পবিত্র লাইলাতুল বরাত
আজ দিবাগত রাত পবিত্র লাইলাতুল বরাত। পরম করুণাময় আল্লাহতায়ালা তার বান্দাদের গুনাহ মাফ, বিপদমুক্তি ও
ভারত-বাংলাদশ সম্পর্কে চিড় ধরেছে, এমন সংবাদ দেশ-বিদেশের পত্র-পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে। ভারতের সাথে বাংলাদেশের সর্বোচ্চ বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক কিংবা বন্ধুত্বের সোনালী অধ্যায় বিভিন্ন ইস্যুতে কিছুটা অবনতি হয়েছে, এমন কথা ঐসব সংবাদে তুলে ধরা হয়েছে। সম্প্রতি ভারতের আনন্দবাজার পত্রিকার এক প্রতিবেদনে এ সম্পর্কের অবনতির কারণ হিসেবে রামন্দির নির্মাণ, জাতীয় নাগরিক পঞ্জিসহ অন্যান্য বিষয়ের কথা উল্লেখ করা হয়েছে। বাংলাদেশের প্রতি ব্যবসা-বাণিজ্য, বিনিয়োগসহ নানা সুযোগ-সুবিধা নিয়ে অকুণ্ঠচিত্তে চীনের হাত বাড়িয়ে দেয়া এবং পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী ইমরান খানের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে ফোন করার বিষয়গুলো ভারতের উদ্বেগ বাড়িয়ে দিয়েছে বলেও বলা হয়েছে। পর্যবেক্ষকরা মনে করেন, এ ধরনের প্রতিবেদনে বাংলাদেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ খুশি হয়েছে। কারণ, তারা বছরের পর বছর ধরে বাংলাদেশের প্রতি ভারতের বিরূপ আচরণ এবং কোনো কিছু না দিয়ে তার সব ধরনের স্বার্থ আদায় করে নেয়ার বিষয়টি মেনে নিতে পারছিল না। করোনা পরিস্থিতি এ দৃশ্যপট বদলে দিয়েছে। বুঝতে অসুবিধা হয় না, ভারতের অন্যায্য আচরণের বিষয়টি সরকার ভেতরে ভেতরে পছন্দ না করলেও ভারতের প্রতি বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক ও কৃতজ্ঞতার কারণে এতদিন টু শব্দ করেনি। করোনা যেন সরকারের মধ্যে ভারতমুখী প্রবণতাকে নতুন করে উপলব্ধি করতে সহায়তা করেছে। পাশাপাশি চীন তো রয়েছেই, নেপাল ও ভুটানের মতো দেশ যখন ভারতের দাদাগিরির বিরুদ্ধে একেবারে ৩৬০ ডিগ্রী ঘুরে দাঁড়িয়ে প্রতিবাদ এবং বিভিন্ন পদক্ষেপ নেয়া শুরু করেছে, তখন তা বাংলাদেশ সরকারের জন্য অনেকটা অনুপ্রেরণা হিসেবে কাজ করেছে। এক্ষেত্রে বলতেই হবে, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তার দূরদর্শিতা ও বিচক্ষণতা দিয়ে কূটনীতিতে অসাধারণ ভূমিকা পালন করেছেন। সাপও মরবে লাঠিও ভাঙ্গবে না-এমন একটা নীতি যেন ভারতের প্রতি পরিদৃষ্ট হয়। ভারত ভাল করেই বুঝতে পারছে, বাংলাদেশ ধীরে ধীরে তার কাছ থেকে দূরে সরে যাচ্ছে। ফলে তার সাউথ ব্লকের উতলা হওয়া স্বাভাবিক। এমন এক প্রেক্ষাপটে ভারতের পররাষ্ট্র সচিব হর্ষবর্ধন শ্রিংলা গত মঙ্গলবার দুপুরে এক আকস্মিক সফরে আসেন। এ সফরের মূল কারণ যে বাংলাদেশকে তার পক্ষে ঠিক রাখা, তা বোধকরি বলার অপেক্ষা রাখে না। বাংলাদেশ সরকারের বিভিন্ন নেতৃবৃন্দও ইতোমধ্যে ভারতকে আশ্বস্ত করার মতো বক্তব্য দিয়েছেন। পররাষ্ট্রমন্ত্রী একে আব্দুল মোমেন বলেছেন, বাংলাদেশের উন্নয়ন মানে ভারতের উন্নয়ন, ভারতের উন্নয়ন মানে বাংলাদেশের উন্নয়ন। আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এবং সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বলেছেন, ভারতের সাথে বাংলাদেশের একাত্তরের রক্তের রাখিবন্ধনের সম্পর্ক। বলা বাহুল্য, এসব বক্তব্য ভারতকে আশ্বস্ত করার জন্য এবং ভারতের উদ্বেগ প্রশমনের জন্য বলা। অন্যদিকে চীন-বাংলাদশ সম্পর্ক যে এখন এক নতুন উচ্চতার দিকে ধাবিত তা বিদেশি পত্র-পত্রিকায় প্রতিবেদন প্রকাশিত হচ্ছে। বলা হচ্ছে, বহু বছর ধরে চীন বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় উন্নয়নের অংশীদার। এ অংশীদারিত্ব এখন নতুন উচ্চতায় পৌঁছেছে। করোনাকালে বাংলাদেশের পাশে চীনের নিঃস্বার্থভাবে দাঁড়ানো দুই দেশের মধ্যে নতুন এক দিগন্ত উন্মোচন করেছে। মূলত চীনের সাথে বাংলাদেশের ঘনিষ্ঠতা বৃদ্ধি ভারতের গা জ্বালার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
দুই.
করোনা বিশ্ব রাজনীতি, কূটনীতি এবং অর্থনৈতিক পরিস্থিতির আমূল পরিবর্তন করে দিয়েছে। বিশ্বের প্রতাপশালী দেশগুলোও এখন নিজেদের ঘর গোছাতে হিমশিম খাচ্ছে। নতুন পরিকল্পনা নিয়ে এক ‘নিউ ওয়ার্ল্ড অর্ডার’ বা ‘নিউ নরমাল’ পরিস্থিতির দিকে ঝুঁকেছে। এ পরিস্থিতি অনেকটা নতুন করে শুরু করার মতো। এই নিউ স্টার্ট-এ যে নেতৃত্বে এগিয়ে থাকবে, সেই হবে বিশ্বের রাজনীতি, অর্থনীতি ও কূটনীতির নিয়ন্ত্রক। প্রশ্ন হচ্ছে, বর্তমানে বিশ্ব নেতৃত্বের দিক থেকে কে এগিয়ে? যারা পর্যবেক্ষক তাদের জন্য উত্তরটা সহজ। এক্ষেত্রে তারা চীনকে এগিয়ে রাখবেন। এর কারণ, তারা দেখছেন, যে চীন থেকে করোনার উৎপত্তি এবং তাকে নাস্তানাবুদ করে বিশ্বে ছড়িয়েছে, সেই চীনই এখন ঘুরে দাঁড়িয়ে বিশ্ব অর্থনীতির নিয়ন্ত্রকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছে। আর অর্থনীতি নিয়ন্ত্রণ মানেই রাজনীতি, কূটনীতি, মানুষের উন্নতি-অগ্রগতি নিয়ন্ত্রণ করা। চীনের হাতে এখন এ নিয়ন্ত্রণের চাবি-কাঠি। দেশটি এ কাজটি করতে পারছে কি করে এবং কীভাবে, এ প্রশ্ন আসতে পারে। জবাবে বলা যায়, সে কাজটি করতে পারছে তার দূরদর্শী চিন্তা দিয়ে। নিজের অর্থনীতির ভিত্তি শক্ত করার জন্য আগে থেকেই যত ধরনের অবকাঠামোগত উন্নয়ন প্রয়োজন, তার সব কিছু করে তৈরি করে রেখেছে। ফলে সাময়িক বিপর্যয়ের মধ্যে পড়লেও তার অর্থনীতির ভিত্তি নড়ে যায়নি। এই ভিত্তির উপর দাঁড়িয়েই সবার আগে সে নিউ ওয়ার্ল্ড অর্ডার-এর নেতৃত্বে এগিয়ে রয়েছে। প্রতাপশালী যুক্তরাষ্ট্রকেও টেক্কা দিয়েছে। চীনের প্রতিটি পদক্ষেপ পর্যবেক্ষণ করলে বোঝা যায়, নিউ ওয়ার্ল্ড অর্ডার প্রতিষ্ঠায় সে প্রথমে তার প্রতিবেশী দেশগুলোর দিকে নজর দিয়েছে। দেশগুলোকে তার ঘরের বলয়ের মতো বিবেচনা করে অর্থনৈতিক উন্নয়নে ব্যাপক সহায়তা দিয়ে যাচ্ছে। চীন ভাল করেই জানে, প্রতিবেশী ভাল থাকলে তার শক্তিও বৃদ্ধি পাবে। তাই সে যেখানে যার জন্য যা প্রয়োজন এবং যে ধরনের আচরণ করতে হবে, এ নীতি অবলম্বন করে চলেছে। সে প্রতিবেশী দেশগুলোর সাথে ভারতের দাদাগিরিকে ভেঙ্গে দেয়ার কৌশলী পদক্ষেপ নিয়েছে। প্রথমে নিজেই ভারতের সাথে সীমান্তে এক ধরনের মল্লযুদ্ধের মাধ্যমে বুঝিয়ে দিয়েছে, প্রতিবেশীদের সাথে দাদাগিরি করা চলবে না। চীনের এই পদক্ষেপে নেপাল শক্তি ও সাহসী হয়ে ভারতকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে দুই দেশের বিরোধপূর্ণ জায়গা উত্তর খন্ড রাজ্যের অন্তর্গত কালাপানি, লিম্পিয়াধুরা ও লিপুলেখ এলাকা মানচিত্রে অন্তর্ভুক্ত করে নিয়েছে। নেপালের প্রধানমন্ত্রী কে পি শর্মা অলির এই দেশাত্মবোধ এবং সাহসী নেতৃত্ব তার দেশের জনগণ অকুণ্ঠচিত্তে সমর্থন জানিয়েছে। এমনকি মোদি সরকার বাবরি মসজিদের জায়গায় যে রাম মন্দির নির্মাণ করছে এবং রামের ঝান্ডা তুলে ধরার প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে, সেই রামের জন্মস্থান নেপালে বলে দাবী করেছে। ইতোমধ্যে নেপাল রামমন্দির নির্মাণের ঘোষণা দিয়েছে। নেপালের পর ভুটানও পানি বন্ধ করে দিয়ে ভারতকে এক হাত নিয়েছে। ভারতের বিরুদ্ধে প্রতিবেশী এই দুই দেশের পদক্ষেপ গ্রহণকে চেয়ে চেয়ে দেখা ছাড়া ভারতের কিছু করার ছিল না। শ্রীলঙ্কা তো আরও আগেই তাকে তোয়াক্কা করা ছেড়ে দিয়েছে। এর ফলে সম্প্রতি অনুষ্ঠিত নির্বাচনে রাজাপাকসের দল দুই-তৃতীয়াংশ ভোট পেয়ে পুনরায় নির্বাচিত হয়েছে। পরিস্থিতি বেগতিক দেখে ভারত, বাংলাদেশ ও মালদ্বীপকে সামলানোর দিকে মনোযোগ দিয়েছে। মালদ্বীপকে ধরে রাখতে পারলেও বাংলাদেশকে কতটা পারছে, তা এক রহস্যের ঘেরাটোপের মধ্যে রয়েছে। ভারত হয়তো বুঝতে পারছে না, বাংলাদেশ কোন অবস্থানে রয়েছে। বাংলাদেশের অবস্থানের বিষয়টি একটু পরে আলোচনা করব। দেখা যাচ্ছে, ভারত একে একে তার প্রভাববলয়ে থাকা প্রতিবেশিদের হারিয়ে একা হয়ে পড়ছে। এ নিয়ে সম্প্রতি এক ভার্চুয়াল সভায় ভারত এবং যুক্তরাষ্ট্রের বিশ্লেষকরা স্পষ্টভাবেই প্রতিবেশিদের সাথে ভারত সরকারের আধিপত্যবাদী নীতি ও বিরূপ আচরণের সমালোচনা করে বলেছেন, ভারত দক্ষিণ এশিয়ায় নিজেকে একা করে ফেলেছে। ভারতের বিরোধী দলের সংসদ সদস্য শশী থারুর আলোচনায় অংশগ্রহণ করে বলেছেন, নরেন্দ্র মোদি সরকার তার অহংকার এবং অদক্ষতার কারণে প্রতিবেশিদের সাথে শত্রু তামূলক আচরণের মাধ্যমে ভারতকে সংকটের মধ্যে ফেলে দিয়েছে। তিনি নাগরিকত্ব সংশোধনী বিল (সিএএ)-এর কথা উল্লেখ করে বলেছেন, এর মাধ্যমে মোদি সরকার দেশকে বিভক্তির মধ্যে ঠেলে দিয়েছে। ফলে পুরো বিশ্ব আমাদের এখন অসহিষ্ণু ও সংকীর্ণমনা জাতি হিসেবে দেখছে। ভারতের অশোকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ভাইস চ্যান্সেলর শিক্ষাবিদ প্রতাপ ভানু মেহতা মোদি সরকারের কঠোর সমালোচনা করে বলেছেন, সরকার শুধু মাত্র তার আভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে লাভবান হওয়ার জন্য পররাষ্ট্রনীতিকে ব্যবহার করছে, যেখানে শুধু প্রপাগান্ডা এবং মিথ্যা ছাড়া কিছুই নেই। ভারতের বিশ্লেষকদের এ ধরনের কঠোর মন্তব্য থেকেই প্রতীয়মান হচ্ছে, দেশটি ঘরের মধ্যে যেমন বিরূপ সমালোচনার শিকার হচ্ছে, তেমনি উপমহাদেশে একা হয়ে পড়ছে। বলার অপেক্ষা রাখে না, করোনার থাবায় ভারতের অর্থনীতি তলানিতে গিয়ে ঠেকেছে। দেশটি অত্যন্ত নাজুক অবস্থায় রয়েছে। এ অবস্থার মধ্যে প্রতিবেশিদেরও ধরে রাখতে পারছে না শুধু মাত্র তার দাদাগিরি আচরণের কারণে। প্রতিবেশিরাও স্বাভাবিকভাবেই তাদের ওপর প্রভাব খাটানোর মতো আচরণের জবাব দেয়ার জন্য তার দুর্বলতার সুযোগ নেবে। হয়েছেও তাই। এখন ভারত মরিয়া হয়ে ঢাকার চেয়েও আয়তনে ছোট (২৯৮ বর্গকিলোমিটার) দেশ মালদ্বীপকে ধরে রাখার চেষ্টা করে যাচ্ছে। নিজের অর্থনৈতিক দুর্বলতার মধ্যেও করোনায় অর্থনৈতিক সংকটে পড়া দেশটিকে তারল্য সংকট কাটিয়ে উঠতে ৪০০ মিলিয়ন ডলারের মুদ্রা সহায়তা দিয়েছে। এর বাইরে ১৪০ কোটি ডলার দিয়েছে। এ নিয়েও বিশেষজ্ঞরা শঙ্কায় আছেন, এ সহায়তা সত্তে¡ও মালদ্বীপ শেষ পর্যন্ত ভারতের প্রভাব বলয়ে থাকবে কিনা। কারণ, মালদ্বীপে চীনের দৃষ্টি রয়েছে।
তিন.
চীন যে উপমহাদেশে তার প্রতিবেশী দেশগুলোর সাথে আন্তরিক ও বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক এবং উন্নয়নমূলক সহযোগিতার মাধ্যমে তার বন্ধুচক্র গড়ে তোলার দিকে মনোযোগী, তা স্পষ্টতই বোঝা যাচ্ছে। প্রভুত্বমূলক আচরণ নয়, বরং বন্ধু হয়ে যেভাবে সে হাত বাড়িয়ে দিয়েছে, তা উপলব্ধি করেই দেশগুলোও তার সাথে হাত মিলাচ্ছে। বাংলাদেশ যে এর বাইরে নয়, তা পরোক্ষভাবে হলেও বোঝা যাচ্ছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তার বিচক্ষণ ও দূরদর্শী কূটনৈতিক প্রজ্ঞা দিয়ে দেশের স্বার্থে বুঝেশুনে অগ্রসর হচ্ছেন। বলা যায়, তিনি ‘সুপার ডিপ্লোমেসি’ দিয়ে পুরো পরিস্থিতি সামলে এগুচ্ছেন। যেহেতু চীনই হতে যাচ্ছে পরিবর্তিত বিশ্বের অর্থনীতি, রাজনীতি এবং কূটনীতির নিয়ন্ত্রক এবং তার শক্তিশালী অর্থনৈতিক ভিত্তি রয়েছে, স্বাভাবিকভাবেই বিভিন্ন দেশ পারস্পরিক স্বার্থে তার দিকেই ঝুঁকবে। ইতোমধ্যে আমরা দেখেছি, করোনাকালে না চাইতেই চীন আমাদের অনেক কিছু দিয়েছে এবং দিচ্ছে। আট শতাধিক পণ্যের শুল্কমুক্ত সুবিধা, করোনা সুরক্ষা সামগ্রী, বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক দল প্রেরণ থেকে শুরু করে তার আবিষ্কৃত ভ্যাকসিনের তৃতীয় দাপ পরীক্ষার সুযোগসহ অন্যান্য সুবিধা নিয়ে হাজির হয়েছে। ব্যবসা-বাণিজ্য ও বিনিয়োগ, এগুলোতো আছেই। ফলে যার কাছ থেকে দাদাগিরির পরিবর্তে পারস্পরিক বন্ধুত্বপূর্ণ আচরণের মাধ্যমে সার্বিক সহায়তা পাওয়া যাবে, তার কাছে যাওয়াই বিশ্ব রাজনীতি ও কূটনীতির স্বাভাবিক প্রক্রিয়া। বাংলাদেশ সরকার তা ভাল করেই বুঝতে পারছে এবং অত্যন্ত সুকৌশলে পদক্ষেপ নিচ্ছে। এই যে নেপালের সাথে রেল ট্রানজিট চালু করার উদ্যোগ নেয়া হয়েছে, বলা যায়, তা এই কৌশলেরই অংশ। এই ট্রানজিট শুরু হলে নেপালের সাথে ব্যবসা-বাণিজ্যের কার্যক্রম ব্যাপক আকার ধারণ করবে। শুধু নেপাল নয়, এর সঙ্গে ভুটান ও চীনের সাথেও বাণিজ্যিক কার্যক্রম শুরু হবে। সমস্যা হচ্ছে, কয়েক দশক আগে এই রেল ট্রানজিট চালু হওয়ার কথা থাকলেও তা শুরু করা সম্ভব হয়নি ভারতের কারণে। ভারত চায়না এর মাধ্যমে নেপালের সাথে আমদানি-রফতানি শুরু হোক। তার ভয়, এতে চীনও ঢুকে পড়বে। তবে আশার কথা হচ্ছে, বাংলাদেশ ও নেপাল এই রেল ট্রানজিট চালু করতে সম্মত হয়েছে। এটা সম্ভব হয়েছে, ভারতকে নেপালের তোয়াক্কা না করা এবং নেপথ্যে চীনের প্রভাব। শুধু এই ট্রানজিটই নয়, বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চলের সর্বশেষ সীমান্তে অবস্থিত পঞ্চগড় থেকে ৫৭ কিলোমিটার দূরে বাংলাবন্দ স্থলবন্দরটিও নেপাল, ভুটান ও ভারতের সাথে আমদানি-রফতানি পুরোদমে শুরু করার ক্ষেত্রে ভারত বাধা হয়ে রয়েছে। নেপাল ও ভুটানের সাথে যোগাযোগের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ বিচ্ছিন্ন হয়ে রয়েছে ভারতের মধ্যকার ৫২ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যরে পথ যা শিলিগুঁড়ি করিডোর নামে পরিচিত। ভারত যদি এই পথটুকু পুরোপুরি ব্যবহার করতে দিত, তাহলে নেপাল ও ভুটানের সাথে বাংলাদেশের ব্যাপক বাণিজ্যিক কার্যক্রম শুরু হতো। ভারত তা পুরোপুরি দিচ্ছে না শুধু চীনের কারণে। তার ভয় পুরোপুরি চালু হলে চীনও এর মধ্যে যুক্ত হয়ে পড়বে এবং তার আধিপত্য খর্ব হবে। মূলত চীনের সাথে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নতি ও অগ্রগতির সহায়তামূলক সম্পর্ক গতি পায় ২০১৬ সালের অক্টোবরে যখন চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং বাংলাদেশ সফর করেন। এ সময় দুই দেশ চীনের বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ (বিআরআই)-এর অধীনে সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষর করে। কৌশলগত অংশীদারিত্বে সহযোগিতার জন্য দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ককে উন্নত করার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। এতে উভয় দেশের জন্য বিজয় ভিত্তিক সহযোগিতার নতুন সুযোগ সৃষ্টি হয়। তখন থেকেই দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক গতি লাভ করে। করোনাকালেও বেল্ট অ্যান্ড রোড-এর সহযোগিতামূলক কার্যক্রম থেমে থাকেনি। চীনের সহায়তায় পদ্মা সেতু প্রকল্প ও কর্ণফুলি টানেল নির্মাণের কাজ যেমন চলেছে, তেমনি গত মে মাসে পায়রায় দেশের বৃহত্তম ২৬৬০ মেগাওয়াটের কয়লা চালিত বিদ্যুৎকেন্দ্রর একটি ইউনিটের কাজ সম্পন্ন হয়েছে। ইতোমধ্যে বিদ্যুৎকেন্দ্রটি থেকে জাতীয় গ্রিডে বিদ্যুৎ সরবরাহ শুরু হয়েছে। গত ২ আগস্ট কর্ণফুলি টানেল প্রজেক্টে বাম লেন সম্পন্ন করার মধ্য দিয়ে একটি বড় সাফল্য অর্জিত হয়েছে। তিস্তার পানি ধরে রাখার প্রকল্পে ইতোমধ্যে চীন ১০০ কোটি ডলার সহায়তায় রাজী হয়েছে। এতে ভারত সরকার উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছে এবং তড়িঘড়ি করে হর্ষবর্ধন শ্রীংলাকে বাংলাদেশ সফরে পাঠিয়েছে বলে ভারতের দ্য প্রিন্ট পত্রিকায় বলা হয়েছে। বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নতি ও অগ্রগতির এই দৃশ্যমান সহযোগিতায় চীন যেভাবে কাজ করছে, তাতে দুই দেশের সম্পর্ককে গভীর থেকে গভীরতর হচ্ছে। করোনা পরিস্থিতি এ সম্পর্ককে আরও দৃঢ় ভিত্তি দিয়েছে। ইতোমধ্যে বাংলাদেশ সিলেটের ওসমানি বিমানবন্দরের রানওয়ে সম্প্রসারণের কাজ চীনকে দিয়ে দিয়েছে। কাজটি করার কথা ছিল ভারতের। ফলে দেখা যাচ্ছে, পারস্পরিক বন্ধুত্বের সর্বোচ্চ সম্পর্কের মধ্যে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নতি ও অগ্রগতিতে ভারতের কার্যকর তেমন কোনো অবদান নেই। বরং সে কেবল বাংলাদেশের কাছ থেকে তার সব স্বার্থ আদায় করে নিয়েছে, বিনিময়ে কিছুই দেয়নি। বাংলাদেশ সরকার যে তা বোঝে না, এমন মনে করার কারণ নেই। ফলে ভারতের সাথে বৈরী সম্পর্কে না গিয়ে কূটনৈতিক দক্ষতা দিয়ে চীনের মতো অর্থনৈতিক শক্তিধর দেশের সাথে সম্পর্ক সুদৃঢ় করে উন্নয়ন কাজ এগিয়ে নিচ্ছে, যেখানে ভারতের বলার কিছু থাকছে না। চীন যে শুধু বাংলাদেশকে অকুণ্ঠচিত্তে উন্নয়নমূলক সহযোগিতা দিয়ে যাচ্ছে তা নয়, নেপাল, ভুটান, শ্রীলঙ্কাকেও একইভাবে সহযোগিতা করছে। এমনকি যে আফগানিস্তান ভারতের ঘনিষ্ট ছিল, সেই আফগানিস্তানকেও চীন তার সাথে নিয়ে নিয়েছে। পাকিস্তানে তো চীনের উন্নয়ন সহযোগিতা ব্যাপক আকার ধারণ করেছে। এক ‘চীন-পাকিস্তান ইকোনোমিক করিডোরে’র মাধ্যমে পাকিস্তানে উন্নয়নের নতুন জোয়ার বইছে বলে দেশটি দাবী করেছে। এছাড়া দুই দেশের বাণিজ্যিক সম্প্রসারণ এতটাই বৃদ্ধি পেয়েছে যে, অচিরেই পাকিস্তানের অর্থনীতি সুদৃঢ় ভিত্তি লাভ করবে। উপমহাদেশে প্রতিবেশী দেশগুলোর অর্থনৈতিক উন্নয়নে চীনের এই যে ব্যাপক সহযোগিতা, তা কি ভারতের পক্ষে কখনো, কোনো দিন করা সম্ভব? সম্ভব না। কারণ, সে শুধু জানে প্রতিবেশিদের ওপর দাদাগিরি ও ভয় দেখানোর মাধ্যমে তার পক্ষে রাখার নীতি। প্রতিবেশী দেশগুলো তা মানবে কেন? তারা এখন ভাল করেই জানে, ভারতের পক্ষে চীনের মতো বন্ধু হয়ে তাদের অর্থনৈতিক উন্নতি ও অগ্রগতিতে সহায়ক হওয়া সম্ভব নয়। সেই সামর্থ্য ও সক্ষমতা তার নেই। তাই তারা চীনকেই পারস্পরিক মর্যাদাপূর্ণ সম্পর্কের প্রতি আস্থা রেখেছে। ফলে উপমহাদেশে ভারতের অবস্থান কোথায়, তা অনুমাণ করতে কষ্ট হয় না।
চার.
আমরা মনে করি, পরিবর্তিত বিশ্বে বাংলাদেশ সরকার সঠিক অবস্থানেই রয়েছে। বিপদে ঘাবড়ে না গিয়ে কীভাবে অর্থনীতিকে দাঁড় করানো যায়, এমন বাস্তবভিত্তিক উদ্যোগ গ্রহণ করেছে। এটা সম্ভব হয়েছে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দূরদর্শী ও বিচক্ষণ সিদ্ধান্ত এবং উদ্যোগের কারণে। তিনি যেমন দেশের অর্থনীতিকে দাঁড় করাতে একের পর এক উন্নয়নমূলক প্রকল্প ও পদক্ষেপ নিয়েছেন, তেমনি চলমান বৈশ্বিক বাস্তবতা অনুধাবন করে কূটনৈতিক দক্ষতা কাজে লাগিয়ে যেসব দেশের কাছ থেকে সর্বোচ্চ সুবিধা পাওয়া যাবে, তাদের সাথে পারস্পরিক বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক জোরদার করেছেন। উপমহাদেশে ভারতের সাথে সুসম্পর্ক বজায় রেখে অন্য প্রতিবেশিদের সাথে পারস্পরিক অর্থনৈতিক সম্পর্ক জোরদার করার উদ্যোগ নিয়েছেন। তিনি সবার আগে দেশের স্বার্থকে প্রাধান্য দেয়ার নীতি গ্রহণ করে এগিয়ে চলেছেন। এক্ষেত্রে চীন বা অন্য যেসব সমৃদ্ধ দেশ আমাদের অর্থনৈতিক উন্নয়নের অংশীদার হতে এগিয়ে আসছে, তাদের বিনিয়োগ করার আহবান যেমন করছেন, তেমনি সাদরে গ্রহণ করছেন। করোনায় বিপর্যস্ত হয়ে পড়া অর্থনীতি এবং আগামী বিশ্বে শক্তিশালী অর্থনৈতিক দেশ হিসেবে আবির্ভূত হতে এর কোনো বিকল্প নেই। এখন আর কারো একক স্বার্থ দেখা বা একদিকদর্শী হয়ে থাকার সময়ও নেই।
[email protected]
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।