পবিত্র লাইলাতুল বরাত
আজ দিবাগত রাত পবিত্র লাইলাতুল বরাত। পরম করুণাময় আল্লাহতায়ালা তার বান্দাদের গুনাহ মাফ, বিপদমুক্তি ও
প্রায় পঁচিশ বছর আগের কথা। সারাদেশ ঘুরে বেড়ানোর উদ্দেশ্যে নিজের গাড়ী চালিয়ে বেরিয়েছিলাম বন্ধু এডভোকেট নূর ও আমি। সিলেট থেকে গেলাম ঢাকা। পরদিন বিকালে ঢাকা থেকে পৌছালাম ঈশ্বরদি নামক রেলওয়ে ষ্টেশনে। এ ঈশ্বরদি থেকে রেলের একটি লাইন গেছে সিরাজগঞ্জঘাট পর্যন্ত। এ লাইনের একটি ষ্টেশন নাম দিলপাশা। জায়গাটি পাবনা জেলায় চলনবিলের মধ্যে পড়ে।
মনে পড়ে প্রায় তিরিশ ফুট উঁচু বাঁধের উপর দিয়ে গেছে রেল লাইন। তা মাইল চারেক তো হবেই। স্টেশনের পূর্ব-পশ্চিমে ছিল বিশাল প্রান্তর। মাইলের পর মাইল। কিছু দূরে একটি রেল সেতু। তার নীচ দিয়ে গেছে সরু একটি নদী। শীতে নদীও প্রায় মজে যেত। কিন্তু সেতুটির নিচে ছিল বেশ বড়োসড়ো একটি দহ। শীর্ণ নদীর ওই জায়গাটি প্রশস্ত হয়ে সৃষ্টি করে গভীর খাত। গ্রীষ্মে নদী প্রায় শুকিয়ে গেলেও সেখানকার গভীরতা তিরিশ-চল্লিশ ফুট থাকত। এ-ধরনের গভীর জলাশয়কেই বলা হয় দহ।
বর্ষা এলেই পুরো চলনবিল কয়েক ফুট পানির নিচে তলিয়ে গিয়ে হয়ে যেত সমুদ্র। তখন সেই নদী এবং দহ-তাদের আর পৃথক করে চেনা যেত না। ভাদ্র-আশ্বিনেও পানি জমে থাকত স্টেশনের উচুঁ জমির পাশে। সেই পানিতে অজস্র চেলা, কাঁকাল প্রভৃতি ছিল। ছিপে উঠত, রাশি রাশি। আলপিন বাঁকিয়ে বড়শি তৈরি করতেন লোকজন। সেই বড়শির সাহায্যে ধরতেন এদের। মজা করতেন তারা।
আশ্বিনের শেষে চলনবিলের পানি নেমে যেত। দেখা যেত পানিতে টুইটম্বুর সেই নদী এবং দহ। কার্তিকে দিলপাশা আসত মাছের ব্যবসায়ীরা। তাঁদের একজনের সঙ্গে পরিচয় হলো। এখনও মনে পড়ে তার নাম আব্দুল মুত্তালিব। তিনি আসতেন পাবনা শহর থেকে। রেল সংস্থার কাছ থেকে তিনি দহে মাছ ধরার ইজারা নিতেন। কার্তিকে শুরু হত দহে মাছ ধরার পালা। স্বল্প সময় আলাপচারিতায় পরিচয় সূত্রে তা উপভোগ করতে গেলাম। আলাপ হলো। আমাদের অঞ্চলের হাকালুকি, সুনামগঞ্জের টাঙ্গুয়ার হাওর বা কিশোরগঞ্জসহ দেশের এ অঞ্চলের বিভিন্ন হাওর নিয়ে। তাদের ধারণা সিলেট অঞ্চলের মাছের স্বাদই ভিন্ন। একমত হলাম আমরা। প্রশংসা শুনলে কার না ভালো লাগে।
দহটি ছিল কোনো কোনো মাছের আবাস স্থান। বর্ষার সময় কাছে পিঠে তো বটেই, দূরদূরান্ত থেকে আসত নানা রকম মাছ। তাদের পোনা। অনেক মাছ সেই দহে এসে ডিম পাড়ত। এ সবই জানলাম ঐ আব্দুল মুত্তালিবের নিকট থেকে। অভিজ্ঞতায় নিজেকে সমৃদ্ধ ভাবলাম। জানলাম ব্যাপারীদের লোকলস্কর বড়ো বড়ো জাল নিয়ে শুরু করত মাছ ধরা। কত রকম যে মাছ। রুই, কাতলা, কালবাউস, সরপুঁটি, বিথে, বোয়াল, আড়, চিতল, পাবদা, চিংড়ি, বাচা, ফলি আরও কত রকমের মাছ। কী বিশাল তাদের আয়তন। দশ-পনেরো কিলোর রুই, কাতলা দেখেছি। দেখেছি পাঁচ-সাত কিলোর আড়, বোয়াল এবং চিতল। দেখেছি খয়রা মাছ-রূপোর মতো ঝক্ঝকে। কাঠের বাক্স এবং বাঁশের চাঁচ দিয়ে তৈরি ডোলে পুরে সেই মাছ চালান হত ঢাকাসহ বিভিন্ন শহরে প্রতিদিন ফাল্গুনের শেষ সপ্তাহ পর্যন্ত। সে সময় নাকি কুড়ি-পঁিচশ কিলোর কাছিমও পাওয়া যেত।
স্থানীয় এক সাংবাদিকের সাথে কথা বলছিলাম। তিনি বললেন, সে সব এখন গল্প। এক সময় এ অঞ্চলটি ছিল মাছের আকর। এখন মরুভূমি। সংস্কারের অভাবে এবং উজানে বিশেষ করে ভারতের বড় বড় নদীর পানি বাধ দিয়ে আটকানোর ফলে বহু নদী এবং জলাশয় মজে গেছে, মাছ এখন দুর্লভ। বলতে কি, শুধু বাংলাদেশেই নয়। একই অবস্থা পৃথিবীর বহু দেশে। পদ্মা, মেঘনায় এখন আর আগের মত ইলিশ দেখা যায় না। পুকুর ডোবা জলায় শিঙ্গি মাচের উৎপাদন দারুণভাবে কমে গেছে। কেন এমন হল? কারণ, গত পঞ্চাশ বছর ধরে কৃষি উৎপাদন বাড়াতে গিয়ে কাজে লাগানো হয়েছে প্রচুর পরিমাণ কীট এবং জীবাণুনাশক রাসায়নিক যৌগ। যাদের ইংরেজিতে বলা হয় ‘পেস্টিসাইডস’। সেই বিষের দরুন বর্ষার পানি ভরা মাঠ এবং জলাশয়ে কই, মাগুর, শিঙ্গি আর বেঁচে থাকতে পারে না। নদীর পানিও দূষিত হয়। মারা পড়ে ডিম এবং পোনা। জমির অতিরিক্ত সার বর্ষার পানির তোড়ে পুকুর খাল বিল নদীতে পড়ে । সেই সার জলজ গাছপালা দারুণভাবে বাড়ায়।
জলজ গাছপালা জঙ্গলে মাছের পক্ষে বাস করা শক্ত হয়। অতিরিক্ত গাছের দরুন পানিতে দ্রবীভূত অক্সিজেনের পরিমাণ কমে। এমন অবস্থায় মাছের বাচ্চা, ডিম, এমনকি বয়স্ক মাছও মারা পড়ে। বাড়তে পারে না। অতিরিক্ত চাষের দরুন জমির মাটি আলগা হয়। বাতাস এবং পানির প্রবাহে সেই মাটি জলাশয়ে পড়ে। এর ফলে বহু নদী-নালা-বিল, পুকুর মজে যায়। মাছের বাস করার ঠাঁইটুকুও এখন গেছে কমে। প্লাবন রোধ করতে তৈরি হয়েছে প্রচুর বাঁধ-রাস্তা। এর ফলে বর্ষার সময় পানির স্রােতে বিভিন্ন অঞ্চল থেকে মাছ, মাছের চারাপোনা এবং ডিম আগের মতো যাতায়াত করতে পারে না। যেমনটি দেখেছি দিলপাশায়। তাই নদী, খাল, বিল, জলাশয়ে এখন মাছের এত অভাব। প্রাকৃতিক সুযোগ-সুবিধার উপর মানুষ যেমন নির্বাচন করে তার বাসস্থান ঠিক তেমনি মাছও সুযোগ বেছে নেয় তাদের সহজে বাস করার মতো এক একটি অঞ্চল। কোনো কারণে সেখানে গোলমাল ঘটলেই উদ্বাস্তুর মতো তারা সেই জায়গাটি ছেড়ে অন্যত্র চলে যায়। নতুন অঞ্চলে গিয়ে কোনো কোনো মাছ কোনো রকমে নিজেদের টিকিয়ে রাখে, আবার অনেক মাছ বিলুপ্ত হয়। সেখানকার প্রতিকূল আবহাওয়া, শত্রু ভাবাপন্ন জলজ প্রাণী, খাদ্যের অভাব এবং জীবাণুর আক্রমণে মাছ মারা যায়। ইদানীং কালে নদী এবং সমুদ্র উপকূলে তৈরি হয়েছে বন্দর। এখনও তৈরি হচ্ছে। সেইগুলোও মাছের বাসস্থানে বিপর্যয় ঘটায়।
না, শুধু স্থলভাগই নয়। বিপর্যস্ত এখন সাগর মহাসাগরেরও মাছ। মাছ মানুষের মূল্যবান প্রোটিন খাদ্য। জনসংখ্যা বৃদ্ধিতে মাছেরও চাহিদা বেড়েছে প্রচুর। সাগর মহাসাগর মাছের বৃহত্তম ভাঁড়ার। বিভিন্ন দেশে এখন সমুদ্রে মাছ ধরার জন্যে বড়ো বড়ো জালে ধরা পড়ে এমনও মাছ অথবা প্রাণী যা মানুষের খাদ্য নয়। জালে পড়ে ওই সব প্রাণী মারা যায়। অথচ তারাই অন্যান্য মাছের খাদ্য। এর ফলে যেসব মাছ আমরা খাদ্য হিসেবে পেতে চাই, তাদের খাবারে পড়ে টান। তারা মারা যায়। আন্তর্জাতিক আইন অনুযায়ী সমুদ্রে চড়া মাছ এবং অপুষ্ট মাছ ধরা নিষিদ্ধ। কিন্তু কে শোনে সে কথা? দেশের নিজস্ব সমুদ্র অঞ্চলের কথা না হয় বাদই দিলাম। কিন্তু উন্মুক্ত যেসব অঞ্চল, আন্তর্জাতিক সীমানার বাইরে সেখানে কোনো দেশই বাধা দিতে পারে না। ওইসব অঞ্চলে যেসব মাছ ধরার কথা নয়, তাদেরও ধরা হয়। ডিম পাড়ার বয়সের আগেই ধরা হয় নানান মাছ। তাই সাগর-মহাসাগরেও বহু মাছ কমে গেছে। গত কয়েক দশক ধরে নদীর স্বাভাবিক গতিপথ আটকে পানিবিদ্যুৎ উৎপাদন, ড্যাম ও ব্যারেজ নির্মান, নদীর ধারে ইটভাটা তৈরী ও নিজেদের প্রয়োজনে নদীর স্বাভাবিক গতিপথ রুদ্ধ করে কলকারখানার নোংরা পানি নদীতে ফেলা ইত্যাদি কারণে মাছের স্বাভাবিক প্রজনন স্থানগুলো বিনষ্ট প্রায়। মাছের ডিম ফোটার জন্য দরকার পানির স্রোত, সঠিক মাত্রার দ্রবীভূত অক্সিজেন ও নির্দিষ্ট কতকগুলো ভৌত রাসায়নিক গুণাবলিযুক্ত পানি। আমাদের দেশের অধিকাংশ বড় ও ছোট নদীতে এ অবস্থা বিদ্যমান নেই। এরপর আছে নদী সংযুক্তিকরণের মত বিপদ যাতে দূষিত নদীর পানি কলুষিত করবে অন্য অদূষিত নদীগুলোকে। তাই দেশীয় বড় কার্প মাছগুলোকে কৃত্রিমভাবে ডিম ফুটিয়ে বংশ বৃদ্ধির চেষ্টা করা হলেও অন্যান্য মাছের বংশ ধরে রাখার কোনো ব্যবস্থা নেই। বাঘ, কুমির, পাখিদের জন্য সরকারি ব্যবস্থা থাকলেও এদের ব্যাপারে কেউ খেয়াল করেন না। গত দশ বছর যাবত কয়েকটি অশ্বক্ষুরাকৃতি হ্রদের উপর গবেষণা করতে গিয়ে দেখা গেছে যে এ হ্রদগুলো এ জাতীয় দেশীয় মাছের প্রজননে যে রকম ভৌত ও রাসায়নিক অবস্থার প্রয়োজন হয় এ হৃদগুলোর বৈশিষ্ট্য প্রায় সে রকম এবং এগুলোর কয়েকটি প্রায় সারা বছরই বিশেষত বর্ষাকালে মূল নদীর সঙ্গে যোগাযোগ থাকায় মাছের ডিম ফোটার সময় পানির প্রয়োজনীয় গুণাবলি বিদ্যমান থাকে। একজন বা দুইজন মানুষের উদ্যোগে এ প্রজাতিগুলোকে বাঁচিয়ে রাখা অসম্ভব। দরকার সরকারি উদ্যোগের ও সাহায্যের। মাছ সংরক্ষণের জন্য ১৮৯৭ সালে ওহফরধহ ঋরঝযবৎরবঝ অপঃ নামে একটি আইন ব্রিটিশ সরকার প্রবর্তন করেন, সেটি বর্তমানে পরিবর্তিত হয়ে নুতন নতুন আইন প্রণয়ন করা হচ্ছে, যাতে পানি দূষণের প্রতিরোধ, মাছ ধরার জালের নির্দিষ্ট মাপের কথা, বিস্ফোরক ও বিষাক্ত পদার্থ দিয়ে মাছ ধরা নিষেধ। এছাড়া প্রজনন ঋতুতেও মাছ ধরা নিষিদ্ধ। অপরিণত মাছ ধরা নিষেধ করা হলেও মানুষের লোভ এগুলোকে তোয়াক্কা করে না। আমাদের দেশে মাছ ধরার ব্যাপারে আইন থাকলেও প্রয়োগ নেই। অবাধে চলে মাছের পোনা নিধন। তাহলে উপায় কী? মাছগুলোকে বাঁচানোর দুটি পদ্ধতি বর্তমান। প্রথম উপায়টিতে স্বল্প খরচে অশ্বক্ষুরাকৃতি হৃদগুলোতে বাস্তুতান্ত্রিক প্রযুক্তিবিদ্যার দ্বারা পরিবর্তন ঘটিয়ে স্বাভাবিক প্রজনন ব্যবস্থা চালু ও নজরদারী বৃদ্ধি করা। দ্বিতীয় গবেষণাগার গুলোর উন্নতি ঘটিয়ে লুপ্তপ্রায় প্রজাতিগুলোর জন্য জার্মপ্লাজমের হিমায়িত সংরক্ষণ। তার থেকে সংরক্ষিত মীনাশ্রয়-তে তার সংখ্যা বৃদ্ধি করানো। যে সব প্রাণী সম্পদ দফতরে Cryopre Servation facility আছে সেখানে দরকার সমন্বয়ের মাধ্যমে মাছগুলোকে প্রকৃতি থেকে হারিয়ে যাওয়ার আগে বাঁচানো। বিবর্তনের ইচ্ছায় এরা বেঁচে আছে। এদের প্রকৃতিতে প্রয়োজন আছে। হয়তো আমরা জানি না। আমাদের অবহেলায় এরা যদি হারিয়ে যায় আর কোনদিন ফিরে পাওয়া যাবে না এদের। ক্ষতি হয়ে যাবে পরিবেশের। অভাব অনুভব করবে মানুষ।
লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।