Inqilab Logo

শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

এই ধড়িবাজের বিচার আদৌ হবে কি?

মোহাম্মদ আবদুল গফুর | প্রকাশের সময় : ২৩ জুলাই, ২০২০, ১২:০৪ এএম

বিশ্বব্যাপী করোনাভাইরাসের এ সময়ে আরেক করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাব ঘটেছে বাংলাদেশে, যা একান্তই বাংলাদেশের। তবে রহস্যময় করোনাভাইরাসের মতো এরোগ বায়বীয় নয়। এ ভাইরাস মানবদেহী। মানবদেহী এ ভাইরাসের নাম সাহেদ তথা সাহেদ করিম। তার কৃতিত্ব এই যে, সে দীর্ঘদিন ধরে নানাজনের সাথে নানাভাবে প্রতারণা করে এলেও তার পরিচিতি ছিল একজন বুদ্ধিজীবী ও হাসপাতাল মালিক হিসাবে।
তবে তার এ পরিচিতি বদলে গেছে কঠোর বাস্তবতার নিরিখে। এখন তার নতুন পরিচিতি হয়ে দাঁড়িয়েছে একজন ভিআইপি প্রতারক হিসাবে। তাছাড়া সে দেশের একজন অন্যতম শীর্ষ ধনী ব্যক্তি হিসেবেও সমাজে স্থান করে নিয়েছিল। দৈনিক ইনকিলাবে গত ১১ জুলাই সংখ্যার প্রথম পৃষ্ঠায় তার সম্পর্কে দুটি খবর ছাপা হয়; তার একটির শিরোনাম ছিল কী হবে রিজেন্ট সাহেদের? প্রতিবেদনে বলা হয়, মিডিয়ার সৃষ্ট হঠাৎ বুদ্ধিজীবী মো. সাহেদ করিম ওরফে সাহেদ। এমএলএম ব্যবসা করে হাতিয়ে নিয়েছেন ৫শ কোটি টাকা। সেই টাকায় গড়েছেন ক্লিনিক, আবাসন ব্যবসা, কুরিয়ার সার্ভিসসহ নানা প্রতিষ্ঠান। এসব প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমেও করেছেন বহুমাত্রিক প্রতারণা, চাতুর্যের সাথে বোকা বানিয়েছেন সরকারকেও। করেছেন দখলবাজি। সাবলেট নিয়ে ভবন দখল নিয়েছেন। জমি দখল, প্রতিষ্ঠানের ডাক্তার, কর্মচারী আয়া-বুয়াদের বেতনের টাকা আত্মসাৎ করেছেন। বহু মানুষের কাছ থেকে সামগ্রী কিনে তাদের পাওনা টাকা মেরে দিয়েছেন।

বিজ্ঞাপনচিত্র নির্মাণ করে টাকা দেননি নির্মাতাকে। কোটি কোটি টাকা পাওনার বিপরীতে দিয়েছেন চেক। কিন্তু নগদায়ন হয়নি সেই চেক। কোটি কোটি টাকা তার কাছে ধরা খেয়ে নিঃস্ব হয়েছেন অনেকে। সর্বশেষ তার মালিকানাধীন ঢাকার উত্তরার রিজেন্ট হসপিটাল করোনা টেস্টের ভুয়া রিপোর্ট দিয়ে হাতিয়ে নিয়েছে কোটি কোটি টাকা। র‌্যাবের অভিযানের পর এক এক করে উন্মোচিত হয়েছে সাহেদের কুৎসিৎ চেহারা। উদঘাটিত হচ্ছে তার নানামাত্রিক অপরাধ সম্ভার, তার অপরাধ জগতের তথ্য।

সিআইডি সূত্র জানায়, প্রতারণার দায়ে সাহেদের বিরুদ্ধে ৩১টি মামলা ছিল আগে থেকেই। করোনা টেস্ট নিয়ে প্রতারণার দায়ে উত্তরা পশ্চিম থানায় দায়েরকৃত র‌্যাবের মামলাসহ সংখ্যা দাঁড়ায় ৩২। আর সাহেদ গ্রেফতার হওয়ার পর তার বিরুদ্ধে যত অভিযোগ প্রকাশ পাচ্ছে তার পরিপ্রেক্ষিতে শেষ পর্যন্ত মামলা সংখ্যা ঠিক কত হতে পারে তা ধারণা করাও মুশকিল হয়ে পড়েছে। প্রশ্ন হচ্ছে, সাহেদের যে এত অপরাধ, তিনি যে এত মানুষকে নিঃস্ব করেছেন, দেশ ও জাতির সঙ্গে প্রতারণা করেছেন, এসবের কি কার্যকর অর্থে কোনো বিচার হবে? সাহেদ কি তার কৃত অপরাধের সমান শাস্তি পাবে? এ বিষয়ে সন্দেহ সংশয় প্রকাশ করেছেন আইনজীবীরা। ঢাকা বারের সিনিয়র অ্যাডভোকেট মাহবুবুর রহমানের মতে, সাহেদসহ ১৭ জনের বিরুদ্ধে র‌্যাব দায়েরকৃত মামলায় ব্যবহৃত ধারাগুলো ততটা শক্ত নয়। এজাহারে তার অপরাধগুলোকে দন্ডবিধির ৪০৬, ৪১৭, ৪৬৫, ৪৬৮, ৪৭১ ও ২৬৯ ধারার আওতায় আনা হয়েছে। বলা হয়েছে, কোভিড-১৯ রোগীদের টেস্ট নিয়ে বিশেষ প্রতারণা, বিশ্বাস ভঙ্গ, জাল জালিয়াতি, ভুল ভুয়া রিপোর্টকে খাঁটি রিপোর্ট বলে চালিয়ে দেয়া এবং কোভিড-১৯ সংক্রমণ বিস্তারে ভূমিকা রাখার অপরাধ করেছে আসামীরা।

এসব ধারার মধ্যে সর্বোচ্চ শাস্তি রয়েছে ৪৬৮ ধারায় ৭ বছরের কারাদন্ড। বিচারে অপরাধ প্রমাণিত হলে এ মামলায় তাকে সর্বোচ্চ ৭ বছর কারাদন্ড ভোগ করতে হবে। মামলায় আরও ধারা থাকলেও সর্বোচ্চ ধারার ভেতর বাকিগুলোর শাস্তি পরিগণিত হবে। এমনকি তার বিরুদ্ধে আগের যে ৩১টি মামলা রয়েছে এবং আরও যেসব মামলা হচ্ছে সেগুলোও যদি বিচারে প্রমাণিত হয় এবং ৪৬৮ ধারার চেয়ে কঠিন কোনো ধারা উল্লেখ না থাকে সেগুলোর শাস্তি ও একই সঙ্গে পরিগণিত হবে।

ঢাকা বারের এই সিনিয়র আইনজীবী বলেন, একাধিক মামলায় কেউ দন্ডিত হলে সবগুলোর দন্ড একইসঙ্গে পরিগণিত হবে। যদি সাহেদের বিরুদ্ধে দায়ের হওয়া মামলা বিচারে প্রমাণিত হয় তাহলে তাকে ৭ বছরের বেশি কারাভোগ করতে হবে না। তবে দন্ডবিধিতে মামলা করে সাহেদের অপরাধকে গৌন করে দেখা হচ্ছে বলে মনে করেন দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) অবসর প্রাপ্ত জেলা জজ এবং সাবেক মহাপরিচালক (লিগ্যাল) মো. সাইদুল ইসলাম। তিনি বলেন, যে ধারায় মামলা হয়েছে তা দিয়ে তার যথাযথ শাস্তি নিশ্চিত করা কঠিন।

প্রকাশিত তথ্যে যেটুকু জানা যাচ্ছে, সেটি হচ্ছে, সাহেদ অপরাধমূলক কর্মকান্ডের মাধ্যমে অর্থ রোজগার করেছেন। এই গ্রাউন্ডে তার বিরুদ্ধে অধিক কঠোর শাস্তি দেয়ার মতো মামলা হতে পারতো। সেটি হয়নি। অর্থপাচার আইনে উল্লেখিত প্রায় সবগুলো অপরাধই তিনি করেছেন। তাই এ আইনে মামলা করে আইনশৃংখলা বাহিনীর উচিত তার সব একাউন্ট জব্দ করা। আদালতের আদেশ নিয়ে তার স্থাবর অস্থাবর সম্পত্তি ক্রোক করা।

তিনি বলেন, র‌্যাব যেসব ধারায় মামলা করেছে, সেগুলো হালকা ধারা। জামিন লাভ সহজ। দেশের বিচারব্যবস্থা বিবেচনায় তার কৃতকর্মের যথাযথ বিচার হওয়ার সম্ভাবনা কম। বিভিন্ন ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে তিনি যে প্রতারণা ও আত্মসাৎ করেছেন, সেগুলোর জন্য ভুক্তভোগীদের পৃথক মামলা করতে হবে। যে ঘটনায় তার বিরুদ্ধে মামলাটি হয়েছে সেটির সঙ্গে সেগুলো সম্পর্কিত নয়। অবসরপ্রাপ্ত এই বিচারক বলেন, দন্ডবিধির যেসব ধারা মামলায় যুক্ত করা হয়েছে সেসব হাতুড়ে ডাক্তারের কাজ কারবারের মতো। ১৮৬০ সালে প্রণীত দন্ডবিধির ৪৬৮ ধারা যুক্ত করা হয়েছে। যদি কাগজে কলমে জালিয়াতি প্রতারণা মামলা করা হতো, তাহলে এসব ধারা ঠিক ছিলো। কিন্তু সাহেদ জালিয়াতি করেছেন ডিজিট্যাল পদ্ধতিতে। তাহলে ডিজিট্যাল সিকিউরিটি এখানে কোথায়? প্রযোজ্য ধারাগুলো প্রয়োগের সুযোগ এখনো যায়নি। আইনের সঠিক প্রয়োগ না হলে তো অপরাধী সুযোগ নেবেই।

ভিআইপি প্রতারক সাহেদ সম্পর্কে একই দিন দ্বিতীয় আরেকটি যে সংবাদ পতিবেদন দৈনিক ইনকিলাবের প্রথম পৃষ্ঠায় প্রকাশিত হয়, তার শিরোনাম ছিল, সাহেদের উপরে ওঠার সিঁড়ি ছিল সুন্দরী নারী। প্রতিবেদনে বলা হয়, ভিআইপি প্রতারক সাহেদ করিম বহুমুখী ব্যবসার নামে বিভিন্ন পরিচয়ে মানুষের সঙ্গে প্রতারণা করতেন। কখনো সেনাবাহিনীর মেজর বা কর্নেল, কখনো আওয়ামী লীগ নেতা অথবা প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের সাবেক কর্মকর্তা এমন নাম পরিচয়ে কাজ বাগিয়ে নিতেন। এমনকি ভারতের সাবেক প্রেসিডেন্ট প্রণব মুখার্জী, বাংলাদেশের সাবেক প্রেসিডেন্ট জিল্লুর রহমান, আইনমন্ত্রী আওয়ামী লীগের সিনিয় কয়েকজন নেতা, স্বাস্থ্য মন্ত্রীর সঙ্গে তার ছবি দেখিয়ে কাজ আদায় করে নিতেন। আবার কাউকে সুন্দরী নারী উপহার দিতেন। আবার কাউকে কাউকে নারী ঘটিত কেলেঙ্কারিতে জড়ানোর ভয় দেখিয়ে কাজ বাগিয়ে নিতেন। সুন্দরী নারীই ছিল সাহেদের ব্যবসায়িক সাফল্য ও উপরে উঠার সিঁড়ি। এই সুন্দরী নারী ব্যবসার কারণে তার স্ত্রী সাদিয়া সংসার ছেড়ে বাপের বাড়ি সিলেট চলে গিয়েছিলেন।

সূত্র জানায়, রাজনীতিক, আমলা, ইঞ্জিনিয়ার, ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা কে কিসে খুশি হন প্রথম দিকের কথাবার্তার মধ্যেই বুঝতে পারতেন ধূর্ত সাহেদ। এজন্য রিজেন্ট হাসপাতালসহ সব ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে সহকারী হিসাবে রাখতেন সুন্দরী নারী। আর এই নারীদের নানাভাবে কাজে লাগাতেন। আবার কখনো নারীর ভয় দেখিয়ে কাজ বাগিয়ে নিতেন। মূলত উপরতলায় সাহেদকে অবাধ সুযোগ করে দিয়েছে সুন্দরী নারী।

একাধিক টিভির টকশোতে সাহেদের সঙ্গে আলোচনায় অংশ নিতেন এমন একজন নেতা জানান, সাহেদ দামী গাড়িতে চলাফেরা করতো। ওর সাথে তিনজন বডিগার্ডসহ সব সময় এক একজন সুন্দরী নারী থাকতো। তাকে সে ব্যক্তিগত সেক্রেটারি হিসাবে পরিচয় দিতেন। তার স্ত্রী সাদিয়া মাসে এক সময় বিটিভিতে খবর পড়তেন। তিনি জানান, তিনি যে এমন প্রতারক তা তিনি জানতেন না। নানা অপকর্মের সময় তিনি সাহেদকে অনেক সুযোগ করে দিয়েছেন বলে দাবি করেন। আমি সংসার ছেড়ে চলে গিয়েছিলাম। কী কারণে গিয়েছিলাম পরিবারের সকলেই তা জানেন। কিন্তু দুটি সন্তানের কথা ভেবে আগের সংসারে ফিরে এসেছি। ভেবেছিলাম, একসময় সে শুধরে উঠবে। এক সময় আমাদের পরিবারে খুব খারাপ সময় গিয়েছে। ২০০৮ সালে ও ২০১১ সালে সাহেদ জেল খেটেছে। তারপর মনে করলাম, সে শুধরে যাবে। কিন্তু এখন দেখছি সে শুধরায়নি। তবে গণমাধ্যমে সাহেদের বিরুদ্ধে তদন্তের যে দাবি উঠেছে তাকে সমর্থন করে তিনি বলেন, তার তদন্ত ও বিচার হওয়া উচিত। সূত্র আরও জানায়, ভিআইপি প্রতারক সাহেদ সুন্দরী নারী ও টাকা দিয়েও ব্যর্থ হয়েছেন জাতীয় অলিম্পিক কমিটির সহ-সভাপতি হতে। প্রভাব খাটিয়ে এবং সুন্দরী নারী ব্যবহার করার চেষ্টা করেও ব্যর্থ হয়েছেন। তার কাউকে হাত করার উপায় যেমন ছিল সুন্দরী নারী উপহার দেয়া, তেমনি ছিল টর্চার সেল।

উপরে ভিআইপি প্রতারক সাহেদের নানা ধরনের অপকর্মের যে তথ্য দেয়া হলো, তার তদন্ত সাপেক্ষে যথাযথ শাস্তির দাবি উঠেছে সর্বমহল থেকে। এমন কি তার স্ত্রীও মনে করেন, সাহেদের এসব অন্যায় অপকর্মের যথাযথ তদন্ত ও বিচার হওয়া উচিৎ। অবশ্য অনেকের মনেই প্রশ্ন: এই ধড়িবাজের বিচার ও শাস্তি আদৌ হবে কি?

এতদিনে সাহেদ সম্পর্কে দুর্নাম এতটাই ছড়িয়ে পড়েছে যে, এখন আর সরকার এ ব্যাপারে চোখ বুঝে থাকতে পারছে না। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে ঘোষণা দেয়া হয়েছে, ভিআইপি প্রতারক সাহেদকে আর কোনমতেই বরদাস্ত করা হবে না। সে নিরিখে তাকে গ্রেফতার করা হয়েছে। কিন্তু যে মহা প্রতারক সাহেদ এতদিন এত অপরাধ করেও অধরা থেকেই গেছে, তাকে ধরার দাবি তো জনগণ তুলেছে অনেক আগে থেকেই। প্রশাসনের যাদের প্রশ্রয়ে সে মহা প্রতারকের পরিণত হলো তার দায় প্রশাসন তথা সরকারকেও অবশ্যই বহন করতে হবে। আমরা আশা করব, সরকার দ্রুততম সময়ের মধ্যে ভিআইপি প্রতারক সাহেদকে যথাযথ শাস্তিদানের ব্যবস্থা নিশ্চিত করা হবে।



 

Show all comments
  • Jack Ali ২৩ জুলাই, ২০২০, ৬:৩০ পিএম says : 0
    When head is absolutely corrupt ----------- nothing will happen this cheater/criminal''
    Total Reply(0) Reply

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: ধড়িবাজ
আরও পড়ুন