পবিত্র লাইলাতুল বরাত
আজ দিবাগত রাত পবিত্র লাইলাতুল বরাত। পরম করুণাময় আল্লাহতায়ালা তার বান্দাদের গুনাহ মাফ, বিপদমুক্তি ও
করোনা মহামারীর দুর্দিনে দেশের রাষ্ট্রায়াত্ব পাটকলগুলো বন্ধ ঘোষণা করার মধ্য দিয়ে স্থায়ী-অস্থায়ী অর্ধলক্ষাধিক পাটকল শ্রমিককে বেকারত্বের মুখে ঠেলে দেয়া হল। পঞ্চাশের দশক থেকে একাত্তর পর্যন্ত বাংলাদেশের রাষ্ট্রায়াত্ব পাটকলগুলো দেশের অর্থনীতির মূল চালিকাশক্তি হয়ে উঠেছিল। বাংলাদেশের পাটশিল্প দেশের কৃষি, কৃষক, রফতানি বাণিজ্য এবং মূলধারার জাতীয় অর্থনীতির মধ্যে একটি অর্থবহ নিবিড় সমন্বয় ও সাযুজ্য বিধান করতে সক্ষম হয়েছিল। এ শিল্পের প্রসার মানে কিছু শ্রমিকের কর্মসংস্থান আর মালিকশ্রেণীর পুঁজির স্ফীতি নয়, এর সাথে দেশের লাখ লাখ প্রান্তিক পাটচাষী, মধ্যস্বত্বভোগী ও পাটকল শ্রমিকদের ভাগ্যও জড়িয়ে আছে। একাত্তুরে মহান মুক্তিযুদ্ধের পর দেশের পাটখাত পরিকল্পিত ষড়যন্ত্রের শিকার হয়। স্বাধীনতার পর একের পর এক পাটের গুদামে আগুন, রাষ্ট্রায়াত্ব পাটকলগুলোতে শ্রমিক অসন্তোষ, শ্রমিক আন্দোলনের নামে, আঞ্চলিকতার দ্ব›েদ্বর নামে দেশের বৃহত্তম পাটকল আদমজীসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে যেসব সহিংস ঘটনার জন্ম দেয়, তা পাটকলগুলোর উৎপাদন সক্ষমতাকে চরমভাবে ব্যাহত করে। লোকসানের মুখে বাংলাদেশের পাটকলগুলো যখন বন্ধ হতে শুরু করে তখন ভাগীরথির ওপারে পশ্চিমবঙ্গে নতুন নতুন পাটকল স্থাপিত হতে থাকে। মূলত বাংলাদেশে উৎপাদিত কাঁচা পাটের উপর ভর করেই ভারতে নতুন এসব পাটকল গড়ে উঠে। সম্ভবত পাট ও পাটপণ্যে বাংলাদেশের ট্রাডিশনাল রফতানি বাজারকে করায়ত্ব করাই ছিল ভারতের পাটশিল্প সম্প্রসারণের মূল লক্ষ্য। দীর্ঘ প্রচেষ্টায় ভারতের সে লক্ষ্য অনেকটাই সফল। গত ৫০ বছরে বাংলাদেশের পাটশিল্প ভেতর থেকে যতই দুর্বল হয়েছে, ভারতের পাটশিল্প ততই বেগবান হয়েছে। পাটের বিশ্ববাণিজ্যের কর্তৃত্ব বাংলাদেশের কাছ থেকে ভারতের হাতে চলে গেছে। এখনো বিশ্বে পাট উৎপাদনে বাংলাদেশই প্রথম। সবচেয়ে উৎকৃষ্ট মানের পাট বাংলাদেশেই উৎপাদিত হয়। বেসরকারিভাবে পাটের গবেষণা, পাটপণ্যের নতুন নতুন ব্যবহার এবং সম্ভাবনার নতুন নতুন ক্ষেত্র আবিস্কৃত হচ্ছে। আমাদের বিজ্ঞানী-উদ্ভাবকরা একদিকে পাটের জিনোম সিকোয়েন্স উদঘাটন করেন, অন্যদিকে পাট থেকে সেলুলোজ নিংড়ে পরিবেশবান্ধব পলিথিন উদ্ভাবন করে বিশ্বের সামনে নতুন সম্ভাবনার দুয়ার উন্মোচন করেন।
বিগত দশক থেকে একের পর এক প্রাকৃতিক দুর্যোগ-দুর্বিপাকের আঘাত বিশ্বকে বিপর্যস্ত করে তুলেছে। জলবায়ুর পরিবর্তন, উষ্ণায়ণ, হিমালয়ের আইসক্যাপ গলে গিয়ে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতাবৃদ্ধি, প্রশান্ত-আটলান্টিক-ভারত মহাসাগরের তলদেশে ভূমিকম্প এবং প্রলয়ঙ্করী সুনামিতে হাজার হাজার মানুষের মৃত্যু থেকে চলমান করোনাভাইরাস মহামারী পর্যন্ত সব প্রাকৃতিক দুর্যোগের সাথে পরিবেশ দূষণ, পরিবেশের ভারসাম্যহীনতা এবং মানুষের অপরিনামদর্শী জীবনাচারকে দায়ী করা হচ্ছে। ইন্টারন্যাশনাল সেন্টার ফর বায়োলজিক্যাল ডাইভারসিটির এক রিপোর্টে বলা হয়েছে, ২০৫০ সাল নাগাদ বিশ্বের সমুদ্রগুলোতে মাছের চাইতে প্লাস্টিক বর্জের পরিমান বেড়ে যাবে। পরিবেশ দূষণ তথা মাটি, পানি ও বাতাসের দূষণ ও ভারসাম্যহীনতার কারণে ইতিমধ্যে বিশ্বের জনস্বাস্থ্য এবং ভূ-প্রকৃতিতে যেসব বিপর্যয় দেখা দিয়েছে, এ ধারা অব্যাহত থাকলে সামনে আরো কত কি ঘটবে, তা ভেবে বিজ্ঞানী ও পরিবেশবাদিরা উদ্বেগ প্রকাশ করছেন। পরিবেশের ভারসাম্যহীনতার কারণে ইতিমধ্যে সমুদ্রে এবং ভূ-পৃষ্টের হাজার হাজার প্রাণী প্রজাতি বিলুপ্ত হয়ে জীববৈচিত্র্যের উপর বড় ধরনের নেতিবাচক প্রভাব সৃষ্টি করেছে। ইউরোপের পরিবেশবাদিরা চারদশক আগে থেকেই এ বিষয়ে বিশ্বসংস্থাগুলোর কাছে নানাবিধ সতর্কবার্তা, আন্দোলন ও দাবি-দাওয়া তুলে ধরলেও পুঁজিবাদী সা¤্রাজ্যবাদ তা কখনো আমলে নেয়নি। যখন দেখা গেল, বিশ্বকে ধ্বংস করার পারমানবিক ক্ষমতা দিয়ে হারিকেন ক্যাটেরিনার মত সামুদ্রিক ঘূর্ণিঝড়ের আঘাত মোকাবেলা করা যায় না, ওজনস্তর ক্ষয়প্রাপ্ত হওয়ার কারণে বিশ্বে ছড়িয়ে পড়া অতিবেগুণী রশ্মির প্রভাবে ক্যান্সারসহ নানাবিধ দুরারোগ্য ব্যাধির প্রকোপ মোকাবেলা করা অসম্ভব হয়ে পড়ছে, তখনি তারা গতানুগতিক উন্নয়ন প্রকল্পের ধারণার বদলে টেকসই উন্নয়ন প্রকল্প এবং পরিবেশবান্ধব পণ্য ও জীবনাচারের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করতে শুরু করেছে। তবে ইতিমধ্যে অনেক দেরি হয়ে গেছে। কোটি কোটি টন পলিথিন, রাসায়নিক বর্জ্য সব সমুদ্রে, নদ-নদীতে, মাটিতে, পানিতে ও বাতাসে ছড়িয়ে পড়েছে। খাদ্য, বাতাস, পানি ও নানাবিধ ব্যবহার্য পণ্যের মাধ্যমে মানুষের শরীরে ঢুকে পড়েছে ক্যানসারসহ দুরারোগ্য ব্যাধি। এ থেকে মুক্তির উপায় হিসেবে কৃত্রিম সিনথেটিক পণ্যের বদলে প্রাকৃতিক ও পরিবেশবান্ধব পণ্য ব্যবহারের কথা বলছেন পরিবেশবাদি ও স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা। প্লাস্টিক ও পলিয়েস্টার তন্তুর বদলে তুলা, রেশম ও পাটপণ্য, প্রাকৃতিক তন্তু ও পশুর চামড়া ব্যবহারের গুরুত্ব বুঝতে অনেক বেশি সময় নিয়েছে বিশ্বের মানুষ। এভাবেই আমাদের পাটশিল্প ও পাটপণ্যের সামনে নতুন বৈশ্বিক অর্থনৈতিক সম্ভাবনার হাতছানির কথা আবারো উঠে আসে।
বিশ্বব্যাপী প্রাকৃতিক তন্তুর চাহিদাবৃদ্ধি এবং অর্থনৈতিক সম্ভাবনার কথা পুনরুচ্চারিত হওয়ার সাথে সাথেই উঠে আসে বাংলাদেশের পাটশিল্পের নতুন সম্ভাবনার কথা। এই একটি প্রাকৃতিক তন্তুর উপর ঐতিহ্যগতভাবে বাংলাদেশের একাধিপত্য রয়েছে। গত চার-পাঁচ দশকে এ পাট নিয়ে ষড়যন্ত্র ও আত্মঘাতী তৎপরতা অব্যাহত থাকা সত্তে¡ও পাটের উৎপাদন এবং বেসরকারি উদ্যোগে পাটের আন্তর্জাতিক বাজারে প্রভাব অক্ষুন্ন রাখার সম্ভাবনা এখনো হাতছাড়া হয়ে যায়নি। দেশের রাষ্ট্রায়াত্ব পাটকলগুলো যখন ধুঁকে ধুঁকে মরতে বসেছে, তখন বেসরকারি উদ্যোগে পাটশিল্প সম্ভাবনার জানান দিচ্ছে। তবে বিগত সময়ে দেশের রাষ্ট্রায়াত্ব শিল্পপ্রতিষ্ঠানগুলো বেসরকারি মালিকানায় ছেড়ে দেয়ার যে প্রক্রিয়া দেখা গেছে, সেখানে কোন স্বচ্ছ প্রক্রিয়া, শিল্প বাঁচানোর জন্য উপযুক্ত শর্তাবলী, সহযোগিতা ও নজরদারির ব্যবস্থা না থাকায় নামমাত্র মূল্যে ছেড়ে দেয়া সরকারি শিল্পপ্রতিষ্ঠানগুলোর বেশিরভাগ মূলত একশ্রেণীর ঠগবাজ-প্রতারক ব্যক্তির হস্তগত হওয়ার পর শিল্পপ্রতিষ্ঠান ও কর্মসংস্থান রক্ষার বদলে লুটপাট বেচাবিক্রির মধ্য দিয়ে কয়েকগুন লাভ উঠিয়ে নিয়ে বিশাল জায়গাজমি পতিত জমিতে পরিণত হয়েছে অথবা তার উপর অনুৎপাদনশীল অবকাঠামো গড়ে উঠতে দেখা গেছে। অথবা এসব সরকারি সম্পদের উপর কোটি কোটি টাকা ব্যাংকঋণ নিয়ে টাকা বিদেশে পাচার করা হয়েছে। খুলনা-নারায়নগঞ্জ, নরসিংদীসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে থাকার রাষ্ট্রায়াত্ব পাটকলের হাজার হাজার কোটি টাকার যন্ত্রপাতি, অবকাঠামো, হাজার হাজার বিঘা জমি এবং অনিশ্চয়তার মধ্যে ধুঁকে ধুঁকে বাঁচা হাজার হাজার শ্রমিকের জীবনের মূল্য পরিশোধ বা ক্ষতিপুরণের সক্ষমতা আমাদের রাষ্ট্রের নেই। দেশের খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত রাখতে সরকারের পক্ষ থেকে এক ইঞ্চি জমিও পতিত না রাখার কথা বলা হচ্ছে। অথচ দশকের পর দশক ধরে হাজার হাজার কোটি টাকায় গড়ে তোলা রাষ্ট্রায়াত্ব শিল্প কারখানাগুলোকে পতিত রেখে এসব কারখানার যন্ত্রপাতি ও অবকাঠামোগুলোকে ভাগাড়ে পরিণত করা হল কোন বিবেচনায়, কার স্বার্থে?
অনেক প্রতিবন্ধকতা সত্তে¡ও মূলত বেসরকারি উদ্যোগে ও বিনিয়োগে প্রতিষ্ঠিত বাংলাদেশের গার্মেন্টশিল্প, ওষুধশিল্প, জাহাজ নির্মানশিল্প বিশ্ববাজারে অব্যাহত অগ্রগতি নিয়ে এগিয়ে চলেছে। বেশিরভাগ কাঁচামাল বিদেশ থেকে আমদানি করে করেই এসব শিল্পকারখানায় লাখ লাখ মানুষের কর্মসংস্থান এবং হাজার হাজার কোটি ডলারের রেমিটেন্স আয় অব্যাহত থাকলেও দেশের কৃষকদের উৎপাদিত শতভাগ দেশীয় কাঁচামাল, সুলভ শ্রমিক, বিজেএমসি’র জনবল ও প্রশাসনিক কাঠামো এবং সরকারি বিনিয়োগের উপর গড়ে ওঠা রাষ্ট্রায়াত্ব পাটকলগুলো কেন টিকতে থাকতে পারল না, তা নিয়ে যেন কোরো কোনো জবাবদিহিতা নেই। অথচ বাংলাদেশ থেকে কাঁচা পাট নিয়ে ভারতীয় পাটকলগুলো বিশ্ববাজার দখল নিয়েছে। দেশের পাটশিল্প নিয়ে রাজনীতিও কম হয়নি। অব্যাহত লোকসানের মুখে রাষ্ট্রায়াত্ব পাটকলগুলো বন্ধ হয়ে যাওয়ার ধারাবাহিক তৎপরতা নিয়ে বিরোধীদল সব সময়ই সরকারের সমালোচনা করেছে। বাহাত্তুর সাল থেকে ধ্বংসাত্মক অগ্রযাত্রার সাক্ষী পাটকলগুলোর লোকসান বাড়তে বাড়তে এর দায় বহনে সরকারের পক্ষে যখন দুর্বহ হয়ে ওঠে, তখন বিশ্বব্যাংকের টোপ গিলে দেশের বৃহত্তম আদমজী পাটকল বন্ধ করে দেয়ার পদক্ষেপ নেয় বিএনপি নেতৃত্বাধীন চারদলীয় জোট সরকার। যেখানে ভারতে পাটশিল্পের বিকাশ ঘটছে, বিশ্বব্যাংকের সহায়তায় নতুন পাটকল গড়ে উঠছে তখন এক সময়ের বিপুল লাভজনক, হাজার হাজার শ্রমিকের কর্মসংস্থানে ঐতিহ্যবাহী বিশ্বের বৃহত্তম পাটকলটির অব্যবস্থাপনা ও দুর্নীতি বন্ধ করে আধুনিকায়ন ও স্বচ্ছ ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে লাভজনক প্রতিষ্ঠানে পরিণত করার উদ্যোগের বদলে তা বন্ধ করে দেয়ার প্রক্রিয়ার বিরুদ্ধে আওয়ামীলীগের রাজনৈতিক অবস্থান ছিল চোখে পড়ার মত। আওয়ামীলীগ নেতৃত্বাধীন মহাজোটের নির্বাচনী ইশতেহারে আদমজী পাটকল পুনরায় চালুর প্রতিশ্রæতি ছিল। মহাজোট ক্ষমতায় আসার পর গত এক দশক ধরে পাটশিল্প নিয়ে সরকারের নানাবিধ পরিকল্পনা ও প্রতিশ্রæতিতে মানুষের মধ্যে নতুন প্রত্যাশার জন্ম দিয়েছিল। ইতিপূর্বে বন্ধ হয়ে যাওয়া কয়েকটি পাটকল পুনরায় শুরু করার পাশাপাশি পাটশিল্পে নতুন নতুন উদ্ভাবন ও নতুন বৈশ্বিক অর্থনৈতিক সম্ভাবনার স্বপ্ন দেখে সে প্রত্যাশা আরো বেড়ে গিয়েছিল। বাংলাদেশী বিজ্ঞানীর পাটের জিনোম সিকোয়েন্স উদ্ভাবন, বাংলাদেশের জিআই বা ভৌগলিক নির্দেশক হিসেবে পাটপণ্যের স্বীকৃতির সম্ভাবনা, উপকারী ভেষজ চা হিসেবে অর্গানিক পাটপাতার ব্যবহার ও আন্তর্জাতিক বাজারের সম্ভাবনা, পলিথিনের বিকল্প হিসেবে পাটের সেলুলোজ থেকে উদ্ভাবিত সোনালিব্যাগ উৎপাদন ও বিশ্বব্যাপী রফতানি ও বিপণনের যে অর্থনৈতিক সম্ভাবনা দেখা গিয়েছিল, শেষ পর্যন্ত ২৫টি রাষ্ট্রায়াত্ব পাটকল বন্ধের হঠকারি সিদ্ধান্তের মধ্য দিয়ে সে অবস্থান থেকে ১৮০ ডিগ্রী ঘুরে যাওয়ার বাস্তবতা মেনে নেয়া কঠিন।
বাংলাদেশের রাষ্ট্রায়ত্ব পাটকলগুলোর উৎপাদন সক্ষমতা কমে যাওয়া বা বন্ধ হয়ে যাওয়ায় দেশে উৎপাদিত কাঁচা পাটের একক বাজার হয়ে উঠে ভারত। দেশে উৎপাদিত উৎকৃষ্টমানের পাটগুলো ভারতের পাটকলগুলোতে চলে যাওয়ার মধ্য দিয়ে বিশ্ববাজারে বাংলাদেশের পাটপণ্য ভারতের কাছে বাজার হারাতে শুরু করে। বিশ্বব্যাপী প্রাকৃতিক তন্তুর চাহিদা বৃদ্ধি এবং বাংলাদেশের পাটের সুদিন ফিরিয়ে আনতে সরকারের পক্ষ থেকে যখন নানামাত্রিক উচ্ছ¡াস ও প্রত্যাশার কথা বলা হচ্ছিল। বন্ধ হয়ে যাওয়া কয়েকটি রাষ্ট্রায়াত্ব পাটকলে উৎপাদন শুরু হয়েছিল। এমনই সময়ে ২০১৭ সালের জানুয়ারীতে অপ্রত্যাশিতভাবে ভারতের পক্ষ থেকে বিনা মেঘে বজ্রপাতের মত বাংলাদেশের পাট ও পাটপণ্যের উপর এন্টিডাম্পিং করের বোঝা চাপিয়ে দেয়া হয়। এটি যেনতেন ব্যারিয়ার নয়, পাটকলের মান ও অবস্থানভেদে প্রতি মেট্টিক টনে ২০ মার্কিন ডলার থেকে ৩৫২ ডলারের করের সুউচ্চ দেয়াল খাড়া করিয়ে দেয়া হয়। এটি ছিল ভারতের পক্ষ থেকে বাণিজ্যিক প্রটোকল ও শিষ্টাচার বর্জিত পদক্ষেপ। বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে এ পদক্ষেপের বিরুদ্ধে তেমন কোনো জোরালো প্রতিবাদ দেখা যায়নি। ভারতের রফতানি বাণিজ্যের বিশাল বাজার হওয়ার কারণে বাংলাদেশ সহজেই এর বিরুদ্ধে পাল্টা পদক্ষেপ নিতে পারত। বাণিজ্য ঘাটতির সুযোগে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে চীনা পণ্যের উপর হাজার হাজার কোটি ডলারের ট্যাক্স নির্ধারণের মধ্য দিয়ে চীন-মার্কিন বাণিজ্যযুদ্ধই শুধু হয়নি, এর মধ্য দিয়ে দুই অর্থনৈতিক পরাশক্তি একটি বাণিজ্যিক সমঝোতায় পৌঁছতে সক্ষম হয়েছে। বাণিজ্য ঘাটতি কমিয়ে আনতে শত শত বিলিয়ন ডলারের মার্কিন কৃষিপণ্য আমদানির প্রস্তাবে সাড়া দিয়েছে চীন। সম্প্রতি করোনার অজুহাতে স্থলবন্দর দিয়ে ভারতের পক্ষ থেকে বাংলাদেশী পণ্য আমদানি বন্ধ করে দেয়ার পর বাংলাদেশী আমদানিকারকরাও ভারতীয় পণ্য আমদানি বন্ধ করে দিলে দুই পক্ষের সমঝোতার পথ তৈরী হয় এবং পরিস্থিতি স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে আসতে শুরু করে। পাটের উপর ভারতের এন্টিডাম্পিং করের বিরুদ্ধে বাংলাদেশ উপযুক্ত পদক্ষেপ নিতে ব্যর্থ হয়েছে। বাংলাদেশে গরু রফতানি বন্ধের প্রতিক্রিয়ায় দেশে হাজার হাজার গরুর খামার গড়ে ওঠার মধ্য দিয়ে পশুসম্পদে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন করেছে বাংলাদেশ। এখন ভারতীয় গরু ছাড়াই বাংলাদেশে কোরবানির ঈদসহ সারাবছরের চাহিদা পূরণ করা সম্ভব হচ্ছে। ভারতের এন্টিডাম্পিং ব্যারিয়ারের জবাবে বাংলাদেশ সরকার সরকারি বেসরকারি সব পাটকলে উৎপাদন বৃদ্ধি, মানোন্নয়ন এবং আন্তর্জাতিক বাজার ধরার প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেয়ার উদ্যোগ নিলে তা সফল হওয়ার সম্ভাবনাই বেশি ছিল। সেদিকে না গিয়ে এই করোনার সময় দেশের সবগুলো রাষ্ট্রায়াত্ব পাটকল বন্ধ করে দিয়ে সরকার ভারতীয় কূটকৌশল ও ভারতের পক্ষে বিশ্বব্যাংকের কারসাজির কাছেই যেন আত্মসমর্পণ করল। আদমজী পাটকল বন্ধ করে দেয়ায় এতদিন ধরে বিএনপির উপর বেøইমগেমের রাজনীতি করছিল সরকার। সব সরকারি পাটকল বন্ধ করে দিয়ে বর্তমান সরকার চারদলীয় জোট সরকারের পদাঙ্কই অনুসরণ করল।
রাষ্ট্রায়াত্ব পাটকল বন্ধ হয়ে যাওয়া মানে বাংলাদেশের পাটের অর্থনৈতিক সম্ভাবনা শেষ হয়ে যাওয়া নয়। বিশ্বব্যাংকের প্রেসক্রিপশনে পাটকল বন্ধের যে শর্তই থাক না কেন, বন্ধ হয়ে যাওয়া পাটকলের বিশাল অবকাঠামো ও সম্পদের উপর বেসরকারি উদ্যোগে পাট পাটপণ্যের নতুন কর্মউদ্যোগ ও উৎপাদনব্যবস্থা গড়ে তোলার কার্যকর উদ্যোগ নেয়া যেতে পারে। কাঁচা পাট রফতানি বন্ধ করে পাটের সুতা, গালিচা-কার্পেট, সোফার কাপড়, পর্দার কাপড়, তাবু, ব্যাগ, দড়ি, গাড়ীর সিট-কভারসহ নানা রকম হ্যান্ডিক্রাফট উৎপাদনের মধ্য দিয়ে দেশের রফতানি বাণিজ্য ও অর্থনীতির জন্য নতুন সম্ভাবনার দুয়ার খুলে দেয়া অসম্ভব নয়। পাটপাতা থেকে সবুজ চা উৎপাদন এবং তা এখন জার্মানিতে রফতানি শুরু হয়েছে। এর উপকারিতা সম্পর্কে প্রমোশনাল প্রচারনা শুরুর পাশাপাশি বিপণন ও উৎপাদন সক্ষমতা বৃদ্ধির মাধ্যমে পাটের চা হতে পারে সম্ভাবনাময় রফতানি পণ্য। পলিথিনের পরিবেশবান্ধব বিকল্প হিসেবে পাট থেকে পাটকলে উৎপাদিত সোনালি ব্যাগের বিশ্বব্যাপী চাহিদার কথা নতুন করে বলার কিছু নেই। বাণিজ্যিক উৎপাদনে যাওয়ার আগেই ইউরোপের বিভিন্ন দেশ থেকে যে পরিমান আগ্রহ ও অগ্রীম সম্ভাব্য ক্রয়াদেশ পাওয়া গেছে, তাতে এর বিশাল অর্থনৈতিক সম্ভাবনা নিশ্চিত। যেসব কারণে আন্তর্জাতিক বাজারে ভারতের কাছে বাংলাদেশী পাটপণ্য মার খাচ্ছে সেসব প্রতিবন্ধকতা দূর করা খুব কঠিন কিছু নয়। বাংলাদেশ থেকে কাঁচা পাট কিনে ভারতের পাটকলগুলো ক্রমবর্ধমান হারে লাভ করছে। সরকারি অব্যবস্থাপনা ও নানাবিধ ব্যর্থতা সত্তে¡ও বাংলাদেশের বেসরকারি পাটকলগুলোও এখনো লাভজনক অবস্থায় টিকে আছে। গার্মেন্টস সেক্টর ও ওষুধ শিল্পের মত বিদেশ থেকে আমদানি নির্ভর কাঁচামালে রফতানিমুখী শিল্পের চেয়ে পাট ও পাটপণ্যের রফতানিতে অর্থনৈতিক সম্ভাবনা অনেক বেশি।
বিশ্বজুড়ে পরিবেশগত সচেতনতা, প্লাস্টিক ও সিনথেটিক পণ্যের বিরুদ্ধে দেশে দেশে নিষেধাজ্ঞা জারি এবং প্রাকৃতিক তন্তুর প্রতি আগ্রহ বৃদ্ধির কারণে গত দশ বছর ধরে পাটের সুদিন ফিরে আসার গল্প শোনা যাচ্ছিল। বিশেষত জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা(এফএও) ২০০৯ সালকে প্রাকৃতিক তন্তু বর্ষ হিসেবে ঘোষণা করে প্রাকৃতিক তন্তুর স্বাস্থ্য ও পরিবেশগত উপযোগিতার দিকগুলো বিশ্বের সামনে তুলে ধরার মধ্য দিয়ে তুলার পাশাপাশি পাটের বিশ্ববাজার অর্থনৈতিক গুরুত্ব নতুনভাবে উঠে আসে। এ সুযোগ কাজে লাগিয়ে পাট ও পাটপণ্যের মত নিজস্ব ট্রাডিশনাল রফতানি পণ্যের বাজার সম্প্রসারণের মধ্য দিয়ে সে অর্থনৈতিক সম্ভাবনার কথাই বলেছে সরকার। বছরে শত শত কোটি টাকা লোকসান দেয়া রাষ্ট্রায়াত্ব পাটকলগুলোকে লাভজনক করা না গেলে তা বন্ধ করে দেয়ার যৌক্তিকতা উড়িয়ে দেয়া যায় না। তবে প্রতিটন ৫০০-৬০০ ডলারে কাঁচা পাট রফতানির বদলে প্রতিটন ৫-১০ হাজার ডলারে উন্নত পাটপণ্য রফতানির সম্ভাবনাকে কাজে লাগানোর উদ্যোগই হতে পারে রাষ্ট্রায়াত্ব পাটকল বন্ধের বিপরীতে উপযুক্ত উদ্যোগ। এ ক্ষেত্রে চীন, জাপান, জার্মানিসহ বিভিন্ন দেশের অংশিদারিত্ব ও বিনিয়োগ পাওয়ার সম্ভাবনাকে কাজে লাগানো যেতে পারে। আমরা হলফ করে বলতে পারি, ভারতের মনোপলি বাণিজ্য রুখতে কাঁচা পাট রফতানি বন্ধ করে পাটপণ্যের মানোন্নয়ন ও উপযুক্ত প্রমোশনের মাধ্যমে আন্তর্জাতিক বাজারে বাংলাদেশী পাটপণ্যের বিশাল বাজার নিশ্চিত করা সম্ভব। বিদেশ থেকে তুলা, ফেব্রিক্সসহ ব্যাকওর্য়াড লিঙ্কেজ পণ্য আমদানি করে দেশের গার্মেন্ট ফ্যাক্টরিগুলো লাভ করতে পারলে শতভাগ দেশীয় কাঁচামাল ও উৎপাদনব্যবস্থার উপর ভর করে বাংলাদেশের পাটশিল্প লাভবান না হওয়ার কোনো কারণ নেই। দেশের পাটচাষি ও পাটকল শ্রমিকদের স্বার্থ এবং জনগণের ট্যাক্সের টাকায় বেতনভুক বিজেএমসি’র জনবল কাজে লাগিয়ে বিশ্ববাজারে বাংলাদেশের পাটের অর্থনৈতিক সম্ভাবনা বাস্তবায়ণের মাধ্যমে এক সময়ের ‘গোল্ডেন ফাইবার’ পাটের সুদিন ফিরিয়ে আনা সম্ভব।
[email protected]
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।