Inqilab Logo

রোববার ১৭ নভেম্বর ২০২৪, ০২ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ১৪ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

রক্তপাথার সাঁতারি আবার আসে মুসলিম জাহানে দিন

রূহুল আমীন খান | প্রকাশের সময় : ৭ আগস্ট, ২০২০, ১২:০৩ এএম

২০২০ সালের ২৪ জুলাই শুক্রবার দিনটি তুরস্ক প্রজাতন্ত্রের ইতিহাসে সোনালী হরফে লেখা থাকবে। বিশ্ব মুসলিমের হৃদয়েও এ দিনটির স্মৃতি জাগ্রত থাকবে বহুদিন। কর্ণে গুঞ্জরিত হবে সহস্র সহস্র আবেগাপ্লুত, হর্ষোৎফুল্ল, ইসলামপ্রিয় তুর্কি জনতার স্বতঃস্ফুর্ত ‘আল্লাহ আকবার’ তকবীর ধ্বনি। টিভির পর্দায় ভেসে উঠছিল বসফরাসের সুনীল জলরাশি, তীরভূমিতে লীলায়িত বৃক্ষরাজির নয়নাভিরাম গাড় সবুজ শ্যামল পত্র পল্লব। সম্মুখে অনন্য সৌন্দর্য্য ও বৈশিষ্টের কালজয়ী স্থাপত্য আয়াসুফিয়া (হাগিয়া সুফিয়া : হায়া সুফিয়া)। তার চত্তরে, চারপাশে, সড়কে, অলিতে গলিতে উল্লাস মুখর জনতার ভীড়। কিছুক্ষণের মধ্যে এ মসজিদে অনুষ্ঠিত হবে সালাতুল জুম্আ। চলছে কুরআন খতম। সবার মধ্যে বসে আছেন প্রেসিডেন্ট রিসেপ তায়েব এরদোগান। মাইক তুলে দেয়া হলো তাঁর হতে।(কুরআন খতমের নিয়ম অনুযায়ী) সর্বশেষে সুরা ফাতিহা ও সুরা বাকারার প্রথম রুকু তিলাওয়াত করলেন তিনি, তারতীলের সাথে, বিশুদ্বভাবে, সুললিত কন্ঠে। মসজিদের ৪মিনার থেকে ভেসে আসল আজানের ধ্বনি। এরপর খতীব সাহেব কনষ্টান্টিনোপলের (ইস্তাম্বুল) গুরুত্ব এর বিজয়ের ইতিহাস, আয়া সুফিয়ার ইতিহাস তুলে ধরে বক্তব্য রাখলেন বলিষ্ঠ ভাষায়। শুরু হল নামাজ। খতীব সাহেব প্রথম রাকাতে সুরা ফাতিহার পর সুরা ফাতহের প্রথম তিন আয়াত তিলাওয়াত করলেন, যার অর্থ “নিশ্চয়ই আমি তোমাদেরকে দিয়েছি সুস্পষ্ট বিজয় যাতে আল্লাহ তোমার অতীত ও ভবিষ্যৎ ক্রুটিসমুহ মার্জনা করেন এবং তোমার প্রতি তাঁর অনুগ্রহ পূর্ণ করেন ও তোমাকে সরল পথে পরিচালিত করেন এবং আল্লাহ তোমাকে বলিষ্ঠ সাহায্য দান করেন”। (৪৮:১,২,৩) দ্বিতীয় রাকাতে সুরা ফাতিহার পরে ঐ সুরারই শেষের দিকের আয়াত পাঠ করলেন। যার অর্থ- “নিশ্চয়ই তাঁর রাসূলের স্বপ্ন বাস্তবায়িত করেছেন। আল্লাহর ইচ্ছায় তোমরা মসজিদুল হারামে প্রবেশ করবে, কেউ মস্তক মুন্ডন করবে, কেউ কেশ কর্তন করবে। তোমাদের কোন ভয় থাকবেনা। আল্লাহ যা জানেন তোমরা তা’ জাননা। এ ছাড়াও তোমাদের দিয়েছেন সদ্য বিজয়। (৪৮:২৭)

এসব আয়াতে যে বিজয়ের সুসংবাদ দেওয়া হয়েছে তা মূলতঃ মক্কা বিজয় ও খায়বার বিজয় সম্পর্কে। তা বাস্তবায়িত হয়েছে নবীজীর জীবদ্দশায়, আয়াত নাযিলের কিছুদিনের মধ্যেই। তবে তিনি নিশ্চিতভাবে কনষ্টান্টিনোপল (ইস্তাম্বুল) বিজয়, কাইজারের (বাইজেন্টাইন সম্রাট) পতন, এই সাম্রাজ্য ধ্বংস হওয়া এবং অতঃপর আর কোন কাইজার না হওয়ার ভবিষ্যৎ বানীও করে গেছেন। সুসংবাদ দিয়ে গেছেন এর বিজয়াভিযানে অংশ গ্রহণ কারীদের সম্পর্কেও। সে আলোচনায় আমরা পরে আসছি।

কনষ্টান্টিনোপল এবং হায়াসুফিয়ার ভৌগলিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, ধর্মীয় ও সামাজিক গুরুত্ব অপরিসীম। পৃথিবীতে এমন শহর যার দুই প্রান্তে দুটি মহাদেশ (এশিয়া ও ইউরোপ) কেবলমাত্র একটিই আছে- সেটি হল কনষ্টান্টিনোপল। এক দিকে ভূমধ্যসাগর, অপর দিকে কৃষ্ণসাগর, মাঝখানে আর একটি ছোট সাগর মর্মরা। কৃষ্ণসাগর ও মর্মারা সাগরকে সংযোগকারী প্রনালীর নাম বসফরাস। এরই উভয়তীর ব্যাপী কণষ্টান্টিনোপল। ইটালীর ভ্যাটিকান গির্জা ক্যাথলিক খ্রিষ্টান সম্প্রদায়ের নেতৃত্ব দেয়। তার প্রধান হলেন পোপ। আর পূর্বাঞ্চলীয় অর্থডক্স খ্রিষ্টানদের প্রধান চার্চ ছিল আয়া সুফিয়া। তৃতীয় শতাব্দীতে রোমের প্রথম খ্রিষ্টান সম্রাট কনষ্টানটিন আয়া সুফিয়ার ভিত্তি প্রস্তর স্থাপন করেন। সম্রাট জাষ্টিনিয়ান ৫৩২ খ্রিষ্টাব্দে এ ভিতের উপরে নির্মান করেন স্থাপত্য শিল্পের অপূর্ব নিদর্শন আয়া সুফিয়া। তিনি আনন্দের আতিশয্যে সগর্বে বলেন : ‘ সোলায়মান (আ.) আমি তোমার থেকে এগিয়ে গেছি’। কনষ্টান্টিনোপলের মর্যাদা ও অপরিসীম গুরুত্বের কথা চিন্তা করে ফ্রান্সের প্রখ্যাত নেপুলিয়ান বোনাপার্টও একে জয় করার আশা পোষন করতেন। প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এই কনষ্টান্টিনোপল একদিন মুসলামানের অধিকারে আসবে বলে যে ভবিষ্যৎবানী করেন তা এরূপ : “নিশ্চয় তোমরা কনষ্টান্টিনোপল জয় করবে। তার আমীর হবে উত্তম আমীর এবং সেই বাহিনী হবে উৎকৃষ্ট সেনা বাহিনী”। (মুসনাদে ইমাম আহমাদ)।

তিনি আরও বলেন : “কায়সারের ধ্বংসের পর আর কোন কায়সার (বাইজেন্টাইন সম্রাটের উপাধি) জন্মাবেনা”।
বিশ্বনবী স. এর ভবিষৎবানী অনুযায়ী এই মহাসৌভাগ্যলাভের জন্য মুসলিম খলীফাগন বিভিন্ন সময় একে জয় করার লক্ষ্যে অভিযান চালিয়েছেন। তাদের মধ্যে প্রথম ছিলেন উমাইয়া খলীফা হযরত মুআবিয়া রা.। তিনি যে সেনাবাহিনী প্রেরণ করেন তাদের মধ্যে ছিলেন রাসুলুল্লাহ স. এর মেজবান প্রখ্যাত সাহাবী হযরত আবু আইয়ুব আনসারী রা.। নগর প্রাচীর পর্যন্ত পৌঁছার পূর্বেই তিনি গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়েন। মৃত্যু সজ্জায় তিনি অসিয়ত করে যান ‘আমার মৃত্যুর পরে তোমরা যতদূর পার শত্রু ভূমির ভেতরে নিয়ে যাবে আমার মরদেহ এবং ওখানে দাফন করবে’। এই অসিয়ত মোতাবেক ইন্তেকালের পরে তাঁর মরদেহ কনষ্টান্টিনোপলের দিকে নিয়ে যাওয়া হয় এবং নগর প্রাচীরের কাছে দাফন করা হয়। অভিযানকারীরা নগর বিজয়ে অসমর্থ হয়ে ফিরে আসে। এভাবে আরো কয়েকটি অভিযান ব্যর্থ হয়।

চতুর্দশ শতকে ইতিহাসের রঙমঞ্চে আবির্ভূত হয় উসমানিয়া রাজশক্তি। এর স্থিতিকাল ১৯২৪ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত। ১২৯৯ সালে গাজী উসমান বে আনাতোলিয়ায় প্রতিষ্টা করেন উসমানী রাষ্ট্র। তাদের মধ্যে আবির্ভূত থাকেন অনেক অসম সাহসী আদর্শবান রাষ্ট্রনায়কের। তুর্কিদের একটি সঙ্গীতের কাব্যানুবাদ করেছেন সত্যেন সেন। তার অংশবিশেষ এ রূপ :
ভালোবাসি মোরা অস্ত্রের খেলা
ভালোবাসি মোরা যোদ্ধৃসাজ
তুর্কপুরের তোরণে তোরণে
সিংহ সজাগ করে বিরাজ।
শহীদ হইব মৃত্যু সহিয়া
মর ক্ষেত্রে সঁপিব প্রাণ
তুর্ক আমরা কীর্তির তরে
অকাতরে করি জীবন দান।

দিকে দিকে চলে তাদের সমর অভিযান। ছিনিয়ে আনতে থাকেন বিজয়ের পর বিজয়। অধিকারে আসতে থাকে একের পর এক দেশ। এশিয়া, ইউরোপ, আফ্রিকা- তিন মহাদেশ ব্যাপী প্রতিষ্ঠিত হয় এক সুবিশাল সামাজ্য। তাদের শাসন প্রতিষ্ঠিত হয় মক্কা শরীফে, মদীনা শরীফে- সৌদি আরবে, জার্দান, আরব আমিরাত, ইয়েমেন, ওমান, কুয়েত, কাতার, সিরিয়া, জেরুজালেমে, ইউরোপের গ্রীস, সাইপ্রাস, জর্জিয়া, আর্মেনিয়া, ক্রিমিয়া, বুলগেরিয়া, আলবেনিয়া, কসেভো, যুগোশ্লাভিয়া, বসনিয়া-হার্জেগোভিনা, রুমানিয়া, আফ্রিকার- মিশর, সুদান, তিউনিশিয়া, লিবিয়া, ইরিত্রিয়া, আলজেরিয়া প্রভৃতি দেশে। এর বিস্তৃতি ঘটে ৫২লক্ষ বর্গমাইলে। কিন্তু সকল উত্থানেরই পতন আছে। দার্শনিক কবি আল্লামা ইকবালের ভাষায় :

“ আমি কি বলে দেব তোমাদের জাতিসমূহের উত্থান পতনের নেপথ্য কারণ ? উত্থান কালে দেখবে বীরত্ব, বাহাদুরি, সংগ্রাম সাধনা। আর পতনের কালে দেখবে, ভোগ, বিলাস, সাকি, সুরা, নৃত্য সঙ্গীত, গৃহবিবাদ।”

উসমানিয়া খিলাফত ও সাম্রাজ্যও এর ব্যতিক্রম নয়। উত্থান কালে দেখতে পাই সুলতান সুলাইমান দি গ্রেট, সুলতান ফতেহ মুহাম্মদের (বিজয়ী সুলতান মেহমেত, মুহম্মদ) প্রমুখের মত আদর্শনিষ্ঠ, ন্যায় পরায়ন, অকুতভয়, দূরদর্শী, কুশলী বীর সুলতানদের। আর পতনের সময় অকর্মন্য বিলাসী ২য় আবদুল হামীদের মত সুলতানদের।

সুলতান মুহাম্মদ ফতেহ এর কথাই বলি, তাঁর সমর কৌশল, বীরত্ব, বিচক্ষনতা কিংবদন্তি তুল্য। প্রখ্যাত ইংরেজ ঐতিহাসিক এডওয়ার্ড গীবন ফতেহ মুহাম্মদের পাহাড়ি দুর্গম স্থলের উপর দিয়ে জাহাজ নিয়ে যাওয়ার ব্যাখ্যা খুঁজে না পেয়ে বলেছেন এটা মিরাকল অলৌকিক। বাস্তবিকই এক মহাবিস্ময়ের ব্যাপার। সুলতান যখন দেখলেন স্বাভাবিক পথে অভিযান চালিয়ে জয় করা অসম্ভব এই কনষ্টান্টিনোপল। এর চারপাশে রয়েছে পরপর তিনটি দুর্ভেদ্য প্রাচীর। তাতে ১৭০ ফুট পরপর চৌকি। এক প্রাচীর থেকে অপর প্রাচীরের মাঝখানে ৬০ ফুট চওড়া ১০০ ফুট গভীর পরিখা। মুল বসফরাস থেকে আক্রমন করলে কাজ হবেনা। প্রাচীরের নিকটবর্তী স্থানে পৌছতে হলে প্রবেশ করতে হবে গোল্ডেন হর্ণে। কিন্তু সেখানে যুদ্ধ জাহাজ ঢুকানোর উপায় নেই। কঠিন লৌহশিকল দিয়ে বন্ধ করে দেয়া হয়েছে গোল্ডেন হর্ণের প্রবেশদ্বার। এবং তা রক্ষার জন্য মোতায়েন রয়েছে তোপকামান নিয়ে রক্ষী বাহিনী। তিনি ৭০টি ছোট যুদ্ধ জাহাজ তৈরি করলেন। দুর্গম পাহাড়ি স্থল ভাগের উপর দিয়ে কৌশলে ১০মাইল পথে তক্তা বিছালেন, তা পিচ্ছিল করলেন এবং তার উপর দিয়ে জাহাজ গুলো গোল্ডেন হর্ণে পানিতে ভাসিয়ে দিলেন এক রাতের মধ্যে। পৌঁছে গেল তার জানবাজ মুজাহিদরা নগর প্রাচীরের পাদদেশে। অতিক্রম করলেন সেই তিন দুর্ভেদ্য প্রাচীরও। মুখোমুখী হল দুই সেনা দল। সম্রাট কনষ্টানটিন বীরত্বের সাথে যুদ্ধ করে নিহত হলেন। বিজয়ী সুলতান জগত বিখ্যাত গির্জা আয়া সুফিয়ার দ্বারে পৌঁছে ঘোড়া থেকে অবতরন করলেন। ঐতিহাসিক গীবন লিখেছেন, “একজন খ্রিষ্টান ভবিষ্যত বক্তা প্রচার করেছিল, একদিন তুর্কজাতি কনষ্টান্টিনোপলে প্রবেশ করবে এবং রোমানদের পিছু ধাওয়া করে সেন্ট সুফিয়ার সম্মুখে অবস্থিত কনষ্টানটিন নামক স্তম্ভে পৌঁছে যাবে। তখন আকাশ থেকে একজন ফেরেশ্তা তরবারি হাতে অবতরন করবেন। ফেরেশ্তা একজন দরিদ্র মানুষকে বলবেন, এই নাও তরবারি এবং ওদের থেকে প্রতিশোধ গ্রহন করো। এই আওয়াজ শুনে তুর্কিরা পালাতে থাকবে। রোমানরা তাদের মরক্কো ও আনাতোলিয়া থেকে ইরানের সীমান্ত পর্যন্ত তাড়িয়ে নেবে”। কিন্তু সেদিন তুর্কিরা সে স্তম্ভ পার হয়ে সেন্ট সোফিয়ায় পৌছে গেল। ঐ ভবিষ্যৎবানীর উপর ভরসা করে যারা ফেরেশ্তা আগমনের প্রতীক্ষায় গির্জায় আশ্রয় নিয়েছিল তারা দেখতে পেল তাদের সামনে কোন আসমানী সাহায্যকারী ফেরেশ্তা নয়, স্বয়ং বিজয়ী সুলতান মোহাম্মদ ও তাঁর সৈন্যরা উপস্থিত। এ ৮৫৭ হিজরির কথা। সুলতান মোহাম্মদ ফতেহ হাগিয়া সুফিয়ার পরিচালনা কর্তৃপক্ষ বিশপ ডেনাডিয়াস থেকে আলোচনার মাধ্যমে ব্যক্তিগত অর্থ দিয়ে ন্যাজ্যমূল্যে নিজ নামে গির্জাটি কিনে নিলেন। কিছুদিন পরে তিনি ইসলামী শরীয়াহ অনুযায়ী একটি ট্রাষ্ট গঠন করে ওয়াকফ করলেন। ব্যয় নির্বাহের জন্য বাৎসরিক ১৪,০০০/- হাজার স্বর্ণমুদ্রা আয়ের ব্যবস্থা করলেন। এটিকে মসজিদ ঘোষণা দিলেন, মুসলমানরা নামাজ আদায় করতে লাগলেন আয়া সুফিয়ায়। প্রায় পাঁচশত বছর ধরে আয়া সুফিয়া মসজিদ রূপে বিদ্যমান ছিল এবং এখানে নামাজ ও অন্যান্য ইবাদত হয়েছে। কামাল আতাতুর্ক নব্য তুরস্ক প্রজাতন্ত্রের কর্ণধার হয়ে ১৯৩৫ সালে এই মসজিদকে যাদুঘরে রূপান্তরিত করেন। বন্ধ করেন এখানে নামাজ আদায় করা।

জাতীয় রাষ্ট্র হিসেবে তুরস্কের ইতিহাস ১ম বিশ্বযুদ্ধের পর হতে শুরু হয়। সুলতান ৬ষ্ঠ মোহাম্মদ ১৯২০ সালে সেভরা (ঝবাৎবং) সন্ধি মেনে নেন। এই সন্ধি অনুসারে উসমানি সাম্রাজ্যকে খন্ড বিখন্ড করে একটি নগন্য রাজ্যে পরিনত করা হয়। কামাল আতাতুর্কের নেতৃত্বে জাতীয়তাবাদীরা আক্রমনকারী গ্রীক বাহিনীকে বিদ্ধস্ত করে ইজমির বিজয় এবং সুলতান ২য় আব্দুল হামিদকে সিংহাসনচ্যুত করে। তুরস্ক প্রজাতন্ত্র ঘোষিত হয়। ১৯২৩ সালে কামাল প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন। একনায়কত্বের ক্ষমতাবলে উগ্র জাতীয়তাবাদীদের নিয়ে শুরু করেন তুরস্কের পাশ্চত্যীকরণ। অনেক মসজিদ রূপান্তরিত করেন মিউজিয়ামে। আরবিতে আযান দেয়া বন্ধ করে তুর্কি ভাষায় আযান দেয়া চালু করেন। আরবি হরফে তুর্কি ভাষা লেখা হতো আগে। তিনি আরবির পরিবর্তে লাতিন বর্ণমালা চালু করেন। তুর্কি ফেজ, ঐতিহ্যবাহী মুসলিম পোশাক এর পরিবর্তে অফিসে টাই, স্যুট, হ্যাট পড়ার আদেশ জারি করেন । আরবিতে নাম রাখাও নিষিদ্ধ ঘোষিত হয় । মহিলাদের হিজাব পড়া নিষিদ্ধ হয় । ফেজ গেল , বোরকা গেল , আরবি হরফ গেল , রাষ্ট্রের সরকারি খাতা হতে ইসলাম গেল , আযানের ভাষা হতে আরবি গেল , খলিফা গেল, খিলাফতের দাবিও গেল । তাদের মন ও মস্তিষ্কে বিকৃত খেয়াল এমনভাবে বাসা বাঁধলো যে , একবারও ধারণায় এল না- তাদের পূর্বপুরুষগণ একটি যাযাবর গোষ্ঠী থেকে এসব ধারণ করেই তৎকালীন দুনিয়ার সর্বশেষ্ঠ শক্তিতে পরিণত হয়েছিল। প্রায় ৭০০ বছর ধরে দোর্দন্ড প্রতাপে শাসন করেছিল ৫২ লক্ষ বর্গ মাইলের সুবিশাল সাম্রাজ্য যা এখন খন্ড বিখন্ড হয়ে ৪৯টি রাষ্ট্রে আত্মপ্রকাশ করেছ। এই বিকৃতি, এই মোহ আচ্ছন্নতাও কেটে যাবে একদিন। উর্দু কবির ভাষায়:
ইয়্যে নূরে হক হাঁয় এসকো কভি বুঝ না সাকেগা যেতনা হি দাবাওগো উভারতাহি রাহেগা”
আমাদের রেনেসাঁর কবি ফররুখ আহমদের কথায় :
রক্তপাথার সাঁতারি আবার
আসে মুসলিম জাহানে দিন
জাগে একসাথে, নবীন আশাতে
লক্ষ সূর্য শঙ্কাহীন।

তুরস্কের তা শুরু হয়েছে। ফিরে এসেছে আরবি জবানের আজান আল্লাহু আকবার, আল্লাহু আকবার। আয়া সোফিয়া ফিরে পেয়েছে তার মসজিদ হওয়ার মর্যাদা ও গৌরব। গরিবের সন্তান এরদোগান, যিনি সংসারের খরচে সহায়তা করার জন্য ছাত্র জীবনে লেবুর শরবত বিক্রি করতেন ইস্তাম্বুলের গলিতে; যিনি ৪ মাস কারাদন্ড ভোগ করেন এই কবিতা লিখে :
মসজিদ হচ্ছে আমাদের ব্যারাক /
গম্বুজ হচ্ছে আমাদের হ্যালমেট/
এবং মিনার হচ্ছে আমাদের বেয়োনেট।
বাড়াবাড়ি নয়, যারা সত্যিকার ইসলামকে প্রাণ দিয়ে ভালবাসেন- তাদের উত্থান ঘটছে হালের তুরস্কে। নির্বাসন দশা থেকে ইসলামের স্বমহিমায় প্রতিষ্ঠাকামী যারা তাঁরা এরদোগানের পতাকা তলে জমায়ে়ত হচ্ছেন, হবেন। তিনি প্রধানমন্ত্রী হয়েছেন, প্রেসিডেন্ট হয়েছেন, তাকে উৎখাতের জন্য তার বিরূদ্ধে সামরিক অভ্যূত্থান হয়েছে, ইসলামী জনতা তা প্রতিহত করার জন্য বিদ্রোহী সেনাদের ট্যাংক-কামানের সামনে বুক পেতে দাড়িয়েছে। নির্বাসিত ইসলাম ফিরে আসতে শুরু করেছে স্বগৌরবে। ইসলামী খেলাফত নেই, খলীফাতুল মুসলিমীনও নেই। তবে ইসলামী রাষ্ট্রসমূহের সংস্থা থাকার প্রয়জনীয়তা অনুভব করছে ইসলামী উম্মাহ। ওআইসি সে প্রয়োজন পূরণ করতে পারেনি। ইসলামী উম্মাহকে নিয়ে় যিনি ভাববেন, তাদের সুখ দুঃখের অংশভাগী হবেন, পাশে গিয়ে় দাঁড়াবেন এমন নেতৃত্বের বড় প্রয়োজন আজ। এমন অভিভাবকের বড় আবশ্যক। এরদোগানের মধ্যে সে গুণ আছে বলে মনে করার যুক্তি ও প্রমাণ আছে বহু। এমনকি আমাদের দেশে যখন রোহিঙ্গা শরণার্থী নিয়ে সংকট তখন তিনি তার সহধর্মিনীকে এখানে পাঠিয়েছেন সরোজমিনে অবস্থা পর্যবেক্ষণের জন্য, সহায়তা করার জন্য। এটা কম কথা নয়।

আয়া সোফিয়ার মসজিদ- মর্যাদা পুনঃ প্রতিষ্ঠায় আমরা তাঁকে অভিনন্দন জানাই। কেননা, এটি ছিল সুলতান ফাতেহ মোহাম্মদের নিজ অর্থে ক্রয় করা ও আল্লাহর ওয়াস্তে ওয়াকফ করা সম্পত্তি। ব্যক্তি এরদোগান নন, বরং ১৯৩৪ সালের মন্ত্রীসভা যে সিদ্ধান্তের দ্বারা আয়া সোফিয়ার মসজিদী মর্যাদা হরণ করে এটিকে যাদুঘরে রূপান্তরিত করেছিল সেই সিদ্ধান্তকে অবৈধ ও বেআইনি বলে বাতিল ঘোষণা করে তুরস্কের কাউন্সিল অব স্টেট- শীর্ষ আদালত। প্রেসিডেন্ট হিসেবে এতে দস্তখত করেন এরদোগান। তুরস্কের ধর্মপ্রাণ মুসলিমগণ এ দাবি জানিয়ে আসছিল দীর্ঘদিন ধরে। তিনিও তাই চাইছিলেন। কিন্তু এতে নাখোশ হন পাশ্চাত্যের অনেকে। এ পদক্ষেপের আপত্তি ও নিন্দা জানায় ওয়ার্ল্ড কাউন্সিল অব গির্জা এবং অনেক আন্তর্জাতিক নেতৃবৃন্দ। প্রেসিডেন্ট এরদোগান এসবের তোয়াক্কা করেননি। তিনি দৃঢ় কণ্ঠে বলেছেন : যারা আয়া সোফিয়া সম্পর্কে তুরস্কের বিরুদ্ধে অভিযোগ তুলছে- তারা সরাসরি তুরস্কের সার্বভৌমত্বের দিকে আঙ্ল তুলছে। এর আগে তিনি বলেছিলেন : তুরস্কে ৪৩৫টি গির্জা ও সিনেগগ রয়েছে, সেখানে খ্রিস্টানরা ও ইয়াহুদীরা প্রার্থনা করতে পারে ।

অবশ্য ইসলাম বিদ্বেষীদের মজ্জাগত স্বভাব হল মুসলমানরা ভালো কিছু করলেও তা ওদের গা জ্বালার কারণ হয়। মুসলিমদের শত শত মসজিদ ধ্বংস করলেও ওরা টু শব্দটি পর্যন্ত করেনা। যে স্পেন সাত শত বছরের মতো মুসলমানরা শাসন করেছে, পাইকারীভাবে মুসলিম নিধনযজ্ঞ চালানোর পর সেখানে মসজিদগুলোর কী দশা হয়েছে? কমিউনিস্ট শাসন প্রতিষ্ঠার পর সোভিয়েত ইউনিয়নের মুসলিম অধ্যুষিত দেশগুলির মসজিদসমূহের পরিণতি কী দাঁড়িয়েছে? ভারতে মোদির গুজরাটে ও বিভিন্ন এলাকায় কত মসজিদ নিশ্চিহ্ন করা হয়েছে, ইউরোপের বলকান অঞ্চলে এককালীন মুসলিম শাসিত দেশসমূহে কত মসজিদ গুঁড়িয়ে দেয়া হয়েছে, ১৯৪৮ সালে অবৈধ ইসরাইল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পর ফিলিস্তিনের কত মসজিদ ধ্বংস করা হয়েছে? এভাবে বিভিন্ন দেশে কত মসজিদকে পানশালা, নাইটক্লাব, হোটেল, রেস্তোরাঁ, সিনেগগ, যাদুঘরে রূপান্তরিত করা হয়েছে তার পরিসংখ্যান কি তারা নিয়েছেন কখনো? এইতো ৩১ জুলাই ২০২০ আনাদুলুর বরাতে এক প্রতিবেদনে উল্লেখ করেছে “ ইসরাইলে আরব নাগরিকদের হাইফলোয়াপ কামাল খতিবের এক জরিপ থেকে জানা যায়, ইসরাইল কর্তৃপক্ষ ১৫টি মসজিদকে সিনেগগে রূপান্তরিত করেছে, ৪০টি মসজিদকে ধ্বংস বা পরিত্যক্ত করেছে, ১৭টি মসজিদকে গোলাবাড়ি, বার- রেস্তোরা, যাদুঘর, ক্যাফে বানিয়ে ব্যবহার করছে। অযোধ্যায় ৪০০ (চারশত) বছরের পুরাতন ঐতিহাসিক বাবরী মসজিদ খানা প্রকাশ্য দিবালোকে উৎসব করে ভেঙ্গে গুড়িয়ে দিয়েছে উগ্রহিন্দুরা। এখন সেই স্থানে রামমন্দির নির্মান করা হচ্ছে। আর এই গত ৫ই আগষ্ট বুধবার সেই মন্দিরের ভিত্তি প্রস্তর স্থাপন করলেন স্বয়ং ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। ইউনিসেফ বা কোন আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা কি তার বিরুদ্ধ সোচ্চার হয়েছে? না, হয়নি। হবে বলেও মনে হয় না। মুসলমানদের নিজেদেরকেই অস্তিত্ব রক্ষা, মর্যাদা রক্ষা, দেশের স্বাধীনতা সার্বভৌমত্ব রক্ষার পদক্ষেপ নিতে হবে। নিজেদের মধ্যে ঝগড়া, ফাসাদ, যুদ্ধ, লড়াই বন্ধ করে ঐক্যবদ্ধ হতে হবে। আল্লাহর প্রিয় হাবীব বলেছেন : “সব মুসলিম যেন একটি দেহ। এই দেহের কোন একটি অঙ্গ আঘাত প্রাপ্ত হলে গোটা দেহই তার যন্ত্রণা অনুভব করবে এবং সুস্থ করে তুলতে সচেষ্ট হবে”। প্রার্থনা করি, আমাদের সবার মধ্যে এই বোধ, এই অনুভূতি জাগ্রত হোক।



 

Show all comments
  • Zubair Salauddin ৭ আগস্ট, ২০২০, ১২:৩৪ পিএম says : 0
    Ameen...........
    Total Reply(0) Reply

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: মুসলিম-জাহান
আরও পড়ুন