Inqilab Logo

রোববার ১৭ নভেম্বর ২০২৪, ০২ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ১৪ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

এখন আর বসে থাকার সময় নেই

কামরুল হাসান দর্পণ | প্রকাশের সময় : ১৬ আগস্ট, ২০২০, ১২:০১ এএম

করোনাকারণে বৈশ্বিক অর্থনৈতিক মহামন্দাবস্থা উত্তরণে এখন একটি কার্যকর ভ্যাকসিন খুবই প্রয়োজন। এই ভ্যাকসিনই হতে পারে পর্যুদস্ত বিশ্ব অর্থনীতির ঘুরে দাঁড়ানোর অন্যতম ভিত্তি। তবে ‘সোনার হরিণে’ পরিণত হওয়া এই ভ্যাকসিন কবে নাগাদ মানুষের কাছে পৌঁছে ভরসার কেন্দ্রস্থলে পরিণত হবে, তা নিশ্চিত করে বলা যায় না। ফলে বিশ্ব অর্থনীতির মন্দাবস্থা কাটানোর বিষয়টিও দোদুল্যমান অবস্থার মধ্যে পড়ে গেছে। মানুষ এখন দুধারি তলোয়ারের মুখোমুখি। একদিকে করোনা, আরেক দিকে জীবন-জীবিকা। দুটোই টিকে থাকার থাকার ঝুঁকি সৃষ্টি করেছে। করোনায় যেমন মৃত্যুঝুঁকি রয়েছে, তেমনি জীবিকার অভাবে না খেয়ে মরার শঙ্কাও কাজ করছে। তারপরও এটাই শেষ কথা নয়। শত শত বছর ধরে মহামারি ও প্রাণসংহারকারী দুর্যোগ মোকাবেলা করেই মানুষ টিকে রয়েছে। বিলুপ্ত হয়ে যায়নি। আসলে মানুষ পরাজিত হয় না, সাময়িক বিপর্যয়ের মধ্যে পড়লেও উত্তরণের পথ ঠিকই বের করে নেয়। এই যে করোনার মহামারি চলছে এবং বিশ্ব অর্থনীতি বিধ্বস্ত হয়ে পড়েছে, তা থেকে উত্তরণে এই মানুষই পথ বের করবে এবং ঘুরে দাঁড়াবে। আমরা যদি নিকট অতীতের দিকে তাকাই তাহলে দেখব, ১৯৩০ সালে বিশ্ব অর্থনীতি মহামন্দার কবলে পড়েছিল। তারপর দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় এবং অতি নিকটের কথা যদি বলি, তবে ২০০৭-৮ সালেও বিশ্ব অর্থনীতি মন্দা কবলিত হয়। এসব মন্দা মোকাবেলা করে মানুষ ঠিকই ঘুরে দাঁড়িয়েছে। তবে এবারের বিশ্ব অর্থনৈতিক মহামন্দা অতীতের সব মহামন্দাকে ছাড়িয়ে গেছে। মাইক্রোস্কোপিক এক ভাইরাস পুরো মানবজাতির জন্য হুমকি হয়ে উঠায় মানুষের জীবন এবং অর্থনৈতিক সকল কর্মকান্ড স্থবির হয়ে পড়েছে। আশার কথা হচ্ছে, অনিবার্য এই বিপদকে মেনে নিয়েই মানুষ তার জীবনযাপন এবং অর্থনৈতিক কর্মকান্ড ধীরে হলেও শুরু করেছে। জোর কদমে এগিয়ে যাওয়ার প্রস্তুতি নিয়েছে। এছাড়া আর উপায়ও নেই। মানবজীবন এবং সভ্যতাকে এগিয়ে নিতেই হবে। আমাদের সরকারও এ বাস্তবতা মেনে নিয়ে অর্থনৈতিক কর্মকান্ড পুরোদমে শুরু করেছে। যদিও আমাদের মতো উন্নয়নশীল একটি দেশের জন্য কাজটি অত্যন্ত কষ্টকর, তারপরও যে কোনো উপায়ে অর্থনৈতিক কর্মকান্ড সচল করে এগিয়ে যাওয়া ছাড়া গত্যন্তর নেই।
দুই.
করোনার কারণে ইতোমধ্যে আমাদের অর্থনীতির কী হাল হয়েছে, তা বোধকরি একজন দিন মজুরও জানেন। সরকার আরও ভাল জানে। আমাদের দুর্ভাগ্য যে, করোনার এই সময়ে প্রকৃতিও যেন বিরূপ হয়ে উঠেছে। করোনার মধ্যেই গত মে মাসে প্রবল ঘূর্ণিঝড় আম্ফান আঘাত হেনেছে। এর আঘাতে উপকূলীয় কয়েকটিসহ ২৬টি জেলা লন্ডভন্ড হয়ে যায়। মারা গেছে ১০ জন। তছনছ হয়ে গেছে কয়েক হাজার বাড়িঘর, ভেসে গেছে মাছের ঘের। দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা মন্ত্রণালয়ের তথ্যমতে, এতে প্রাথমিক ক্ষতি হয়েছে ১১০০ কোটি টাকা। এই দুর্যোগের মধ্যেই দেখা দিয়েছে ভয়াবহ বন্যা। ১৯৯৮ সালের পর এবারের বন্যা দীর্ঘস্থায়ী হবে বলে বিশেষজ্ঞরা বলেছেন। ইতোমধ্যে এ বন্যায় দেশের ৩৬ শতাংশ এলাকা প্লাবিত হয়েছে। বন্যা কবলিত হয়েছে ৫৫ লাখ মানুষ। বাড়ি-ঘর, ফসলি জমি, মৎস্য ও গবাদি পশুর খামার, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, মসজিদ-মাদরাসা, রাস্তা-ঘাটসহ অসংখ্য স্থাপনা পানিতে তলিয়ে গেছে এবং নদী ভাঙ্গনে বিলীন হয়েছে। কৃষি মন্ত্রণালয়ের সর্বশেষ হিসাব অনুযায়ী, কৃষিতে ক্ষতি হয়েছে ৪০০ কোটি টাকা। এসব পরিসংখ্যান তুলে ধরার কারণ হলো, করোনায় স্থবির হয়ে যাওয়া অর্থনীতির মধ্যে আম্ফান ও বন্যা কীভাবে আরও বেশি ক্ষতি করেছে এবং করে চলেছে, তা তুলে ধরার জন্য। করোনায় মানুষের জীবন-জীবিকার কী ক্ষতি হয়েছে, তার হিসাব ইতোমধ্যে বিভিন্ন সংস্থা দিয়েছে। বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠান (বিআইডিএস) বলেছে, করোনাকালে নতুন করে দারিদ্র্যসীমার নিচে চলে গেছে ১ কোটি ৬৪ লাখ মানুষ। আর বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়লগের হিসাবে, করোনার আগে দেশে দারিদ্র্য জনগোষ্ঠীর হার ছিল ২০ শতাংশ। করোনা সংক্রমণের পর তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৩৫ শতাংশে। দেশের জনসংখ্যা ১৭ কোটি ধরলে দেখা যাচ্ছে, সংস্থাটির হিসাবে ৫ কোটি ৯৫ লাখ মানুষ দারিদ্র্যসীমার নিচে চলে গেছে। অর্থাৎ যারা দারিদ্র্যসীমার উপরে ছিল এখন তারা প্রান্তিক পর্যায় বা কোনো রকমে খেটে খাওয়া মানুষ কিংবা দিনে তিনবার খাওয়ার মতো সক্ষমতা হারিয়েছে। এগুলো তো পরিসংখ্যানের হিসাব। বাস্তবতা হচ্ছে, পরিসংখ্যান সবসময় সঠিক চিত্র দেয় না। এটা পরিস্থিতির উন্নতি-অবনতি বোঝার অনুমাণ ভিত্তিক একটি প্রাথমিক ধারণা মাত্র। বাস্তবে যে এ সংখ্যা আরও অনেক বেশি, তাতে সন্দেহের অবকাশ নেই। কারণ, অতি দরিদ্র এবং দরিদ্র এই দুই শ্রেণী মিলিয়েই আগে ছিল প্রায় পাঁচ কোটি। করোনার কারণে তা যে জনসংখ্যার অর্ধেকের বেশি দাঁড়িয়েছে, এটা যোগ-বিয়োগ করার জ্ঞানসম্পন্ন একজন মানুষও বোঝে। করোনার কারণে দেশে বেকার এবং কর্মহীন হওয়া মানুষের সংখ্যাটা যে কত কোটি হয়েছে, তার সঠিক হিসাব এখনও পাওয়া যায়নি। এর মধ্যে হাজার হাজার গার্মেন্ট ও অন্যান্য কলকারখানা বন্ধ হয়েছে। কর্মী ছাঁটাই হয়েছে বেশুমার। কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শনের (ডিআইএফআই) হিসাব অনুযায়ী, সব ধরনের কলকারখানা বন্ধ হয়েছে ১৫ হাজার ৯৬৫টি। এর মধ্যে গার্মেন্ট রয়েছে ১৯১৫টি। এসব কারখানায় কর্মরত ছিল ১০ লাখ ৫১ হাজার শ্রমিক। এ হিসাব তো প্রাতিষ্ঠানিক। এর বাইরে অপ্রাতিষ্ঠানিক কাজে যেসব মানুষ নিয়োজিত ছিল, তাদের সংখ্যা কোটি কোটিতে পরিণত হয়েছে। বলা হয়, অপ্রাতিষ্ঠানিক কাজে প্রায় ছয় কোটি মানুষ বেকার হয়ে পড়েছে। এসব পরিসংখ্যা থেকে সহজেই অনুমেয়, দেশের অর্থনীতি ভয়াবহ বিপর্যয়কর অবস্থার মধ্যে রয়েছে। মাসের পর মাস ধরে এ পরিস্থিতি চলছে। এভাবে চলতে থাকলে মানুষের কি বাঁচার আর কোনো উপায় থাকে? এই নিরুপায় মানুষগুলো এখন আর করোনার ভয় করছে না। না করাই স্বাভাবিক। ঘরে বসে না খেয়ে মরার চেয়ে বের হয়ে কাজের সন্ধান করা কিংবা মানুষের কাছে হাত পেতে হলেও অন্ন যোগাড় করার মতো নিরুপায় পথ অবলম্বন করছে। তাদের মধ্যে এখন এই মনোভাব কাজ করছে, এমনিতেও মরেছি, ওমনিতেও মরেছি। কাজেই মরার আগে চেষ্টা করে মরি। এই মরিয়া হয়ে উঠা মানুষ এখন কাজের সন্ধানে হণ্যে হয়ে ঘুরছে। রাস্তা-ঘাটে এসব মানুষের ভিড় দেখা যায়। অনেককে দেখলে বোঝা যায়, তারা পেশাদার কোনো ভিক্ষুক নন। সংকোচ নিয়ে পাশে দাঁড়িয়ে থাকে বা হাত বাড়ানো থেকেই বোঝা যায়, তারা কর্মজীবী ছিল। কর্মহীন হয়ে বাধ্য হয়ে মানুষের কাছে হাত পাতছে। এছাড়া তাদের আর কোনো উপায় নেই। এ কথা তো সবারই জানা, রাজধানীতে বাসা ভাড়া দিয়ে জীবন-জীবিকা চালাতে না পেরে হাজার হাজার মানুষ গ্রামে চলে গেছে। এখনও যাচ্ছে। স্বপ্নের ঢাকায় তাদের বসবাসের স্বপ্ন ভেঙ্গে গেছে।
তিন.
করোনার শুরুতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা অর্থনীতিকে চাঙ্গা রাখতে ১ লাখ ৩ হাজার কোটি টাকার প্রণোদনা প্যাকেজন ঘোষণা করেছিলেন। গার্মেন্ট খাত, ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প, কৃষি খাত এবং কর্মহীন হয়ে পড়া ৫০ লাখ পরিবারকে নগদ অর্থ সহায়তা এ প্রণোদনার আওতায় রয়েছে। এছাড়া খাদ্য সহায়তামূলক ত্রাণ কার্যক্রমও শুরু করা হয়। প্রধানমন্ত্রীর এই আন্তরিক ও দূরদর্শী উদ্যোগ প্রশংসিত হলেও তার যথাযথ বাস্তবায়ন এখনও হয়নি। প্রণোদনা প্যাকেজের অর্থছাড় এতটাই ধীর গতি লাভ করেছে যে কচ্ছপের চলাচলকেও হার মানিয়েছে। হিসাব অনুযায়ী, এক লাখ কোটি টাকা প্রণোদনা প্যাকেজের মধ্যে ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পে এখন পর্যন্ত ছাড় হয়েছে মাত্র ২০০ কোটি টাকা। অন্যদিকে স্বল্প সুদে কৃষকের জন্য বরাদ্দকৃত ঋণের অর্থ ছাড়ের ক্ষেত্রেও কোনো গতি নেই। অর্থছাড় সংক্রান্ত কর্তৃপক্ষের জবাব হচ্ছে, এসব অর্থছাড়ের ক্ষেত্রে অনেক প্রক্রিয়া অবলম্বন করতে হয়। তাদের এ কথায় সেই পুরণো আমলাতান্ত্রিক জটিলতার কথাই ফুটে উঠে। তারা এটা আমলে নিচ্ছে না, প্রধানমন্ত্রী অগ্রাধিকার ভিত্তিতে এসব প্রণোদনামূলক সহায়তার মানুষের জীবন-জীবিকা ও অর্থনীতি যাতে নেতিয়ে না পড়ে এ জন্যই তা দ্রুত সরবরাহ করে চাঙ্গা রাখার নিমিত্তে দিয়েছেন। জরুরি পরিস্থিতিতে মানুষকে বাঁচাতে এবং অর্থনীতিকে সচল করতে এক কুমিরের বাচ্চা সাতবার দেখানোর মতো আমলাতান্ত্রিক জটিলতা প্রদর্শনের জন্য দেননি। এ সময়ও এখন নয়। এখন মানুষের জীবিকার ক্ষেত্র প্রস্তুত করাসহ অর্থনীতিকে দ্রুত চাঙ্গা করার সব ধরনের উদ্যোগ নেয়ার মধ্য দিয়ে নিরলস পরিশ্রম করার সময়। দুঃখের বিষয়, প্রধানমন্ত্রী এককভাবে অত্যন্ত বিচক্ষণতা ও দূরদর্শী সিদ্ধান্তের মধ্য দিয়ে একের পর এক যেসব নির্দেশনা দিচ্ছেন, তা সংশ্লিষ্টরা বাস্তবায়নে ধীর গতি অবলম্বন করছেন। প্রধানমন্ত্রী যখন দ্রুত গতিতে চলছেন, তখন অনেক মন্ত্রী-এমপি নিজেদের ঘরবন্দী করে রেখেছেন এবং প্রশাসনের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের অনেকে বাড়িতে বসে হোম অফিসের নামে অনেকটা ছুটির আমেজে শুয়ে-বসে কাটিয়েছেন। অথচ তারাই সরকারের সবচেয়ে বেশি সুবিধাভোগী শ্রেণী। সরকার তাদের সর্বোচ্চ সুবিধা দিয়েছে দেশ ও জনগণের কল্যাণে, যাতে তারা সবার আগে ঝাপিয়ে পড়তে পারে এবং সামনের সারিতে থাকে। অত্যন্ত পরিতাপের বিষয়, দেশের এই ক্রান্তিকালে প্রশাসনের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের এ ভূমিকা পরিলক্ষিত হয়নি। বলার অপেক্ষা রাখে না, করোনার সংকটের মধ্যেও পার্শ্ববর্তী দেশগুলোর তুলনায় আমাদের অর্থনীতি যথেষ্ট ভাল অবস্থায় রয়েছে। প্রবাসী শ্রমিকদের পাঠানো রেমিট্যান্সে রিজার্ভ সর্বকালের সব রেকর্ড ছাড়িয়েছে। রিজার্ভের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৩৭.২৮ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের বেশি। এটা আল্লাহর রহমত ছাড়া কিছু নয়। এখন এ অর্থ যদি অর্থনৈতিক কর্মকান্ডে বিনিয়োগ করা যায়, তবে অর্থনীতি সচল হতে খুব বেশি সময় লাগবে না। ইতোমধ্যে প্রধানমন্ত্রী নির্দেশনা দিয়েছেন, রিজার্ভের এ অর্থ কোথায়, কিভাবে বিনিয়োগ করা যায়, তা পরিকল্পনা প্রণয়নের মাধ্যমে বাস্তবায়ন করতে। আমরা এখনও জানি না, প্রধানমন্ত্রীর এ নির্দেশনা সংশ্লিষ্টরা বাস্তবায়নের কোনো উদ্যোগ নিয়েছে কিনা। তবে ধরে নেয়া যায়, যেভাবে প্রধানমন্ত্রীর প্রণোদনা প্যাকেজের অর্থছাড় কচ্ছপ গতি লাভ করেছে, রিজার্ভের অর্থ বিনিয়োগের বিষয়টি তার চেয়েও বেশি পিছিয়ে রয়েছে। অথচ প্রণোদনার অর্থ যদি দ্রুত ছাড় হতো এবং এর সাথে রিজার্ভের অর্থের বিনিয়োগের বিষয়টি যুক্ত হতো, তবে আমাদের অর্থনীতিকে দাঁড় করাতে খুব বেশি সময় লাগার কথা নয়। অর্থনীতিকে সচল করতে দেশি-বিদেশি বিনিয়োগের বিষয়েও প্রধানমন্ত্রী দিক নির্দেশনা দিয়েছেন। বিদেশি বিনিয়োগ বৃদ্ধিতে তিনি বিনিয়োগকারীদের লাভের অর্থ নিজ দেশে নিয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে ব্যাংকিং সুবিধা সহজ করার নির্দেশ দিয়েছেন। এছাড়া অন্যান্য যেসব সুবিধা দেয়া প্রয়োজন, তার সব দেয়ার ঘোষণা দিয়েছেন। এখন প্রধানমন্ত্রীর এসব নির্দেশনা এবং উদ্যোগ বাস্তবায়ণ করার দায়িত্ব যাদের, তারা যদি কুম্ভকর্ণের মতো ঘুমিয়ে থাকেন, কিংবা করব, করছি নীতি অবলম্বন করেন, তাহলে অর্থনীতির চাকা সচল করা দূরে থাক বিদ্যমান যে অর্থনীতি রয়েছে, তাও ধরে রখা অসম্ভব হয়ে পড়বে। বলা বাহুল্য, অর্থনীতিকে সচল করতে দেশি-বিদেশি বিনিয়োগের বিকল্প নেই। দেখা যাচ্ছে, আমাদের দেশে বিদেশি অনেক বিনিয়োগকারীর আগ্রহ থাকলেও, যখন তারা বিনিয়োগের নানা প্যাঁচগোছ ও আমলাতান্ত্রিক জটিলতা দেখেন, তখন আগ্রহ হারিয়ে অন্য দেশে চলে যান। যেখানে প্রধানমন্ত্রী নির্দেশ দিয়েছেন বিনিয়োগকারীরা যাতে সহজে বিনিয়োগ করতে পারে এবং কোনো ধরনের সমস্যার মুখোমুখি না হন, সেখানে দেখা যাচ্ছে, সেই পুরণো জটিলতাগুলো রয়েই গেছে। আমলাতান্ত্রিক, ভ্যাট ও করনীতি, কারখানা স্থাপনের ক্ষেত্রে জমি বরাদ্দ পাওয়ার মতো জটিলতাগুলো রয়েই গেছে। এতসব ঝক্কি-ঝামেলা পেরোতে গিয়ে একজন বিনিয়োগকারীকে নাজেহাল অবস্থার মধ্যে পড়তে হয়। ফলে অর্থ বিনিয়োগ করে এত ঝামেলায় কেন তার জড়াবেন? এই যে চীন থেকে ৮৭টি জাপানি কোম্পানি সরে গিয়ে থাইল্যান্ড, ভিয়েতনাম, মিয়ানমার, মালয়েশিয়া ও লাওসে গেলেও বাংলাদেশে একটিও আসেনি। এর কারণ হচ্ছে, জাপানের এসব কোম্পানি ভাল করেই জানে, বাংলাদেশে কারখানা স্থাপন করতে গেলে কত ঘাটে দৌড়াদৌড়ি করতে হয়। তাদের তো এত সময় নেই। ফলে উল্লেখিত দেশগুলোর বিনিয়োগ নীতি সহজ হওয়ায় তারা সেখানে চলে গেছে। অথচ এসব কোম্পানির মধ্যে এক-দুটিও যদি বাংলাদেশে আনা যেত, তবে অর্থনীতির এই দুঃসময়ে কতই না কাজে দিত।
চার.
দেশে এখন বন্যা যে ভয়াবহ তান্ডব চালাচ্ছে, তা অর্থনীতির জন্য অশনিসংকেত। প্রায় প্রতিদিনই পত্র-পত্রিকার প্রতিবেদনে বন্যার ভয়াবহ চিত্র উঠে আসছে। ফসলি জমিসহ বিভিন্ন স্থাপনা তলিয়ে যাওয়া তো রয়েছেই, সাথে ভাঙনের যে তীব্রতা দেখা দিয়েছে, তাতে ভূমি বিলীন হয়ে যাচ্ছে। পানি উন্নয়ন বোর্ডের তথ্যমতেই উত্তরাঞ্চলের রংপুরসহ ৩৩টি জেলায় ইতোমধ্যে ৩ হাজার ৭৪৫ হেক্টর ভূমি নদীগর্ভে বিলীন হয়েছে। কৃষি বিভাগের হিসাবে বৃহত্তর ফরিদপুরে নদীভাঙ্গনে ১৩০ হেক্টর ফসলি জমি বিলীন হয়েছে। রংপুর বিভাগে চিরতরে বসবাটি হারিয়ে উদ্বাস্তুতে পরিণত হয়েছে ২৩ হাজার ৩৫১ মানুষ। বলা হচ্ছে, ভাদ্র মাসের মাঝামাঝি বন্যা হলে তা দীর্ঘস্থায়ী হবে। এর অর্থ হচ্ছে, ক্ষতির পরিমাণ আরও বাড়বে। তাহলে করণীয় কি? এর জবাব হচ্ছে, পানি উন্নয়ন বোর্ড, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয় এবং কৃষি মন্ত্রণালয়কে এজন্য আগাম প্রস্তুতি নিতে হবে। এক্ষেত্রে দুযোর্গ মোকাবেলায় সরকারের সর্বোচ্চ সুবিধাভোগী প্রশাসনের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সক্রিয় হতে হবে। কারণ, তাদের এ সুবিধা দেয়া হয়েছে, যাতে দেশের মানুষ তাদের কাছ থেকে সর্বোচ্চ সেবা পায়। এখন তাদের এ সুবিধার সেবা মানুষকে দিতে হবে। দেশের অর্থনীতিকে সচল করতে তাদেরকে সামনের সারিতে থেকে কাজ করতে হবে। মানুষের সেবায় নিয়োজিত হতে হবে। দেশের বিনিয়োগের পরিবেশকে যেমন দ্রুততার সাথে সহজ করতে হবে, তেমনি বন্যায় ক্ষতিগ্রস্থ এলাকার সংস্কার এবং মানুষের পুনর্বাসনে কাজ করতে হবে। বন্যার পানি নেমে যাওয়ার সাথে সাথে ক্ষতিগ্রস্থ এলাকার সংস্কার, বাঁধ নির্মাণ থেকে শুরু করে কৃষক যাতে দ্রুত কৃষিকাজে নিয়োজিত হতে পারে, এ পদক্ষেপ নিতে হবে। এই পুনর্বাসন এবং সংস্কার করতে গিয়ে বেকার হয়ে পড়া মানুষের যেমন কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা হবে, তেমনি অর্থনীতির চাকাও সচল হবে। এ কথা মনে রাখতে হবে, এখন আর করোনার ভয়ে বসে থাকার সময় নেই। একে সঙ্গী করেই এগিয়ে যেতে হবে। আশা করা যায়, দ্রুতই করোনার কার্যকর ভ্যাকসিন চলে আসবে। তবে সে পর্যন্ত অপেক্ষায় না থেকে এখন থেকেই অর্থনীতির সব খাতকে সচল করতে কার্যকর উদ্যোগ নিতে হবে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ইতোমধ্যে যেসব প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণা করেছেন, সেগুলোর দ্রুত বাস্তাবায়নের পদক্ষেপ নিতে হবে। এ কাজটিও যদি অনতিবিলম্বে করা যায়, তবে অর্থনীতির চাকাটি ধীরে ধীরে সচল হয়ে দ্রুত গতি লাভ করবে। সরকারের মন্ত্রী, এমপি থেকে শুরু করে প্রশাসনের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের এখন অর্থনীতি পুনর্গঠনে ঝাপিয়ে পড়তে হবে।
[email protected]



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: অর্থনৈতিক-মহামন্দাবস্থা
আরও পড়ুন