পবিত্র লাইলাতুল বরাত
আজ দিবাগত রাত পবিত্র লাইলাতুল বরাত। পরম করুণাময় আল্লাহতায়ালা তার বান্দাদের গুনাহ মাফ, বিপদমুক্তি ও
পর্যটন শহর কক্সবাজারের মেরিনড্রাইভ সড়কে পুলিশ চেকপোস্টে পরিকল্পিত হত্যাকান্ডের শিকার হয়েছেন অবসরপ্রাপ্ত তরুণ সেনা কর্মকর্তা সিনহা মোহাম্মদ রাশেদ খান। উল্লেখ্য মেরিন ড্রাইভ সড়কে পুলিশ ছাড়াও বিজিবি ও সেনাবাহিনীর তল্লাশি চৌকিও আছে। সেনা কর্মকর্তা সিনহার গাড়িটি এসব চেকপোস্ট পেরিয়ে পুলিশের চেকপোস্টে গিয়ে নির্মম হত্যাকান্ডের শিকার হলেন কেন? এমন প্রশ্নে আবারো দেশের পুলিশ বাহিনীকে দেশের নাগরিক সমাজের কাঠগড়ায় দাঁড়াতে হচ্ছে। যদিও পুলিশ বাহিনী এবং সেনাবাহিনীর সর্বোচ্চ কমান্ডের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, সিনহা হত্যার দায় বিশেষ ব্যক্তি বা ব্যক্তিবর্গের। কোনো বাহিনীর নয়। এবং এই ঘটনায় দেশের প্রধান দুই বাহিনীর মধ্যকার স্বাভাবিক সম্পর্ক ও সম্প্রীতি নষ্ট হবে না। পুলিশ বাহিনী রাষ্ট্রের একটি অপরিহার্য প্রতিষ্ঠান। রাষ্ট্র যেমন নাগরিক সমাজের একটি রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান, তেমনি পুলিশ বাহিনীও রাষ্ট্র ও নাগরিক সমাজের মধ্যে একটি নিবিড় সেতুবন্ধন। রাষ্ট্রীয় আইন ও নাগরিক সমাজের সাংবিধানিক অধিকার রক্ষা করে বলেই পুলিশ ও তার সহযোগী বাহিনীগুলোকে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী বলে অভিহিত করা হয়। বিশ্বের উন্নত ও সভ্য জাতি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত দেশগুলোতে পুলিশ বাহিনী ইতিমধ্যে জনবান্ধব বাহিনী হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। রাস্তায় ট্রাফিক শৃঙ্খলা থেকে শুরু করে কমিউনিটি শৃঙ্খলা এবং যে কোনো পারিবারিক সামাজিক ও ব্যক্তিগত সমস্যার জন্য পুলিশের হেল্পলাইন হয়ে উঠেছে নাগরিক সমাজের অন্যতম অবলম্বন। অপরাধ দমনের পাশপাশি অসুস্থ্য রোগীকে হাসপাতালে পৌঁছে দেয়া বা দুর্যোগ কালে মানুষের পাশে দাঁড়িয়ে সামাজিক দায়িত্বও পালন করে থাকে পুলিশ। বৈশ্বিক সমস্যাগুলো যেমন সব দেশের সব নাগরিককেই কমবেশি আক্রান্ত করছে, একইভাবে তথ্যপ্রযুক্তি ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের সুবাদে বৈশ্বিক সামাজিক-রাজনৈতিক প্রবণতা ও প্রক্রিয়াগুলোও সব দেশের সমাজকে কমবেশি প্রভাবিত করে চলেছে। পুলিশ হেল্পলাইন এখন আমাদের দেশেও চালু হয়েছে। প্রতিদিন অসংখ্য মানুষ ট্রিপল নাইন, ট্রিপল থ্রি বা কোভিড-নাইনটিন হেল্পলাইন থেকে উপকৃত হচ্ছে। তবে আমাদের আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর একশ্রেণীর সদস্য বেআইনী, বেপরোয়া কর্মকান্ড থেকেও বেরিয়ে আসতে পারছে না। নানা ধরনের অপরাধ-দুর্নীতির দায়ে প্রতি বছর হাজার হাজার পুলিশ সদস্য বিভাগীয় শাস্তির সম্মুখীন হওয়ার পরও এ অপরাধ প্রবণতা কমছে না। আইনগত সুরক্ষা কবচ ব্যবহার করে এক শ্রেণীর পুলিশ সদস্য গুরুতর অপরাধে জড়িয়ে পড়লেও তাদের বিরুদ্ধে বিভাগীয় শাস্তির নামে লঘুদন্ডের কারণেই পুলিশের অপরাধপ্রবণতা কমছে না বলে দেশের অপরাধ বিশেষজ্ঞরা মনে করেন।
পুলিশের এক শ্রেণীর সদস্যের মধ্যে অপরাধ প্রবণতা কোনো নতুন বিষয় নয়। ঔপনিবেশিক আমলে প্রণীত পুলিশ আইনেই অনেক ক্ষেত্রে পুলিশকে দায়মুক্তি দেয়া হয়েছিল। ১৮৬১ সালের পুলিশ অধ্যাদেশ প্রণীত হয়েছিল বৃটিশ ঔপনিবেশিক শাসনের বিরুদ্ধে ক্ষেপে ওঠা স্বাধীনতা ও গণতন্ত্রকামি ভারতীয়দের দমনের উদ্দেশ্যে। এটি কোনো স্বাধীন-গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের পুলিশ বাহিনী ছিল না। অন্য মহাদেশের, অন্য ধর্মাবলম্বী একটি ক্ষুদ্র জাতি বিশাল ভারতকে শাসন করতে গিয়ে পুলিশ বাহিনীকে যথেচ্ছ শক্তি প্রয়োগের সুযোগ করে দিয়েছিল। দীর্ঘদিনের অনেক সংগ্রাম, ত্যাগ-তিতিক্ষার বিনিময়ে অবশেষে এ উপমহাদেশ ঔপনিবেশিক শাসনের নিগড় থেকে মুক্ত হয়ে রাজনৈতিক বিবর্তনের মধ্য দিয়ে বেশ কয়েকটি স্বাধীন রাষ্ট্রের জন্ম হলেও স্বাধীন দেশের নাগরিক হিসেবে আমরা ঔপনিবেশিক আমলের আইনী কাঠামো থেকে বের হতে পারিনি। তখন বৃটিশরা নিজেদের ক্ষমতা টিকিয়ে রাখতে পুলিশের আইন ও অস্ত্রকে ব্যবহার করেছে। স্বাধীনতা পরবর্তী সময় থেকে দেশের শাসকশ্রেণী রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে দমন করে নিজেদের কায়েমি রাজনৈতিক স্বার্থ সুরক্ষিত রাখতে পুলিশের পুরনো আইনের উপর নির্ভরশীল হওয়ায় এ দেশের সাধারণ মানুষ সত্যিকার অর্থে স্বাধীন রাষ্ট্রের আইনগত সুরক্ষা ও পুলিশি নিরাপত্তার স্বাদ কখনো পায়নি। এখনো দেশের মানুষের মধ্যে পুলিশ বাহিনীর প্রতি ভীতি, বিদ্বেষ ও অনাস্থা কাজ করছে। এখনো এ দেশের মানুষকে শুনতে হচ্ছে, ‘দেশের রাজা পুলিশ’ পুলিশের গ্রেফতার বাণিজ্য, বিচার বহির্ভুত হত্যাকান্ড, ক্রসফায়ার ইত্যাদি শব্দগুলোর সাথে জড়িয়ে আছে দেশের রাজনৈতিক ক্ষমতার দ্ব›দ্ব এবং গণতান্ত্রিক দাবী দামিয়ে রাখার ইতিহাস। অতএব পুলিশ বাহিনীর সদস্যদের গুরুতর অপরাধে অভিযুক্ত ব্যক্তিবর্গের যেমন দায় রয়েছে, তেমনি দায় রয়েছে দেশের সরকার ও রাজনৈতিক ব্যবস্থার। পুলিশ বাহিনী নিজেই নিজের আইন প্রণয়ন করেনি। নিজের অস্তিত্বের প্রয়োজনে জনগণের উপর স্টিম রোলার চালায়নি। বৃটিশ ঔপনিবেশিক কাল থেকে এখন পর্যন্ত রাজনৈতিক সরকার নিজের প্রয়োজনে পুলিশের আইন তৈরী করেছে এবং সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতা অগ্রহ্য করে পুলিশকে ক্ষমতা প্রয়োগের হুকুম জারি করেছে। এক শ্রেণীর পুলিশ সদস্য রাজনৈতিক যোগসাজশে ক্ষমতার সেই খেলাকে নিজের স্বার্থ সিদ্ধির হাতিয়ারে পরিণত করার মধ্য দিয়ে পুরো বাহিনীকে জনগণের আস্থার সংকটে ঠেলে দিয়েছে।
পুলিশ বাহিনীর সদস্যরা সমাজেরই মানুষ। রাজনৈতিক দুর্বৃত্তায়ণ এবং প্রশাসনিক দুর্নীতির কবলে পড়ে লাখ লাখ টাকা ঘুষ দিয়ে চাকরি, পদায়ন, বদলির যে সংস্কৃতি চালু হয়েছিল তা প্রকারান্তরে পুলিশকে ঘুষ-চাঁদাবাজি ও মিথ্যা মামলার মত অনৈতিক কাজে বাধ্য করেছে। ক্ষমতাসীনরা পুলিশকে রাজনৈতিক ক্ষমতার লাঠিয়াল হিসেবে ব্যবহার করার কারণে এক শ্রেণীর পুলিশ সদস্য পেশাদারিত্ব ও আইনগত বাধ্যবাধকতার তোয়াক্কা না করে রাজনৈতিক তকমা ব্যবহার করে অগাধ সম্পদের মালিক বনে যাওয়ার প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হয়েছে। ওসি প্রদীপ কুমার দাশ কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। তার আগেও অনেক পুলিশ কর্মকর্তার শত শত কোটি টাকার সম্পদের হদিস পাওয়ার খবর গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে। ভারতের বিভিন্ন শহরে ওসি প্রদীপের বেশ কয়েকটা বাড়ি ও সম্পদের সন্ধান ইতিমধ্যেই পাওয়া গেছে। আমাদের পুলিশ বাহিনীর কোনো কোনো কর্মকর্তা ইউরোপ-আমেরিকায় অর্থ পাচার ও কোটি কোটি টাকার ব্যাংক ব্যালেন্সের তথ্যও ইতিপূর্বে প্রকাশিত হয়েছে। পুলিশ বাহিনীকে স্বচ্ছ, দুর্নীতিমুক্ত এবং জনবান্ধব হিসেবে গড়ে তুলতে হলে প্রথমেই পুলিশকে রাজনৈতিক ঠেঙ্গাড়ে বাহিনী হিসেবে ব্যবহারের সুযোগ বন্ধ করতে হবে। সেই সাথে পুলিশ বাহিনীতে নিয়োগ, বদলি ও পদায়ন ঘুষ-দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতি ও দলীয় রাজনীতির প্রভাবমুক্ত করার পাশাপাশি অপরাধী পুলিশের বিভাগীয় ও আইনগত শাস্তির বিধান আরো কঠোর ও সময়োপযোগী করতে হবে। অবৈধ চাঁদাবাজি বা মাদক চোরাচালানের দায়ে অভিযুক্ত সাধারণ নাগরিকের যে শাস্তির বিধান আছে, বৈধ অস্ত্রধারি হওয়ায় পুলিশের বিরুদ্ধে এ ধরণের অভিযোগের শাস্তি আরো কঠোর হওয়া প্রয়োজন। মানুষকে জিম্মি করে কোটি কোটি টাকার মালিক হওয়ার পর কদাচিৎ দু’একজন পুলিশ সদস্য ধরা পড়লে বিভাগীয় শাস্তি হিসেবে তিরস্কার, প্রত্যাহার বা পদন্নোতি স্থগিত করার মত লঘু দন্ড তারা তেমন পরোয়া করছে না বলেই বছরে ১০-১২ হাজার পুলিশ সদস্য বিভাগীয় শাস্তির সম্মুখীন হওয়ার পরও তাদের অপরাধ প্রবণতা কমছে না।
পুলিশকে জনবান্ধব হিসেবে গড়ে তোলার বিষয়টা মূলত রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত ও কমিটমেন্টের ব্যাপার। বৃটিশ ঔপনিবেশিক শাসনের উত্তরাধিকার বহনের পরও শুধুমাত্র গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক মূল্যবোধের কারণে আমেরিকার পুলিশ বাহিনী জনবান্ধব বাহিনী হয়ে উঠতে পেরেছিল। তবে আমাদের দেশে যেমন পুলিশকে রাজনৈতিক ক্ষমতা টিকিয়ে রাখার জন্য লাঠিয়াল হিসেবে ব্যবহারের অপসংস্কৃতি চালু রয়েছে। একইভাবে আমেরিকায়ও পুলিশের বর্ণবাদী আচরণ ও চেতনা ঔপনিবেশিক সূত্রে পাওয়া। তবে পার্থক্য হচ্ছে, আমেরিকায় পুলিশের অপকর্মের বিরুদ্ধে বিরুদ্ধে জনগণ রাস্তায় নেমে প্রতিবাদ করতে পারে। প্রতিবাদ কখনো কখনো ক্ষমতাসীন প্রেসিডেন্টের জন্য বিপদ সংকেত হয়ে দেখা দেয়। এমনকি প্রতিবাদী জনতার সাথে স্থানীয় পুলিশ সদস্যদের একাত্মতা প্রকাশের নজিরও দেখা যায়। কোভিড-১৯ মহামারীতে আমেরিকায় যখন প্রতিদিন হাজার হাজার মানুষ মারা যাচ্ছে, লকডাউনে সবকিছু অচল হয়ে মানুষ ঘরবন্দী জীবন কাটাচ্ছে, তখন বর্ণবাদী পুলিশের হাতে একজন কৃষ্ণাঙ্গ মার্কিনীর মৃত্যুর ঘটনায় পুরো আমেরিকায় প্রতিবাদের আগুন জ্বলে উঠেছিল। সে আগুনের রেশ এখনো নিভে যায়নি। গত ২২ মে মিনেসোটার মেনিয়াপোলিসে পুলিশের হাতে জর্জ ফ্লয়েডের মৃত্যুর পর গত ৩ মাসে মার্কিন সমাজের অনেক কিছুই বদলে যেতে শুরু করেছে। বিভিন্ন রাজ্যে এবং ফেডারেল সরকারের পুলিশ আইনে বেশ কিছু পরিবর্তনের সিদ্ধান্ত এসেছে। জর্জ ফ্লয়েডের সাথে পুলিশের বাক-বিতন্ডা হয়েছিল। তার কাছে ২০ ডলারের নকল নোট পাওয়ার কথাও শোনা গেছে। কিন্তু অবসরে যাওয়া একজন তরুণ সেনা কর্মকর্তা যিনি ক্রিয়েটিভ ডকুমেন্টারি বানানোর কাজে কক্সবাজারে অবস্থান করছিলেন তার সাথে স্থানীয় পুলিশের বৈরীতার কারণ কি ছিল, তা এখন তদন্তের বিষয়। এসআই লিয়াকতের গুলিতে মাটিতে লুটিয়ে পড়ার পর তাকে দ্রæত হাসপাতালে নেয়ার ব্যবস্থা না করে কালক্ষেপণ এবং ওসি প্রদীপের লাথি এবং নিজের পিস্তল দিয়ে আরো দু’টি গুলি করার যে তথ্য পাওয়া যাচ্ছে, তাতে বোঝাই যাচ্ছে মেজর সিনহা ডেলিবারেট কিলিংয়ের শিকার হয়েছেন। তবে পুলিশের এমন নির্মম হত্যাকান্ডের পরও বাংলাদেশের সমাজে-রাজনীতিতে তেমন কোনো প্রতিবাদী চেহারা দেখা যায়নি। যে ধরনের প্রতিবাদের কারণে পুলিশের আচরণ এবং পুলিশি আইন পরিবর্তনে সরকারকে বাধ্য করতে পারে, যেটা জর্জ ফ্লয়েড হত্যার পর আমেরিকায় ঘটেছে।
বাংলাদেশে কোনো বর্ণবাদ নেই। রাজনৈতিক বা প্রশাসনিকভাবে ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের সংখ্যাগরিষ্ঠের বৈষম্যমূলক আচরণ বা আইন নেই। একজন ওসি প্রদীপ কুমার দাশের ধর্মীয় পরিচয় কোনো বড় বিষয় নয়। তবে তার সাথে প্রতিবেশী দেশ ভারতের যোগসূত্র, দ্বৈত নাগরিকত্ব, বাংলাদেশের চাকরি করে আগরতলা, শিলিগুঁড়ি ও আসাম-কলকতায় সম্পদের পাহাড় গড়ার যে কাহিনী পাওয়া যাচ্ছে, তা উদ্বেগের বিষয়। বিশ্বের দীর্ঘতম সমুদ্রসৈকতের পর্যটন শহর কক্সবাজারের সবচেয়ে নয়নাভিরাম স্পট ইনানি বিচ, মেরিন ড্রাইভ সড়কটিকে ভীতিকর মৃত্যুর উপত্যকায় পরিণত করার পাশাপাশি কক্সবাজারের পর্যটনশিল্পের সম্ভাবনাকে নস্যাৎ করা এবং ক্রসফায়ারের ভয় দেখিয়ে কোটি কোটি টাকা চাঁদাবাজি ও মুক্তিপণ আদায় করে টাকা বিদেশে পাচার করার মিশন নিয়ে কি কাজ করছিল ওসি প্রদীপ, লিয়াকত-নন্দদুলালরা? জনমনে এখন এই প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে।
প্রদীপ কুমার দাশ টেকনাফ থানার ওসি হিসেবে যোগ দেয়ার পর গত দুই বছরে কক্সবাজার-টেকনাফ মেরিনড্রাইভ সড়কে অন্তত ২০০ মানুষকে হত্যা করা হয়েছে বলে স্থানীয়রা জানিয়েছেন। অর্থাৎ সিনহা মোহাম্মদ রাশেদ খানকে হত্যার আগে আরো প্রায় দু’শ লোককে একই কায়দায় হত্যা করা হয়েছিল। সিনহা মোহাম্মদ রাশেদ খান একজন তরুণ চৌকষ সেনা কর্মকর্তা ছিলেন। সেনাবাহিনীতে যারা যোগ দেন তারা সারাজীবন দেশের নিরাপত্তার স্বার্থে কাজ করার অঙ্গিকারাবদ্ধ থাকেন। যে ডকুমেন্টারি বনানোর কাজে মেজর (অব:) সিনহা দীর্ঘদিন ধরে কক্সবাজারে অবস্থান করছিলেন, সে ডক্যুমেন্টারির মূল উপজীব্য মেরিন ড্রাইভ সড়কে ক্রসফায়ারে হত্যাকান্ডের ঘটনাবলী। দুর্দান্ত বেপরোয়া পুলিশ অফিসার ও তার সহযোগিদের হাতে একের পর এক হত্যাকান্ডের ঘটনা নিয়ে প্রামান্যচিত্র নির্মানের মধ্য দিয়ে কি ওসি প্রদীপ কুমার দাশের মুখোশ উন্মোচন হতে চলেছিল? বেশ কয়েক সপ্তাহ ধরে চলা শুটিংয়ে ক্রসফায়ারে নিহত স্থানীয় ভিকটিম পরিবার ও প্রত্যক্ষদর্শী অনেকের সাক্ষাৎকার নেয়ার পর নিহত হওয়ার আগে ওসি প্রদীপ কুমারের সাক্ষাৎকার গ্রহণ করার কথা ছিল। সে সাক্ষাৎকারটি নেয়া হয়েছিল কিনা তা এখনো পরিষ্কার নয়। পুলিশের করা মাদক ও অস্ত্র মামলার আসামি, মেজর (অব:) সিনহার সহযোগী সিফাত ও শিপ্রা জামিনে বেরিয়ে আসার পর তা অনেকটা পরিস্কার হয়ে যাবে বলে আশা করছেন সংশ্লিষ্টরা। তবে পুলিশের মামলায় জব্দ তালিকায় মেজর সিনহার গাড়িতে থাকা ল্যাপটপ, ক্যামেরা এবং কম্পিউটার হার্ডডিস্কের কোন উল্লেখ না থাকার ঘটনায় সন্দেহের মাত্রা বাড়িয়েছে। ইতিমধ্যে মামলাগুলো তদন্তের ভার এলিট ফোর্স র্যাবের উপর অর্পিত হওয়ায় সিনহার সংগৃহীত তথ্য এবং হত্যা রহস্য সহসাই উন্মোচিত হওয়ার জনপ্রত্যাশা অনেক বেড়ে গেছে। এখানে সরকারের রাজনৈতিক সদিচ্ছা না থাকলে সিনহা হত্যা মামলাও হয়তো সাগর রুনী হত্যা মামলার ভাগ্য বরণ করতে পারে। সাংবাদিক দম্পতি সাগর সারওয়ার ও মেহেরুন রুনিকে নিজ ফ্লাটে কুপিয়ে ও শ্বাসরোধ করে হত্যা করার পর বাসার আর কিছু লুণ্ঠিত না হলেও তাদের ল্যাপটপটি শুধু গায়েব হয়ে যায়। সেই ল্যাপটপের গুরুত্বপূর্ণ তথ্যগুলো ফাঁস হলে অনেক রাঘব বোয়ালের দুর্নীতির মুখোশ উন্মোচিত হয়ে পড়ত বলেই কি সাগর-রুনি নির্মম হত্যাকান্ডের শিকার হয়েছিলেন? সিনহা মোহাম্মদ রাশেদ খান হত্যার মোটিফও তার ক্যামেরা, ল্যাপটপ এবং কম্পিউটার হার্ডডিস্কেই পাওয়া যেতে পারে।
দেশের প্রধান পর্যটন শহরের নয়নাভিরাম সমুদ্র সৈকতের মেরিনড্রাইভকে মৃত্যুপুরিতে পরিণত করার রোমহর্ষক ঘটনাবলীর প্রামান্য তথ্যাবলী তুলে আনার মধ্য দিয়ে শত খুনের খলনায়কদের বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড় করানোর অসম সাহসী কাজের মাঝপথে নিজেই পুলিশি হত্যাকান্ডের শিকার হলেন মেজর (অব.) সিনহা। তবে এই হত্যাকান্ডের মধ্য দিয়ে খুনি অপরাধিরা নিজেদের সিরিয়াল কিলিংয়ের তথ্য ধামাচাপা দেয়ার ব্যর্থচেষ্টা করে আরো বড় ধরনের বিপদ ডেকে এনেছেন। সিনহা হত্যাকান্ডেরর পর সেনাপ্রধান এবং পুলিশ প্রধান কক্সবাজারে ছুটে গেছেন। তারা দু’জন যৌথ সংবাদ সম্মেলনে বলেছেন, হত্যাকান্ডের দায় ব্যক্তি বা ব্যক্তিবর্গের। কোনো বাহিনীর নয়। আমরাও তাই মনে করি। তবে মেজর (অব.) সিনহার হত্যাকান্ডের মধ্য দিয়ে প্রমানীত হয়েছে ওসি প্রদীপ কুমার দাস ও তার সাঙ্গ-পাঙ্গরা কতটা বেপরোয়া দানবীয় শক্তিতে পরিণত হয়েছিল। দেশ ও জাতির স্বার্থে সেই দানবীয় শক্তির মুখোশ উন্মোচন করতে গিয়ে মেজর (অব.) সিনহা পরিকল্পিত হত্যাকান্ডের শিকার হলেন। এই ঘটনায় নাগরিক সমাজ এবং সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সাধারণ মানুষের যে তীব্র প্রতিক্রিয়া দেখা গেছে, তাতে পুলিশ বাহিনীর আচরণ ও আইনগত পরিবর্তনের দাবি উঠে এসেছে। সিনহার হত্যার পর দেশের সংক্ষুব্ধ মানুষ যে পরিবর্তনের দাবি তুলে ধরেছেন তা যেন ব্যর্থ হয়ে না যায়। বিশেষত: শাসক শ্রেণীর রাজনৈতিক স্বার্থে দেড়শ’ বছরের পুরনো পুলিশ আইনের যে সব ধারা পুলিশকে জনগণের উপর বেপরোয়া ক্ষমতা প্রয়োগের সুযোগ দিচ্ছে, সেসব আইন বাতিল না করলে পুলিশকে জনবান্ধব করে তোলা অসম্ভব। পুলিশের বর্তমান মহাপরিদর্শক বেনজির আহমেদ পুলিশের চাকুরী ও বদলি প্রক্রিয়াকে ঘুষ-দুর্নীতিমুক্ত করার প্রত্যয় ব্যক্ত করেছেন। পুলিশের পক্ষ থেকে এটা সদিচ্ছার ইঙ্গিত বহন করছে। অপরাধী পুলিশের কঠোর শাস্তির বিধানসহ ১৮৬১ সালের পুলিশ আইন পরিবর্তনের সময়োপযোগী উদ্যোগ সরকার এবং জাতীয় সংসদকে গ্রহণ করতে হবে। লাখো প্রাণের বিনিময়ে অর্জিত স্বাধীন দেশে ঔপনিবেশিক আমলের পুলিশ আইন চলতে পারে না।
[email protected]
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।