Inqilab Logo

শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

পানিবন্দি ৩০ লাখ মানুষ

ঢাকার পূর্বাঞ্চলে পানি বৃদ্ধি পাচ্ছে : ২১ জেলায় বন্যা : সরকারি ত্রাণ অপ্রতুল

ইনকিলাব রিপোর্ট | প্রকাশের সময় : ২১ জুলাই, ২০২০, ১২:০০ এএম

বৃষ্টি আর ভারতের ঢলে দেশের বন্যা পরিস্থিতির ক্রমাগত অবনতি হচ্ছে। পদ্মা, মেঘনা, যমুনা, তিস্তা, সুরমাসহ দেশের প্রায় অধিকাংশ নদ-নদীর পানি বিপদসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। এতে গত ২৪ ঘণ্টায় ২১ জেলার নতুন নতুন এলাকা প্লাবিত হয়েছে। এতে প্রায় ৩০ লাখ মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছে। বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্র জানিয়েছে আগামী দু’তিনদিন বৃষ্টি অব্যাহত থাকতে পারে। এতে নদ-নদীর পানি বৃদ্ধি পেয়ে বন্যা পরিস্থিতির আরও অবনতির আশঙ্কা রয়েছে।
আবহাওয়ার পূর্বাভাসে বলা হয়েছে, মৌসুমি বায়ু বাংলাদেশের ওপর সক্রিয় এবং উত্তর বঙ্গোপসাগরে প্রবল অবস্থায় বিরাজ করছে। এতে দেশের উপক‚লীয় অঞ্চলসহ অনেক জায়গায় ঝড়ো হাওয়াসহ ভারি বৃষ্টি হচ্ছে। এ কারণে দেশের চার সমুদ্র বন্দরে ৩ নম্বর স্থানীয় সতর্ক সংকেত দেখাতে বলা হয়েছে। নদী বন্দরগুলোতে দেখাতে বলা হয়েছে ১ নম্বর সতর্ক সংকেত। রাজশাহী, রংপুর, ময়মনসিংহ, সিলেট এবং চট্টগ্রাম বিভাগের কোথাও কোথাও ভারি বৃষ্টির সতর্কতা জারি করা হয়েছে।
পূর্বাভাসে আরও বলা হয়, মৌসুমি বায়ুর অক্ষ পাঞ্জাব, হরিয়ানা, উত্তর প্রদেশ, বিহার, হিমালয়ের পাদদেশীয় পশ্চিমবঙ্গ ও বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চল হয়ে আসাম পর্যন্ত বিস্তৃত রয়েছে। এতে আসাম মেঘালয় ও পশ্চিমবঙ্গে ব্যাপক বৃষ্টি হচ্ছে ও বন্যার অবনতি হয়েছে। ভারতের বন্যার পানি আগামী দু’তিনদিনের মধ্যে বিভিন্ন নদী দিয়ে নেমে এসে বাংলাদেশের বন্যা পরিস্থিতির আরও অবনতি হতে পারে।
দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, দেশের বন্যাকবলিত ১৮ জেলায় পানিবন্দি মানুষের সংখ্যা ২৬ লাখ ১৭ হাজার ৩৯৮ জন। পানিবন্দি পরিবারের সংখ্যা ৫ লাখ ৮০ হাজার ৬৫৫টি। বন্যার পানি থেকে বাঁচতে এসব মানুষ কেউ নিজের বাড়িতে উঁচু মাচা করে, কেউ সরকারি আশ্রয়কেন্দ্রে, কেউ বেড়িবাঁধের ওপর, কেউ নিজের বাড়িঘর ছেড়ে আত্মীয়স্বজনের বাড়িতে, আবার কেউ খোলা আকাশের নিচে বসবাস করছেন। তবে আমাদের সংবাদদাতাদের পাঠানো তথ্য অনুযায়ী, দেশে কমপক্ষে ২১ জেলায় প্রায় ৩০ লাখ লোক পানিবন্দি। বিভিন্ন জেলার আশ্রয়কেন্দ্রে সরকারি ত্রাণ বিতরণ হচ্ছে, তবে তা প্রয়োজনের তুলনায় অপ্রতুল বলে অভিযোগ করছেন ভুক্তভোগীরা।
বন্যাকবলিত জেলাগুলো হচ্ছে- লালমনিরহাট, কুড়িগ্রাম, গাইবান্ধা, নীলফামারী, নওগাঁ, রংপুর, সিলেট, সুনামগঞ্জ, হবিগঞ্জ, নেত্রকোনা, জামালপুর, টাঙ্গাইল, সিরাজগঞ্জ, বগুড়া, রাজবাড়ী, কুষ্টিয়া, মানিকগঞ্জ, মাদারীপুর, ফরিদপুর, মুন্সীগঞ্জ ও ফেনী। বন্যার পানিতে ডুবে এ পর্যন্ত ২১ জনের মৃত্যু হয়েছে। অব্যাহত বৃষ্টিতে ঢাকার আশপাশের নদ-নদীর পানি বৃদ্ধি পাচ্ছে। এতে ঢাকার পূর্বাঞ্চলের অনেক এলাকা পানিতে তলিয়ে গেছে।
ফরিদপুর থেকে নাজিম বকাউল জানান, গত ২৪ ঘণ্টায় পদ্মার পানি আরো ২ সেন্টিমিটার বৃদ্ধি পেয়ে এখন তা বিপদসীমার ১০৬ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। টানা কয়েকদিন ধরে পদ্মার পানি বৃদ্ধি অব্যাহত থাকায় ফরিদপুর সদর উপজেলার আলীয়াবাদ ইউনিয়নে শহর রক্ষা বেড়িবাঁধ ভেঙে পানির নিচে তলিয়ে গেছে। একই এলাকায় পানির স্রোতে ভেঙে গেছে চলাচলের একমাত্র পাকা সড়কটি। তবে বেড়িবাঁধ ভাঙনের পরে পানি উন্নয়ন বোর্ড বালি ভর্তি জিও ফেলে সংস্কারের উদ্দ্যোগ গ্রহণ করলেও বৃষ্টির কারণে তা ব্যাহত হচ্ছে। এদিকে পানিবন্দি মানুষ আশ্রয় গ্রহণ করেছে শহররক্ষা বাঁধের ওপর। এসব এলাকায় দেখা দিয়েছে বিশুদ্ধ খাবার পানি, শুকনো খাবার ও গো-খাদ্যের সঙ্কট।
কুড়িগ্রাম থেকে শফিকুল ইসলাম বেবু জানান, অবিরাম বৃষ্টির কারণে ধরলা নদীর পানি গত ২৪ ঘণ্টায় ১০ সেন্টিমিটার বৃদ্ধি পেয়েছে। ধরলার পানি ব্রিজ পয়েন্টে ৪৯ সেন্টিমিটার, ব্রহ্মপুত্র নদের পানি চিলমারীতে ৫৫ ও নুনখাওয়া পয়েন্টে বিপদসীমার ৪০ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। ফলে আবারো পানিবন্দি হয়ে পড়েছে ধরলা তীরবর্তী মানুষ। অপরদিকে ব্রহ্মপুত্রের পানি অপরিবর্তিত থাকলেও বিপদসীমার ওপরে অবস্থান করায় টানা তিন সপ্তাহ ধরে মানুষ অবর্ণনীয় কষ্টের মধ্যে রয়েছে। এদিকে চিলমারী উপজেলার কাঁচকোল এলাকায় ভাঙা রাস্তা দিয়ে বন্যার পানি প্রবেশ করে উপজেলা শহরসহ নতুন করে আরে ৫০ গ্রাম প্লাবিত করেছে। এ নিয়ে জেলার ৩ লাখ মানুষ পানিবন্দি। জেলার ৭৩টি ইউনিয়নের মধ্যে ৫৬টি ইউনিয়নের ৪৭৫টি গ্রাম পানির নীচে তলিয়ে আছে।
সিরাজগঞ্জ থেকে সৈয়দ শামীম শিরাজী জানান, সিরাজগঞ্জের চলনবিল অঞ্চলে বিস্তৃর্ণ এলাকার ৪শ’ পুকুরের চাষের মাছ বন্যার পানিতে ভেসে গেছে। পানি আরো বৃদ্ধি পেলে বাকি ৩শ’ পুকুরের মাছ ভেসে যাওয়ার সম্ভাবনায় আতঙ্কিত চাষিরা। সিরাজগঞ্জের পাঁচটি উপজেলার দেড় লক্ষাধিক মানুষ পানিবন্দি। সিরাজগঞ্জের কাজিপুর, সদর, বেলকুচি, চৌহালী ও শাহজাদপুর উপজেলার যমুনা তীরবর্তী ৩৩টি ইউনিয়নের ২১৬টি গ্রামের ১ লাখ ৫৯ হাজার ১৫৩ জন মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। চরে বসবাসকারী প্রায় দেড় লক্ষাধিক মানুষ বেঁচে আছে সরকারি-বেসরকারি কিংবা বিভিন্ন এনজিও’র দেয়া ত্রাণের ওপর ভর করে।
হবিগঞ্জ থেকে মো. ফজলুর রহমান জানান, টানা বৃষ্টি আর ভারত থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢলে হবিগঞ্জের বিভিন্ন নদীতে পানি অব্যাহতভাবে বৃদ্ধি পাচ্ছে। নদীগুলোর পানি উপচে জেলার চারটি উপজেলার ফসলি মাঠ, গ্রামীণ সড়কসহ বিস্তীর্ণ এলাকা প্লাবিত হয়েছে। এতে চরম দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে এসব উপজেলার বাসিন্দাদের। রাস্তা পানিতে তলিয়ে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে বানিয়াচং-আজমিরীগঞ্জ সড়ক যোগাযোগ।
টাঙ্গাইলের ভ‚ঞাপুর থেকে আলীম আকন্দ জানান, যমুনার তীব্র ভাঙনে ৬টি বাড়ি নদীতে বিলিন হয়ে গেছে। আগে থেকেই বাড়িগুলিতে পানি উঠেছিল। নতুন করে পানি বৃদ্ধির ফলে প্রবল স্রোতের টানে অতর্কিত ভেসে যায়। গভীর রাত থাকায় কোন কিছু উদ্ধার করা যায়নি। তবে প্রাণহানির ঘটনা ঘটেনি। এসব বাড়ির লোকজন আশপাশের বিভিন্ন বাড়িতে এবং রাস্তায় আশ্রয় নিয়েছে।
ল²ীপুরের রামগতি থেকে আমানত উল্যাহ জানান, মেঘনার ভয়াবহ ভাঙন থেকে ল²ীপুরের রামগতি উপজেলার আলেকজান্ডার ইউনিয়ন রক্ষার দাবিতে মানববন্ধন কর্মসূচি পালন করা হয়েছে। গতকাল উপজেলা পরিষদের সামনে আলেকজান্ডার-সোনাপুর আঞ্চলিক সড়কে ‘আলেকজান্ডার ইউনিয়ন রক্ষা মঞ্চ’ নামে একটি সংগঠন এ মানববন্ধনের আয়োজন করে। বেলা ১১টা থেকে দুপুর ১২টা পর্যন্ত ঘণ্টাব্যাপী এ মানববন্ধনে জনপ্রতিনিধি, রাজনীতিক-সামাজিক সংগঠনের নেতা ও শিক্ষার্থীসহ বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ অংশ নেন।
এদিকে গাইবান্ধার পাঁচ উপজেলার সার্বিক বন্যা পরিস্থিতির অবনতি হয়েছে। বাড়িঘরে এখনও হাঁটু পানি থেকে কোমর পানি থাকায় মানবেতর জীবনযাপন করছেন চরাঞ্চলের দেড় লাখ মানুষ। দ্বিতীয় দফার বন্যায় নদীভাঙনে ফুলছড়ি উপজেলার তিনটি প্রাথমিক বিদ্যালয় নদীগর্ভে বিলিন হয়েছে। এছাড়া হুমকির মুখে পড়েছে বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধসহ সাঘাটা, ফুলছড়ি ও গোবিন্দগঞ্জ উপজেলার বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা। গাইবান্ধার ফুলছড়ি ঘাট পয়েন্টে ব্রহ্মপুত্র নদের পানি বিপদসীমার ৭৮ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। ঘাঘট নদীর পানি গাইবান্ধা শহরের নতুন ব্রিজ পয়েন্টে বিপদসীমার ৫৪ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। ব্রহ্মপুত্র নদ ও যমুনা নদীর ডান তীরঘেঁষা বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধটি চরম হুমকির মুখে পড়েছে।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: বন্যা

১৫ অক্টোবর, ২০২২

আরও
আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ