পবিত্র লাইলাতুল বরাত
আজ দিবাগত রাত পবিত্র লাইলাতুল বরাত। পরম করুণাময় আল্লাহতায়ালা তার বান্দাদের গুনাহ মাফ, বিপদমুক্তি ও
ভারতীয় সীমান্ত রক্ষী বাহিনী (বিএসএফ) প্রকাশ্য বিবৃতি দিয়ে গরু চোরাচালানীর জন্য বাংলাদেশের বিজিবিকে দায়ী করেছে। পাচার করা গরু দিয়ে কোরবানি হয় কিনা, সেই কোরবানি নাকি পশু নির্যাতনের শামিল- এমন বক্তব্যও এই আধা সামরিক বাহিনীর তরফ থেকে এসেছে।
দুই
এই বিরোধের শুরু গত ৬ জুলাই। বিএসএফের সাউথ বেঙ্গল ফ্রন্টিয়ারের ডিআইজি এস এস গুলেরিয়া পবিত্র ঈদের আগে গরু চোরাচালান নিয়ে একটি বিবৃতি দেন। বিএসএফের ঐ বিবৃতিতে ঈদের আগে গরু চোরাচালানে মদদ দেওয়ার জন্য বাংলাদেশের সীমান্ত রক্ষী বাহিনী বিজিবিকে অভিযুক্ত করা হয়। ঐ বিবৃতিতে আরও বলা হয় যে, যেভাবে কোরবানির উদ্দেশ্যে গরুগুলোকে ভারত থেকে বাংলাদেশে ঢোকানো হয়, তা পশু নির্যাতনের শামিল। ঐসব গরু দিয়ে আদৌ কোরবানি হয় কিনা তা নিয়েও প্রশ্ন তোলা হয়।
বিএসএফের ঐ বিবৃতির দুই সপ্তাহ পর গত রোববার ১৯ জুলাই বাংলাদেশ সীমান্ত রক্ষী বাহিনী বিজিবির তরফ থেকে একটি পাল্টা বিবৃতি দেওয়া হয়। ঐ বিবৃতিতে বলা হয়, প্রকৃতপক্ষে ভারতীয় চোরাচালানীদের মাধ্যমে সীমান্ত এলাকায় ভারতীয় ঘাঁটিতে গরু সমাগম ও নদীপথে গরু পাচারে বিএসএফের নিষ্ক্রিয়তা নিঃসন্দেহে বিভিন্ন প্রশ্নের অবতারণা করে। কোরবানির সাথে গরু নির্যাতন নিয়ে বিএসএফ যে প্রশ্ন তুলেছে তার তীব্র প্রতিবাদ করে বিজিবি বলেছে, এই ধরনের বক্তব্য ঈদুল আযহার জন্য অবমাননাকর এবং মুসলমানদের ধর্মীয় অনুভূতিতে চরম আঘাত হানার শামিল।
এই ঘটনা নিয়ে বাংলাদেশ সীমান্ত রক্ষী বাহিনী বিজিবির প্রাক্তন প্রধান লে. জেনারেল (অব.) মইনুল ইসলাম বিবিসিকে বলেন, প্রকাশ্য বক্তব্য বিবৃতি দিয়ে এক বাহিনী আরেকটি বাহিনীকে চোরাচালানের জন্য দায়ী করায় তিনি বিস্মিত। তিনি বিবিসিকে বলেন, বিএসএফ কিন্তু কোনো ব্যক্তিকে দায়ী করেনি। বাংলাদেশের পুরো একটি বাহিনীকে (বিজিবি) দায়ী করেছে। এটা যেমন অস্বাভাবিক তেমনি অন্যায়। ফলে বিজিবির তরফ থেকে পাল্টা বিবৃতি জারী করা যথাযথ হয়েছে বলে আমি মনে করি। লে. জে. (অব) মইনুল ইসলাম মনে করেন যে, গরু চোরাচালান নিয়ে ৬ জুলাই প্রকাশিত বিএসএফের ঐ অস্বাভাবিক বিবৃতি এককভাবে ঐ বাহিনী দিতে পারে না। তার পেছনে ভারত সরকারের রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত কাজ করছে।
জেনারেল (অব.) মইনুল ইসলাম আরো বলেন, সীমান্তে নানা রকম মতবিরোধ রুটিন ব্যাপার। স্থানীয়ভাবে তার সমাধান হয়। গুরুত্বর মতবিরোধ দেখা দিলে কূটনৈতিক পর্যায়ে তার সমাধানের চেষ্টা করা হয়। কিন্তু এখানে তা হয়নি। বিশেষ করে ধর্ম নিয়ে কথা বলা একেবারেই অবিবেচকের কাজ হয়েছে। আমি বুঝতে পারছি না, কেন ভারত সরকার একটি বর্ডার ফোর্সকে দিয়ে এমন সব কথা বলাচ্ছে। এ ব্যাপারে তার নিজস্ব মতামত দিয়েছে। বিবিসির মতে, জেনারেল মইন সন্দেহ করছেন যে, চীন-ভারত সীমান্ত নিয়ে যে বিরোধ চলছে সে বিষয়ে নিশ্চুপ থাকার জন্য ভারত হয়তো বাংলাদেশের ওপর কোনো চাপ সৃষ্টির চেষ্টা করছে।
এ ব্যাপারে বিবিসি তার নিজস্ব বিশ্লেষণ ও পর্যবেক্ষণ দিয়েছে। বলা হয়েছে যে, চীন-ভারত সীমান্ত বিরোধ নিয়ে বাংলাদেশসহ দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলো একটি নিরপেক্ষ অবস্থানে থাকার চেষ্টা করছে। কাশ্মিরে পুলওয়ামার জঙ্গী হামলায় ভারতীয় সৈন্যের মৃত্যুতে বাংলাদেশ সরকারের তরফ থেকে দ্রুত সহমর্মিতা জানিয়ে বিবৃতি জারী করা হয়েছিলো। কিন্তু গালওয়ানে ২০ জন ভারতীয় সৈন্যের মৃত্যুতে চুপ ছিলো ঢাকা। বিবিসির মত অনুযায়ী, পর্যবেক্ষকদের অনেকেই মনে করছেন যে, ভারত সরকার এবং ভারতীয় সমাজের একটি অংশের মধ্যে প্রতিবেশীদের এই ভূমিকা নিয়ে ক্ষোভ তৈরি হয়েছে।
তিন
মার্কিন সাময়িকী ‘ব্লু মবার্গে’ দুইজন ভারতীয় এ ব্যাপারে মন্তব্য প্রতিবেদন লিখেছেন। এরা হলেন অর্চনা চৌধুরী এবং বিভূদত্ত ওরাধন। তাঁরা লিখেছেন, নরেন্দ্র মোদি যদি আশা করে থাকেন যে, বিপদের সময় তিনি প্রতিবেশীদের কাছ থেকে সমর্থন পাবেন তাহলে তিন ভুল ভেবেছিলেন। যেখানে তাদের সৈন্যদের নিহত হওয়ার ঘটনায় আমেরিকা বা বৃটেন সমবেদনা জানিয়েছে সেখানে ভারতের ট্র্যাডিশনাল মিত্র বাংলাদেশ এবং নেপাল এখনও রয়েছে সম্পূর্ণ নিশ্চুপ। ঐ রিপোর্টে আরো বলা হয়, নরেন্দ্র মোদি দ্বিতীয় দফা শাসনে তাঁর কট্টর হিন্দু জাতীয়তাবাদী এজেন্ডায় প্রতিবেশীদের মধ্যে ভয়, সন্দেহ এবং অশ্বস্তি ঢুকেছে। এটা সবারই জানা যে, ভারতে এনআরসি এবং ধর্মের ভিত্তিতে করা নাগরিকত্ব সংশোধনী আইন নিয়ে বাংলাদেশ বেশ অসন্তুষ্ট। দিল্লির জওহরলাল বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক সঞ্জয় ভরদোয়াজ বলেন, বিজেপি ক্ষমতায় আসার পর থেকে গরু চোরাচালান কমাতে তারা প্রকাশ্য কথা বলছে। গরু চোরাচালান অনেকের কাছে দশটি ব্যবসার মতো একটি ব্যবসা। কিন্তু অনেকের কাছে এটি একটি ধর্ম বিশ্বাস। তিনি আরো বলেন, চীন-ভারত বিরোধ নিয়ে দক্ষিণ এশিয়ার ছোট দেশগুলো হয়তো ভেতরে ভেতরে খুশি। তারা মনে করছে, দক্ষিণ এশিয়ার একাধিপত্যকে চীন চ্যালেঞ্জ করছে এবং তারা মনে করছে, ভারতের সাথে সম্পর্কে ভারসাম্য তৈরি করার ক্ষেত্রে এটা প্রকট সুযোগ সৃষ্টি করেছে। চীন পরোক্ষাভাবে সেই ভারসাম্য সৃষ্টিতে সাহায্য করছে।
অধ্যাপক ভরদোয়াজের মতে, ভারত এখনও চীনের সাথে সর্বাত্মক বিরোধে জড়াতে অনিচ্ছুক। তাঁর মতে, নিরাপত্তার উদ্বেগ থেকে যুক্তরাষ্ট্রের সাথে সুসম্পর্ক চাইছে ভারত। কিন্তু ভারত এখনও আমেরিকার ক্লায়েন্ট স্টেট হতে অনিচ্ছুক। সেজন্য ইন্দোপ্যাসিফিক জোটে পুরোপুরি ঢোকার ব্যাপারে ভারতের মধ্যে এখনও কুণ্ঠা রয়েছে। তবে অনেক বিশ্লেষক মনে করেন যে, চীন-ভারত বিরোধ যদি দীর্ঘস্থায়ী হয় তাহলে ভারত হয়তো চীন বিরোধী ইন্দোপ্যাসিফিক জোটে ঢুকতে বাধ্য হবে। সে ক্ষেত্রে ভারতের ছোট প্রতিবেশী দেশগুলোর পক্ষে আর নিরপেক্ষ থাকা সম্ভব নাও হতে পারে।
চার
ঐ দিকে সামান্য অজুহাতে বাংলাদেশের বিরুদ্ধে ভারতের একশ্রেণির রাজনৈতিক নেতা এবং মিডিয়ায় বাংলাদেশ বিরোধী বিষোদগারের সমালোচনা করেছেন ভারতের সাবেক বিদেশ সচিব এবং নিরাপত্তা উপদেষ্টা শিবশঙ্কর মেনন। ‘আনন্দ বাজার’ পত্রিকাকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, কিছু নেতার অবিবেচক মন্তব্যে যেন ভারত-বাংলাদেশের অর্জিত ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক নষ্ট না হয়। উল্লেখ করা যেতে পারে যে, বাবু শিবশঙ্কর মেননকে ভারতে একজন বাংলাদেশ বিশেষজ্ঞ হিসাবে গণ্য করা হয়। তার মতে, ভারতে নাগরিক পঞ্জি এবং নাগরিক আইন সংশোধনী প্রয়োগের সময় বাংলদেশিদেরকে নিয়ে নির্বিচারে মন্তব্য করা উচিত হয়নি। উল্লেখ করা যেতে পারে যে, ঐ সময় বিজেপির একজন বড় নেতা বাংলাদেশিদেরকে উইপোঁকার সাথে তুলনা করেন। বাবু শিবশঙ্কর মেনন মনে করেন যে, ঐ মন্তব্য অত্যন্ত অশোভন হয়েছে।
পাঁচ
ফিরে আসছি গরু সম্পর্কে। আমার কাছে এটা বিস্ময়কর মনে হয়েছে যে গরু নিয়ে বিএসএফ যে মন্তব্য করেছে সে ব্যাপারে বাংলাদেশের নেতারা বিশেষ করে ধর্মীয় রাজনৈতিক নেতারা নীরবতা অবলম্বন করেছে। লে. জেনারেল মইনুল ইসলাম (অব.) কোনো ইসলামী রাজনৈতিক দলের কোনো নেতাও নন, কোনো সদস্যও নন। বস্তুত তিনি কোনো রাজনৈতিক দলের সমর্থক কিনা সেটি মানুষ জানে না। তার মতো একজন অরাজনৈতিক ব্যক্তির মনে গরু কোরবানিকে পশু নির্যাতন বলায় যদি তার ধর্মীয় অনভূতিতে আঘাত লেগে থাকে তাহলে ইসলামী রাজনৈতিক দলগুলোর ধর্মীয় অনভূতিতে বিএসএফের এই বাজে মন্তব্য আঘাত করে না কেন? বিএনপিকে মানুষ ধর্মীয় মূল্যবোধের দল হিসাবেই জানে। তাদের মধ্যে বিএসএফের মন্তব্য কোনো প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করেনি কেন?
[email protected]
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।