয়ার মাধ্যমে তার দেশ এক সাহসী পদক্ষেপ নিয়েছে। কারণ এর মাধ্যমে পশ্চিম তীরকে সংযুক্ত করার যে পরিকল্পনা নিয়ে ইসরাইল আগাচ্ছিল, সেই টাইম বোমা থামিয়ে দেয়া গেছে।’ অপরদিকে, ইসরাইলের প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহু গত ১৭ আগস্ট বলেছেন, ‘আমিরাতের সাথে সাম্প্রতিক চুক্তির অর্থ এই নয় যে তেল আবিব তার দখলকৃত পশ্চিম তীরের বিশাল অংশের নিয়ন্ত্রণ ত্যাগ করবে।’ তাই বিশেষজ্ঞদের অভিমত: এই চুক্তিতে আমিরাত অতিরিক্ত কিছুই পায়নি। কারণ, যেসব সুবিধা পাওয়ার কথা বলা হয়েছে, তা যে কোন মুসলিম দেশ থেকেও পেত। তেমনি ইসরাইলেরও তাই। তবে ইসরাইলের রাজনৈতিক লাভ হয়েছে। যেমন, একটি মুসলিম দেশকে হাতে পাওয়া, মধ্যপ্রাচ্যের মুসলিম দেশগুলোর মধ্যে অনৈক্য সৃষ্টি করা। উপরন্তু এই অনৈক্যকে কেন্দ্র করে দেশগুলোর মধ্যে সংঘাত বেঁধে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। আর সেটা হলে ইসরাইলের শক্তি আরও বেড়ে যাবে এবং আর পার্শ্ববর্তী মুসলিম দেশগুলোর শক্তি আরও দুর্বল হয়ে পড়বে। উপরন্তু আমেরিকার অস্ত্র ব্যবসা বাড়বে। এই চুক্তিতে ফিলিস্তিনিদের বিন্দুমাত্র লাভ হয়নি। কারণ, পশ্চিম তীর সংযুক্ত করার পরিকল্পনা ইসরাইল ত্যাগ করেনি। আপাতত স্থগিত করার কথা বলেছে। স্মরণীয় যে, মিশর ও জর্ডানের সাথে ইসরাইলের শান্তি চুক্তিতেও ফিলিস্তিনিদের বিন্দুমাত্র লাভ হয়নি। ইসরাইলের সাথে প্রথমে মিশরের চুক্তি হয় ১৯৭৯ সালে। এই চুক্তি করার পরিণামে মিশরের প্রেসিডেন্ট আনোয়ার সাদাতকে প্রাণ দিতে হয়েছে। দ্বিতীয় চুক্তি হয় জর্ডানের সঙ্গে, ১৯৯৪ সালে। তদ্রুপ আমিরাতের চুক্তির ফলে ফিলিস্তিনের বিন্দুমাত্র লাভ হয়নি। যার প্রমাণ এই চুক্তির পরপরই ইসরাইল ফিলিস্তিনে ব্যাপক হামলা অব্যাহত রেখেছে। উপরন্তু গাজার একমাত্র বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্র বন্ধ করে দিয়েছে। সর্বোপরি ফিলিস্তিনিদের স্বাধীনতার আন্দোলন দুর্বল হয়ে পড়ার আশঙ্কা আছে। প্রসঙ্গত উল্লেখ করা যেতে পারে, গত ১৫ আগস্ট কোভিড-১৯ ভ্যাকসিন নিয়ে গবেষণা ও উন্নয়নে আমিরাত ও ইসরাইলি কোম্পানির সঙ্গে বাণিজ্যিক চুক্তি হয়েছে। দু’দেশের মধ্যে টেলিফোনসেবাও চালু করা হয়েছে। মোসাদ প্রধান আমিরাত সফর করেছেন। খুব শিগগিরই হোয়াইট হাউজে আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে চুক্তিটি আনুষ্ঠানিকভাবে স্বাক্ষরিত হবে বলে জানা গেছে। আমিরাত এই শান্তি চুক্তিকে কোনোভাবেই ইরানকে মোকাবেলা করার জন্য নয় বলে জানিয়েছে এবং এই চুক্তির বিষয়ে তুরস্কের সমালোচনাকে প্রত্যাখ্যান করেছে।

যা’হোক, আমিরাত ও ইসরাইলের সম্পর্ক স্থাপনের চুক্তিতে ব্যাপক প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়েছে ফিলিস্তিনসহ সব মুসলিম দেশে। হামাস এ ঘটনাকে ‘আমাদের পিঠে ওরা ছুরি মেরেছে’ বলে অভিহিত করেছে। আর ফিলিস্তিনি প্রেসিডেন্ট আব্বাস এর নিন্দা জানিয়ে বলেছেন, ‘জেরুজালেম, আল-আকসা ও ফিলিস্তিনিদের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করা হয়েছে।’ উপরন্তু আমিরাত থেকে ফিলিস্তিনি দূতকে প্রত্যাহার করে নিয়েছেন তিনি। সাধারণ ফিলিস্তিনিরা আমিরাতের এই পদক্ষেপকে ‘বিশ্বাসঘাতকতা’ হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন। ইরানও খুব কঠোর ভাষায় এই সমঝোতার নিন্দা করেছে। ইসরাইলের সাথে কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপনের সিদ্ধান্তকে ‘বিপজ্জনক’ ও ‘বোকামি’ বলে বর্ণনা করে ইরানের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একজন মুখপাত্র বলেছেন, ‘ফিলিস্তিনদের সাথে বিশ্বাসঘাতকতার জন্য ইউএই কখনোই ক্ষমা পাবে না।’ খুবই কড়া হুঁশিয়ারি দিয়েছে তুরস্ক। দেশটি আমিরাতের সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করার হুমকি দিয়েছে। প্রেসিডেন্ট এরদোয়ান বলেছেন, ‘ফিলিস্তিনিদের বিরুদ্ধে এই পদক্ষেপ হজম করা যায় না।’ এর পর আরও মুসলিম দেশ এরূপ প্রতিক্রিয়া জানাবে তা নিশ্চিত। এ ঘটনায় সমগ্র মুসলিম জাহানে প্রচন্ড ক্ষোভ সৃষ্টি হয়েছে। লিবিয়ার ত্রিপোলিতে আমিরাতের দূতাবাসে হামলা হয়েছে। বহুসংখ্যক মানুষ এ হামলায় অংশ নিয়ে তাদের ক্ষোভ প্রকাশ করেছে। তারা আবুধাবির চুক্তিকে ‘কলঙ্ক’ বলে আখ্যায়িত করেছেন। পাকিস্তানেও চুক্তি বিরোধী ব্যাপক বিক্ষোভ হয়েছে। এরূপ অবস্থা আরও অনেক মুসলিম দেশে ঘটতে পারে বলে বিশেষজ্ঞারা আশঙ্কা করছেন। তবে এই সমঝোতার পক্ষেও কিছু দেশ রয়েছে। মিশরের প্রেসিডেন্ট সিসি এই চুক্তিকে স্বাগত জানিয়েছেন। জর্ডানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী সাফাদিও বলেছেন, ‘এই চুক্তির পর থমকে যাওয়া মধ্যপ্রাচ্য শান্তি আলোচনা নতুন করে শুরু হতে পারে।’ বাহরাইন ও ওমানও এই চুক্তিকে সমর্থন জানিয়েছে। আমিরাত-ইসরাইল চুক্তিটি কম-বেশি বিশ্বব্যাপীই আলোচিত হচ্ছে। বিষয়টি বিশ্ব মিডিয়ায় খুবই গুরুত্ব পেয়েছে। নিউইয়র্ক টাইমসের বিখ্যাত কলামিস্ট টমাস এল ফ্রিডম্যান একে ‘একটি ভূ-রাজনৈতিক ভূমিকম্প মাত্রই আঘাত হেনেছে মধ্যপ্রাচ্যে’ বলে বর্ণনা করেছেন গত ১৪ আগস্ট। কিন্তু একই দিনে প্রকাশিত ফিলিস্তিনের আল-হায়াত আল-জাদিদা পত্রিকার শিরোনাম ছিল: ‘ফিলিস্তিনি জনগণের অধিকারের ওপর ত্রিপক্ষীয় আগ্রাসন।’
আমিরাত ও ইসরাইলের স্বাভাবিক সম্পর্ক স্থাপনে তেমন কোনো লাভ হচ্ছে না মধ্যপ্রাচ্যের। বরং অঞ্চলটিতে নতুন করে দ্ব›দ্ব ও সংঘাত বেধে যাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। এ ক্ষেত্রে মালয়েশিয়ার সাবেক প্রধানমন্ত্রী মাহাথিরের মন্তব্য প্রণিধানযোগ্য। তিনি বলেছেন, ‘মুসলিম বিশ্বের এই বিভক্তি যুদ্ধের দিকে নিয়ে যেতে পারে। বলা বাহুল্য, মার্কিন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের মধ্যপ্রাচ্য শান্তি পরিকল্পনায়ও কোনো লাভ হয়নি মধ্যপ্রাচ্যের। ট্রাম্প জেরুজালেমকে ইসরাইলের রাজধানী করে গত ২৮ জানুয়ারি ‘ডিল অব দ্য সেঞ্চুরি’ ঘোষণা করেন। কিন্তু তার এ পরিকল্পনা দু’চারটি দেশ ছাড়া কেউই সমর্থন করেনি। এমনকি জাতিসংঘ, ইইউ, ওআইসি, আরব লীগও নয়। তারা সাথে সাথেই এই পরিকল্পনা প্রত্যাখ্যান করেছে। প্রত্যাখ্যান করেছে খোদ যুক্তরাষ্ট্রের শান্তিপ্রিয় মানুষও। কারণ, দীর্ঘদিন যাবত যুক্তরাষ্ট্রের নীতি হচ্ছে, ‘পূর্ব জেরুজালেমকে ফিলিস্তিনের রাজধানী করে দু-রাষ্ট্রের সমাধান’। কিন্তু ট্রাম্প সেই নীতি লঙ্ঘন করেছেন। ফলে তার পরিকল্পনার পালে হাওয়া লাগেনি। তেমনি ইসরাইলের প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহুর সম্প্রসারণনীতিরও একই অবস্থা হয়েছে। পশ্চিম তীর, গাজা ও জর্ডানের কিছু অংশ নিয়ে ইসরাইলকে সম্প্রসারণ করার এবং সেখানে ইহুদী বসতি স্থাপন করার ঘোষণা দিয়েছেন নেতানিয়াহু। কিন্তু কোন দেশই তাতে সমর্থন করেনি। জাতি সংঘ, ইইউ, ওআইসি, আরব লীগসহ সকলেই ১৯৬৭ সালের যুদ্ধের পূর্ববর্তী সীমান্ত বহাল রাখার দাবী জানিয়েছে। এই অবস্থায় আগামী ৩ নভেম্বর অনুষ্ঠেয় মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে বাইডেনের কাছে চরম বর্ণবাদী ট্রাম্প পরাজিত হতে চলেছেন বলে জনমত জরিপে প্রকাশ। সে মতে নির্বাচনে ট্রাম্প হেরে গেলে তার উক্ত পরিকল্পনাও ফানুশ হয়ে যাবে নিঃসন্দেহে। অপরদিকে ট্রাম্পের পরম বন্ধু এবং চরম উগ্রবাদী ও যুদ্ধবাজ নেতানিয়াহুরও অবস্থা তথৈবচ। দুর্নীতির অভিযোগে তার বিচার চলছে আদালতে। তাই দেশটির বিপুল সংখ্যক মানুষ সারাদেশে প্রতিদিন ব্যাপক বিক্ষোভ করছে তার পদত্যাগের দাবিতে। বিক্ষোভকারীরা তাকে ‘ক্রাইম মিনিস্টার’ আখ্যায়িত করে তার পদত্যাগের দাবি করছে। এই অবস্থায় নেতানিয়াহুর প্রধানমন্ত্রীত্বের অবসান ঘটতে পারে যেকোন সময়ে। কারণ, কোয়ালিশন সরকারের শরীক দল তার কলংকের বোঝা বহন করবে না। উপরন্তু আদালতের রায়ে দন্ডিত হয়ে কারাগারেও যেতে পারেন নেতানিয়াহু। তাহলে তার সম্প্রসারণনীতিরও ইতি ঘটবে। কারণ, ইসরাইলের শান্তিপ্রিয় মানুষ দেশটির সম্প্রসারণনীতির বিরুদ্ধে। ওদিকে গত ৯ আগস্ট ইটালির আদালত এক রায়ে বলেছেন, ‘ফিলিস্তিনের পশ্চিম তীরে জেরুজালেম শহরকে ইসরায়েলের রাজধানী হিসেবে মানে না ইতালি। কেউ তা মানলে আন্তর্জাতিক আইনকে অমান্য করবে। কারণ আন্তর্জাতিক আইন জেরুজালেমকে ইসরাইলের রাজধানী হিসেবে স্বীকৃতি দেয় না।’ আর ইইউ’র পররাষ্ট্র বিষয়ক মন্ত্রী বলেছেন, ইইউ ইসরাইলের সম্প্রসারণনীতি সমর্থন করে না। তারা ১৯৬৭ সালের সীমানা রক্ষা করার পক্ষে।
এখন আসা যাক মধ্যপ্রাচ্যের সংকটের ইতিকথায়। এ ব্যাপারে ২২ অগাস্ট, ২০১৮ বিবিসির খবরে প্রকাশ, ‘১৯৪৮ সালের ১৪ মে ইসরাইল রাষ্ট্রের গোড়া পত্তন হয় ফিলিস্তিনে। আর সেদিনই লাখ লাখ ফিলিস্তিনি তাদের বাড়ি-ঘর থেকে উচ্ছেদ হয়। তার পর থেকে তারা প্রতিবছর এ দিনটিকে নাকবা বা বিপর্যয়ের দিন শুরু হিসাবে পালন করে আসছেন। বিংশ শতাব্দীর শুরুতে ইউরোপে বাসকারী ইহুদীরা ব্যাপক বিদ্বেষ-নির্যাতনের শিকার হয়েছিল। সেখান থেকেই ইহুদীবাদী আন্দোলনের শুরু। তাদের লক্ষ্য ছিল ইউরোপের বাইরে কেবলমাত্র ইহুদীদের জন্য একটি রাষ্ট্র পত্তন করা। তখন ফিলিস্তিন ছিল তুর্কী অটোমান সা¤্রাজ্যের অধীন। এটি মুসলিম, ইহুদী ও খ্রিস্টান- এই তিন ধর্মের মানুষের কাছেই পবিত্র ভূমি হিসেবে বিবেচিত। ইহুদীবাদী আন্দোলন দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়ে ইউরোপের ইহুদীরা দলে দলে ফিলিস্তিনে গিয়ে বসত গড়তে শুরু করে। কিন্তু তাদের এই অভিবাসন স্থানীয় আরব এবং মুসলিমদের মধ্যে অসন্তোষ তৈরি করে। সে সময় আরব ও মুসলিমরাই ছিল সেখানে সংখ্যাগরিষ্ঠ। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর তুর্কী অটোমান সাম্রাজ্য ভেঙ্গে পড়ে। তখন লিগ অব নেশনের পক্ষ থেকে ব্রিটেনকে ‘ম্যান্ডেট’ দেয়া হয় ফিলিস্তিন শাসন করার। পুরো মধ্যপ্রাচ্য তখন ভাগ করে নিয়েছিল ব্রিটেন আর ফ্রান্স। তারা পুরো অঞ্চলকে তাদের মতো করে ভাগ করে নিজেদের প্রভাব বলয়ে ঢোকায়। ফিলিস্তিনে তখন ইহুদী এবং আরবরা লড়াইয়ে জড়িয়ে পড়ে। এদিকে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে লাখ লাখ ইহুদীকে হত্যার পর ইহুদীদের জন্য একটি স্বতন্ত্র রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠায় চাপ বাড়তে থাকে। ব্রিটিশ ম্যান্ডেটের অধীনে থাকা অঞ্চলটি তখন ফিলিস্তিনি আর ইহুদীদের মধ্যে ভাগ করার সিদ্ধান্ত হয়। এই সিদ্ধান্তের ভিত্তিতেই ১৯৪৮ সালের ১৪ মে প্রতিষ্ঠিত হয় ইসরায়েল। কিন্তু পরদিনই মিশর, জর্ডান, সিরিয়া এবং ইরাক মিলে অভিযান চালায় ব্রিটিশ ম্যান্ডেটের অধীনে থাকা অঞ্চলে। সেটাই ছিল প্রথম আরব-ইসরায়েল যুদ্ধ। ইহুদীদের কাছে এটি স্বাধীনতার যুদ্ধ হিসেবে পরিচিত। জাতিসংঘ ফিলিস্তিনে আরবদের জন্য একটি স্বতন্ত্র রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠায় যে অঞ্চলটি বরাদ্দ করেছিল, এই যুদ্ধের পর তার অর্ধেকটাই চলে যায় ইসরাইলের দখলে। ইহুদী বাহিনী প্রায় সাড়ে সাত লাখ ফিলিস্তিনকে বাড়ি-ঘর থেকে উচ্ছেদ করে। তারা প্রতিবেশী দেশগুলোতে আশ্রয় নেয়। তারপর ২০১৪ সালে গাজা যুদ্ধে ফিলিস্তিনদের ঘর-বাড়ি বোমা মেরে মাটিতে মিশিয়ে দিয়েছিল ইসরাইল। প্রায় দুহাজারের বেশি মানুষ সেই যুদ্ধে নিহত হয়। এরপর ১৯৬৭ সালের ৫-১০ জুন পর্যন্ত ছয় দিনের আরব-ইসরাইল যুদ্ধ হয়। এতে ইসরাইল জয়ী হয়। তারা গাজা এবং সিনাই উপদ্বীপ দখল করে নেয়, যা ১৯৪৮ সাল হতে মিশরের নিয়ন্ত্রণে ছিল। অন্যদিকে পূর্ব জেরুজালেমসহ পশ্চিম তীরও তারা দখল করে নেয় জর্ডানের কাছ থেকে। সিরিয়ার কাছ থেকে দখল করে নেয় গোলান মালভূমি। ফলে আরও পাঁচ লাখ ফিলিস্তিনিকে বাড়ি-ঘর ফেলে পালাতে হয়। এর পর ১৯৭৩ সালের অক্টোবরে মিশর ও সিরিয়ার সাথে যুদ্ধ হয় ইসরাইলের। মিশর এই যুদ্ধে সিনাই অঞ্চলে তাদের কিছু হারানো ভূমি পুনরুদ্ধার করে। তবে গাজা ও গোলান মালভূমি থেকে ইসরাইলকে হটানো যায়নি। এই যুদ্ধের ছয় বছর পর মিশর প্রথম কোন আরব রাষ্ট্র যারা ইসরাইলের সঙ্গে শান্তি চুক্তি করে। এর পর তাদের পথ অনুসরণ করে জর্ডান। তবুও ফিলিস্তিনিদের সঙ্গে ইসরাইলের যুদ্ধ শেষ হলো না। গাজা ভূখন্ড যেটি বহু দশক ধরে ইসরাইল দখল করে রেখেছিল, সেটি ১৯৯৪ সালে তারা ফিলিস্তিনিদের কাছে ফিরিয়ে দিল। সেখানে ইসরাইলি এবং ফিলিস্তিনিদের মধ্যে বড় ধরনের লড়াই হয় ২০০৮, ২০০৯, ২০১২ এবং ২০১৪ সালে।
ফিলিস্তিনিরা ইসরাইলের বিরুদ্ধে দুটি ‘ইন্তিফাদা’ ঘটিয়েছে। প্রথমটি ১৯৮৭ সালে। এ সময় ফিলিস্তিনিরা ছিল কার্যত নিরস্ত্র। ফিলিস্তিনি তরুণরা পাথর ছুড়ে ইসরাইলি সশস্ত্র বাহিনীর মোকাবেলা করেছে। এর পর ২০০০-২০০৫ সাল পর্যন্ত দ্বিতীয় ইন্তিফাদা ছিল অনেক বেশি রক্তাক্ত। ফিলিস্তিনিদের দাবি: ১৯৬৭ সালের যুদ্ধের আগে যে সীমানা ছিল, সেই সীমানার ভিত্তিতেই তাদের রাষ্ট্র হবে। আর পূর্ব জেরুজালেম হবে ফিলিস্তিনি রাষ্ট্রের রাজধানী। এই অবস্থায় নরওয়ের অসলোতে ১৯৯৩ সালের ২৯ আগস্ট গোপনে ফিলিস্তিনি ও ইসরাইলিদের মধ্যে শান্তি চুক্তি হয়, যা অসলো চুক্তি নামে খ্যাত। সে চুক্তির অন্যতম শর্ত হচ্ছে- ফিলিস্তিনিরা স্বশাসনের অধিকার পাবে এবং ইসরায়েল পশ্চিম তীরের জেরিকো ও গাজা থেকে সৈন্য প্রত্যাহার করে নেবে। আর ইসরাইলি রাষ্ট্রের বৈধতা স্বীকার করে নেবে পিএলও। এই চুক্তির জন্য আরাফাত এবং তৎকালীন ইসরাইলি প্রধানমন্ত্রী রাবিন নোবেল শান্তি পুরস্কার পান। এ চুক্তির সময় ইসরাইলের তৎকালীন পররাষ্ট্রমন্ত্রী শিমন পেরেজ উপস্থিত ছিলেন। এর তিন সপ্তাহ পর অসলো চুক্তি আনুষ্ঠানিকভাবে স্বাক্ষরিত হয় ওয়াশিংটনের হোয়াইট হাউজে। তাতে সই করেন আরাফাত ও রাবিন। কিন্তু এই চুক্তি ফিলিস্তিনের হামাস ও ইসরাইলের কট্টরপন্থীরা প্রত্যাখ্যান করে। উপরন্তু ইসরাইলের কট্টরপন্থীরা প্রধানমন্ত্রী রাবিনকে গুলি করে হত্যা করে। ফলে অসলো শান্তি চুক্তির বাস্তবায়ন থেমে যায়। আর ফিলিস্তিন ও ইসরাইলের মধ্যে রক্তাক্ত সংঘর্ষ অব্যাহতই থাকে। এই প্রেক্ষাপটে ২০০০ সালে যুক্তরাষ্ট্রের প্রাক্তন প্রেসিডেন্ট ক্লিনটন ক্যাম্প ডেভিডে শান্তি আলোচনার উদ্যোগ নেন। কিন্তু সেই বৈঠকে তৎকালীন ইসরাইলি প্রধানমন্ত্রী এহুদ বারাক এবং ফিলিস্তিনি নেতা ইয়াসির আরাফাত একমত হতে পারেননি বিভিন্ন বিষয়ে। এর পর ২০০২ সালে আরব লিগে এক চুক্তি হয়। ‘আরব পিস ইনিশিয়েটিভ’ শিরোনামে ঐ চুক্তিতে ইসরাইলের প্রতি ১৯৬৭ সালের মধ্যপ্রাচ্য যুদ্ধের আগ পর্যন্ত বিদ্যমান সীমানা থেকে তার দখলদারি ছেড়ে দিতে অনুরোধ জানানো হয়। বিনিময়ে দেশটির সঙ্গে আরব ও এই অঞ্চলের ইসলামি দেশগুলোর সম্পর্ক স্বাভাবিক করার প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়। অর্থাৎ দুই রাষ্ট্র নীতি গ্রহণ করা হয়। কিন্তু চুক্তিটি কার্যকর হয়নি। ফলে সংঘাত অব্যাহতই আছে !
লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: আমিরাত-ইসরাইল-চুক্তি
আরও পড়ুন