Inqilab Logo

বৃহস্পতিবার ২১ নভেম্বর ২০২৪, ০৬ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ১৮ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

মানসিক দাসত্ব ঘুচবে কি?

তৈমূর আলম খন্দকার | প্রকাশের সময় : ২৭ জুলাই, ২০২০, ১২:০২ এএম

দাসপ্রথা চালু করার নায়কেরা এখন খলনায়কে পরিণত হয়েছে। শুধু তাই নয়, বরং তাদের মূর্তি ভেঙ্গে পানিতে নিক্ষেপ করে নিন্দার গভীরতা প্রকাশ করেছে জেগে উঠা জনগণ। দাসপ্রথা বা মানুষকে দাস বানিয়ে বিক্রি করে যারা মুনাফা অর্জন করেছে তাদের অন্যতম কলোম্বাস, ভাসকোদাগামা, রবার্ট ক্লাইভ প্রমুখকে গণমানুষ এখন নিন্দার চোখে দেখছে। জনতার ক্ষোভ থেকে কেউ বাদ পড়ছে না। গত ২৫ মে মিনেসোটা অঙ্গরাজ্যের অন্যতম বড় শহর মিনেপলিসে পুলিশী হেফাজতে কৃষ্ণাঙ্গ জজ ফ্লয়েডকে হত্যার পর দাস ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে পুনরায় গণঘৃণা জেগে উঠেছে। ব্রিটেনে বর্ণ বৈষম্য ও কৃষ্ণাঙ্গ নির্যাতন বিরোধী আন্দোলনকারীরা অন্যান্যদের সাথে দাস ব্যবসায়ী অ্যাডওয়ার্ড কোলস্ট্রেনের মূর্তি ভেঙ্গে সাগরে নিক্ষেপ করেছে। দাসপ্রথার বিরুদ্ধে মানবাধিকার সংগঠনগুলি বার বারই কথা বলে আসছে। কিন্তু তাদের কথা কেউ কানে তোলেনি। দুর্বলের উপর সবলের প্রভাব প্রতিপত্তি থেকেই দাসপ্রথার উদ্ভব হয়েছিল। দুর্বলতা বলতে যেমন শারীরিক দুর্বলতা বুঝায়, এ ক্ষেত্রে দুর্বলতা বলতে অর্থনৈতিক দুর্বলতাই মুখ্য বিষয় হিসাবে কাজ করেছে। শরীরের রং, অশিক্ষা ও দারিদ্রের‌্য কষাঘাতে নিপীড়িত-নির্যাতিত মানুষগুলিই দাসপ্রথার ভিকটিম হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছে। দাসের কথিত মালিকরা ভিকটিমের সাথে পশুর চেয়েও খারাপ আচরণ করতো। যে মানুষগুলি পণ্যের মতো বাজারে বিক্রি হয়েছে তারাই দাস। বিক্রিত মানুষ ‘মানুষ’ হিসাবে কোথাও কোনো প্রকার দাবি, অধিকার প্রত্যাশা করতে পারেনি। ইউরোপ ছাড়াও আরব অধ্যুষিত এলাকায় দাসপ্রথা প্রকটভাবে ছিল। দাসপ্রথা নিয়ে এখন অনেকেই অনেক কথা বলেন বটে, কিন্তু আজ থেকে ১৫ শত বছর পূর্বে মানবতার মুক্তির দূত হযরত মুহাম্মদ (সা.) ঐতিহাসিক বিদায় হজ্জের ভাষণে বলেছিলেন, ‘আজ থেকে দাস প্রথা রহিত করা হলো।’ অর্থাৎ সৌদী ধনাঢ্য ব্যক্তিদের ক্রয়কৃত দাসরা মুক্তি পেলো এবং ভবিষ্যতে কেউ দাস ক্রয়-বিক্রয় করতে পারবে না। হযরত মুহাম্মদ (সা.) দাসপ্রথাকে কেবল মাত্র বিলুপ্ত ঘোষণা করেন নাই, তিনি দাসমুক্তিকে এবাদতের অংশ হিসাবে গণ্য করেছেন। যুগে যুগে মানবতাবাদী মণিষীরা দাসপ্রথার বিরুদ্ধে আন্দোলন-সংগ্রাম করেছেন, যাদের মধ্যে আব্রাহাম লিংকনের নাম উল্লেখযোগ্য। তবে অনেক দাস ব্যবসায়ী ছিল যাদের রাষ্ট্রীয়ভাবে পুরস্কৃত করা হয়েছিল।

অথচ, হযরত মুহাম্মদ (সা.) আনুষ্ঠনিকভাবে ১৫০০ বছর পূর্বেই দাসপ্রথা বিলুপ্ত ঘোষণা করেন। আমেরিকা অতিসম্প্রতি সংবিধান সংশোধন করে দাসপ্রথা বিলুপ্ত করেছে। মানবাধিকার বিষয়ক ইউরোপীয় কনভেনশনের ৪ অনুচ্ছেদে যেভাবে দাসত্ব বা জবরদস্তি শ্রম নিষিদ্ধকরণ লিপিবদ্ধ করা হইয়াছে, তা ১৯৯৮ সালের মানবাধিকার আইনের ফলস্বরূপ যুক্তরাজ্যের আইনের অঙ্গীভ‚ত। বাংলাদেশের সংবিধানের ৩৪ অনুচ্ছেদের জবরদস্তি শ্রম নিষিদ্ধ করা হয়েছে।

দাসের ইংরেজি শব্দার্থ Slave. Oxford Dictionary এর মতে, ঝষধাব হলো (১) a person who is legally owned and is forced to work for them, (২) a person who is completely dominated or influenced. বাংলা একাডেমি প্রণীত অভিধানে ঝষধাব বলতে (১) ক্রীতদাস, কেনা গোলাম, (২) ‘যে ব্যক্তি অন্যোর জন্য কঠোর পরিশ্রম করতে বাধ্য হয়’ শব্দার্থ করা হয়েছে।

লেলিন বলেছেন যে, দাসত্ব তিন প্রকার। প্রথমত: এক শ্রেণির লোক স্বেচ্ছায় দাসত্ব গ্রহণ করে বিনিময়ে তার ক্ষুধার জ্বালা নিবারনসহ জীবনধারণের প্রয়োজনীয়তা মিটাতে পারে, কিন্তু ব্যক্তি স্বাধীনতা থাকে না। দ্বিতীয়ত: এক শ্রেণির লোক রয়েছে, যারা নিজেরা বুঝতেই পারে না যে, তারা দাসত্ব করে যাচ্ছে বিনিময়ে আরাম-আয়াশে দিন কাটাচ্ছে, কিন্তু সত্য-মিথ্যার তারতম্য করতে পারে না। (৩) ব্যতিক্রমধর্মী এক শ্রেণির লোক রয়েছে, যারা দাসত্বকে না মেনে প্রতিবাদ করে আসছে। তারাই বিদ্রোহী হিসাবে পরিচিতি লাভ করেছে, বিনিময়ে পাচ্ছে জেল-জুলুম, লাঞ্ছনা-গঞ্জনা, এমনকি ফাঁসির দড়ি।

দাসত্ব গ্লানিকর ও অপমানজনক, অন্যদিকে বিদ্রোহী জীবন অনেক কষ্টের, তবে সম্মানজনক। যদিও আইন করে কৃতদাসপ্রথা বা দাসপ্রথা বিলুপ্ত বা নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়েছে, কিন্তু আমাদের সমাজে কি দাসত্ব বন্ধ হয়েছে? দেখা যাচ্ছে, ‘মানসিক দাসত্বের’ পরিমান অনেকাংশে বৃদ্ধি পেয়েছে। খেয়ে পরে একটু স্বস্তিতে থাকার জন্য, কোথাও প্রমোশনের জন্য, কোথাও পদ-পদবী পাওয়ার জন্য অনেকেই নির্লজ্জের মতো দাসত্ব করে যাচ্ছে। এমন লোকের সংখ্যাও নিতান্ত কম নয়, যারা পার্শ্ববর্তী রাষ্ট্রকে নিজেদের দেশ মনে করে।

মানসিক দাসত্ব করতে শরীর খাটাতে হয় না, বরং মনমানসিকতা ও বিবেকে বিক্রি করে নিজ স্বত্তাকে জলাঞ্জলি দিতে হয়। নিয়োগকর্তার স্বার্থ রক্ষার্থে সত্যকে মিথ্যায় এবং মিথ্যাকে সত্যে পরিণত করে বিনিময়ে শাসক গোষ্ঠির সুদৃষ্টি অর্জন করে নিজ ও পরিবারের জন্য সুখ স্বাচ্ছন্দ্য আদায় করার নামও মানসিক দাসত্ব। এ ধরনের দাসের সংখ্যা কম হলেও আছে।

মানুষের জন্যই সভ্যতা। গর্ভ করে বুক ফুলিয়ে মানুষ দাবি করে বলে যে, ‘মানুষ হলো সৃষ্টিকর্তার সর্বশ্রেষ্ঠ সৃষ্টি।’ সর্বশ্রেষ্ঠ সৃষ্টির স্বীকৃতির একমাত্র উপাদান মানুষের বিবেক। অনেক পশু রয়েছে যারা অনেক চতুর বা চালাক, অনেক সাহসী, অনেক শক্তিধর। কিন্তু জন্মলগ্ন থেকে তারা বিবেক সম্পন্ন হয় না বিধায় তাদেরকে পশু বলা হয়। তবে মানবজাতির মধ্যে কিছু মানুষ রয়েছে যাদের কর্মকান্ড পশুর কর্মান্ডকেও হার মানায়। দু’পা বিশিষ্ট মানব জাতিকে রক্ষা করার জন্য যুগে যুগে সৃষ্টিকর্তা বার্তাবাহক পাঠিয়েছেন, যাদের কেউ অনুকরণ করে, কেউ করে না। মানুষ মাত্রেরই বিবেক রয়েছে। কিন্তু পশুত্ব, লোভ, কামনা, বাসনার কাছে কোথাও কোথাও মানুষের বিবেক হার মেনে যায়। ‘বিশ্বাসযোগ্যতা’ বলতে যা বুঝায় তা পৃথিবীতে এখন বিরল। মানসিক দাসত্বের কারণে মানুষ হয়ে পড়ে বিবেকবর্জিত এবং যাদের বিবেক চলে গেছে তাদের পক্ষে যেকোন কাজ করা সম্ভব, যা চার পা বিশিষ্ট পশুও করে থাকে।

সবচেয়ে দুঃখজনক বিষয় এই যে, রাষ্ট্রও মিথ্যার আশ্রয় গ্রহণ করে। যখন শাসকগোষ্ঠি মনে করে যে, যখন বুঝতে পারে মিথ্যা বলা ছাড়া জনগণকে ধোঁকা দেয়া যাবে না তখনই রাষ্ট্রীয় প্রচার যন্ত্র মিখ্যাকে সত্য বানিয়ে প্রচার করা শুরু করে। ফলে রাষ্ট্রীয় প্রচারযন্ত্রের উপরেও জনগণের আস্থা কমে গেছে। পাশাপাশি ব্যক্তি মালিকানাধীন প্রচার যন্ত্রগুলিও কোথাও সরকারের বা কোথাও মালিকের স্বার্থ রক্ষা করে, প্রয়োজনে সত্যকে জলাঞ্জলি দিচ্ছে। সৃষ্টিকর্তা আল্লাহপাক বলেছেন যে, ‘মানুষ আসলে বড়ই ক্ষতির মধ্যে রয়েছে, তবে তারা ছাড়া, যারা ঈমান এনেছে ও সৎকাজে নিয়োজিত থেকেছে এবং একজন অন্যজনকে হক কথা ও সরব করার উপদেশ দেয়।’ (সূত্র: সুরা আল-আসর: ২-৩)। উল্লেখ্য, ‘হক’ শব্দটি ‘বাতিলের’ বিপরীত। অর্থাৎ হক কথা বলতে সঠিক, নির্ভুল, সত্য, ন্যায় ও ইনসাফের কথা বলাকে বুঝায়। কোরানিক নির্দেশনা মোতাবেক হক কথা ইবাদতের অংশ, ব্যর্থতায় গুনাগার হতে হবে। তবে যারা নাস্তিক তাদের নিকট ইবাদত সম্পর্কে কথা বলা অরণ্য রোদনের শামিল।

বিবেক সব সময়ই সত্যের সন্ধানে থাকে। কিন্তু ব্যত্যয় হয় তখনই যখন লোভ, বৈষয়িক প্রতিপত্তি ও চাওয়া-পাওয়ার কামনা-বাসনা মনে গভীরভাবে বাসা বাঁধে। সত্যকে মানুষ তখনই পরিহার করে যখন সুখ স্বাচ্ছন্দ্যের আশা আকাক্সক্ষা প্রকট আকার ধারণ করে। গেরুয়া পোশাক পরে সাধু হওয়ার সংখ্যাই এখন বেশি, মন রাঙ্গিয়ে সাধু হওয়া অর্থাৎ মনে প্রাণে সাধু হওয়ার আধিক্য এখন কোথায়?
লেখক: রাজনীতিক, কলামিস্ট ও আইনজীবী



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

আরও পড়ুন